তেল নিয়ে
তেল নিয়ে
---
আমার ছোটবেলায় গ্রামে একজন লোক ছিলেন, তাকে দাদী বলতেন তেলি, আমরা বলতাম তেলি দাদা। তেলি দাদাকে বাড়িমুখো আসতে দেখলেই আমরা খুশিতে ভরে ওঠতাম। কারণ উনি যে টুকরি দুটো ভার দিয়ে বহন করতেন, ওখানে থাকত কাঠি লজেন্স। মহিলারা উনাকে দেখলে খুশি হতেন, কারণ উনার টুকরিতে থাকত পান সুপারী, সাদাপাতা, সিদল শুটকি, মিষ্টি আলু, ছিকর এসব। তেলি দাদার মাথায় চুল ছিল না, কিন্তু উনার মাথা ওলওয়েজ চকচক করত। আমার তখন ধারণা ছিল তেলি দাদা গোসল সেরেই মাথায় এক বোতল তেল ঢেলে তারপর বাইরে বের হন। আমার নানী বলতেন তেলা মাথায় তেল, কারণ যাদের কাছে তেলযুক্ত খাবার সহজলভ্য, তাদেরই তেলযুক্ত খাবার দিতে সবাই উৎসাহি; যারা টাকার অভাবে তেলহীন খাবার খায়, তাদের কেউ তেল দেয় না, জগতের এই নিয়ম । তেলি দাদার মাথা ছিল সেরকম তেলতেলে। হয়ত তেল উনার পছন্দ ছিল ভীষণ।
তেল গতিশীল হলে তেলি আর তেলির আধার যে সে হল তেলী। তো বঙ্গীয় শব্দকোষে তেলি, তেলী, তিলি আছে যার অর্থ তৈলবিক্রেতা হিন্দুজাতি-বিশেষ। যিনি তেলি তিনিই তৈলকার।
ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুযায়ী, তেল = তারীর দিশাগ্রস্ত লালন-লয়ন যাহাতে। তেল আর তৈল একই বস্তু হিসেবে প্রচলিত। যদিও তৈল সংস্কৃত আর তেল বাংলা শব্দ। তৈল-এর ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হল তারীর দিশাগ্রস্ত-আধারের লালন-লয়ন যাহাতে। তবে বাংলাভাষায় তেল শব্দটির যথেষ্ট বিকাশ সাধন হয়েছিল বলেই আমরা পেয়েছি 'তেলা মাথায় তেল দেওয়া', 'তেল মারা', 'তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠা', 'তেল দেওয়া' এরকম অনেক বাগধারা। এই তৈল বা তেল এতটাই জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ বস্তু যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন তৈল প্রবন্ধ। 'তৈল যে কী পদার্থ তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন, তাহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ বাস্তবিক স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর, অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কী? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠাণ্ডা করে তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর কিসে পারে! --- তৈল'। তেল হল একপ্রকার স্নেহজাতীয় পদার্থ, আবার দম্ভ, অহংকার, তেজ এসব বোঝাতেও তেল কথাটি ব্যবহৃত হয়। তেলাপোকা বা তেলাচোরা নামক একটি গৃহবাসী প্রাণী আছে যে নাকি তেল চুরি করে, তার নাম আবার তৈলপা। তেলাকচু নামে একটি শাক আছে। জামাকাপড়ে বা ব্যবহার্য্য সামগ্রীতে তেলচিটে বা তেলচিটা পড়ে, তেলচিটে হল তেলধুলায় মিশ্রিত চিটের মত ময়লা। যা হাতে লাগলে চটচট করে। আর বেশি তেল দিলে তেলতেলে হয়, তেলতেলে মানে তৈলাক্ত। লবন বেশি হলে যেমন হয় লবনাক্ত তেমনি বেশি তেলে তৈলাক্ত। অতিরিক্ত কিছুই আবার ভাল নয়।
এবার আসি খাদ্যদ্রব্যে তেল প্রসঙ্গে। আদতে তেল তরকারিতে সবারই কমবেশি পছন্দ। কেউ রান্নায় দিতে, কেউ স্বাদে পেতে। তবে আজকাল কোথাও খাঁটি তেল নেই। সর্ষে কিংবা সয়াবিন অথবা অলিভ সবখানেই ভেজাল। তরকারিতে কিংবা নাস্তায় আপনাকে ভেজালটিই দিতে হবে। কোথায় পাবেন খাঁটি তেল? ওই ভেজাল তেলেই আমরা খুশিতে ডগমগ, মাংসে, শুটকিতে, ভর্তায় নাস্তায় ঢালো ঢালো ঢালো ভেজাল তেল। অথচ ভেজাল তেল স্বাস্থ্যকর নয় মোটেও। আবার বয়স যখন বেড়ে যায়, তখন তেল হিতকর নয়। শিশুদের জন্য খাঁটি তেল পরিমিত পরিমাণে উপকারী। প্রবীণদের জন্য ক্ষতিকর, অথচ শিশুদের তেল দিয়ে রান্না করে খাবার পরিবেশনে আমাদের ততটা উৎসাহ নেই, যতটা উৎসাহে আমরা প্রবীণদের খাবারে তেল দিই। তেল বেশি দিলে খাবার স্বাদ হয়, তা ভেজালই হোক। ওতে কী কী মেশায় আল্লাহ জানেন।
অথচ কেউ যদি কেবল গভীর মায়ামমতা শ্রদ্ধাভক্তি ভরে তেলবিহীন ব্যঞ্জন রান্না করে, তবে তা কারো মুখে রুচে না। শ্রদ্ধাভক্তি হালে পানি পায় না, যতটা তেল পায়। তাই ঢালো তেল, হোক ভেজাল, তেলই-তো! আমরা তৈলাক্ত সব খাবারই পছন্দ করি, অবশ্য ঠেলায় পড়লে বা অসুস্থ হলে বেছে নিই বিরসবদনে সিদ্ধকেই। শরীরের উপর পড়লে বুঝি তেল কাহাকে বলে। মনের উপরও যদি পড়ে!
তেল প্রসঙ্গে কথা হবে অথচ কলুর বলদ কথাটি আসবে না, তা হয় না। তেলি বা কলু বিভিন্ন তৈলবীজ থেকে খাবার তেল উৎপাদন করতেন। তেলবীজ পেষার জন্যে পশুর সাহায্যে যে দেশীয় যন্ত্রটি কলুরা ব্যবহার করত তার নাম ঘানি। কলুরা বলদ দ্বারা ঘানি টানতেন। বলদ সারাদিন ঘানি টানত, কলুর ইচ্ছে মত টানত, এতে বলদের কঠিন পরিশ্রম হত। ঘানি টেনে সে তেল উৎপাদন করত ঠিকই, সে তেল তার কোন কাজে লাগত না। ফলভোগ তার ভাগ্যে ছিল না অথচ খেটে মরত। সেজন্য বিনালাভে কেউ পরিশ্রম করলে তাকে কলুর বলদ বলা হয়।
তেল নিয়ে আরো কথা বলা যায়। কিন্তু কলুর বলদ হয়ে লাভ কী!
---
আমার ছোটবেলায় গ্রামে একজন লোক ছিলেন, তাকে দাদী বলতেন তেলি, আমরা বলতাম তেলি দাদা। তেলি দাদাকে বাড়িমুখো আসতে দেখলেই আমরা খুশিতে ভরে ওঠতাম। কারণ উনি যে টুকরি দুটো ভার দিয়ে বহন করতেন, ওখানে থাকত কাঠি লজেন্স। মহিলারা উনাকে দেখলে খুশি হতেন, কারণ উনার টুকরিতে থাকত পান সুপারী, সাদাপাতা, সিদল শুটকি, মিষ্টি আলু, ছিকর এসব। তেলি দাদার মাথায় চুল ছিল না, কিন্তু উনার মাথা ওলওয়েজ চকচক করত। আমার তখন ধারণা ছিল তেলি দাদা গোসল সেরেই মাথায় এক বোতল তেল ঢেলে তারপর বাইরে বের হন। আমার নানী বলতেন তেলা মাথায় তেল, কারণ যাদের কাছে তেলযুক্ত খাবার সহজলভ্য, তাদেরই তেলযুক্ত খাবার দিতে সবাই উৎসাহি; যারা টাকার অভাবে তেলহীন খাবার খায়, তাদের কেউ তেল দেয় না, জগতের এই নিয়ম । তেলি দাদার মাথা ছিল সেরকম তেলতেলে। হয়ত তেল উনার পছন্দ ছিল ভীষণ।
তেল গতিশীল হলে তেলি আর তেলির আধার যে সে হল তেলী। তো বঙ্গীয় শব্দকোষে তেলি, তেলী, তিলি আছে যার অর্থ তৈলবিক্রেতা হিন্দুজাতি-বিশেষ। যিনি তেলি তিনিই তৈলকার।
ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুযায়ী, তেল = তারীর দিশাগ্রস্ত লালন-লয়ন যাহাতে। তেল আর তৈল একই বস্তু হিসেবে প্রচলিত। যদিও তৈল সংস্কৃত আর তেল বাংলা শব্দ। তৈল-এর ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হল তারীর দিশাগ্রস্ত-আধারের লালন-লয়ন যাহাতে। তবে বাংলাভাষায় তেল শব্দটির যথেষ্ট বিকাশ সাধন হয়েছিল বলেই আমরা পেয়েছি 'তেলা মাথায় তেল দেওয়া', 'তেল মারা', 'তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠা', 'তেল দেওয়া' এরকম অনেক বাগধারা। এই তৈল বা তেল এতটাই জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ বস্তু যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন তৈল প্রবন্ধ। 'তৈল যে কী পদার্থ তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন, তাহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ বাস্তবিক স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর, অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কী? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠাণ্ডা করে তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর কিসে পারে! --- তৈল'। তেল হল একপ্রকার স্নেহজাতীয় পদার্থ, আবার দম্ভ, অহংকার, তেজ এসব বোঝাতেও তেল কথাটি ব্যবহৃত হয়। তেলাপোকা বা তেলাচোরা নামক একটি গৃহবাসী প্রাণী আছে যে নাকি তেল চুরি করে, তার নাম আবার তৈলপা। তেলাকচু নামে একটি শাক আছে। জামাকাপড়ে বা ব্যবহার্য্য সামগ্রীতে তেলচিটে বা তেলচিটা পড়ে, তেলচিটে হল তেলধুলায় মিশ্রিত চিটের মত ময়লা। যা হাতে লাগলে চটচট করে। আর বেশি তেল দিলে তেলতেলে হয়, তেলতেলে মানে তৈলাক্ত। লবন বেশি হলে যেমন হয় লবনাক্ত তেমনি বেশি তেলে তৈলাক্ত। অতিরিক্ত কিছুই আবার ভাল নয়।
এবার আসি খাদ্যদ্রব্যে তেল প্রসঙ্গে। আদতে তেল তরকারিতে সবারই কমবেশি পছন্দ। কেউ রান্নায় দিতে, কেউ স্বাদে পেতে। তবে আজকাল কোথাও খাঁটি তেল নেই। সর্ষে কিংবা সয়াবিন অথবা অলিভ সবখানেই ভেজাল। তরকারিতে কিংবা নাস্তায় আপনাকে ভেজালটিই দিতে হবে। কোথায় পাবেন খাঁটি তেল? ওই ভেজাল তেলেই আমরা খুশিতে ডগমগ, মাংসে, শুটকিতে, ভর্তায় নাস্তায় ঢালো ঢালো ঢালো ভেজাল তেল। অথচ ভেজাল তেল স্বাস্থ্যকর নয় মোটেও। আবার বয়স যখন বেড়ে যায়, তখন তেল হিতকর নয়। শিশুদের জন্য খাঁটি তেল পরিমিত পরিমাণে উপকারী। প্রবীণদের জন্য ক্ষতিকর, অথচ শিশুদের তেল দিয়ে রান্না করে খাবার পরিবেশনে আমাদের ততটা উৎসাহ নেই, যতটা উৎসাহে আমরা প্রবীণদের খাবারে তেল দিই। তেল বেশি দিলে খাবার স্বাদ হয়, তা ভেজালই হোক। ওতে কী কী মেশায় আল্লাহ জানেন।
অথচ কেউ যদি কেবল গভীর মায়ামমতা শ্রদ্ধাভক্তি ভরে তেলবিহীন ব্যঞ্জন রান্না করে, তবে তা কারো মুখে রুচে না। শ্রদ্ধাভক্তি হালে পানি পায় না, যতটা তেল পায়। তাই ঢালো তেল, হোক ভেজাল, তেলই-তো! আমরা তৈলাক্ত সব খাবারই পছন্দ করি, অবশ্য ঠেলায় পড়লে বা অসুস্থ হলে বেছে নিই বিরসবদনে সিদ্ধকেই। শরীরের উপর পড়লে বুঝি তেল কাহাকে বলে। মনের উপরও যদি পড়ে!
তেল প্রসঙ্গে কথা হবে অথচ কলুর বলদ কথাটি আসবে না, তা হয় না। তেলি বা কলু বিভিন্ন তৈলবীজ থেকে খাবার তেল উৎপাদন করতেন। তেলবীজ পেষার জন্যে পশুর সাহায্যে যে দেশীয় যন্ত্রটি কলুরা ব্যবহার করত তার নাম ঘানি। কলুরা বলদ দ্বারা ঘানি টানতেন। বলদ সারাদিন ঘানি টানত, কলুর ইচ্ছে মত টানত, এতে বলদের কঠিন পরিশ্রম হত। ঘানি টেনে সে তেল উৎপাদন করত ঠিকই, সে তেল তার কোন কাজে লাগত না। ফলভোগ তার ভাগ্যে ছিল না অথচ খেটে মরত। সেজন্য বিনালাভে কেউ পরিশ্রম করলে তাকে কলুর বলদ বলা হয়।
তেল নিয়ে আরো কথা বলা যায়। কিন্তু কলুর বলদ হয়ে লাভ কী!
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ২৮/০২/২০২২চমৎকার লেখনশৈলী
-
একনিষ্ঠ অনুগত ০৪/০১/২০২২তেল সমাচার। তেল নিয়ে অনেক লিখলেন। চাইলে আরও লেখা যেত, কিন্তু ঐযে বললেন 'লাভ কী'। আমিও সেটাই বলি।
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৪/০১/২০২২ভাল লাগল।
-
বোরহানুল ইসলাম লিটন ০৪/০১/২০২২সুন্দর উপলব্ধির উচ্চারণ।
সত্যিই তো!
সবাই তেল ভোগ করে অথচ বলদ শুধু খেটেই মরে! -
ফয়জুল মহী ০৩/০১/২০২২চমৎকার লেখনী ।
-
শ.ম.ওয়াহিদুজ্জামান ০৩/০১/২০২২বেশ ভাবনা।
-
মোঃজাকিরুল চৌধুরী ০৩/০১/২০২২চমৎকার লিখেছেন কবি