একুশের গল্প অ আ ক খ
গল্পের শিরোনাম : অ আ ক খ
কলমে - কামরুজ্জামান সাদ
১.
১৯৫২ সাল।ফেব্রুয়ারি মাস।একুশ তারিখ।সেদিন খুব
ভোরে মজিদ ভাই বেরিয়ে গেলেন।কেউ টের পেয়েছে
কি জানি না তবে আমি জেগে ছিলাম সেই কারণে
মজিদ ভাইয়ের বেরিয়ে যাওয়া দেখতে পেলাম।নুরুল
আমীন সরকার সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনকে বানচাল
করার জন্য দীর্ঘ একমাসের ১৪৪ ধারা জারি করেছেন।
তার ভিতরে মজিদ ভাইয়ের এই বাইরে যাওয়াটা
বাড়াবাড়ি।কি দরকার বাপু এত সাহস দেখানোর।মজিদ
ভাইয়ের সাহস যে খুব একটা কার্যকর হবে সেটা বলা
যাচ্ছে না।এই গত মাসের কথাই ধরা যাক না-সাহস করে
নীতু আপাকে একটা চিঠি পর্যন্ত দিতে পারল না,অথচ
নীতু আপার সাথে দুই বছর তিন মাস চারদিনের প্রেম।
হিশেবটা মজিদ ভাইয়ের।মজিদ ভাই মানুষটাই এরকমের।
সাহস করে কিছুই তার করে ওঠা হয় না।সেই মজিদ ভাই
এতো ভোরে বেরিয়ে গেলেন সংগ্রাম পরিষদের
কর্মসূচীতে।ভাষার জন্য আলাদা একটা মায়া আছে
বলতে হয়।
আটচল্লিশে যখন ঝিনাইদহ মহকুমা থেকে ঢাকাতে এলাম
তখন থেকেই পরিচয় হয় মজিদ ভাইয়ের সাথে।মজার মানুষ।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকত।এক বিকেলে আমার
মেসে এসে বললেন,চলে এলাম।সেই থেকে আছেন।বুঝলি
বায়েজিদ,মেসটার তো নাম নেই।একটা নাম দেয়া যাক।
মজিদ ভাই বলেছেন আর সেটা আমি করিনি এরকম হয়না।
চারদিনে ভাবলাম প্রায় আঠারোটা নাম।মজিদ ভাইকে
নামগুলো তেলাওয়াত করে শুনালাম।মজিদ ভাই
বললেন,কি সব বকছেন জনাব মেহেদি হাসান বায়েজিদ!
আপনাকে এত ভাবতে হবে না,মেসের নাম ঠিক করে
ফেলেছি।আমি যথা সম্ভব মনক্ষুণ্ণ হলাম।মজিদ ভাইয়ের
উপর রাগ হতে লাগল।এমন মূহুর্তে মজিদ ভাই বললেন,
মেসের নাম "অ আ ক খ" মেস।বড়ই সুন্দর নাম।আমার মনটা
ভাল হয়ে গেল।
কর্মসূচী বানচাল করার জন্য ১৪৪ ধারা জারির কারণে
ছাত্ররা ক্ষোভ দেখাতে শুরু করল।মিছিল,মিটিং
,শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ।মজিদ ভাই সলিমুল্লাহ মুসলিম
হলের ছাত্রদের জরুরি বৈঠকে সমবেত হয়েছেন এবং ১৪৪
ধারা ভঙ্গের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তিনি
সেখানেও আছেন।সবমিলিয়ে পরিস্থিতি গুমোট হচ্ছে।
মজিদ ভাইয়ের এই সাহসী পদক্ষেপের কথা জানতে
পারলাম নীতু আপার কাছে।নীতু আপা কার কাছ থেকে
যেন শুনেছেন এই ঘটনা।তিনি কান্না করে চোখ ফুলিয়ে
ফেলেছেন।সুন্দরী মেয়েদের কান্না দেখতে ভাল
লাগলেও নীতু আপাকে ঠিক মানাচ্ছে না।এক সকালেই
নীতু আপার বয়স বেড়ে গেছে অনেকখানি।
২.
দশজনের একটি মিছিল বের করে ছাত্ররা।পুলিশ
আন্দোলন প্রতিহত করার নামে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ
করল এবং ছাত্রদের লাঠিচার্জ করল।কিন্তু ছাত্রদের এই
ক্ষোভ কি আর এসবে দমে!পুলিশ মিছিলে গুলি
চালিয়েছে।সেখানে নিহত হয়েছে অনেকেই।তবে মেস
থেকে যেহেতু বের হতে পারছি না তাই সঠিক খবর পাওয়া
সম্ভব হচ্ছে না।ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মোটামুটি পুলিশে
ছেয়ে গেছে।ভয়টা তাই বেড়েছে শতগুণ।নীতু আপা
আমাদের মেস থেকে চলে গেলেন বিকাল পাঁচটায়।
ফাল্গুনের এই সময়টাতে কোকিল ডাকে তবে আজ
ব্যতিক্রম।কোকিলের পরিবর্তে কাক ডাকছে,কা কা।
কাকের ডাক খুব একটা ভাল লক্ষণ নয়।মেসের সবচেয়ে
বয়স্ক বর্ডার জয়নাল আবেদীন চিন্তামুক্ত মানুষ,তাকেও
আজ চিন্তিত দেখা গেল।তিনি বললেন,বায়েজিদ শহর
তো ফাঁকা হয়ে গেল।শুনলাম নিহত ছাত্রদের ট্রাকে করে
ফেলা হচ্ছে।কি সাংঘাতিক!কত মানুষ মরলে ট্রাকে
করে ফেলা হয় বলতে পারবা?আমি চুপ করে রইলাম।
মজিদ ভাই সন্ধ্যা পর্যন্ত ফিরলেন না।ফিরবেন কি না
বলা যাচ্ছে না।আমার জ্বর জ্বর ভাল হচ্ছে।দু'বার বমি
হয়েছে।আমার বমি হওয়াতে ঘুম আসছে।ইদ্রাকপুরে
গ্রামের বাড়িতে থাকার সময় খেজুরের গুড় বেশি খেয়ে
একবার বমি এসেছিল।আব্বা জবা ডাক্তারের কাছ
থেকে ঔষুধ এনেছিল সেটা খেয়ে আর হয়নি।সেটাও সাত-
আট বছর আগের কথা।আজকের বমিটা আতঙ্কের,বমি আর
না হলেও আতঙ্কটা যে কাটবে না সেটা বুঝা যাচ্ছে।
রাতে চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখলাম।একদল হাঁস পানিতে
ভেসে বেড়াচ্ছে।হাঁসগুলো প্যাক প্যাক করছে।নীতু আপা
পানিতে ঢিল ছুড়ে মারছেন।হাঁসগুলোর ব্যাঘাত ঘটছে।
মজিদ ভাই বললেন,কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা
উচিত হচ্ছে না নী।মজিদ ভাই নীতু আপাকে নী বলেই
ডাকেন।নীতু আপা ঢিল ছুড়া বন্ধ করলেন এবং সাথে
সাথেই হাঁসগুলো প্যাক প্যাক করা বন্ধ করে বলতে থাকল,
"অ আ ক খ"।আমি নীতু আপা এবং মজিদ ভাইকে দেখলাম,
তারা এতে অবাক হচ্ছেন না।অথচ নীতু আপার অবাক
হওয়ার কথা ছিল।নীতু আপা অল্পতেই অবাক হয়ে যান।
স্বপ্নটা বাস্তব মনে হচ্ছে।
৩.
১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে নিহত
হন।এই লোকটার প্রতি মজিদ ভাইয়ের রাগ ছিল।লিয়াকত
আলী মারা যাওয়াতে মজিদ ভাই বুনো উদ্যাপন করলেন।
মেসের বিশজন বর্ডারকেই তিনি মিষ্টিমুখ করালেন।তাঁর
মৃত্যুর পর খাজা নাজিম উদ্দীন পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী হন।এইক্ষেত্রে মজিদ ভাইয়ের বক্তব্য হল
তাঁর নিযুক্তি বেআইনি ও অগণতান্ত্রিক।খাজা নাজিম
উদ্দীন ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি কায়েদে আজমের
অনুকরণে ঢাকার এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে,"উর্দুই
হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা"এই ঘোষণাতে
সারাদেশে জনগণের প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে।ফলে
আন্দোলন চরম আকার ধারণ করতে লাগল।মজিদ ভাইয়ের
পরিবর্তনটা মূলত সেখান থেকেই।আমরা পেলাম এক
সাহসী মজিদ ভাইকে।সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম
পরিষদে যোগ দিলেন।তখন এর সদস্য ছিলেন জনাব আবুল
হাসিম,জনাব আতাউর রহমান খান,জনাব কামরুদ্দীন আহমদ
প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।
ভাষা আন্দোলনে সমর্থন করার জন্য ভাসানী,মুজাফফর,
মুনীর চৌধুরিসহ অনেকেই গ্রেপ্তার হলেন।একুশ
তারিখের দুপুরের অক্তে বরকত,সালাম,জব্বার নিহত
হয়েছে।নীতু আপা জেলে খোঁজ নিয়েছেন সেখানে
মজিদ ভাইকে পাওয়া যায়নি।এই কয়দিনেই নিতু আপার
শরীর ভেঙে গেছে।নাদুস-নুদুস চেহারার নীতু আপাকে
অদ্ভুত লাগছে।মজিদ ভাইকে নিয়ে শঙ্কাটা বেড়ে
গেছে।নীতু আপা কান্নাকাটি করছেন তাতে খুব একটা
লাভ হচ্ছে না।নীতু আপার চাচা হাশেম আলি করাচীতে
থাকেন,তিনিও কম তদবির করেন নি।একটা মানুষ এভাবে
লাপাত্তা হয়ে যাবে এটা অকল্পনীয়।এক হপ্তা মজিদ
ভাই আমাদের সাথে নেই।এখন আমি বসে আছি নীতু
আপার সামনে।নীতু আপার হাতে একটা কমদামি খাম।
নিতু আপা বললেন, বায়েজিদ এই খামে কিছু টাকা আছে
এগুলো মজিদের বাসায় পাঠাতে হবে।আমি চাচ্ছি
টাকাটা তুমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসবে।পারবে তো?
আমি বললাম, পারব।
আপা বললেন, ওর বাসা পটুয়াখালীর দুমকিতে।স্থলপথে
যেতে পারবে না,নদীপথে যেতে হবে।
আমি বললাম, নীতু আপা আমি জানি।আমি যাব।টাকাটা
আমি পৌঁছিয়ে দেব।আমার সাথে যাবে মাহফুজ।মাহফুজুর
রহমান লিমন।
এত খারাপ সময়েও নীতু আপা হাসলেন।এই হাসিটা সুখের
নয়,কোন দায়িত্ব থেকে নির্ভার হওয়ার হাসি।ঢাকা
শহরের শত নীতু আপা এই হাসিটা হাসেন।আর রাত জেগে
চোখের জলে বালিশ ভিজাতে থাকেন মজিদ ভাইদের
জন্য।আর দীর্ঘশ্বাসগুলো জমাট বাঁধে প্রতিনিয়ত।
৪.
আমি আর লিমন দুমকি থেকে ফিরে এলাম আটদিন পর।
ভাষা আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে,তখন পরিষদের
অধিবেশনেও চরম বাকবিতণ্ডা দেখা দেয়।এসময়
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিম
উদ্দীন এবং নুরুল আমীন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের
মুখ্যমন্ত্রী।মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে
সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন আইন পরিষদে তাঁর
সদস্যপদ ত্যাগ করেন।দেশের সর্বত্র সরকারের ঘৃণ্য
প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ধিক্কার ধ্বনি উত্থিত হয়।সে সাথে
বাঙালিদের দাবি আদায়ের সংগ্রাম আরও দুর্বার
গতিতে এগিয়ে যায়।একুশে ফেব্রুয়ারি পরবর্তি
মিছিলগুলোতে আমরা যোগ দিতে শুরু করলাম।আলীপুরের
ছেলে আশানুর,আমাদের ঝিনেদার তরিকুল,সোহেল আর
নারায়ণগঞ্জের ছেলেরা মিছিলে যোগ দিত।একুশে
ফেব্রুয়ারিতে বাংলার দেওয়ালে দেওয়ালে,পথঘাট
প্রান্তরে যে রক্ত শপথের বীজ ছড়িয়ে পড়ে তার কাছে
সরকারকে নতি স্বীকার করতে হয়।এপ্রিলের দিকে
প্রাদেশিক পরিষদে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন বাংলা
ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করেন।বাংলা
ভাষা উর্দু ভাষার পাশে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা
লাভ করে।আজকাল নীতু আপার কথাবার্তা কমে গেছে।
একদম কথা না বলতে পারলেই বেঁচে যান টাইপ।অথচ এই
মানুষটিই কত চঞ্চল ছিল,সারাদিন মাতিয়ে রাখত
আমাদের।মজিদ ভাইয়ের জন্য কিছু তৈরি করে আনলেই
ইনিয়ে বিনিয়ে কত কথাই বলতেন।অনেক বড় রকমের
আঘাত তিনি পেয়েছেন।কিছু জিজ্ঞাসা করেও উত্তর
পাওয়া যায় না।যেন শুনতেই পাননি,পাশ কেটে বেরিয়ে
যান।তাতে ভাবান্তর খুঁজে পাওয়া যায় না।সব ইচ্ছে
টিচ্ছে মরে যাচ্ছে।এভাবে চলতে থাকলে বড় কোন
ব্যামো যে শরীরে আঘাত হানবে সেটা বুঝা যাচ্ছে।
চোখের নিচে কালি পড়েছে।মজিদ ভাইকে হারিয়ে নীতু
আপা অসহায় হয়ে পড়েছেন।কত স্বপ্নই না দেখত! জীবনের
মাঝপথে এ ধরনের বিচ্যুতি কেউই মেনে নিতে পারে না।
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে ভাষা আমরা পেয়েছি
সেটা কেউ কেঁড়ে নিতে পারবে না।অথচ এই
জিনিসটাতেও নীতু আপা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।জুন
মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নীতু আপাকে আর দেখা গেল
না।আমি,লিমন,তরিকুল,আশানুর,সোহেল অনেক খোঁজার
পরও নীতু আপার কোন হদিস পেলাম না।নীতু আপাকে
হারিয়ে আমরা নিরাশায় আচ্ছন্ন হলাম।নীতু আপা এবং
মজিদ ভাই কেউই আমাদের কাছে নেই,হয়ত হারিয়ে গেল
সময়ের অতলে অথবা কখনো খুঁজে পেতে পারি আমাদের
অনিশ্চয়তার শহরে।
৫.
মজিদ ভাইকে ফিরে পাব এটা কল্পনীয় ছিল না।
বাহান্নোর আগস্টে মজিদ ভাই ফিরে এলেন।স্নিগ্ধ
উজ্জ্বল চেহারার মজিদ ভাইকে আমরা আমরা আবিষ্কার
করলাম মুখভর্তি চাপ দাড়িতে।১৯৪১ সাল যখন
জামায়াতে ইসলামী হিন্দ আত্মপ্রকাশ করল তখন তাদের
নেতাদের মুখে এই ধরনের দাড়ি ছিল।এই অবস্থা দেখলে
অন্যসময় হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতাম,আজকে ভিন্ন।
মজিদ ভাইকে দেখে কোনভাবেই কান্না আটকাতে
পারছিলাম না।এই মানুষটি আমাদের মাঝে এতগুলো দিন
নেই।বাম হাতটা অপেক্ষাকৃত চিকন হয়ে গেছে।মজিদ
ভাই এসেই বললেন,বায়েজিদ এক গ্লাস জল দে তো!মজিদ
ভাই পানিকে জল বলছেন এটা অবাক লাগল।আমি পানি
এনে দিলাম।পানি খেয়ে বললেন,নীতু আছে ত্রিপুরার
ধর্মনগরে।ভাল আছে।শুয়োরের বাচ্চারা আমার হাতে
গুলি করেছিল।কিছুই করতে পারেনি।আমার ভাষা আমি
ফিরে পেয়েছি।
জয়নাল ভাই দ্বীনদার মানুষ।তিনি মজিদ ভাইয়ের ফিরে
আসার আগ পর্যন্ত রাতে নফল ইবাদত করতেন।মসজিদে
একদিন মিলাদ দিয়েছেন পর্যন্ত।মজিদ ভাইয়ের ফিরে
আসাতে তিনি খুব একটা অবাক হলেন না।যেন অবাক
হওয়াটা মানা।যেন মজিদ ভাইয়ের ফিরে আসাটা তিনি
জানতেন।
মজিদ ভাইয়ের প্রায় নষ্ট হওয়া বামহাত নিয়ে তাকে
চিন্তিত মনে হচ্ছে না।বরং মাতৃভাষায় অবাধে কথা
বলার আনন্দ তার চোখেমুখে উজ্জ্বলভাবে দেখা
দিয়েছে।তবে এতদিন কোথায় ছিলেন,কীভাবে ছিলেন
এগুলো বলছেন না।এই প্রশ্ন করলেও তার চেহারাতে
ভেসে উঠছে অজানা কোন আতঙ্ক।যে আতঙ্ক তাড়িয়ে
বেড়াচ্ছে তাকে,তার বিবেককে।মজিদ ভাই ফেরার
তিনদিন পরেই হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হলেন।সন্ধ্যা থেকেই
জ্বর ছিল।শেষরাতের দিকে জ্বরটা মারাত্মক রকমের
বেড়ে গেল।তিনি বিড়বিড় করতে থাকলেন-"নীতু খুব ভাল
মেয়ে।নীতু খুব ভাল মেয়ে।শুয়োরের বাচ্চারা আবার
আসবে।"
জয়নাল ভাই বললেন,বায়েজিদ অবস্থা তত ভাল ঠেকছে
না।
আমি বললাম,কি করা যায়?
'আপাতত পানি দিতে থাক মাথায়।আমি ডাক্তার পাই
কিনা দেখি।'এই কথা বলে জয়নাল ভাই চলে গেলেন।
জয়নাল ভাই যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মজিদ ভাই
মারা গেলেন।মারা যাওয়ার আগে তিনি বললেন,অ আ ক
খ।
ভাষার প্রতি এই মজিদ ভাইয়ের অসম্ভব রকমের মমত্ববোধ
ছিল।শাসকচক্রের শোষণ তিনি মেতে নিতে পারেননি।
মজিদভাই চলে গেলেন রেখে গেলেন ভাষা।বাঙলা
ভাষা।এই ভাষা আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত
করে,জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটায়।
কলমে - কামরুজ্জামান সাদ
১.
১৯৫২ সাল।ফেব্রুয়ারি মাস।একুশ তারিখ।সেদিন খুব
ভোরে মজিদ ভাই বেরিয়ে গেলেন।কেউ টের পেয়েছে
কি জানি না তবে আমি জেগে ছিলাম সেই কারণে
মজিদ ভাইয়ের বেরিয়ে যাওয়া দেখতে পেলাম।নুরুল
আমীন সরকার সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনকে বানচাল
করার জন্য দীর্ঘ একমাসের ১৪৪ ধারা জারি করেছেন।
তার ভিতরে মজিদ ভাইয়ের এই বাইরে যাওয়াটা
বাড়াবাড়ি।কি দরকার বাপু এত সাহস দেখানোর।মজিদ
ভাইয়ের সাহস যে খুব একটা কার্যকর হবে সেটা বলা
যাচ্ছে না।এই গত মাসের কথাই ধরা যাক না-সাহস করে
নীতু আপাকে একটা চিঠি পর্যন্ত দিতে পারল না,অথচ
নীতু আপার সাথে দুই বছর তিন মাস চারদিনের প্রেম।
হিশেবটা মজিদ ভাইয়ের।মজিদ ভাই মানুষটাই এরকমের।
সাহস করে কিছুই তার করে ওঠা হয় না।সেই মজিদ ভাই
এতো ভোরে বেরিয়ে গেলেন সংগ্রাম পরিষদের
কর্মসূচীতে।ভাষার জন্য আলাদা একটা মায়া আছে
বলতে হয়।
আটচল্লিশে যখন ঝিনাইদহ মহকুমা থেকে ঢাকাতে এলাম
তখন থেকেই পরিচয় হয় মজিদ ভাইয়ের সাথে।মজার মানুষ।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকত।এক বিকেলে আমার
মেসে এসে বললেন,চলে এলাম।সেই থেকে আছেন।বুঝলি
বায়েজিদ,মেসটার তো নাম নেই।একটা নাম দেয়া যাক।
মজিদ ভাই বলেছেন আর সেটা আমি করিনি এরকম হয়না।
চারদিনে ভাবলাম প্রায় আঠারোটা নাম।মজিদ ভাইকে
নামগুলো তেলাওয়াত করে শুনালাম।মজিদ ভাই
বললেন,কি সব বকছেন জনাব মেহেদি হাসান বায়েজিদ!
আপনাকে এত ভাবতে হবে না,মেসের নাম ঠিক করে
ফেলেছি।আমি যথা সম্ভব মনক্ষুণ্ণ হলাম।মজিদ ভাইয়ের
উপর রাগ হতে লাগল।এমন মূহুর্তে মজিদ ভাই বললেন,
মেসের নাম "অ আ ক খ" মেস।বড়ই সুন্দর নাম।আমার মনটা
ভাল হয়ে গেল।
কর্মসূচী বানচাল করার জন্য ১৪৪ ধারা জারির কারণে
ছাত্ররা ক্ষোভ দেখাতে শুরু করল।মিছিল,মিটিং
,শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ।মজিদ ভাই সলিমুল্লাহ মুসলিম
হলের ছাত্রদের জরুরি বৈঠকে সমবেত হয়েছেন এবং ১৪৪
ধারা ভঙ্গের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তিনি
সেখানেও আছেন।সবমিলিয়ে পরিস্থিতি গুমোট হচ্ছে।
মজিদ ভাইয়ের এই সাহসী পদক্ষেপের কথা জানতে
পারলাম নীতু আপার কাছে।নীতু আপা কার কাছ থেকে
যেন শুনেছেন এই ঘটনা।তিনি কান্না করে চোখ ফুলিয়ে
ফেলেছেন।সুন্দরী মেয়েদের কান্না দেখতে ভাল
লাগলেও নীতু আপাকে ঠিক মানাচ্ছে না।এক সকালেই
নীতু আপার বয়স বেড়ে গেছে অনেকখানি।
২.
দশজনের একটি মিছিল বের করে ছাত্ররা।পুলিশ
আন্দোলন প্রতিহত করার নামে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ
করল এবং ছাত্রদের লাঠিচার্জ করল।কিন্তু ছাত্রদের এই
ক্ষোভ কি আর এসবে দমে!পুলিশ মিছিলে গুলি
চালিয়েছে।সেখানে নিহত হয়েছে অনেকেই।তবে মেস
থেকে যেহেতু বের হতে পারছি না তাই সঠিক খবর পাওয়া
সম্ভব হচ্ছে না।ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মোটামুটি পুলিশে
ছেয়ে গেছে।ভয়টা তাই বেড়েছে শতগুণ।নীতু আপা
আমাদের মেস থেকে চলে গেলেন বিকাল পাঁচটায়।
ফাল্গুনের এই সময়টাতে কোকিল ডাকে তবে আজ
ব্যতিক্রম।কোকিলের পরিবর্তে কাক ডাকছে,কা কা।
কাকের ডাক খুব একটা ভাল লক্ষণ নয়।মেসের সবচেয়ে
বয়স্ক বর্ডার জয়নাল আবেদীন চিন্তামুক্ত মানুষ,তাকেও
আজ চিন্তিত দেখা গেল।তিনি বললেন,বায়েজিদ শহর
তো ফাঁকা হয়ে গেল।শুনলাম নিহত ছাত্রদের ট্রাকে করে
ফেলা হচ্ছে।কি সাংঘাতিক!কত মানুষ মরলে ট্রাকে
করে ফেলা হয় বলতে পারবা?আমি চুপ করে রইলাম।
মজিদ ভাই সন্ধ্যা পর্যন্ত ফিরলেন না।ফিরবেন কি না
বলা যাচ্ছে না।আমার জ্বর জ্বর ভাল হচ্ছে।দু'বার বমি
হয়েছে।আমার বমি হওয়াতে ঘুম আসছে।ইদ্রাকপুরে
গ্রামের বাড়িতে থাকার সময় খেজুরের গুড় বেশি খেয়ে
একবার বমি এসেছিল।আব্বা জবা ডাক্তারের কাছ
থেকে ঔষুধ এনেছিল সেটা খেয়ে আর হয়নি।সেটাও সাত-
আট বছর আগের কথা।আজকের বমিটা আতঙ্কের,বমি আর
না হলেও আতঙ্কটা যে কাটবে না সেটা বুঝা যাচ্ছে।
রাতে চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখলাম।একদল হাঁস পানিতে
ভেসে বেড়াচ্ছে।হাঁসগুলো প্যাক প্যাক করছে।নীতু আপা
পানিতে ঢিল ছুড়ে মারছেন।হাঁসগুলোর ব্যাঘাত ঘটছে।
মজিদ ভাই বললেন,কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা
উচিত হচ্ছে না নী।মজিদ ভাই নীতু আপাকে নী বলেই
ডাকেন।নীতু আপা ঢিল ছুড়া বন্ধ করলেন এবং সাথে
সাথেই হাঁসগুলো প্যাক প্যাক করা বন্ধ করে বলতে থাকল,
"অ আ ক খ"।আমি নীতু আপা এবং মজিদ ভাইকে দেখলাম,
তারা এতে অবাক হচ্ছেন না।অথচ নীতু আপার অবাক
হওয়ার কথা ছিল।নীতু আপা অল্পতেই অবাক হয়ে যান।
স্বপ্নটা বাস্তব মনে হচ্ছে।
৩.
১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে নিহত
হন।এই লোকটার প্রতি মজিদ ভাইয়ের রাগ ছিল।লিয়াকত
আলী মারা যাওয়াতে মজিদ ভাই বুনো উদ্যাপন করলেন।
মেসের বিশজন বর্ডারকেই তিনি মিষ্টিমুখ করালেন।তাঁর
মৃত্যুর পর খাজা নাজিম উদ্দীন পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী হন।এইক্ষেত্রে মজিদ ভাইয়ের বক্তব্য হল
তাঁর নিযুক্তি বেআইনি ও অগণতান্ত্রিক।খাজা নাজিম
উদ্দীন ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি কায়েদে আজমের
অনুকরণে ঢাকার এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে,"উর্দুই
হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা"এই ঘোষণাতে
সারাদেশে জনগণের প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে।ফলে
আন্দোলন চরম আকার ধারণ করতে লাগল।মজিদ ভাইয়ের
পরিবর্তনটা মূলত সেখান থেকেই।আমরা পেলাম এক
সাহসী মজিদ ভাইকে।সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম
পরিষদে যোগ দিলেন।তখন এর সদস্য ছিলেন জনাব আবুল
হাসিম,জনাব আতাউর রহমান খান,জনাব কামরুদ্দীন আহমদ
প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।
ভাষা আন্দোলনে সমর্থন করার জন্য ভাসানী,মুজাফফর,
মুনীর চৌধুরিসহ অনেকেই গ্রেপ্তার হলেন।একুশ
তারিখের দুপুরের অক্তে বরকত,সালাম,জব্বার নিহত
হয়েছে।নীতু আপা জেলে খোঁজ নিয়েছেন সেখানে
মজিদ ভাইকে পাওয়া যায়নি।এই কয়দিনেই নিতু আপার
শরীর ভেঙে গেছে।নাদুস-নুদুস চেহারার নীতু আপাকে
অদ্ভুত লাগছে।মজিদ ভাইকে নিয়ে শঙ্কাটা বেড়ে
গেছে।নীতু আপা কান্নাকাটি করছেন তাতে খুব একটা
লাভ হচ্ছে না।নীতু আপার চাচা হাশেম আলি করাচীতে
থাকেন,তিনিও কম তদবির করেন নি।একটা মানুষ এভাবে
লাপাত্তা হয়ে যাবে এটা অকল্পনীয়।এক হপ্তা মজিদ
ভাই আমাদের সাথে নেই।এখন আমি বসে আছি নীতু
আপার সামনে।নীতু আপার হাতে একটা কমদামি খাম।
নিতু আপা বললেন, বায়েজিদ এই খামে কিছু টাকা আছে
এগুলো মজিদের বাসায় পাঠাতে হবে।আমি চাচ্ছি
টাকাটা তুমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসবে।পারবে তো?
আমি বললাম, পারব।
আপা বললেন, ওর বাসা পটুয়াখালীর দুমকিতে।স্থলপথে
যেতে পারবে না,নদীপথে যেতে হবে।
আমি বললাম, নীতু আপা আমি জানি।আমি যাব।টাকাটা
আমি পৌঁছিয়ে দেব।আমার সাথে যাবে মাহফুজ।মাহফুজুর
রহমান লিমন।
এত খারাপ সময়েও নীতু আপা হাসলেন।এই হাসিটা সুখের
নয়,কোন দায়িত্ব থেকে নির্ভার হওয়ার হাসি।ঢাকা
শহরের শত নীতু আপা এই হাসিটা হাসেন।আর রাত জেগে
চোখের জলে বালিশ ভিজাতে থাকেন মজিদ ভাইদের
জন্য।আর দীর্ঘশ্বাসগুলো জমাট বাঁধে প্রতিনিয়ত।
৪.
আমি আর লিমন দুমকি থেকে ফিরে এলাম আটদিন পর।
ভাষা আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে,তখন পরিষদের
অধিবেশনেও চরম বাকবিতণ্ডা দেখা দেয়।এসময়
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিম
উদ্দীন এবং নুরুল আমীন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের
মুখ্যমন্ত্রী।মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে
সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন আইন পরিষদে তাঁর
সদস্যপদ ত্যাগ করেন।দেশের সর্বত্র সরকারের ঘৃণ্য
প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ধিক্কার ধ্বনি উত্থিত হয়।সে সাথে
বাঙালিদের দাবি আদায়ের সংগ্রাম আরও দুর্বার
গতিতে এগিয়ে যায়।একুশে ফেব্রুয়ারি পরবর্তি
মিছিলগুলোতে আমরা যোগ দিতে শুরু করলাম।আলীপুরের
ছেলে আশানুর,আমাদের ঝিনেদার তরিকুল,সোহেল আর
নারায়ণগঞ্জের ছেলেরা মিছিলে যোগ দিত।একুশে
ফেব্রুয়ারিতে বাংলার দেওয়ালে দেওয়ালে,পথঘাট
প্রান্তরে যে রক্ত শপথের বীজ ছড়িয়ে পড়ে তার কাছে
সরকারকে নতি স্বীকার করতে হয়।এপ্রিলের দিকে
প্রাদেশিক পরিষদে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন বাংলা
ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করেন।বাংলা
ভাষা উর্দু ভাষার পাশে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা
লাভ করে।আজকাল নীতু আপার কথাবার্তা কমে গেছে।
একদম কথা না বলতে পারলেই বেঁচে যান টাইপ।অথচ এই
মানুষটিই কত চঞ্চল ছিল,সারাদিন মাতিয়ে রাখত
আমাদের।মজিদ ভাইয়ের জন্য কিছু তৈরি করে আনলেই
ইনিয়ে বিনিয়ে কত কথাই বলতেন।অনেক বড় রকমের
আঘাত তিনি পেয়েছেন।কিছু জিজ্ঞাসা করেও উত্তর
পাওয়া যায় না।যেন শুনতেই পাননি,পাশ কেটে বেরিয়ে
যান।তাতে ভাবান্তর খুঁজে পাওয়া যায় না।সব ইচ্ছে
টিচ্ছে মরে যাচ্ছে।এভাবে চলতে থাকলে বড় কোন
ব্যামো যে শরীরে আঘাত হানবে সেটা বুঝা যাচ্ছে।
চোখের নিচে কালি পড়েছে।মজিদ ভাইকে হারিয়ে নীতু
আপা অসহায় হয়ে পড়েছেন।কত স্বপ্নই না দেখত! জীবনের
মাঝপথে এ ধরনের বিচ্যুতি কেউই মেনে নিতে পারে না।
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে ভাষা আমরা পেয়েছি
সেটা কেউ কেঁড়ে নিতে পারবে না।অথচ এই
জিনিসটাতেও নীতু আপা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।জুন
মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নীতু আপাকে আর দেখা গেল
না।আমি,লিমন,তরিকুল,আশানুর,সোহেল অনেক খোঁজার
পরও নীতু আপার কোন হদিস পেলাম না।নীতু আপাকে
হারিয়ে আমরা নিরাশায় আচ্ছন্ন হলাম।নীতু আপা এবং
মজিদ ভাই কেউই আমাদের কাছে নেই,হয়ত হারিয়ে গেল
সময়ের অতলে অথবা কখনো খুঁজে পেতে পারি আমাদের
অনিশ্চয়তার শহরে।
৫.
মজিদ ভাইকে ফিরে পাব এটা কল্পনীয় ছিল না।
বাহান্নোর আগস্টে মজিদ ভাই ফিরে এলেন।স্নিগ্ধ
উজ্জ্বল চেহারার মজিদ ভাইকে আমরা আমরা আবিষ্কার
করলাম মুখভর্তি চাপ দাড়িতে।১৯৪১ সাল যখন
জামায়াতে ইসলামী হিন্দ আত্মপ্রকাশ করল তখন তাদের
নেতাদের মুখে এই ধরনের দাড়ি ছিল।এই অবস্থা দেখলে
অন্যসময় হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতাম,আজকে ভিন্ন।
মজিদ ভাইকে দেখে কোনভাবেই কান্না আটকাতে
পারছিলাম না।এই মানুষটি আমাদের মাঝে এতগুলো দিন
নেই।বাম হাতটা অপেক্ষাকৃত চিকন হয়ে গেছে।মজিদ
ভাই এসেই বললেন,বায়েজিদ এক গ্লাস জল দে তো!মজিদ
ভাই পানিকে জল বলছেন এটা অবাক লাগল।আমি পানি
এনে দিলাম।পানি খেয়ে বললেন,নীতু আছে ত্রিপুরার
ধর্মনগরে।ভাল আছে।শুয়োরের বাচ্চারা আমার হাতে
গুলি করেছিল।কিছুই করতে পারেনি।আমার ভাষা আমি
ফিরে পেয়েছি।
জয়নাল ভাই দ্বীনদার মানুষ।তিনি মজিদ ভাইয়ের ফিরে
আসার আগ পর্যন্ত রাতে নফল ইবাদত করতেন।মসজিদে
একদিন মিলাদ দিয়েছেন পর্যন্ত।মজিদ ভাইয়ের ফিরে
আসাতে তিনি খুব একটা অবাক হলেন না।যেন অবাক
হওয়াটা মানা।যেন মজিদ ভাইয়ের ফিরে আসাটা তিনি
জানতেন।
মজিদ ভাইয়ের প্রায় নষ্ট হওয়া বামহাত নিয়ে তাকে
চিন্তিত মনে হচ্ছে না।বরং মাতৃভাষায় অবাধে কথা
বলার আনন্দ তার চোখেমুখে উজ্জ্বলভাবে দেখা
দিয়েছে।তবে এতদিন কোথায় ছিলেন,কীভাবে ছিলেন
এগুলো বলছেন না।এই প্রশ্ন করলেও তার চেহারাতে
ভেসে উঠছে অজানা কোন আতঙ্ক।যে আতঙ্ক তাড়িয়ে
বেড়াচ্ছে তাকে,তার বিবেককে।মজিদ ভাই ফেরার
তিনদিন পরেই হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হলেন।সন্ধ্যা থেকেই
জ্বর ছিল।শেষরাতের দিকে জ্বরটা মারাত্মক রকমের
বেড়ে গেল।তিনি বিড়বিড় করতে থাকলেন-"নীতু খুব ভাল
মেয়ে।নীতু খুব ভাল মেয়ে।শুয়োরের বাচ্চারা আবার
আসবে।"
জয়নাল ভাই বললেন,বায়েজিদ অবস্থা তত ভাল ঠেকছে
না।
আমি বললাম,কি করা যায়?
'আপাতত পানি দিতে থাক মাথায়।আমি ডাক্তার পাই
কিনা দেখি।'এই কথা বলে জয়নাল ভাই চলে গেলেন।
জয়নাল ভাই যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মজিদ ভাই
মারা গেলেন।মারা যাওয়ার আগে তিনি বললেন,অ আ ক
খ।
ভাষার প্রতি এই মজিদ ভাইয়ের অসম্ভব রকমের মমত্ববোধ
ছিল।শাসকচক্রের শোষণ তিনি মেতে নিতে পারেননি।
মজিদভাই চলে গেলেন রেখে গেলেন ভাষা।বাঙলা
ভাষা।এই ভাষা আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত
করে,জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটায়।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
রুনা লায়লা ২৪/০৯/২০১৭সুন্দর লিখেছেন ।পড়ে ভালো লাগলো কবি।শুভেচ্ছা নিরন্তর।
-
আজাদ আলী ২৪/০৯/২০১৭Very good discussion and every poet's need it