www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সংবাদ পরিক্রমা

সংবাদ পরিক্রমা

কলমে- কামরুজ্জামান সাদ

মধ্যরাতের হিংস্র আকাশটা দুলতে থাকে মজিদের কাছে৷ মেঘে ঢাকা চাঁদবিহীন আকাশটা ভয়ঙ্কর রকমের হিংস্র। নৈঃশব্দের রাত দ্রুত শেষ হতে চায় না। কেমন যেন একা লাগছে তার। শরীর শীতল করা নিঃসঙ্গতা। অনুচ্চারিত সত্যাসত্যের মাঝামাঝি ঐশ্বরিক রাতটাও বড্ড নিঃসঙ্গ। ওয়ান ইলেভেনের পর মানুষের গন্তব্যটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। পরিবর্তন হয়েও কি দৃঢ় কোন গন্তব্য মানুষ পেয়েছে? অবসাদগ্রস্ত দায়হীন একটা সমাজ গড়ে উঠেছে। এখানে মজিদের কাজ কি?

কয়েকঘণ্টা আগে দুইটা খুন হয়েছে। দুইটা না কি একটা? ঠিক মনে করে উঠতে পারে না সে। একটাই হয়তো। খুন! মানে আরো একটি অনিচ্ছুক যাত্রা, কাউকে এই বিশ্বসংসার ছেড়ে যেতে বাধ্য করা যখন কি না সে থাকতে চায় এখানে। পৃথিবীতে আমরা বাঁচতে চাই, সুখ খুঁজি। আদম ও হাওয়াকে সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল কৃতকর্মের সাজা ভোগ করতে। সাজা কোথায় দেওয়া হয়? জাহান্নামে। পৃথিবী নামক জাহান্নামেই আমরা বাঁচতে চাই এবং বাঁচতে চাই। যে খুন হয়েছে তারও হয়তো এরকমই আশা ছিল। মরার আগে একটা প্রেমিকা কি তার ছিল না? প্রেমিকাই কেন বলছি! সে যদি নারী হয়? তাহলে তো একটা প্রেমিক থাকার কথা। প্রেমিকটা অপেক্ষায় থাকত বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে। আজও হয়তো অপেক্ষায় ছিল। এভাবে খুনোখুনি করে ধ্বংস হতে থাকলে ডাইনোসরের মতোই একদিন হারিয়ে যাবে বাঙালি জাতি। ভিকটিম নারী না পুরুষ? খুনই তো হয়েছে, তাহলে নারী পুরুষ ভেদাভেদ কেন? ফরিদপুরের এক্সিডেন্টের কথাই ধরা যাক। ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটল। চ্যানেলওয়ালারা নিউজ করলো, ‘তিনজন নারী ও শিশুসহ চৌদ্দজন নিহত।’ মৃতেরা শুধুই সংখ্যা, তারা কখনোই কদর্যরুপে নারীতে বা পুরুষে ভাগ হতে পারে না। এত রাতে ঘটনার বিস্তারিত কে বলতে পারবে? ক্রাইম রিপোর্টার শাকুর আলিকে কল করা যেতে পারে। খুবই এক্টিভ পার্সন। ডেডিকেটেড। তিনবার রিং হওয়ার পর শাকুর রিসিভ করল। বেচারারই বা দোষ কোথায়? এত রাতে জেগে থাকবে কেন? ক্রাইম রিপোর্টারদের এই সময়ে ঘুমাতে মানা। মানা এজন্য যে, তাবৎ প্রাণীকূলের মারাত্মক অপরাধগুলো রাতেই ঘটে।
কী অবস্থা এখন?
কার?
কার মানে, এত রাতে তোমার ভালো-মন্দ জানতে কল দিয়েছি?
ও, মজিদ ভাই?
শোন শাকুর, হয় ভাই বলবে নাহলে মজিদ বলবে। মজিদ ভাই শুনতে ভালো লাগে না। খুনের ওই সংবাদটা কি পত্রিকায় গিয়েছে?
অনেক আগেই পাঠানো হয়েছে।
ভিকটিম সম্পর্কে বল।
খুন হয়েছে একটা তরুণ। বছর পঁচিশের টগবগে তরুণ। গায়ের রং শ্যামলা, চুলগুলো এলোমেলো, মায়াবি একটা চেহারা। মুখে হালকা দাড়ি..
তুমি আমার সাথে ফাজলামো মার্কা কথা বলবে না। শাহাব হোসাইনের উপন্যাসের মতো ত্যানা প্যাঁচাতে যাওয়ার কারণ নেই তো। একটা চল্লিশ পেজের উপন্যাসকে টেনে তিনশো পেজে নিয়ে যায়। শোন, এই লেখকের কোন লেখা যেন আমাদের পত্রিকায় না যায়। মুখে হালকা দাঁড়ি রাখা এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। ছেলেটি নিশ্চিতভাবে জঙ্গিদের সহযোগী। আজকাল জঙ্গিরা এধরনের ছেলেদেরই টার্গেট করে। পুলিশ হয়তো অস্ত্র উদ্ধারে গিয়েছিলো ওখানেই সহযোগীদের হাতে মারা গেছে। এইসব ছেলেদের নিয়ে বিশ্বাস নেই, পুলিশের দুঘা পাছায় পড়লেই সব বলে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এদের মেরে দেওয়াই ভালো। ইউরোপে জঙ্গিরা আত্মঘাতি হয়ে উঠছে। বাংলাদেশেও এর ট্রেন্ড চলে আসছে। আহারে! কোন মায়ের যে বুক খালি হলো। এরা জন্ম নেয় বাপ মাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য...
আরে না, ঘটনা অন্যখানে ছেলেটি অবিবাহিত..
বুঝেছি। প্রেমঘটিত কেস। এসব ছেলেরা ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে। তারপর আত্মহত্যা। অনেকে আবার অন্যের বউয়ের সাথে সম্পর্কে উৎসাহী। ফলাফল যা হয়? স্বামী একদিন হাতে নাতে দেখে ফেললো। খুন! হয় প্রেমিক খুন, নয়তো স্ত্রী খুন । এখানে প্রেমিক খুন। সিম্পল ইকুয়েশন। অনেক সময় অবিবাহিত মেয়েদের প্রেমিকেরাও শক্তিশালী হয়। প্রতিপক্ষ মাঠে রাখতে চায় না। মন দেখে প্রেম করতে পারলে পুরুষরা ঠিক নারীতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারত। কিন্তু পুরুষ তো প্রেমে পড়ে চেহারা আর শরীর দেখে। মনের বিষয়টা অনেক পরে। বিশুদ্ধ প্রেম না হলে মন বোঝা যায় না।
আরে না না, জমি নিয়ে বিরোধ। ভাইয়ের হাতে ভাই খুন হয়েছে। যে ছেলেটা খুন হয়েছে সে হলো ছোট ভাই। বড় ভাই বিবাহিত কিন্তু ছোটভাই অবিবাহিত।
মনটা খারাপ হয়ে যায় মজিদের। ভাইয়ের হাতেই ভাই খুন! সমাজের এ অধঃপতন জাতি হিশেবে আমাদের কোথায় দাঁড় করাচ্ছে? কয়দিন পরেই জাতির শ্রেষ্ঠ অবকাঠামো পদ্মাসেতু চালু হয়ে যাবে। সত্তর শতাংশ কাজও শেষ। রুচিহীন একটি জাতি কি পদ্মাসেতুর মর্ম বুঝবে? বোঝার কথাও না। নিজেরাই গণ্ডগোল বাঁধাবে আর মরবে।
এই মুহুর্তে মজিদের অনেক কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিলো। রাত হলেই কথাগুলো মনে পড়ে। এত কথা মনে করতে গেলে ঘুমটা চলে যায়, সকালে অফিসে যাওয়াটা বিলম্বিত করা হয়। শান্ত রাতটা হাহাকার করে ওঠে। মজিদ তখন পত্রিকা অফিসে যুগ্ম সম্পাদক হিশেবে আছে। বড় ভাই চিকিৎসা নিতে ঢাকাতে আসলো অথচ সে সময় দিতে পারলো না। ঢাকা মেডিকেলে একটা সিরিয়াল অবশ্য করে দিতে পেরেছিল। অভিমানী ভাইটা আর ঢাকাতে আসেনি চিকিৎসার জন্য। মারা গেছে মাসখানেকের মাথায়। সত্যিই কি মারা গেছে? না কি মজিদের অবহেলায় খুন হয়েছে সে? ভাই মারা যাওয়ার পর তার জীবন তো থেমে নেই; কিন্তু সেই ছন্দটা কি আছে? ভাবী পুরোপুরি গৃহবন্দী, ভাইয়ের ছেলেটাও ব্যবসাটা গুটিয়ে ফেলেছে, বাড়ির পাশের পুকুরটাও কমদামে বিক্রি করেছে। ভাইয়ের ছেলেটার নামটা মনে পড়ছে না। এসএসসিতে প্লাস পেল। পড়াশোনা কি ও আর চালাচ্ছে? প্রতি মাসে মজিদ দশ হাজার টাকা পাঠায়, সে টাকায় হয়তো ওদের সংসার চলে না। ভাই গেলেন, যাওয়ার আগে কিছু বলে গেলেন না। না কি বলতে চেয়েও মজিদকে পায়নি? বড় ভাইয়ের কবরটা একবারই দেখেছিল মজিদ। কবরের পাশে একটা শিউলি গাছ। শরতের সকালে হয়তো কবরের ওপরে ঝরে পড়ে ফুল। সেই ফুল কেউ কুড়ায় কি না কে জানে!

বড় ভাই আপাদমস্তক সাংসারিক ছিলেন না। ব্যবসা নিয়েই ছুটে বেড়াতেন। ব্যবসাটা পারিবারিক। ব্যবসা সামলিয়ে সবাইকে নিয়ে ভাবতে পারতেন না। তার কাজ ছিল উপার্জন করা। সংসারের হাল ধরেছিলেন ভাবী। মায়ের মতো স্নেহ করত মজিদকে। বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিতেন পরিবারের সদস্যদের। ভাবী খুব একটা কথা কোনকালেই বলেননি। তবে তখনকার না বলাতেও প্রাণ ছিল। এখনও বলেন না, তবে সেখানে জীবন কই? তিনি কি মজিদকে ঘৃণা করেন? এসব ভাবতে গেলেই যত তালগোল পাকিয়ে যায়। তারচেয়ে শাকুরের সাথে কলটা শেষ করা যাক।
শোন শাকুর, সহজ কেস। অনেক জমি জায়গা থাকলে এরকমই হয়। একের ভাগ অন্যকে দেবে কেন? জমিটা কোথায়? আশুলিয়ায় নাকি বনানীতে?
জমি পুরান ঢাকায়..
আগেই জানতাম,পুরান ঢাকার মানুষ ছাড়া এ ধরনের হীনকাজ কেউ করতে পারেনা। ওরা একটু লোভী প্রকৃতির হয়। আমাদের অফিসের শফিক ভাইয়ের কথাই চিন্তা করেন। কি সাংঘাতিক লোভী! পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক অথচ আতিক সরওয়ার ভাই যেইদিন এখান থেকে চাকুরি ছেড়ে দিলেন ওইদিনই তিনি প্রত্রিকার সম্পাদক হওয়ার জন্য কি তদবিরই না করলেন। অথচ সহকারি সম্পাদক হিশেবে আমার নামটাই আসার কথা ছিলো। বলে কিনা মজিদের কোন যোগ্যতা নেই। শেষমেষ অনেক কাঠখড়ি পুড়িয়ে সম্পাদক হতে হয়েছে। যোগ্যতা থাকলে তুমি সেই জায়গায় যাবেই। কারো ঠেকানোর সাধ্যি আছে! তা যাই বলো, খুনের পেছনে কারণ একটা থাকবেই। সেটা হতে পারে মনস্তাত্ত্বিক অথবা অর্থনৈতিক!
একদম প্রথম পৃষ্ঠায় নিউজ করা যায় না? মনে করেন, একটু রসিয়ে লিখে দিলাম। ক্রাইম রিপোর্টে এইসব খাচ্ছে সবাই। ফলোআপ নিউজে রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে দিলাম। পাব্লিক সিম্প্যাথি মারাত্মক জিনিস।
আচ্ছা, বলো কিভাবে কি ঘটলো?সব বলো।ডেডবডি…
মর্গে আছে।
মর্গে? কেউ নিতে আসেনি? লাশকাটা হিমঘরে তরতাজা প্রাণহীন দেহ। যে ভাইয়ের আদরে মানুষ সে ভাই খুন করলো! হতে পারে পেশাদার খুনি দিয়ে খুন করিয়েছে। অর্থসম্পদের কাছে এসব তুচ্ছ। কোন মামলা হয়েছে?
না, ভাই। পুলিশ বলেছে তারা অভিযোগ পেয়েছে। আত্মীয় স্বজনের ধারণা বড়ভাই খুনটা করে থাকতে পারে।
আসলে ব্যাপার কি জানো, আমাদেরকে আগে ভালো মানুষ হতে হবে। নাহলে জীবনটা শূণ্য থেকে যায়। জীবনের সব কথা তো আর লেখা যায় না। মনে কর তোমার সামনেই একটি রোমহর্ষক ঘটনা ঘটল কিন্তু তুমি ভালো বর্ণনা দিতে পারলে না। আর একজন খুব সাধারণ বিষয়কেই ভয়ঙ্করভাবে উপস্থাপন করল। একারণে কি লিখছি, কেন লিখছি এটা জানা জরুরি।
ভাই একটি বিষয়ে খুবই অবাক হয়েছে সবাই৷ ভিকটিমের গায়ে কোন দাগ পাওয়া যায়নি।
কি সাংঘাতিক! নিশ্চয় মালদার পার্টি। টাকা দিয়ে সব দমিয়ে রাখার চেষ্টা। টাকাই কি সব? টাকা আর ক্ষমতা অনেকেরই আছে কিন্তু পাপ বাপকেও ছাড়ে না। শোন অনলাইন সংস্করণে বিশাল বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করবে। এদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। পলিটিক্যাল ব্যাপার থাকতে পারে। দেশের রাজনীতিটাই খারাপ। রাজনীতি থেকে শ্রদ্ধাবোধটুকু উধাও হয়ে গেছে। নিশ্চিত বড়ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছিলো তাই কৌশলে সরিয়ে দিয়েছে।
নাহ, পলিটিক্যাল ব্যাপার বলে তো মনে হয়না…
তুমি পলিটিক্সের কী বুঝ? বাপ ছেলেকে সরিয়ে দিচ্ছে, আর এটা তো মামুলি ব্যাপার।
পারিবারিক ঝামেলা…
পরকীয়া কেস নাকি তাহলে? আগেই এরকম সন্দেহ ছিল। দেবর-ভাবি রসায়ন জমবে ভালো। পাঠক খাবে মনে হচ্ছে। সম্পর্কটা যতই দূরের হোক। দুষ্টুমির ভাবটা তো থাকেই। সেখান থেকেই এসব ভুলভাল চিন্তা ভাবনা আসে। ছেলেটাকেও ধোয়া তুলসীপাতা ভাবার দরকার নেই। ইয়াং ব্লাড। এসব বিষয়ে ভাবি এগিয়ে না আসলে ছেলেদের অতটা সাহস হয় না।
ভাবনাটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?
ছেলেটাকে তো আর বিনা কাজে মেরে ফেলা হয়নি। সেই রকম একটা নিউজ করতে হবে। বড়ভাই করেটা কি? শিল্পপতি কিংবা রাজনৈতিক কেউ হলে হাতে ছাই দিয়ে ধরতে হবে। এদের ফসকে যাওয়ার প্রবণতা অনেক। গরিবের জন্য যত বিচার, বড়লোক হলে টাকা দিয়ে বিচার ব্যবস্থাটাই কেনা যায়।
বড় ভাই গুলিস্তানে জুতা সেলাই করে। দুই শতক জমি নিয়ে...
তোমাদের তরুণ প্রজন্মের এই একটি জায়গায় সমস্যা; ঘটনা এক লাইনে বলতে পারো না। পত্রিকা ডুবিয়ে দিচ্ছো তোমরা। এই নিউজ কি ফ্রন্ট পেজে দিয়েছে?
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৯০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/০৮/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • আবু সাইদ লিপু ১৮/০৮/২০১৭
    আবার খুন?
    • একটা খুন! অথচ কতগুলো বার্তা দিয়ে যায়
  • মোনালিসা ১৮/০৮/২০১৭
    খব ভাল
 
Quantcast