চব্বিশ ও একাত্তর
চব্বিশ আমাদের একাত্তরের ঘটনা পুনর্মূল্যায়ন করার সুযোগ দিয়েছে। ইতিহাসের ঘটনাগুলো শুধু একবার ঘটে না; সেগুলো বারবার স্মৃতিচারণা, আলোচনা, এবং নতুন তথ্যের আলোকে পুনর্ব্যাখ্যা পায়। একাত্তরের চেতনার প্রকৃত অর্থ কী? এটা নিঃসন্দেহে দলীয়করণ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তান শাসনের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধ।
ইতিহাসের পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়ায় (historical revisionism) ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিক রাখতে হলে তা সময়ের সাথে পুনর্মূল্যায়ন করতে হয়। চব্বিশ আমাদের সেই দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানাচ্ছে।
একাত্তর এবং চব্বিশ কোনটাকেই "ধর্ম" বা "ধর্মগ্রন্থ" হিসেবে দেখানোর সুযোগ নেই। সমাজের একটি অংশের একাত্তরকে পূজার মত করে দেখার প্রবণতাকে ভেঙে দিতেই চব্বিশ এসেছে। একাত্তর এসেছিল আমাদের জাতি গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হিসেবে। অথচ আমরা সেই সুযোগ থেকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও ব্যবহার করতে পারিনি। সুযোগ কাজে না লাগানোর হতাশা এ জাতিকে পিছনে নিয়ে গেছে অনেক দূর। যখন কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা বা চরিত্রকে প্রশ্নাতীত বা পবিত্র করে তোলা হয়, তখন সেই অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ আওয়ামীলিগের সুবিধা করে দিলেও বাম দলগুলোর জন্য ভালো ছিল না। সবাই যুদ্ধে অংশ নিলেও সবার আশা পূরণ হয়নি। আওয়ামীলীগ এটাকে খুব বেশি নিজেদের করে ফেলেছিল। চব্বিশকেও একই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। চব্বিশের আইকন আবু সাঈদকেও সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। এটি করলে বাস্তবতার মূল্যায়নকে বাধাগ্রস্ত করে এবং সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে দুর্বল করে। যৌক্তিক প্রশ্নগুলো করতে হবে। না করলেই আন্দোলন ব্যর্থ হবে।
২০২৪ সালের আন্দোলনে ছাত্রদের নয় দফাতে কিন্তু কোথাও ছিল না সংস্কার। তাই বলে কি সংস্কার করা যাবে না? একটা অভ্যুত্থানের পরে মানুষের ভেতরে স্বাভাবিকভাবেই সংস্কারের চিন্তাভাবনা এসেছে। এখন এই সংস্কারকেও অস্বীকার করা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। তারা চাইলেও অনেক সংস্কার করতে পারে না। কিন্তু সংস্কারপন্থী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষেত্রে এই বাধাটা নেই। তারা চাইলে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে কিছু সংস্কার করে যেতে পারে এবং সেই সুযোগটা তাদেরকে গ্রহণ করা উচিত।
একাত্তরের প্রকৃত শিক্ষা, যেমন মানুষের অধিকার রক্ষা এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম, সমাজে কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, তা বোঝার সুযোগ কমে গিয়েছে এটাকে দলীয়করণ করার ফলে। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে দেশে যেই সংস্কারে হাওয়া বইছে সেটি কেউ প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে ২৪ এর আইকন কে পবিত্র তুল্য করে ফেললে। একাত্তরের প্রয়োজনেই একাত্তর নিয়ে আলোচনা করতে হবে, দেশের প্রয়োজনে চব্বিশকে নিয়েও আলোচনা করতে হবে। চব্বিশ নিয়ে আলোচনা করতে হবে তখন যখন ২৪ এর চাওয়া পাওয়া পূরণে রাষ্ট্র ব্যর্থ হবে। রাষ্ট্রকে সেই সুযোগটি দেওয়া উচিত। চব্বিশ একাত্তরকে সত্যিকার অর্থে অনুধাবন করার এক দুর্লভ ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এই সুযোগটা হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না।
যাদের কাছে একাত্তর একটা ধর্ম। তারা ধর্মগ্রন্থের মতো একাত্তরকে তুলে রাখেন কাপড় মুড়িয়ে, মাঝেমাঝে নামিয়ে চুমু খান। কখনো একাত্তরের ভেতরে ঢুকে দেখেন না। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যেই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সেটাকে প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে হলে ৭১ কে বুঝতে হবে। ভেতরে ঢুকলে কী দেখা যাবে? ভেতরে ঢুকলে দেখতে পাওয়া যাবে, আবু সাইদ শহীদ সামসুজ্জোহার ফিজিক্যাল রিপ্রেজেন্টেশন। মৃত্যুর আগের দিন তাঁর শেষ স্ট্যাটাসে উঠে আসে সামসুজ্জোহার স্পিরিট। তাই একাত্তরের ধারাবাহিকতা হলো চব্বিশ (এই অর্থে চব্বিশকে আমি দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলি না)।
কেউ কেউ চব্বিশকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে চায়। এই বলাটা একটা মেরুকরণের রাজনীতি। কেন বলি না তার কারণ হলো, ১৯৪৭ সাল ছিল ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাত থেকে উপমহাদেশ কে রক্ষা করার মাইল ফলক, ১৯৭১ সাল ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে দেশকে রক্ষার একটি প্রচেষ্টা। এরপর কখনো সামরিক শাসন, কখনো স্বৈরশাসন, কখনো নিয়ম তান্ত্রিক সরকার আমাদের সাথে যে আচরণ করেছে তার ফলশ্রুতিতে মানুষ বার বার রাস্তায় নেমে এসেছে। মনে রাখতে হবে এই চব্বিশও একদিনে আসেনি। এত সহজে স্বাধীনতার প্রশ্ন সামনে এনে সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়াটা উচিত হবে না।
একাত্তর ও চব্বিশের বাস্তবতা আমাদের ভবিষ্যতের প্রতি একটি দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। একাত্তরের বাস্তবতা শুধুমাত্র অতীতের স্মৃতি নয়, এটি বর্তমান এবং ভবিষ্যতের ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, এবং স্বাধীনতার লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত। ২৪ হল সেই লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা। তাই ৭১ কে প্রকৃত অর্থে ধারণ করতে পেরেছিল আবু সাঈদরা।
যশোরের কথাই যদি বলি; সামিউলের মতো দুর্দান্ত তরুণদের চোখে বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন আমি দেখেছি সেটাকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। ওরা সত্যিকার অর্থেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাংলাদেশকে গড়তে চায়।
একাডেমিকভাবে, একাত্তরের চেতনা এবং চব্বিশের বাস্তবতার মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরি করার জন্য আমাদের ইতিহাসের গভীরে যেতে হবে। এটি শুধু অতীতকে নয়, বর্তমানকে বোঝার মাধ্যম হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস এবং স্মৃতিকে শুধুমাত্র ধারণ নয়, প্রশ্ন এবং বিশ্লেষণ করতে হবে, যাতে সত্যিকারের শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণা গ্রহণ করা যায়। ১৯৭১ কে সফল করতে হলে ২০২৪ কে সফল করতে হবে। জয় হোক মানবতার।
কামরুজ্জামান সাদ
ঢাকা, বাংলাদেশ
ইতিহাসের পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়ায় (historical revisionism) ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিক রাখতে হলে তা সময়ের সাথে পুনর্মূল্যায়ন করতে হয়। চব্বিশ আমাদের সেই দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানাচ্ছে।
একাত্তর এবং চব্বিশ কোনটাকেই "ধর্ম" বা "ধর্মগ্রন্থ" হিসেবে দেখানোর সুযোগ নেই। সমাজের একটি অংশের একাত্তরকে পূজার মত করে দেখার প্রবণতাকে ভেঙে দিতেই চব্বিশ এসেছে। একাত্তর এসেছিল আমাদের জাতি গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হিসেবে। অথচ আমরা সেই সুযোগ থেকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও ব্যবহার করতে পারিনি। সুযোগ কাজে না লাগানোর হতাশা এ জাতিকে পিছনে নিয়ে গেছে অনেক দূর। যখন কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা বা চরিত্রকে প্রশ্নাতীত বা পবিত্র করে তোলা হয়, তখন সেই অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ আওয়ামীলিগের সুবিধা করে দিলেও বাম দলগুলোর জন্য ভালো ছিল না। সবাই যুদ্ধে অংশ নিলেও সবার আশা পূরণ হয়নি। আওয়ামীলীগ এটাকে খুব বেশি নিজেদের করে ফেলেছিল। চব্বিশকেও একই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। চব্বিশের আইকন আবু সাঈদকেও সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। এটি করলে বাস্তবতার মূল্যায়নকে বাধাগ্রস্ত করে এবং সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে দুর্বল করে। যৌক্তিক প্রশ্নগুলো করতে হবে। না করলেই আন্দোলন ব্যর্থ হবে।
২০২৪ সালের আন্দোলনে ছাত্রদের নয় দফাতে কিন্তু কোথাও ছিল না সংস্কার। তাই বলে কি সংস্কার করা যাবে না? একটা অভ্যুত্থানের পরে মানুষের ভেতরে স্বাভাবিকভাবেই সংস্কারের চিন্তাভাবনা এসেছে। এখন এই সংস্কারকেও অস্বীকার করা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। তারা চাইলেও অনেক সংস্কার করতে পারে না। কিন্তু সংস্কারপন্থী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষেত্রে এই বাধাটা নেই। তারা চাইলে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে কিছু সংস্কার করে যেতে পারে এবং সেই সুযোগটা তাদেরকে গ্রহণ করা উচিত।
একাত্তরের প্রকৃত শিক্ষা, যেমন মানুষের অধিকার রক্ষা এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম, সমাজে কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, তা বোঝার সুযোগ কমে গিয়েছে এটাকে দলীয়করণ করার ফলে। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে দেশে যেই সংস্কারে হাওয়া বইছে সেটি কেউ প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে ২৪ এর আইকন কে পবিত্র তুল্য করে ফেললে। একাত্তরের প্রয়োজনেই একাত্তর নিয়ে আলোচনা করতে হবে, দেশের প্রয়োজনে চব্বিশকে নিয়েও আলোচনা করতে হবে। চব্বিশ নিয়ে আলোচনা করতে হবে তখন যখন ২৪ এর চাওয়া পাওয়া পূরণে রাষ্ট্র ব্যর্থ হবে। রাষ্ট্রকে সেই সুযোগটি দেওয়া উচিত। চব্বিশ একাত্তরকে সত্যিকার অর্থে অনুধাবন করার এক দুর্লভ ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এই সুযোগটা হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না।
যাদের কাছে একাত্তর একটা ধর্ম। তারা ধর্মগ্রন্থের মতো একাত্তরকে তুলে রাখেন কাপড় মুড়িয়ে, মাঝেমাঝে নামিয়ে চুমু খান। কখনো একাত্তরের ভেতরে ঢুকে দেখেন না। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যেই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সেটাকে প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে হলে ৭১ কে বুঝতে হবে। ভেতরে ঢুকলে কী দেখা যাবে? ভেতরে ঢুকলে দেখতে পাওয়া যাবে, আবু সাইদ শহীদ সামসুজ্জোহার ফিজিক্যাল রিপ্রেজেন্টেশন। মৃত্যুর আগের দিন তাঁর শেষ স্ট্যাটাসে উঠে আসে সামসুজ্জোহার স্পিরিট। তাই একাত্তরের ধারাবাহিকতা হলো চব্বিশ (এই অর্থে চব্বিশকে আমি দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলি না)।
কেউ কেউ চব্বিশকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে চায়। এই বলাটা একটা মেরুকরণের রাজনীতি। কেন বলি না তার কারণ হলো, ১৯৪৭ সাল ছিল ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাত থেকে উপমহাদেশ কে রক্ষা করার মাইল ফলক, ১৯৭১ সাল ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে দেশকে রক্ষার একটি প্রচেষ্টা। এরপর কখনো সামরিক শাসন, কখনো স্বৈরশাসন, কখনো নিয়ম তান্ত্রিক সরকার আমাদের সাথে যে আচরণ করেছে তার ফলশ্রুতিতে মানুষ বার বার রাস্তায় নেমে এসেছে। মনে রাখতে হবে এই চব্বিশও একদিনে আসেনি। এত সহজে স্বাধীনতার প্রশ্ন সামনে এনে সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়াটা উচিত হবে না।
একাত্তর ও চব্বিশের বাস্তবতা আমাদের ভবিষ্যতের প্রতি একটি দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। একাত্তরের বাস্তবতা শুধুমাত্র অতীতের স্মৃতি নয়, এটি বর্তমান এবং ভবিষ্যতের ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, এবং স্বাধীনতার লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত। ২৪ হল সেই লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা। তাই ৭১ কে প্রকৃত অর্থে ধারণ করতে পেরেছিল আবু সাঈদরা।
যশোরের কথাই যদি বলি; সামিউলের মতো দুর্দান্ত তরুণদের চোখে বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন আমি দেখেছি সেটাকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। ওরা সত্যিকার অর্থেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাংলাদেশকে গড়তে চায়।
একাডেমিকভাবে, একাত্তরের চেতনা এবং চব্বিশের বাস্তবতার মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরি করার জন্য আমাদের ইতিহাসের গভীরে যেতে হবে। এটি শুধু অতীতকে নয়, বর্তমানকে বোঝার মাধ্যম হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস এবং স্মৃতিকে শুধুমাত্র ধারণ নয়, প্রশ্ন এবং বিশ্লেষণ করতে হবে, যাতে সত্যিকারের শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণা গ্রহণ করা যায়। ১৯৭১ কে সফল করতে হলে ২০২৪ কে সফল করতে হবে। জয় হোক মানবতার।
কামরুজ্জামান সাদ
ঢাকা, বাংলাদেশ
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শ.ম. শহীদ ২৯/১২/২০২৪অসাধারণ!
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ১৯/১২/২০২৪অপূর্ব
-
ফয়জুল মহী ১৭/১২/২০২৪চমৎকার লিখেছেন শুভ কামনা রইল অফুরান।