www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নলখাগড়া ও কলম

নলখাগড়া ও কলম (ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির গল্প)
--
চমৎকার একটা বিকেল। বাড়ির বলতে গেলে সবাই উঠানে বের হয়েছে। ওদিকে ছোটচাচার ছেলে তপুকে নিয়ে তন্ময়ের বড়আম্মা আর আম্মা পড়েছে। প্রায় শুকনো উঠানের মাঝখানে ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করা হয়েছে। তারই উপর কাঠি দিয়ে দাগ টেনে অক্ষরের মত লেখা হচ্ছে, তপুকে শেখানো হচ্ছে কীভাবে লিখতে হয়। তপু কেবল দাগ টানতে পারে, বড় আম্মা চেষ্টা করছেন ৩ লেখা শেখাতে। ৩ লিখতে পারলে আর তিনটা দাগ ঠিকমত বসাতে পারলেই অ হয়ে যাবে। সবাই খুব উৎসাহ দিচ্ছে। দাদী একটা বেঞ্চে বসে কুটনিতে সুপারী কুটছেন, আর কথা বলছেন। তন্ময়ের নজর একদিকে উঠানে, আরেকদিকে দাদীর কথায়। "আমাদের সময় আমরা এইভাবে উঠানে দাগ দিয়ে অক্ষর শিখতাম। খাগ দিয়ে লেখতাম। কালিতে চুবিয়ে চুবিয়ে লেখতাম, এখনকার মত সুন্দর সুন্দর কলম ছিল না" দাদী সুপারী কুটে আর এক কথাই বলতে থাকে। অদূরে পাল দাদ দুটো খাসীকে কাঁঠালের পাতা খাওয়াচ্ছে। বাড়ী জুড়ে উৎসব উৎসব ভাব, বেশ কিছু আত্মীয় স্বজনও এসেছেন। আগামীকাল তপুর তাক্তি অনুষ্ঠান।
তন্ময়ের মনে অনেক প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর গল্পদাদু ছাড়া আর কে দেবে!
গল্পদাদু একটু পরই নিজের ঘর থেকে বের হলেন। উঠানের মুখর পরিবেশ দেখে নিজেও এককোনায় বসে পড়লেন। তন্ময় আস্তে আস্তে গিয়ে গল্পদাদুর পাশে বসে পড়ে। তন্ময়ের মুখ দেখেই দাদু বুঝতে পারেন সে কিছু বলবে। একটু হেসে বলেন, 'কী দাদু! কী খবর!'
'দাদু! তপুর তাক্তি অনুষ্ঠান এটা আবার কী? এরকম কিছুর নাম আমি আগে শুনিনি।'
দাদু একটু কেশে গলা পরিস্কার করে নিলেন তারপর শুরু করলেন, 'আগের দিনে প্রথম কলম ধরলে হাতেখড়ি অনুষ্ঠান হত। এই অনুষ্ঠানে উলুখাগড়ার কলম বা খড়িমাটি দিয়ে লেখার শুভ উদ্বোধন হত। হিন্দু মুসলমান সবাই এই অনুষ্ঠান করত বেশ আড়ম্বর করে, হিন্দুদের হাতেখড়ি আর মুসলমানদের তাক্তি অনুষ্ঠান। মুসলমানরা মৌলবী এনে বাড়ির শিশুটিকে পিতা, মামা বা হুজুরের কোলে বসিয়ে বাংলা প্রথম অক্ষর বা আরবি প্রথম অক্ষর লিখিয়ে তাক্তি বা হতেখড়ি দিতেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সংস্কৃত অক্ষর দিয়ে হাতেখড়ি দিতেন এবং ব্রাহ্মণ বা মাতুল অথবা পিতা মাতা হতে ধরে শিশুকে প্রথম লিখতে শিখান। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে অর্থ্যাৎ স্বরস্বতী পূঁজার দিন হাতেখড়ির আয়োজন করতো। তাক্তি বা হাতেখড়ি অনুষ্ঠানে ভাল খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হত, লোকজন আসত। আগামীকাল
তপু প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে খাগের কলম ধরবে, লিখবে, ইমাম সাহেব দোয়াদরুদ পড়বেন যেন তপুর বিদ্যাশিক্ষা ভাল হয়। তপুর দাদীর সখ নাতির তাক্তি অনুষ্ঠান করবে।'
তন্ময় মনোযোগ দিয়ে শুনে। 'দাদু, আগের দিনে কি কলম ছিল না? মানুষ নাকি খাগ দিয়ে লিখত? মাটিতে এঁকে লিখত? আমাকে কলমের গল্পটা বল না দাদু!'
'বলব বলব, আগে তোর দাদীর বাটা থেকে পান নিয়ে আয়, মুখে একটু রস আনি।'
তন্ময় দৌড়ে গিয়ে দাদীর বাটা থেকে পান নিয়ে আসে, দাদু পানটা মুখে পুরে শুরু করেন কলমের গল্প।
'কলম শব্দের মূল অর্থ শর বা খাগ। আগের দিনে লোকে শরের কলম ব্যবহার করত। আমরা কলমকে ইংরেজিতে বলি pen, সেই পেন কোথা থেকে এসেছে তা জানো?'
তন্ময় না-সূচক মাথা নাড়ে। 'ল্যাতিন আমেরিকার penna থেকে ইংরেজী pen এসেছে। লাতিন ভাষায় এর অর্থ ছিল পাখির পালক। এ থেকে বোঝা যায় ওরা কলম হিসেবে পাখির পালক ব্যবহার করত। কোনো কোনো অভিধানে আছে কলম মানে একপ্রকার ধান, নল, খাগড়া আবার কলম মানে লেখনী। বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ অভিধান বলছেন, কলের সীমায়ন বহন করে যে তা হল কলম। মানুষ কথা বলে কল কল করে, যেমন নদীর ধারা কল কল করে বয়েই চলে। মানুষের কল কল করে বলা কথাকে কলম সীমায়িত করে লিখে রাখে। আসলে পৃথিবীর সব ভাষার একই আদিভাষা যে এক তা কলম শব্দটি দ্বারা আমরা বুঝতে পারি। পাণিনিরও আগে লিখিত উনাদি সূত্রে কলমের উল্লেখ আছে।'
তন্ময় অবাক হয়ে জানতে চায়, 'দাদু, পাণিনি কে?'
'পাণিনি একজন সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ। ধারণা করা হয় তিনি প্রাচীন ভারতীয় লৌহযুগের সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ। পাণিনির যুগ বা কাল নিয়ে কোনো নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি । ড: আহমদ শরীফের মতে তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম শতকে বর্তমান ছিলেন । পাশ্চাত্যের গো সু স্টুকারের মতে তার কাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৮ম শতাব্দী । জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার এবং অয়েবার মনে করেন পাণিনির সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী। অমরকোষ, বৌদ্ধযুগে লিখিত, তাতেও কলম শব্দটি আছে। বহু প্রাচীন গ্রন্থে কলমের উল্লেখ আছে। কলম যে লেখনী তা বহু প্রাচীন অভিধানে আছে।
লেখনি’ অর্থে কলম, আরবি ‘কলম’ থেকে এসেছে। তবে নালী শাক বা ঘাসের ডাঁটা যে লেখনী, অনুরূপ শব্দ লাতিন, গ্রিক, আরবি ভাষায়ও আছে। হিন্দি, তেলেগু, উড়িয়া ও বাংলা ভাষায় লেখনী অর্থে কলম শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। লেখনী অর্থে কলম আরবী থেকেই সংস্কৃতে এসেছে। আগের দিনে শর, খাগ, কঞ্চির কলম সবই নালিকা। গ্রীক kalamos, ল্যাটিন calamus শব্দের মৌলিক অর্থও নল, বেত, নলের কলম।'
তন্ময়ের কাছে বিষয়টি কঠিন লাগছে। সে প্রশ্ন করে, 'তবে কি দাদু মানুষ শুরু থেকেই কলম ব্যবহার করে আসছে?'
'না দাদু, মানুষ যখন শিকার করত, কাঠি দিয়ে ছবি আঁকত মানুষ। পাতা বা গাছের ডালের কষ দিয়ে গুহার গায়ে পশু বা তার মনের ভাবটি ছবি এঁকে রাখত যাতে অন্যের কাছে তার ভাবনাটি পৌঁছে যায়। কারণ তখন তো মানুষ লিখতে জানত না।
কলমের ইতিহাস প্রায় ৫হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন মিশরীয়রা বিভিন্ন গাছের পাতা ও বাকলের উপর নলখাগড়া শর বা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে লিখত। মধ্যযুগে কাগজ আবিষ্কারের পর পালকের কলমের শুরু। ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা আলমুইজ এর আদেশ অনুসারে হাতে কালি লাগবে না অথচ লেখার সময় আপনা থেকে কলমের ডগায় কালি চলে আসবে এমন কলম আবিষ্কার করা হয়। সেই কলমের নাম ছিল ফাউন্টেন পেন। গ্রীসে ছিল হাতির দাঁতের কলম। এর নাম ছিল স্টাইলাস। লেখার ধরণকে সেজন্য স্টাইল বলা হয়।'
'দাদু, নলখাগড়া দিয়ে কীভাবে কলম হয়?'
'নলখাগড়ার নলের আগাকে চোখা তেরছা করে কেটে কলম বানানো হত। গাছের চারা করা হয় একটা অংশ কেটে আরেক গাছে জোড়া দিয়ে নতুন চারা তৈরীর পদ্ধতিকেও কলম বলে। নলখাগড়ার আগে পাখির পালকের গোড়ার চোখার অংশ দিয়ে লেখা হত এর পর এল বাঁশের কঞ্চি কলম।'
'দাদু তুমি বললে কলম মানে ধান, এটা কী রকম?'
'প্রাচীন কালে বাংলাদেশে ভালো ধানকে ‘কলম’ বলা হত। পরবর্তীকালে এ ‘কলম’ ধানই কলমা ধান নামে পরিচিতি পায়। কালিদাসের এক শ্লোকে­ এ ‘কলম’ বা ‘কলমা’ ধানের বর্ণনা আছে।'
'দাদু, এখন তো আমরা সুন্দর সুন্দর বলপেন দিয়ে লিখি।'
'হ্যাঁ, যুগের পর যুগ কেটে গেছে কলমকে আজকের কলমের আকার নিতে, সে আরেক ইতিহাস। কত রকম যে কলম ছিল আর কতজন যে এই কলমের পিছনে শ্রম দিয়েছেন। বলপেন আবিষ্কারের ইতিহাসও চমকপ্রদ। সে গল্পও তোমাকে একদিন বলব।'
তন্ময় মাথা নাড়ে, সন্ধ্যা হই হই, ঘরে যেতে হবে। দাদু আবার বলেন, 'কলম নিয়ে মজার মজার শব্দ আছে। কলমচি নামে একটি শব্দ আছে, সনদ যারা লিখতেন তাঁদের কলমচি বলা হত। আর বকলম হল এমন একজন লেখাপড়া জানা মানুষ, যিনি লেখাপড়া জানেন না এমন কাউকে চিঠিপত্র লিখে দেন, পড়ে দেন, তার হয়ে স্বাক্ষর করে দেন। বকলম মানে কিন্তু মূর্খ নয়।'
তন্ময় এ বিষয়টি জানত না। তার অবাক হবার পালা। কতকিছু যে জানার আছে তার গল্পদাদুর কাছে। তবে আজ আর নয়, মা বকবে, ঘরে যেতে হবে। গল্পদাদু আর তন্ময় দুজনেই নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়ান।
তথ্যসূত্র ও তথ্যকৃতজ্ঞতা: উইকিপিডিয়া, রোয়ার মিডিয়া, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ।
০৫/০৮/২১
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৫১২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৫/০৮/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • এ বি এস তুষার ১১/০৮/২০২১
    sundor lekha
  • ভালো লাগলো।
  • ফয়জুল মহী ০৫/০৮/২০২১
    সুন্দর উপস্থাপন ! একরাশ মুগ্ধতা শুভেচ্ছা জানবেন I
  • Md. Ashik Hossain Rone ০৫/০৮/২০২১
    অসাধারণ
 
Quantcast