www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

পড় পড়া পাড়া

পড় পড়া পাড়া (ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির গল্প)
---
তন্ময় পড়ার টেবিলে বসেছে, সামনে বই খোলা। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, তন্ময় একমনে বৃষ্টির পড়া দেখছে। তুমুল বৃষ্টি নয়, টিপটিপ বৃষ্টি। খোলায় হৈচৈ শুনা যাচ্ছে। তন্ময় বইয়ের পাতায় চোখ রাখে। ছবিটা মন দিয়ে দেখছে সে, একটা নৌকা গলুইতে মাঝি বৈঠা হাতে। কবিতাটা বেশ চমৎকার। 'মা যদি হও রাজী, বড় হলে আমি হব খেয়া নৌকার মাঝি।' এই লাইনটা তার ভীষণ প্রিয়, সবসময় গুনগুনিয়ে আবৃত্তি করে আর মনে মনে নিজেকে মাঝি ভেবে কল্পনায় নৌকা বায়। তন্ময়ের এখন ঠিক পড়তে ভাল লাগছে না। মন পড়ে রয়েছে খোলায়, সে বই বন্ধ করে দরজা গলে বাইরে এল। বারান্দা থেকে দেখা যায় বাড়ীর ছেলেপুলেরা নৌকায় উঠছে আবার লাফ দিয়ে পানিতে পড়ছে। তন্ময়ের আম্মু ডাক দিলেন, 'তন্ময়! পড়া ছেড়ে উঠে গেলে? পড়তে বসবে না?' হঠাৎ তন্ময় অবাক হল, উঠানের দিকে তাকিয়ে এক দৌড়ে গল্পদাদুর ঘরে। তন্ময়কে দেখে দাদু বললেন, 'কী দাদু! হাফাচ্ছ কেন?'
'দাদু, মারাত্মক একটা প্রশ্ন আমার মনে এসেছে।' তন্ময় দ্রুত উত্তর দেয়। 'কী প্রশ্ন? আমায় বলা যাবে?'
'হ্যাঁ দাদু, আমি পড়া বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাই। সব কেন পড়ে? এই যে গাছ থেকে আম পড়ে, নৌকা থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়ে, মনে পড়ে, আকাশ থেকে পড়ে, পায়ে পড়ে আবার বই-ও তো পড়ে। এত পড়া সবই কি এক?'
দাদু পান চিবোচ্ছেন, মুখে পানের ডাটা দিয়ে একটু চুন পুরে দিলেন তারপর বললেন, 'শোন দাদু, পড়া নিয়ে অনেক কথা আছে তুমি মন দিয়ে শোন।'
তন্ময় মাথা নাড়ে, দাদু বলতে শুরু করেন।
'সংস্কৃতে আছে পত্ (পতিত হওয়া) ও পঠ্ (পাঠ করা) দুটোই বাংলায় এসে পড় ক্রিয়া হয়েছে। এই পড় ক্রিয়ার এত ব্যাপক ব্যবহার বাংলায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ প্রায় ৫০ রকম উদাহরণ দেখিয়েছেন। উপর থেকে পড়া, মনে পড়া, পায়ে পড়া, নজরে পড়া, টান পড়া, ধরা পড়া, মরচে পড়া, ডাকাত পড়া, বাধা পড়া, কাজ পড়া; আবার বই-ও পড়া।'
'দাদু! সবই পড়া? তাহলে পড় একটা মারাত্মক শব্দ তাই না?'
দাদু হাসেন। 'তুমি যখন বই পড়, তখন মনে মনে পড় বা শব্দ করে পড়। উচ্চারণ করে পড় যখন তখন তা তুমি পাঠ কর। উচ্চারণ করে পড়া হল পঠ। কারণ কাগজে যা লেখা তাকে তুমি শব্দে বদলে নিচ্ছ, যা তুমি গ্রহণ করছ, পাচ্ছ বা তা পান করছ। এখানে গ্রহণ করা, পাওয়া বা পান করা যাই বল না, তার রস তুমি পাচ্ছ। ওখানে কী লেখা আছে তা তুমি বুঝতে পারছ। যে ক্রিয়ার সাহায্যই নাও বইটি পড়ে বুঝতে গিয়ে, সেটি হল পঠ্ ক্রিয়া। বাংলায় পঠ নেই, আছে পাঠ। আমরা বলি বই পাঠ করা বা বই পড়া, যিনি পাঠ করেন তিনি পঠক। পঠ করলে জানা যায়, অবগত হওয়া যায়। এবার আসি পঠ কেমন করে পড় হল!
তুমি যখন কিছু পাঠ কর, তখন তা তোমার মনের ভেতর পতিত হয় বা মনে পড়ে, হৃদয়ঙ্গম (হৃদয়ে গমন) হয়। ধর তুমি রেলগাড়ী নিয়ে একটি রচনা পাঠ করলে, তুমি জানলে সেই সাথে তোমার মনে পড়ল রেলে চড়ার কথা, বা তোমার ইচ্ছে হল রেলগাড়ীতে চড়তে, মনে মনে তুমি ভাবছ তুমি রেলে চড়ে আছ। তুমি পাঠ করছ রেলগাড়ী আর অমনি তোমার মন তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দিল কল্পনার রেলগাড়ীতে। তাই পাঠ করলে কিছুটা নীচে যাওয়া বা পড়া হয়, পাঠ (পঠ হতে জাত) করা হয়। এই পড়ার ফলে কেউ নীচে পড়ে স্থির থাকতেও পারে, আবার কেউ তা পড়ে কেউ মনে মনে উড়তেও পারে। এই যে পড়া তা অদৃশ্য, মনে মনে টের পাওয়া যায়, এটা (জ্ঞান সম্পর্কিত) পান-এর গড়ান-উড়ান। যে রস তুমি পাচ্ছ, বা যে বিষয় তুমি জানতে পারছ তার গড়ান-উড়ান।'
তন্ময় প্রশ্ন করে, 'দাদু! গড়ান-উড়ান কী?'
'গড়ান হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যাতে গড়িয়ে চলা চলমান থাকে, উড়ান হল এমন একটি অবস্থা যাতে উড়ে চলা চলমান থাকে। ড় বর্ণটি গড়ান-উড়ান ক্রিয়া বোঝায়।'
'দাদু, এটা হল বই থেকে পাঠ করে বা জ্ঞান বিষয়ক জানা যে ক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা মনের মাঝে টের পাই, তা হল পঠ যা বাংলায় পড় হয়েছে।'
'ঠিক বলেছ দাদু। আর বাদবাকী যেসব পড়া আছে সেগুলো এসেছে পত্ (পতিত হওয়া) ক্রিয়া থেকে। পত্ > প তারিত যাহাতে। যা উপর থেকে পতিত হয়, পড়িয়া যায়, পড়িতে পড়িতে উড়িয়া যায়, অধঃপতিত হয়। উপর থেকে কিছু পতিত হওয়ার পর পরই পতিত বস্তু স্থির হয় না, সে তখন কোনো না কোনো ক্রিয়া করে বা করতে বাধ্য হয়। কেউ পতিত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে থামে, কেউ উড়তে শুরু করে, কেউ লাফাতে শুরু করে। এগুলো হল স্থির হওয়ার ক্রিয়া। পত্ (সত্তার পালন-পানের তারণ) তখন পড় (সত্তার পালন-পানের গড়ান-উড়ান) হয়ে যায়। ড় (গড়ান-উড়ান) প (প্রাপণ-পান-পালন) শব্দতত্ত্বের বিপ্রতীপ নিয়মে প (প্রাপণ-পান-পালন) ড় (গড়ান-উড়ান) হয়ে যায়। ইংরেজী drop শব্দটির অর্থ পড়া বা পতিত হওয়া। ড়প এর উত্তরাধিকার বাংলায় নেই, ইংরেজীতে আছে। এই পত্ বা পড় ক্রিয়াটি দেখা যায়, টের পাওয়া যায় বাস্তবে।
পড় থেকে পড়া হয়। দেখ, পড়া এর দু'রকম অর্থ। পড়া = পড় এর আধার যে, পাঠ করা, পাঠ, পঠিত, অধীত, পাঠ্য বিষয়। পড়া = পতিত হওয়া, নীচে গমন করা, অধঃপতিত হওয়া।'
দাদু থামলেন এবার। দাদুর সামনে চা দেওয়া হয়েছে। চা শেষ করে বাকিটুকু বলবেন। তন্ময় অপেক্ষা করতে থাকে।
দাদু চা শেষ করে আরেকটা পান মুখে পুরে বলতে লাগলেন, 'তুমি স্কুলে পড়, যাকে বলে পড়াশোনা, এই পড়াশোনা-তে পড়া ও শোনা থাকে। এখানে তোমার পড়া থাকে আবার শিক্ষকের উপদেশ শোনাও থাকে যাকে বলে অধ্যয়ন ও গুরু-উপদেশ শ্রবণ। কোনো কিছু পড়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু পড়ছে না; তাকে বলে পড়োপড়ো অবস্থা। যা পড়ে যাচ্ছে তা হল পড়তি, আবার পতনোন্মুখ অর্থাৎ তার তেজ কমে যাচ্ছে সে হল পড়ন্ত। আবার পাড় শব্দটা খেয়াল কর, সে পড় থেকে এসেছে। আমাদের দরকারী জিনিস উপর থেকে নীচে পতিত হয়ে যায় বা পড়ে যায় বা নীচে নামাতে হয় তখন পড় হয় পাড়। যেমন আম পাড়, বা আম পাড়া। পাড় অর্থ পতিত করা বা পাড়ন করা বা পাড়া বা পেড়ে আনা। এই পাড় কেবল পতন ঘটায় না, পঠন-ও ঘটায়। সেই কারণে নামানো-টা যেমন পাড়া হয় তেমনি উৎ-চারণ (উচ্চারণ করে পড়া) মাত্রেও পাড়া হয়। পেড়ে যদি নিজের পরিধির বাইরে পাঠান হয়, তবে তা-ও পাড়। যেমন নদীর পাড়, শাড়ীর পাড়। পাড়াগ্রাম কী? মূল গ্রামের এক প্রান্তে গড়ে ওঠা বসতি, যা মূল বসতির বাইরে। পল্লীগ্রাম হল মূল গ্রামের পল্লবিত গ্রামাংশ, অর্থাৎ গ্রামের বাইরে বসান নতুন গ্রাম। পাড় গতিশীল হয়ে পাড়ি হয়, পাড়ি হল পাড় টপকে যাওয়া।'
গল্পদাদু থামলেন।
'দাদু, এই যে পড় নিয়ে তুমি এত কিছু বললে, এগুলো তুমি কোথায় পেলে?'
গল্পদাদু বইয়ের শেলফের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। ওখানে বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ নামে দুটো অভিধান দেখতে পায় তন্ময়। 'শব্দের ভেতরের ও বাইরের মজা পেতে এই অভিধানের বিকল্প নেই।
তন্ময় দাঁড়ায়, পায়ে পায়ে সেলফের পাশে যায়। বই, বইয়ের গন্ধ নাকে ভেসে আসে। বইয়ের গন্ধ কেন এত ভাল লাগে!
০১/০৮/২১
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৫১৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/০৮/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast