www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

হিয়ার মাঝে

সেদিন ইউটিউবে গান শুনছিলাম। অলৌকিক করুণ একটা সুর, বাদকের বেহালার ছ​ড় থেকে বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধের মতো উঠে আসছে। সঙ্গের ভিডিওটিও অদ্ভুত। একটি বন্ধ জানলার কাচের ওপারে তুষারপাত হচ্ছে, হয়েই চলেছে, যতক্ষণ না বাজনা শেষ হয়। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন নিজের অজান্তেই দু'গাল বেয়ে নেমে এসেছে অশ্রুধারা। চোখের সামনে ফুটে উঠেছে স্পষ্ট একটি ছবি--যা আগে কখনো দেখিনি, অথচ মনে হচ্ছে ভীষণই পরিচিত।

ভুল বললাম। অবশ্যই দেখেছি আগে। আমারই মানসপটে! এ আমার প্রিয় কবির জীবনের এক বহুল-চর্চিত দৃশ্য। তাঁর হৃদয়-ছেঁড়া বেদনা। তাঁর কাব্যের উৎস।

কেনজি মিয়াজাওয়ার কবিতা আমি পড়া শুরু করি ২০১৬ সালের একেবারে শেষের দিকে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা তখন দরজায় কড়া নাড়া ছেড়ে চৌকাঠ পেরিয়ে গিয়েছে। মহাত্মা গাঁধীর অনশন আর কর্সিকার জলবায়ুর ফাঁকে আমার একমাত্র হাঁপ ছাড়ার উপায় পাঠ্যসূচীর বাইরের সাহিত্য। এই জাপানী কবির রচনা আমার হাতে আসে যখন উদ্বেগ এবং হিমশীতল অবসাদ আমার মনে শিকড় ছড়াচ্ছে মহানন্দে।

প্রথম যে কবিতাটি আমি পড়ি, সেটির নাম "এইকেৎসু  নো আসা (শেষ বিদায়ের প্রভাত)"। কবির সম্বন্ধে প্রায় কিছুই না জানা থাকায় কবিতাটির মর্মার্থ সেই মুহুর্তে অনুধাবন করতে পারিনি। রাত সাড়ে বারোটায় গোটা পরিবার যখন গভীর সুপ্তিতে, ইন্টারনেটের শরণ নিলাম আমি। কাটলো কুয়াশা। চোখ ভরে এলো জলে।

কেনজি মিয়াজাওয়ার প্রাণাধিক প্রিয় ছোট বোনের নাম ছিল তোশি। অভূতপূর্ব প্রতিভার অধিকারিণী এই তোশি নাকি রবীন্দ্রনাথকেও চমৎকৃত করে দিয়েছিলেন, বিশ্বকবির জাপান সফরের সময় তাঁর কবিতা ইংরেজি ও বাংলায় আবৃত্তি করে। কিশোর কেনজি যখন নব উদ্যমে রচনা করছেন একের পর এক কবিতা, তাঁকে অক্লান্তভাবে উৎসাহ দিয়ে গেছেন তোশি। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে, মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটান তিনি। ভগ্নহৃদয় কেনজি সেই শোক আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বোনের মৃত্যুর এগারো বছর পরে, ১৯৩৩ সালে তিনিও অমৃতলোকে যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ৩৭!

"এইকেৎসু নো আসা" কবিতা অনুযায়ী, মৃত্যুশয্যায় তোশি তাঁর দাদার কাছে খানিকটা "আমেয়ুজু" (তুষার) চেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুদিনটিতে সম্ভবত তুষারপাত হচ্ছিলো হানামাকি শহরে। শোকে উন্মাদপ্রায় কেনজি লিখছেন, "আমি আবার জন্মাবো/পরের বার, আমি এমন হতে দেব না!"

এখনো চোখ বুজলে আমি ছবিটা দেখতে পাই। ঘরের মেঝেতে পাতা "ফুতোন" শয্যায় শুয়ে আছেন এক রোগশীর্ণা তরুণী, শয্যার পাশে উপবিষ্ট এক যুবক। একটা ক্লিষ্ট কণ্ঠস্বর, কয়েকটা শব্দ যেন বহু যুগের ওপর থেকে ভেসে আসে কানে: "আমেয়ুজু তোতেচিতে, কেনজা!" (একটু "আমেয়ুজু এনে দে না, কেনজি!) জানলার বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে শুভ্র তুষারকণা। অবিরাম।

এ কি নিছকই কিশোরীর আবেগ? নিষ্ফল রোমান্টিকতা? আমার স্বল্প বুদ্ধি, অপরিণত মনকে কেন এভাবে নাড়া দিয়ে গেলো কবিতাটি? এই ইঁদুর দৌড়ের যুগে, অন্ধকারের জয়যাত্রার যুগে গতাসু এক কবির ব্যক্তিগত শোক নিয়ে কাব্য করা কি আমাকে সাজে?

আরেকটা ছবিও যে দেখতে পাই আমি। হয়তো কোনোদিন তুলি দিয়ে তাকে ফুটিয়ে তুলবো কাগজের বুকে । হয়তো, সুদূর ভবিষ্যতের কোনো এক দিন....হয়তো।  

হিমকণায় ঝাপসা এক আলপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক তরুণ ও এক তরুণী। দূরে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে বরফের মুকুট-পরা পাহাড়; সেই দিকেই যাচ্ছেন তাঁরা । কেনজি আর তোশি।


ঋণস্বীকার:   ১. "এইকেৎসু  নো আসা", মিয়াজাওয়া কেনজি (নাম জাপানী রীতিতে লিখিত)
                ২.  Kenji Miyazawa: Wikipedia, the free encyclopedia
                ৩. archive.is/iA0ln
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ৯০১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৩/০৮/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast