হাওরের শিক্ষা ব্যবস্থা ও আমার ভাবনা
হাওরের শিক্ষা ব্যবস্থা ও আমার ভাবনাঃ
--
টাঙ্গুয়ার জল কেটে আমরা যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম চোখে পড়ল একটি প্রাইমারি স্কুল,যেন দ্বীপের মাঝে ঠায় দাড়িয়ে আছে চুপচাপ।এটি একই সাথে ফ্লাড সেন্টারও বটে।নিচতলা খালি,উপরে শ্রেণি কক্ষ।হালকা সবুজ রঙে ছোপানো স্কুল দেখতে দৃষ্টিনন্দন বৈকি।
যতটা নৌকা থেকে দেখা যায় উঁকি দিয়ে দেখছি,স্কুলটির চারপাশে স্থলে দু'চারেক চালাঘর, আর চারদিকে জল।
জলের এই সাগরে বহুদূরে গ্রামের ছায়া দেখা যায় বটে,এখানে কোথায় কী বুঝতে পারিনি তখন।
স্কুল যদি দৃষ্টিনন্দন হয় তাতে কিছু যায় আসে যদি তাতে শিক্ষার্থী না থাকে অথবা শিক্ষার্থীর গমন সহজ সাধ্য না হয়!
স্কুল এমন হবে যা শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য সুগম, আমার ঠিক জানা নেই তরঙ্গসঙ্কুল উত্তাল বর্ষায় কী করে এসব স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ যাতায়াত করেন।
*
আমাদের সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা হল একফসলি এলাকা,বোরোর মৌসুমে বোরোর আবাদ হয়,বৈশাখে ধান তোলা হয় আর সারাবছর জমি থাকে পানির নিচে।তখন হাতে তেমন একটা কাজ থাকে না বলে লোকজন মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।আবার জলাভূমিতে মাছ ধরাটা ঠিক সঙ্গত নয় বিভিন্ন কারণে।যারা কৃষক,জমিতে চাষ করেন তারা হচ্ছেন প্রান্তিক শ্রেণির লোকজন,জমির মালিক থাকেন অন্যরা।অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে যে আয় হয় তা দিয়ে সারাবছরের খোরাকি চলে না।
ধানের ন্যায্য দাম নেই,জমিতে চাষাবাদের খরচ উঠেনা তাই অনেকে জমিতে ধান চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন।
তো এইযে হাওর পাড়ের লোকজন,যারা ওখানেই ঘর বেধে থাকেন,প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকেন, তাঁদের জীবিকা নির্বাহের কোনও সুনির্দিষ্ট উপায় নেই।অনেকে তাই স্থানান্তরিত হন,কেউ পাথরের, বালুর নৌকায় কাজ করেন।কাজটা সহজপ্রাপ্য নয়,হলেও মজুরি পর্যাপ্ত নয়।মোটকথা একটি উন্নত জীবনমান তাতে নির্বাহ বা সুনিশ্চিত করা যায় না।
এই যে আর্থ-সামাজিক অবস্থা এটি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রচুর প্রভাব ফেলে।
একজন বাবা তার শিশুকে স্কুলে না পাঠিয়ে জমিতে নিয়ে যেতে উৎসাহিত বেশি,কারণ ওতে তার সাশ্রয় হয়,আর্থিক লাভ হয়।মাছ ধরার কাজে লাগিয়ে দিলে তাতে সাশ্রয় হয়,অর্থাগম হয়ে সংসারের কাজে লাগে, কাজেই শিক্ষার ভাবনা এখানে গৌণ।
*
টাঙ্গুয়ায় ভরা জলের মৌসুমে গেলে দেখা যাবে স্কুলবয়সী শিশুরা বাবার সাথে নৌকাতে চা বিক্রি করছে,পর্যটকদের সামনে গান গেয়ে টাকা রোজগার করছে,তারা স্কুলে যাচ্ছে না।
মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বেঁচে থাকার জন্য যা তা হল অন্ন,দু'বেলা দু'মুঠো খাবার।এর নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা গেলেই তবে বাদ বাকি আয়োজন।
হাওর পাড়ের শিশুরা তাই স্কুল থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা থেকে অনেকটা বঞ্চিত হয়।
সরকারের আন্তরিকতা আছে,প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুলও আছে কিন্তু অভিভাবকবৃন্দ শিশুদের দিয়ে আয়মূলক কাজে যুক্ত রাখেন বিধায় শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না।
*
এই যে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী উপযুক্ত কর্মসংস্থান ও উৎপাদনমূলক কাজের বাইরে থাকেন বছরের অধিকাংশ সময়,তারা সারাদিন টিভির সামনে বসে থাকে, এদের কাজে লাগানোর জন্য কী করা যায় তা ভাবতে হবে।দেশের উন্নয়নের স্বার্থে এটা জরুরী।
যখন এটা হবে তখন শিশুদের শিক্ষাগ্রহণ সহজতর হয়ে যাবে।
*
একটি পরিবারে নানাবয়সী সদস্য থাকেন, সবার জন্য একইরকম খাবারের আয়োজন করলে চলে না।
বয়স্কদের জন্য একরকম,শিশুদের জন্য একরকম আবার উঠতি বয়সী শিশু কিশোরদের জন্য আরেকরকম খাবার প্রয়োজন হয়।
সেরকম আমাদের দেশের সমস্ত অঞ্চলের ভৌগোলিক কাঠামো এক নয়,এক নয় একইরকম সুগম যাতায়াত ব্যবস্থা।
জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা,সুযোগ সুবিধা এক নয়।এই যে ভিন্নতা - এই ভিন্নতাকে সর্বোচ্চ প্রাধাণ্য দিয়ে হাওর এলাকার জন্য পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরী।
*
সেক্ষেত্রে আমার মতে শিক্ষা ক্ষেত্রে
* সমতল এলাকার চেয়ে হাওর এলাকায় স্কুলগামী শিশুদের উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে।
* শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা সম্বলিত আবাসিক ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
* স্কুলকে সমাজিক সেন্টার হিসেবে গড়ে হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে- যাতে এলাকাবাসী স্কুলের গুরুত্ব বুঝতে পারে।
* ছুটি বিশেষ করে বোরো মৌসুমের ছুটি হাওর এলাকায় চালু করা যেতে পারে।
* দুর্যোগকালীন বিশেষ ছুটির বিধান অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে।
* স্কুল পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি, পাঠদান পদ্ধতি ও যাবতীয় বিষয়াদি অত্যাধুনিক করা যেতে পারে- আইসিটি বেইজড হবে সবকিছু।
* শিক্ষকদের স্পেশাল ভাতা হাওর এলাকার জন্য বাড়াতে হবে।
* আমাাদের দেশে অনেক সামর্থ্যবান মানুষ আছেন তাঁরা এগিয়ে আসতে পারেন,হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন হাওর এলাকায় শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য।
*
স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই,ভাবতে দোষ নেই।যা কিছু ভাবি তাতে ভুলও হতে পারে।তবে ইতিবাচক যদি হয় স্বপ্নটা,ভাবনাটা যদি কল্যাণের কথা ভেবে হয় তবে তাতে ভুল কিছু থাকলেও দোষের নয়- এতে সংশোধন বা পরামর্শ যোগ করা যেতেই পারে।
ধন্যবাদ।
--৩০/১১/২০১৯
--
টাঙ্গুয়ার জল কেটে আমরা যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম চোখে পড়ল একটি প্রাইমারি স্কুল,যেন দ্বীপের মাঝে ঠায় দাড়িয়ে আছে চুপচাপ।এটি একই সাথে ফ্লাড সেন্টারও বটে।নিচতলা খালি,উপরে শ্রেণি কক্ষ।হালকা সবুজ রঙে ছোপানো স্কুল দেখতে দৃষ্টিনন্দন বৈকি।
যতটা নৌকা থেকে দেখা যায় উঁকি দিয়ে দেখছি,স্কুলটির চারপাশে স্থলে দু'চারেক চালাঘর, আর চারদিকে জল।
জলের এই সাগরে বহুদূরে গ্রামের ছায়া দেখা যায় বটে,এখানে কোথায় কী বুঝতে পারিনি তখন।
স্কুল যদি দৃষ্টিনন্দন হয় তাতে কিছু যায় আসে যদি তাতে শিক্ষার্থী না থাকে অথবা শিক্ষার্থীর গমন সহজ সাধ্য না হয়!
স্কুল এমন হবে যা শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য সুগম, আমার ঠিক জানা নেই তরঙ্গসঙ্কুল উত্তাল বর্ষায় কী করে এসব স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ যাতায়াত করেন।
*
আমাদের সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা হল একফসলি এলাকা,বোরোর মৌসুমে বোরোর আবাদ হয়,বৈশাখে ধান তোলা হয় আর সারাবছর জমি থাকে পানির নিচে।তখন হাতে তেমন একটা কাজ থাকে না বলে লোকজন মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।আবার জলাভূমিতে মাছ ধরাটা ঠিক সঙ্গত নয় বিভিন্ন কারণে।যারা কৃষক,জমিতে চাষ করেন তারা হচ্ছেন প্রান্তিক শ্রেণির লোকজন,জমির মালিক থাকেন অন্যরা।অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে যে আয় হয় তা দিয়ে সারাবছরের খোরাকি চলে না।
ধানের ন্যায্য দাম নেই,জমিতে চাষাবাদের খরচ উঠেনা তাই অনেকে জমিতে ধান চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন।
তো এইযে হাওর পাড়ের লোকজন,যারা ওখানেই ঘর বেধে থাকেন,প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকেন, তাঁদের জীবিকা নির্বাহের কোনও সুনির্দিষ্ট উপায় নেই।অনেকে তাই স্থানান্তরিত হন,কেউ পাথরের, বালুর নৌকায় কাজ করেন।কাজটা সহজপ্রাপ্য নয়,হলেও মজুরি পর্যাপ্ত নয়।মোটকথা একটি উন্নত জীবনমান তাতে নির্বাহ বা সুনিশ্চিত করা যায় না।
এই যে আর্থ-সামাজিক অবস্থা এটি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রচুর প্রভাব ফেলে।
একজন বাবা তার শিশুকে স্কুলে না পাঠিয়ে জমিতে নিয়ে যেতে উৎসাহিত বেশি,কারণ ওতে তার সাশ্রয় হয়,আর্থিক লাভ হয়।মাছ ধরার কাজে লাগিয়ে দিলে তাতে সাশ্রয় হয়,অর্থাগম হয়ে সংসারের কাজে লাগে, কাজেই শিক্ষার ভাবনা এখানে গৌণ।
*
টাঙ্গুয়ায় ভরা জলের মৌসুমে গেলে দেখা যাবে স্কুলবয়সী শিশুরা বাবার সাথে নৌকাতে চা বিক্রি করছে,পর্যটকদের সামনে গান গেয়ে টাকা রোজগার করছে,তারা স্কুলে যাচ্ছে না।
মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বেঁচে থাকার জন্য যা তা হল অন্ন,দু'বেলা দু'মুঠো খাবার।এর নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা গেলেই তবে বাদ বাকি আয়োজন।
হাওর পাড়ের শিশুরা তাই স্কুল থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা থেকে অনেকটা বঞ্চিত হয়।
সরকারের আন্তরিকতা আছে,প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুলও আছে কিন্তু অভিভাবকবৃন্দ শিশুদের দিয়ে আয়মূলক কাজে যুক্ত রাখেন বিধায় শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না।
*
এই যে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী উপযুক্ত কর্মসংস্থান ও উৎপাদনমূলক কাজের বাইরে থাকেন বছরের অধিকাংশ সময়,তারা সারাদিন টিভির সামনে বসে থাকে, এদের কাজে লাগানোর জন্য কী করা যায় তা ভাবতে হবে।দেশের উন্নয়নের স্বার্থে এটা জরুরী।
যখন এটা হবে তখন শিশুদের শিক্ষাগ্রহণ সহজতর হয়ে যাবে।
*
একটি পরিবারে নানাবয়সী সদস্য থাকেন, সবার জন্য একইরকম খাবারের আয়োজন করলে চলে না।
বয়স্কদের জন্য একরকম,শিশুদের জন্য একরকম আবার উঠতি বয়সী শিশু কিশোরদের জন্য আরেকরকম খাবার প্রয়োজন হয়।
সেরকম আমাদের দেশের সমস্ত অঞ্চলের ভৌগোলিক কাঠামো এক নয়,এক নয় একইরকম সুগম যাতায়াত ব্যবস্থা।
জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা,সুযোগ সুবিধা এক নয়।এই যে ভিন্নতা - এই ভিন্নতাকে সর্বোচ্চ প্রাধাণ্য দিয়ে হাওর এলাকার জন্য পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরী।
*
সেক্ষেত্রে আমার মতে শিক্ষা ক্ষেত্রে
* সমতল এলাকার চেয়ে হাওর এলাকায় স্কুলগামী শিশুদের উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে।
* শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা সম্বলিত আবাসিক ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
* স্কুলকে সমাজিক সেন্টার হিসেবে গড়ে হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে- যাতে এলাকাবাসী স্কুলের গুরুত্ব বুঝতে পারে।
* ছুটি বিশেষ করে বোরো মৌসুমের ছুটি হাওর এলাকায় চালু করা যেতে পারে।
* দুর্যোগকালীন বিশেষ ছুটির বিধান অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে।
* স্কুল পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি, পাঠদান পদ্ধতি ও যাবতীয় বিষয়াদি অত্যাধুনিক করা যেতে পারে- আইসিটি বেইজড হবে সবকিছু।
* শিক্ষকদের স্পেশাল ভাতা হাওর এলাকার জন্য বাড়াতে হবে।
* আমাাদের দেশে অনেক সামর্থ্যবান মানুষ আছেন তাঁরা এগিয়ে আসতে পারেন,হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন হাওর এলাকায় শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য।
*
স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই,ভাবতে দোষ নেই।যা কিছু ভাবি তাতে ভুলও হতে পারে।তবে ইতিবাচক যদি হয় স্বপ্নটা,ভাবনাটা যদি কল্যাণের কথা ভেবে হয় তবে তাতে ভুল কিছু থাকলেও দোষের নয়- এতে সংশোধন বা পরামর্শ যোগ করা যেতেই পারে।
ধন্যবাদ।
--৩০/১১/২০১৯
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
নুর হোসেন ০১/১২/২০১৯আপনাদের সফলতা কামনা করছি।
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ৩০/১১/২০১৯ভালো লাগলো।
আপনার বেশ মজার চাকরি। কত ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ!!!