কালো আকাশের নীচে
পালা করে শুকনো ডালপাতা আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছিলো ওরা চারজন | এবার শীত পড়েছে জাঁকিয়ে, চারজনেই গুটিসুটি মেরে বসে আছে | প্রত্যেকেই গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছে | কয়েক মিনিট অন্তর অন্তরই কাঠ পোড়ার শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাস |
প্রথম কথা বললো অন্ধ লোকটি | অনুসন্ধিৎসু কুকুরের মতো দু'বার বাতাস শুঁকে সে গম্ভীরভাবে ঘোষণা করলো, "আজ রাতে বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে |"
তার পাশে বসে থাকা খঞ্জ মানুষটা নাকের ভেতর একটা অবজ্ঞার শব্দ করলো, "আমাদের গাধা পেয়েছিস?"
যে লোকটার একটা কান নেই সে বললো, "এমনও তো হতে পারে ও ঠিক বলছে |"
চর্মরোগীর বয়স অল্প, বাইশ-তেইশের বেশি নয় | বাকি তিনজনের থেকে হাতখানেক তফাতে বসে ছিল সে | এবার তার গলা থেকে একটা অস্পষ্ট "ঘোঁত" ধরণের শব্দ বেরিয়ে এলো |
"আমি বৃষ্টি দেখতে চাই," শিশুর মতো স্বীকার করলো অন্ধ |
"কী বললি? তুই...তুই বৃষ্টি দেখতে চাস?" খঞ্জ ওর দিকে এমনভাবে তাকালো যেন ভিন গ্রহের কোনো প্রাণীকে দেখছে | "কিন্তু...না, তোকে ঠিক দোষ দেওয়া যায় না | আমারও বৃষ্টির জন্য মনটা ছটফট করছে !"
"ধুত্তোর !" ছিন্নকর্ণ লোকটি প্রায় গর্জন করে উঠলো, "এক্ষুনি বৃষ্টি হবে ! হতেই হবে !"
চর্মরোগীর শিরদাঁড়া হঠাৎ টানটান হয়ে গেলো | শ্লেষ্মাবিজড়িত স্বরে, কাউকে উদ্দেশ না করে সে ছুঁড়ে দিলো একটা প্রশ্ন :
"আচ্ছা, শেষ যখন বৃষ্টি হয়েছিল আমরা কে কার সাথে ছিলাম?"
একমুঠো শুকনো পাতা নিখুঁত লক্ষ্যে আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে অন্ধ তার মণিহীন চোখদুটো মিশকালো আকাশটার দিকে তুললো | "আমি মনে করার চেষ্টাই করি না | শেষ যখন বৃষ্টি হয়েছিল, আমি সদ্য অন্ধ হয়েছি | অন্ধকারে এতটা অভ্যস্ত হইনি তখনো |"
"তার মানে...ওই বৃষ্টির আগে তুই দেখতে পেতিস?" ছিন্নকর্ণের কণ্ঠে হালকা আগ্রহ |
"অবশ্যই | ওর মুখটা কী সুন্দর ছিল রে ! একেবারে ভগবানের নিজের হাতে গড়া..." অন্ধের কর্কশ গলাটা ভিজে গেলো |
"ও কে রে?" খঞ্জ অন্ধের কাছে আরও ঘন হয়ে বসলো, "তোর কোনো আত্মীয়? কোনো বন্ধু?"
"সম্ভবত আত্মীয়, কিংবা তার চেয়েও বেশি | আমি মনে করতে...চাই না |" গোঁয়ারের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে অন্ধ আবার বললো, "আমি মনে করতে চাই না !"
"দেখ শিন, তুই আজ আমাদের সবকিছু না বললে তোকেই অনন্তকাল এই যন্ত্রণার ভার বইতে হবে," নরম গলায় বললো ছিন্নকর্ণ | "ফোস্কা ফাটানোর সময় ব্যথা লাগে বটে কিন্তু না ফাটালে আরো কষ্ট হয় | আমরাও আমাদের কথা বলবো | বলে ফেল শিন, ভালো লাগবে |"
শিনের দৃষ্টিহীন চোখে বার দুই পলক পড়লো | "তুই ঠিক জানিস, ইয়োশি?"
"হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ | তুই বলে যা," শিনের পিঠে আলতো চাপড় মারলো কর্ণহীন ইয়োশি |
"শেষবার যখন ওকে দেখি, ও খুব ছোট ছিল--এই এতটুকু--" হাত তুলে উচ্চতা বোঝালো শিন | "কাঁধে একটা বই-খাতার ব্যাগ ছিল...আর আমার বাঁ হাতের আঙ্গুলটা জানিস তো, শক্ত করে ধরেছিলো !"
বাকি তিনজন মাটির দিকে চোখ নামিয়ে নিলো |
"তোরা তো জানিস, কেমন একটা ঝকঝকে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন ছিল সেটা !" নাতিউচ্চস্বরে শিন বলে চললো, "আকাশে মেঘের কোনো চিহ্ন ছিল না | কেউই ভাবেনি--আমিও না--যে সেদিন ঐভাবে সাতসকালে বিদ্যুতের ঝলক দেখা যাবে ! কোনোভাবে বুঝতে পারলে হয়তো কালো চশমাটা সঙ্গে নিতাম..."
"বিদ্যুৎ? ও কী বলছে?" ইয়োশির অক্ষত কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রশ্ন করলো খঞ্জ | ইয়োশি ইশারায় তাকে অপেক্ষা করতে বললো |
"চিৎকার করেছিলাম, জানিস তো রে!" যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছিলো শিনের গলা, "বজ্রপাতটা হওয়ার পর এত জোরে চিৎকার করেছিলাম, মনে হয়েছিল গলার স্বরটাও বুঝি হারালাম | তখনই বুঝেছিলাম, আমার আঙ্গুল থেকে ওর হাতটা ছিটকে গেছে |" শিন আর পারলো না; বীভৎস শব্দে ফুঁপিয়ে উঠলো |
একটা শ্বাস ফেলে ইয়োশি থেমে থেমে বললো, "কেন্ | এবার তুই |"
"আমি? কেন, আমি কেন?" খঞ্জ প্রতিবাদ করলো, "তোরা কেউ বল না !"
"কেন্, এটা কোনো খেলা নয় ! যা বলছি কর !" ইয়োশি যেন কোনো শিশুকে ধমকাচ্ছে !
মাটির উপর একটা নিরুপায় ঘুসি কষিয়ে কেন্ শুরু করলো, "সৌভাগ্যক্রমে না দুর্ভাগ্যক্রমে জানি না, ওই বজ্রপাত আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি--মানে তখন তাই মনে হয়েছিল | কিন্তু একটা ধসে-পড়া কংক্রিটের স্তম্ভের নীচে আমার ডান পা-টা চাপা পড়ে যায় ! তখনই আমার পাশে একটা দেহ এসে পড়ে | মুখটা পুরো গলে গিয়েছিলো--" কেন্ শিউরে উঠলো--"বীভৎস দৃশ্য ! পোশাক দেখে চিনলাম, ওটা আর কেউ না, আমার বাবা ! চিৎকার করে উঠতে যাবো, সেই মুহূর্তেই বৃষ্টিটা শুরু হলো |"
চর্মরোগী তার ঘায়ে-ভরা হাতদুটো দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো | শিন কান্না থামিয়ে হাঁটুর উপর মাথা রেখে মূর্তির মতো বসে আছে |
"এবার আমি বলি | সবশেষে বলবে তোশি | কী রে তোশি, ঠিক আছে তো?" ইয়োশি তাকালো চর্মরোগীর দিকে | সে একবার ঘাড়টা হেলিয়ে আবার আগুনের দিকে মুখ ফেরালো |
"বজ্রপাত যখন হয়, আমি ঘুমোচ্ছিলাম |" ইয়োশির স্বর শান্ত গম্ভীর, "তখন বেলা যথেষ্ট, কিন্তু আমার গত দু'দিন ধরে জ্বর ছিল | ...যাই হোক, যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক | আমার বাবা নৌবাহিনীতে ছিলেন বলে বেঁচে যান--পরে অবশ্য শুনেছিলাম, সলিল সমাধি হয়েছে তাঁরও--কিন্তু আমার মাকে কেড়ে নেয় ওই...বজ্রপাত ! বাড়ির আগুন আমার আমার কানটা খেয়েছিলো...আর তারপর..."
"থাক, আর বলতে হবে না," হঠাৎ ছটফটিয়ে উঠে বাধা দিলো কেন্ | "অ্যাই তোশি, তুই শুরু কর |"
সদ্য নিদ্রোত্থিত মানুষের মতো ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে তোশি তাকালো ওদের দিকে | "কিছু বললে?"
"যাব্বাবা, এতক্ষন ঘুমোচ্ছিলি নাকি তুই? প্রশ্নটা তো তুইই করলি !" ইয়োশি ঈষৎ বিরক্ত, "বল আমাদের, বৃষ্টির সময় তুই কার সাথে ছিলি? কি করছিলি?"
চোখ বুজলো তোশি | একটা লম্বা শ্বাস টেনে ভারী কণ্ঠে বললো, "আমি মনের আনন্দে ওই বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম !"
"সে কী !" সমস্বরে আর্তনাদ করে উঠলো বাকিরা |
"আমার বয়স তখন তিন বছরের বেশি নয় | কিচ্ছু বুঝতে পারিনি, জানো | ওই আলো আর শব্দকে তখন বিদ্যুৎ আর বজ্রপাতই ভেবেছিলাম | ভেবেছিলাম, ওই বৃষ্টি শীতল করে দেবে...! বাবা-মাকে সেদিনের পর কেন যে আর দেখতে পাইনি, অনেক পরে বুঝেছি ! ততদিনে তো..." তোশি থেমে গেলো | তার মুখে অদ্ভুত শান্ত এক যন্ত্রণা আলপনা এঁকে চললো নিঃশব্দে |
"আমরাও চেয়েছিলাম রে ওগুলোকে বিদ্যুৎ, বজ্রপাত আর বৃষ্টি ভাবতে ! এখনো চাই !" ইয়োশি প্রায় ফিসফিস করে স্বীকার করলো, "সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ মানুষের প্রাণ নেয়, কিন্তু আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না |...আমরাও তো মানুষ ছিলাম রে ! ওরাও তো মানুষ ! সভ্য মানুষ !"
"দোষটা কার? আমাদের না ওদের?" এতক্ষণে কথা বললো শিন |
"আমি জানি," স্কুলছাত্রের মতো হাত তুললো কেন্ | তিনজোড়া চোখ ঘুরে গেলো তার দিকে |
"দোষটা মানবসভ্যতার !"
ঋণস্বীকার: ডাক্তার মিচিহিকো হাচিয়া-র ডায়েরি, ১৯৪৫
প্রথম কথা বললো অন্ধ লোকটি | অনুসন্ধিৎসু কুকুরের মতো দু'বার বাতাস শুঁকে সে গম্ভীরভাবে ঘোষণা করলো, "আজ রাতে বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে |"
তার পাশে বসে থাকা খঞ্জ মানুষটা নাকের ভেতর একটা অবজ্ঞার শব্দ করলো, "আমাদের গাধা পেয়েছিস?"
যে লোকটার একটা কান নেই সে বললো, "এমনও তো হতে পারে ও ঠিক বলছে |"
চর্মরোগীর বয়স অল্প, বাইশ-তেইশের বেশি নয় | বাকি তিনজনের থেকে হাতখানেক তফাতে বসে ছিল সে | এবার তার গলা থেকে একটা অস্পষ্ট "ঘোঁত" ধরণের শব্দ বেরিয়ে এলো |
"আমি বৃষ্টি দেখতে চাই," শিশুর মতো স্বীকার করলো অন্ধ |
"কী বললি? তুই...তুই বৃষ্টি দেখতে চাস?" খঞ্জ ওর দিকে এমনভাবে তাকালো যেন ভিন গ্রহের কোনো প্রাণীকে দেখছে | "কিন্তু...না, তোকে ঠিক দোষ দেওয়া যায় না | আমারও বৃষ্টির জন্য মনটা ছটফট করছে !"
"ধুত্তোর !" ছিন্নকর্ণ লোকটি প্রায় গর্জন করে উঠলো, "এক্ষুনি বৃষ্টি হবে ! হতেই হবে !"
চর্মরোগীর শিরদাঁড়া হঠাৎ টানটান হয়ে গেলো | শ্লেষ্মাবিজড়িত স্বরে, কাউকে উদ্দেশ না করে সে ছুঁড়ে দিলো একটা প্রশ্ন :
"আচ্ছা, শেষ যখন বৃষ্টি হয়েছিল আমরা কে কার সাথে ছিলাম?"
একমুঠো শুকনো পাতা নিখুঁত লক্ষ্যে আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে অন্ধ তার মণিহীন চোখদুটো মিশকালো আকাশটার দিকে তুললো | "আমি মনে করার চেষ্টাই করি না | শেষ যখন বৃষ্টি হয়েছিল, আমি সদ্য অন্ধ হয়েছি | অন্ধকারে এতটা অভ্যস্ত হইনি তখনো |"
"তার মানে...ওই বৃষ্টির আগে তুই দেখতে পেতিস?" ছিন্নকর্ণের কণ্ঠে হালকা আগ্রহ |
"অবশ্যই | ওর মুখটা কী সুন্দর ছিল রে ! একেবারে ভগবানের নিজের হাতে গড়া..." অন্ধের কর্কশ গলাটা ভিজে গেলো |
"ও কে রে?" খঞ্জ অন্ধের কাছে আরও ঘন হয়ে বসলো, "তোর কোনো আত্মীয়? কোনো বন্ধু?"
"সম্ভবত আত্মীয়, কিংবা তার চেয়েও বেশি | আমি মনে করতে...চাই না |" গোঁয়ারের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে অন্ধ আবার বললো, "আমি মনে করতে চাই না !"
"দেখ শিন, তুই আজ আমাদের সবকিছু না বললে তোকেই অনন্তকাল এই যন্ত্রণার ভার বইতে হবে," নরম গলায় বললো ছিন্নকর্ণ | "ফোস্কা ফাটানোর সময় ব্যথা লাগে বটে কিন্তু না ফাটালে আরো কষ্ট হয় | আমরাও আমাদের কথা বলবো | বলে ফেল শিন, ভালো লাগবে |"
শিনের দৃষ্টিহীন চোখে বার দুই পলক পড়লো | "তুই ঠিক জানিস, ইয়োশি?"
"হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ | তুই বলে যা," শিনের পিঠে আলতো চাপড় মারলো কর্ণহীন ইয়োশি |
"শেষবার যখন ওকে দেখি, ও খুব ছোট ছিল--এই এতটুকু--" হাত তুলে উচ্চতা বোঝালো শিন | "কাঁধে একটা বই-খাতার ব্যাগ ছিল...আর আমার বাঁ হাতের আঙ্গুলটা জানিস তো, শক্ত করে ধরেছিলো !"
বাকি তিনজন মাটির দিকে চোখ নামিয়ে নিলো |
"তোরা তো জানিস, কেমন একটা ঝকঝকে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন ছিল সেটা !" নাতিউচ্চস্বরে শিন বলে চললো, "আকাশে মেঘের কোনো চিহ্ন ছিল না | কেউই ভাবেনি--আমিও না--যে সেদিন ঐভাবে সাতসকালে বিদ্যুতের ঝলক দেখা যাবে ! কোনোভাবে বুঝতে পারলে হয়তো কালো চশমাটা সঙ্গে নিতাম..."
"বিদ্যুৎ? ও কী বলছে?" ইয়োশির অক্ষত কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রশ্ন করলো খঞ্জ | ইয়োশি ইশারায় তাকে অপেক্ষা করতে বললো |
"চিৎকার করেছিলাম, জানিস তো রে!" যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছিলো শিনের গলা, "বজ্রপাতটা হওয়ার পর এত জোরে চিৎকার করেছিলাম, মনে হয়েছিল গলার স্বরটাও বুঝি হারালাম | তখনই বুঝেছিলাম, আমার আঙ্গুল থেকে ওর হাতটা ছিটকে গেছে |" শিন আর পারলো না; বীভৎস শব্দে ফুঁপিয়ে উঠলো |
একটা শ্বাস ফেলে ইয়োশি থেমে থেমে বললো, "কেন্ | এবার তুই |"
"আমি? কেন, আমি কেন?" খঞ্জ প্রতিবাদ করলো, "তোরা কেউ বল না !"
"কেন্, এটা কোনো খেলা নয় ! যা বলছি কর !" ইয়োশি যেন কোনো শিশুকে ধমকাচ্ছে !
মাটির উপর একটা নিরুপায় ঘুসি কষিয়ে কেন্ শুরু করলো, "সৌভাগ্যক্রমে না দুর্ভাগ্যক্রমে জানি না, ওই বজ্রপাত আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি--মানে তখন তাই মনে হয়েছিল | কিন্তু একটা ধসে-পড়া কংক্রিটের স্তম্ভের নীচে আমার ডান পা-টা চাপা পড়ে যায় ! তখনই আমার পাশে একটা দেহ এসে পড়ে | মুখটা পুরো গলে গিয়েছিলো--" কেন্ শিউরে উঠলো--"বীভৎস দৃশ্য ! পোশাক দেখে চিনলাম, ওটা আর কেউ না, আমার বাবা ! চিৎকার করে উঠতে যাবো, সেই মুহূর্তেই বৃষ্টিটা শুরু হলো |"
চর্মরোগী তার ঘায়ে-ভরা হাতদুটো দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো | শিন কান্না থামিয়ে হাঁটুর উপর মাথা রেখে মূর্তির মতো বসে আছে |
"এবার আমি বলি | সবশেষে বলবে তোশি | কী রে তোশি, ঠিক আছে তো?" ইয়োশি তাকালো চর্মরোগীর দিকে | সে একবার ঘাড়টা হেলিয়ে আবার আগুনের দিকে মুখ ফেরালো |
"বজ্রপাত যখন হয়, আমি ঘুমোচ্ছিলাম |" ইয়োশির স্বর শান্ত গম্ভীর, "তখন বেলা যথেষ্ট, কিন্তু আমার গত দু'দিন ধরে জ্বর ছিল | ...যাই হোক, যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক | আমার বাবা নৌবাহিনীতে ছিলেন বলে বেঁচে যান--পরে অবশ্য শুনেছিলাম, সলিল সমাধি হয়েছে তাঁরও--কিন্তু আমার মাকে কেড়ে নেয় ওই...বজ্রপাত ! বাড়ির আগুন আমার আমার কানটা খেয়েছিলো...আর তারপর..."
"থাক, আর বলতে হবে না," হঠাৎ ছটফটিয়ে উঠে বাধা দিলো কেন্ | "অ্যাই তোশি, তুই শুরু কর |"
সদ্য নিদ্রোত্থিত মানুষের মতো ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে তোশি তাকালো ওদের দিকে | "কিছু বললে?"
"যাব্বাবা, এতক্ষন ঘুমোচ্ছিলি নাকি তুই? প্রশ্নটা তো তুইই করলি !" ইয়োশি ঈষৎ বিরক্ত, "বল আমাদের, বৃষ্টির সময় তুই কার সাথে ছিলি? কি করছিলি?"
চোখ বুজলো তোশি | একটা লম্বা শ্বাস টেনে ভারী কণ্ঠে বললো, "আমি মনের আনন্দে ওই বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম !"
"সে কী !" সমস্বরে আর্তনাদ করে উঠলো বাকিরা |
"আমার বয়স তখন তিন বছরের বেশি নয় | কিচ্ছু বুঝতে পারিনি, জানো | ওই আলো আর শব্দকে তখন বিদ্যুৎ আর বজ্রপাতই ভেবেছিলাম | ভেবেছিলাম, ওই বৃষ্টি শীতল করে দেবে...! বাবা-মাকে সেদিনের পর কেন যে আর দেখতে পাইনি, অনেক পরে বুঝেছি ! ততদিনে তো..." তোশি থেমে গেলো | তার মুখে অদ্ভুত শান্ত এক যন্ত্রণা আলপনা এঁকে চললো নিঃশব্দে |
"আমরাও চেয়েছিলাম রে ওগুলোকে বিদ্যুৎ, বজ্রপাত আর বৃষ্টি ভাবতে ! এখনো চাই !" ইয়োশি প্রায় ফিসফিস করে স্বীকার করলো, "সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ মানুষের প্রাণ নেয়, কিন্তু আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না |...আমরাও তো মানুষ ছিলাম রে ! ওরাও তো মানুষ ! সভ্য মানুষ !"
"দোষটা কার? আমাদের না ওদের?" এতক্ষণে কথা বললো শিন |
"আমি জানি," স্কুলছাত্রের মতো হাত তুললো কেন্ | তিনজোড়া চোখ ঘুরে গেলো তার দিকে |
"দোষটা মানবসভ্যতার !"
ঋণস্বীকার: ডাক্তার মিচিহিকো হাচিয়া-র ডায়েরি, ১৯৪৫
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মৌমিতা ১৩/০৬/২০১৭দারুন
-
ফয়জুল মহী ০৮/০৬/২০১৭চমৎকার উপস্থাপন
-
শেলি ০৭/০৬/২০১৭সুন্দর লেখা
-
আলম সারওয়ার ০৭/০৬/২০১৭অসাধারণ। শুভেচ্ছা
-
এম,এ,মতিন ০৬/০৬/২০১৭খুব সুন্দর শিক্ষণীয়।
-
পরশ ০৬/০৬/২০১৭ভাল
-
সাঁঝের তারা ০৫/০৬/২০১৭খুব ভাল