www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মিথ্যার অভিনয়ে বাস্তবতার বিকৃতি

মিথ্যার অভিনয়ে বাস্তবতার বিকৃতি

টকশো বর্তমান সমাজব্যবস্থার একটি বহুল প্রচলিত বিনোদন মাধ্যম, যা একাধারে তথ্য প্রদান, মতামত প্রকাশ এবং বিতর্কের মঞ্চ হলেও, এর পেছনে কাজ করে একধরনের সূক্ষ্ম অভিনয়। এই অভিনয় কখনো ব্যক্তির ভঙ্গিতে, কখনো কণ্ঠের সুরে, কখনো বা কথার গঠনে ফুটে ওঠে। কিন্তু এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপজ্জনক দিক হলো—এই অভিনয়ের প্রকৃত স্বরূপ সাধারণ মানুষের কাছে অস্পষ্ট।

সাধারণত টকশোতে যারা অংশগ্রহণ করেন, তারা নিজেদের বিশেষজ্ঞ, চিন্তাবিদ, অথবা সমাজ সচেতন ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাদের সুর, ভাষা এবং দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময় এমনভাবে সাজানো হয়, যা সরাসরি প্রভাব ফেলে দর্শকের মনে। এটি একধরনের নাটকীয়তা, যা সমাজে সত্য এবং মিথ্যার সীমারেখাকে অস্পষ্ট করে তোলে। টকশোর একটি বড় সমস্যা হলো, এই ভঙ্গিগত নাটকীয়তা ধীরে ধীরে সত্যের স্থান দখল করে নেয়। ফলে যে কথাগুলো সেখানে বলা হয়, তা সত্য হলেও বিকৃত, সংকুচিত এবং নির্দিষ্ট একদিক থেকে উপস্থাপিত।

অভিনয়ের সমাজতাত্ত্বিক প্রভাব

যেকোনো অভিনয়, যদি সেটি বাস্তবতার নামে পরিবেশিত হয়, তাহলে তা সমাজে একটি যান্ত্রিক এবং বিকৃত সম্পর্ক তৈরি করে। টকশোতেও তাই ঘটে। এখানে আলোচনার নামে একদল মানুষ তাদের বক্তব্যকে সত্যের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় শুধুমাত্র তাদের ভঙ্গি, সুর, এবং কণ্ঠের উপর নির্ভর করে। এতে সমাজে একটি ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়—যেনো সিরিয়াস আলোচনায় সবসময় এমন ভঙ্গি ও উপস্থাপনার প্রয়োজন।

এই ভঙ্গিমাটি সত্যের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কথার মর্মার্থ না বুঝে, দর্শকরা বক্তার ভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হয়। এর ফলে সত্য কথার ভেতরেও একধরনের অভিনীত মিথ্যা ঢুকে পড়ে। মানুষ তখন চিন্তার বদলে অনুভূতির মাধ্যমে বিষয়টি গ্রহণ করে, যা জ্ঞানচর্চার পরিবেশকে দূষিত করে তোলে।

টকশোর দর্শক ও বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব

এই সংকটকে অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণ দর্শকরা টকশোকে শিক্ষণীয় বা প্রভাবশালী মাধ্যম হিসেবে দেখে। তারা ধরে নেয়, এখানে বলা সবকিছুই হয়তো সত্য। এই সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে টকশোর আলোচকরা নিজেদের মতামতকে সমাজের ওপর চাপিয়ে দেয়। একদিকে বুদ্ধিজীবীরা এই নাটকীয়তা অনুধাবন করতে পারলেও, তারা এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না। বরং এটিকে স্বাভাবিক ভেবে মেনে নেয়। এই নির্লিপ্ততা শুধু সমস্যাটিকে বাড়িয়ে তোলে।

টকশোর সামাজিক মিথ্যাচারকে সাইজ করার উপায়

এই সমস্যার সমাধান সহজ নয়, তবে এটি অসম্ভবও নয়। টকশোর এই অভিনয়ধর্মী মিথ্যাচারকে প্রতিহত করতে হলে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে—

1. সমালোচনামূলক দর্শক তৈরি: সাধারণ মানুষকে টকশোতে বলা কথা নিয়ে সমালোচনামূলক চিন্তা করতে শেখাতে হবে। তারা যেনো বক্তার ভঙ্গি বা সুরের বদলে বক্তব্যের মূল কথাকে বিচার করতে পারে।


2. বিকল্প মাধ্যমের প্রসার: এমন আলোচনা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা প্রয়োজন, যেখানে ভঙ্গির বদলে যুক্তি ও তথ্যের মাধ্যমে কথা বলা হবে। এটি টকশোর নাটকীয়তার বিকল্প হতে পারে।


3. বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা: সমাজের বুদ্ধিজীবীদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং টকশোর মিথ্যাচার সম্পর্কে সোচ্চার হতে হবে। তারা যদি এই নাটকীয়তার বিরুদ্ধে কথা বলেন, তবে এটি সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।


4. গবেষণা ও সমালোচনা: টকশো নিয়ে গবেষণা এবং এর প্রভাব নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। এই মাধ্যমে সত্য এবং মিথ্যার বিকৃতি কিভাবে কাজ করে তা বিশ্লেষণ করে দেখানো উচিত।


5. টকশোর মান যাচাই: টকশোগুলোতে যেসব আলোচনা হয়, তার বিষয়বস্তু, তথ্যসূত্র এবং উপস্থাপনার ধরন নিয়মিত যাচাই করা প্রয়োজন। দর্শক এবং প্রচারমাধ্যমের উভয়েরই এ বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে।





টকশো সমাজে আলোচনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারতো, কিন্তু এটি নাটকীয়তা এবং ভঙ্গির মোড়কে মিথ্যার এক নতুন সংস্কৃতি তৈরি করেছে। এটি মানুষের চিন্তার জগৎকে সংকুচিত করে, সমাজকে যান্ত্রিক করে তোলে। একে সঠিক পথে আনতে হলে সমাজে চিন্তাশীল দর্শক এবং দায়িত্বশীল আলোচক তৈরি করতে হবে। সত্য, যুক্তি, এবং বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল একটি আলোচনা পরিবেশ গড়ে তোলাই এর সমাধান হতে পারে।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৪৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৯/০১/২০২৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast