www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

রাখাইন কবি ও কবিতা

রাখাইন শব্দটির উৎপত্তি হয় মূলতঃ রক্ষণ শব্দ থেকে। রাখাইন শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে কর্ণেল ফেয়ার বলেন- রাখাইন শব্দটি রাখাইনতঙ্গী বা রাখাইনপি থেকে গৃহিত যার অর্থ হচ্ছে দৈত্য বা রাক্ষস। সত্যিকার অর্থে রাখাইন শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে যে জনগোষ্ঠী স্ব-ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও লোকাচারকে সযতেœ সংরক্ষণ ও পরিচর্যা করে এবং ধ্বংসের হাত থেকে যারা রক্ষা করে তারাই রাখাইন। তাদের ভূমির নাম রাক্ষাপুরা বা রাখাইন পে। অনেকেই পালি শব্দ রক্ষা থেকে রাখাইন শব্দের উৎপত্তি বলে উল্লেখ করে থাকেন। প্রত্যেক জাতিরই একটি নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনাচরণ রয়েছে এবং তা এখনো অনেক জাতি নিজস্ব স্বকীয়তায় অব্যাহত রেখেছে। তেমনি রাখাইনদের নিজস্ব একটি সত্তা রয়েছে। রাখাইনেরা সুদীর্ঘ ইতিহাস থেকে নিজেদের মধ্যে নিজস্ব ভাষা নিয়ে মনের ভাব আদান-প্রদান করে যাচ্ছে। রাখাইন জাতিকে স্থানীয়ভাবে অনেকেই মগ বা মগজাতি বলে থাকে। কিন্তু আসলে তারা মগজাতি নয়। তাদের একটি পৃথক জাতিসত্তা রয়েছে। মগ শব্দটি অবজ্ঞার সাথে তুলনা করে ডাকা হয়। কারণ ষোল শতকে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের পর্তুগীজ দস্যূ ও মগদস্যুদের অত্যাচারে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মগেরা আসলে জলদস্যূজাত। রাখাইন এবং মগদের দৈহিক ও শারিরীক আকৃতির সাদৃশ্যগত মিল থাকায় স্থানীয়রা রাখাইনদেরকে মগনামে অভিহিত করে। যদিও মগ নামে কোন শব্দ রাখাইন অভিধানে নেই।
ইতিহাস পাঠে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৪১ বছর আগে রাখাইন জাতির উৎপত্তি। পন্ডিতমহলের মতে, খ্রিষ্টপুর্ব ৫০০০ ও ৪০০০ খ্রিষ্টপুর্ব যথাক্রমে নিগ্রিতা এবং দ্রাবিডিয়ান জাতির আবাসভূমি ছিল। পরবর্তীকালে আর্য এবং মঙ্গোলিয়রা এখানে বসবাস শুরু করে। আগন্তুক এই দ্রাবিডিয়ান জাতিরা প্রথম জনগোষ্ঠী নিগ্রিতাকে এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে। পরে দ্রাবিডিয়ানদেরকে আর্য ও মঙ্গোলিয়রা বিতাড়িত করে স্থায়ী ভাবে বসবাস করে। পরবর্তীতে সভ্য জনগোষ্ঠী আর্য ও মঙ্গোলীয়দের সংমিশ্রনে রাখাইন জাতির সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গোলিয়রা আসাম, মনিপুর, বিহার, গঙ্গা নদী তীরবর্তী অঞ্চল, উত্তর ভারত ও উত্তর-পুর্ব ভারত হতে আরাকানে অনুুুপ্রবেশ করে। আর্যরাও কপিলাবস্তু, দেবদাহ ও কনিঙ্ক, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ও উত্তর ভারত হতে আরাকানের প্রবেশ করে বসতী স্থাপন করেন। ইন্দো-এরিয়ান গ্র“প সুদূর পথ পরিক্রমন করে বারবার গঙ্গা থেকে কালাদান এবং কালাদান থেকে গঙ্গাতে এসে যুদ্ধে লিপ্ত হত। যুদ্ধে বিজিত দল পালিয়ে গেলে সেখানেই নতুন রাষ্ট্র বর্তমান আরাকান রাজ্য গঠন করেন।
আরাকানী বলতেই রাখাইনকে বুঝায়। আরাকান শব্দটি রাখাইন শব্দের বিকৃতি রূপঃ রাখাইন/রাখাইং/রাখাং/রাকাং/আরকান/আরাকান। আরাকান বাংলাদেশের দক্ষিন-পুর্ব সীমান্তে মায়ানমারের অন্তর্গত একটি প্রদেশ যা রাখাইন ষ্টেট নামে পরিচিত। সাগর, নদী ও পাহাড় ঘেরা পাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি রাখাইন প্রদেশ। ঞযব ঝরিঃুবৎষধহফ ড়ভ ঃযব ঝড়ঁঃয-ঊধংঃ অংরধ নামে পরিচিত। এখানে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে ২৭ জানুয়ারী পর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে স্থায়ী ভাবে রাখাইনেরা বসবাস করেছিল। অনেক যুদ্ধ বিগ্রহের পর মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনস্থ বাংলার সুবেদার শায়েস্তাখান আরাকানীদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করে চট্টগ্রাম দখল করে এর নাম দেন ইসলামাবাদ। তাঁর জৈষ্ঠ্য পুত্র প্রধান সেনাপতি উমেদ খান ২৭ জানুয়ারী চট্টগ্রাম দুর্গে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করেন। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে রাখাইনেরা পরবর্তীতে তাদের রাজ্য পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে আরাকানের রাজনৈতিক অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে পড়ে যায়। যার ফলে রাখাইন ইতিহাসে বিদ্রোহ, পাল্টা বিদ্রোহ, হত্যা ও ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বার্মার (মায়ানমার) আলাঙ্গপায়া বংশের বর্মীরাজ বোধপায়ার (১৭৮২-১৮১৯) রাখাইন ইতিহাসের শেষ রাজা থামাদাকে হত্যা করে আরাকান রাজ্য দখল করে নেয়। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রাখাইনদের পিতৃভূমি আরাকান ভূ-খন্ডটি কুরুক্ষেত্রে পরিণত হলে সদ্য স্বাধীনতা লুপ্ত আরাকানে রেমব্রে, মেংঅং, সেনডোয়ে, ক্যাউ-ফ্রো অঞ্চল থেকে স্বাধীনচেতা তেমেনগ্রী প্যো অং, উ ঘং গ্রী এবং উ অংক্য চৌধূরীর নেতৃত্বে ১৫০টি রাখাইন পরিবার ৫০টি নৌযান যোগে পিতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ অতিক্রম করে দক্ষিণ বাংলায় জনবসতি হীন বন্য অরন্যময় দ্বীপাঞ্চল উপকূলীয় এলাকায় বসতি স্থাপন করে। সে সময় এ অঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকায় বাঘ, ভল্লুক, কুমির ইত্যাদি ভয়ানক জন্তুতে ভরপুর ও বসবাসের অনুপযোগী ছিল। রাখাইনরা সব ভয়ানক জীব জন্তুর সাথে জীবন বাজী রেখে অসীম সাহসের সঙ্গে তীব্র লড়াই করে অনাবাদি পতিত এলাকা সমূহকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সুজলা-সুফলা, শষ্য-শ্যামলা আবাদযোগ্য ভূমিতে পরিণত করে। রাখাইনদের আত্ম-ত্যাগের মহিমায় আজ এতদাঞ্চলে সোনালি ফসল ক্ষেত, মাঠ ভরা সবুজ শস্য। অনাবাদী ভূমিকে আবাদি ভূমিতে রূপান্তর করে যুগান্তরী পরিবর্তন করেছে দেশে দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র কল্লোলিত শেষ প্রান্তকে। রাখাইনরা মূলত কক্সবাজার, রামু, মহেশখালী, চকরিয়া, সাতকানিয়া, উখিয়া, টেকনাফ, বরগুনা, পটুয়াখালী, খেপুপাড়া, পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, আমতলী, গলাচিপা এলাকায় বর্তমানে রাখাইনেরা বসবাস করে আসছে। এখানে বসবাসকারী মোট পরিবারের সংখ্যা- ১৬,৮৮২, জনসংখ্যা ১,৫০,০০০। (তথ্য সূত্র ঃ রাখাইন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন)। খ্রিষ্টপুর্ব ৩৩২৫ অব্দথেকে দক্ষিন-পুর্ব এশিয়ার কালাদান নদীর তীরে গড়ে উঠা সু-সভ্য রাখাইন জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস, বৈচিত্রময় সংস্কৃতি ও লোকাচার, সংস্কার, বিশ্বাস, সামাজিক পটভূমি স্বল্প সময়ে চারিদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন সময়ে উদ্ধারপ্রাপ্ত শিলালিপি ও স্তম্ভ, পুঁথি ও গুহা দেয়ালে উৎকীর্ন লেখা সমূহ থেকে ধারণা করা যায় যে, রাখাইন প্রে তথা খ্রিষ্টীয় ৪র্থ শতকের আগে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে ব্রাহ্ম লিপি ব্যবহার করত, কিন্তু কালক্রমে এর ব্যবহার বিলুপ্তি ঘটে। ছয় শতকের প্রারম্ভে এসে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে রাখাইন ভাষা ব্যবহার করে। রাখাইন সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রথমে উল্লেখ করতে হয় তৎকালিন চকরিয়া (সুরতন) এর আরাকান রাজকুমারী চপ্রেঞো (সুবর্ণা দেবী)। ৬০১ সালে তৎকালিন সামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক চেতনা আর ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে রাজকুমারী চপোক্রো (সুবর্ণা দেবী) “ছিঙকেঙমিংটেঙ” নামে বিরহ গীতিকাব্য রচনা করে রাখাইন সাহিত্যে অনন্য সৃষ্টি হিসাবে বিবেচিত হয়। সুবর্ণা দেবী হারবাঙ গ্রামের আলয়ে বসে এ বিরহ গীতিকাব্য রচনা করেছিলেন। বিরহ গাঁথাটিতে তৎকালীন আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র পরিস্ফুটিত করা হয়েছে। তৎকালে প্রকৃতি ও সামাজিক বিবরণ নির্ভর সাহিত্য কর্ম অকল্পনীয় ছিল। সূবর্ণাদেবীর ঐতিহাসিক প্রেম কাহিনীকে নিয়ে রচিত একটি গীতি কাব্যের কিছু পংক্তির বাংলা অনুবাদ তুলে ধরছি।
কেঁদে ফেলি যখন দিদিরে মারে
বামকানের দুলও হারিয়ে ফেলি গোসলের সময়ে
আছাঃফ্রোকে খুঁজে পাইনা, আছে যুবনেতার বাম পাশে
তার বাম হস্তে পানখিলি, ডান হস্তে সিগারেট
দেশে দেশে রাজা বাদশাহর ঘরে ঘরে চুরুট
সুন্দর হও মোর ছেলে, সুন্দর হও মোর মেয়ে
রেখোনা আর তাদের। সাংগ্রেহ’র পোওয়ে পাঠিয়ে দাও
না পাঠালে নালিশ জানাবো, রাজা পুলিশকর্তার নিকট
ভয় লাগে রে ভয়, ভয় লাগেরে ভয়
মগদের আমার ভয় লাগে
হায়রে হায়রে কি করব এখন।
৭ম শতকের মাঝামাঝি সময়ে রাখাইন ভাষা ও বর্ণমালা পরিশীলিত করার লক্ষ্যে ৭৬০ অব্দে একটি বর্ণমালা সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ঐ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাখাইন বর্ণমালার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ন পরিবর্তন আসে। ৭৬৮ সালে ধম্মজেয়া রাখাইন ভাষায় ৩৩টি বর্ণমালা নিয়ে “লেটঅছেং” নামক একটি গীতিকাব্য রচনা করেন্। এটি ছিল তৎকালীন আরাকান রাজ্যের রণসংগীত। ঢেওয়ের তালে তাল মিলিয়ে যুদ্ধের অনুপ্রেরণা ও স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নৌ-যুদ্ধাগণ গীতটিকে রণসংগীত হিসাবে কোরাস গাইতেন। বর্তমান রাখাইনরা ওই গীতটিকে রণসংগীত হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন।
আরাকান ইতিহাস ‘রাজ-ওয়াং’ পর্যালোচনা কর দেখা যায়- আরাকান রাজ্যের কবিদের মধ্যে উ ওক্কাপ্যেং, উ ওটো, উ অংচাউ, উ ক্যউ, উ ঙামে, উ মংছাথু প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসময় কালজয়ী কবি ও সাহিত্যিকগণ ধর্মীয় অনুশাসন, নীতিকথা, কল্পকাহিনী, সূত্র গাঁথা, ছড়া, শ্লোক, পদ্য, কাব্য-কবিতা, স্লোগান, খনা-বচন, গীতি নাটক, উপন্যাস রচনা করেছেন এবং এসব রাখাইনদের মধ্যে কংগ্যখাং ঝা ম্রাক্যউ, চাইটাগংঝ সোয়েছ, মি পিং রেং, সাকে উম্রাওয়া, উক্কাব্যং, চ য়েইং মি, ঙালাৎবুং প্রমুখ। এরা সবাই রাখাইন ভাষায় কবিতা চর্চা করতেন বলে ক্য থিং অং “রাখাইন ভাষার শিক্ষার হাল আর বিবর্তনে রাখাইন সাহিত্য” নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন।
বর্তমান রাখাইন লিখিয়েরা রাখাইন ভাষায় কবিতা চর্চার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় কবিতা চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছেন। রাখাইনেরা মূলত লিটলম্যাগ কেন্দ্রিক কাব্য চর্চা করেন। মাঝে মধ্যে কিছু কিছু স্থানীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকায়ও লেখালেখি করতে দেখা যায়। তবে তারা এখনো গীতি কবিতার ধারা থেকে বের হতে পারে নি। কিছু কিছু রাখাইন কবি আধুনিক তথা উত্তর ঔপনিবেশিকবা পোষ্ট কলোনিয়াজম ধারায় অনেকেই গীতি কবিতা চর্চা করে থাকেন।
¬¬¬¬¬¬বর্তমান যুগের রাখাইন কবিদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে রামু খিজারী স্কুল শিক্ষক মংহ্ল প্র“ পিন্টু। তিনি নববই দশকের শুরু থেকে লেখালেখি করে আসছেন। তাঁর কবিতায় রাখাইনদের রাজ্য দখল করে রাখাইনদের জন্ম পরিচয়হীন করে তুলেছে তার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। এক সময় রাখাইনদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র ছিল, স্বাধীন সার্বভৌম ছিল। কিন্তু ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বার্মা সরকার তাদের রাজ্য আরকান দখল করে নেয়ায় তারা পরিচয়হীন হয়ে শরণার্থী হিসাবে বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় বসবাস করে আসছে। তবুও তারা সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে বন্দুকের সীসার ন্যায় দীপ্ত পায়ে এগিয়ে এসে স্বদেশভূমি রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তার একটি বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর “শৃংখলিত জন্মদাতার মুক্তির জন্য” কবিতায়।
আমি বারবার সম্মুখিন হই
একটি প্রশ্নের
“তোমার পিতৃ-পরিচয়?
এর জবাব জানা আছে আমার
বলে ফেলি পিতার আদ্যোপান্ত
যুগ যুগ ধরে
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে,
সেই ১৭৮৪ খৃষ্টাব্দ থেকে অদ্যাবধি
আমার পিতার পায়ে শিকল পরিয়ে
অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী করে রেখেছে
সভ্যতার অগ্রদূত(?) সাম্রাজ্যবাদী স্বৈরশাসক
এবং দোসর সমাজতন্ত্রী (?) একনায়কেরা।
তাই পিতৃ-সেèহ বঞ্চিত-
আমার অসংখ্য ভাই-বোন
আমি, আমরা সবাই।
অতএব, আমরা জারজ সন্তান নই।
আমাদের ধমনীতে যার রক্ত
তার পায়ের শৃংখল মুক্ত করাই
আমাদের মহান দায়িত্ব।
হে জন্ম দাতা
আমরা তোমার জন্য সুযোগ্য সন্তানেরা আসছি
স্বৈরাচারীর ঐ রক্তচক্ষু
আর বন্দুকের উত্তপ্ত সীসাকে উপেক্ষা করে
তোমার পায়ের শৃংখল মুক্ত করতে
এবং এখনই।
মংবা অং (মংবা) স্বাতন্ত্র মন্ডিত এক রাখাইন গবেষক ও কবি। কক্সবাজারের চাউল বাজার সড়কে জন্মগ্রহণকারী এ কবির কবিতায় প্রকৃতি ও নিসর্গই প্রধান। কবি রবীন্দ্রনাথের মত ধন্য-ধান্যে পুষ্পে ভরা বাংলাদেশের সবুজ বন, পশু-পাখি, পত্র-পল্লব দেকে কবির মন ভরে যায়। কবিতায় ......
যেখানে জনম মোর, সেখানো মরণ আমি
বাদ ধরণীতে যুক্ত অনিল জোয়ার ধণ্য ধান্যে পুষ্পে
শত নদ, সবুজ বন, পশু-পক্ষী, সুন্দর পল্লবের বৃক্ষ।
আমি যে তারই সম্পদ।
এছাড়া তিনি কবিতা চর্চার পাশাপাশি রাখাইনদের নিয়ে “বাংলাদেশে রাখাইন সম্প্রদায়ঃ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনধারা” নামক মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেন।
অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত তরুণ কবিতাকর্মী মা হ্লা মে মালর কবিতায় পাওয়া বাংলার স্বাধীনতার স্বরুপ বর্ণনা পাওয়া যায়। স্বাধীনতা কবি হয়ত দেখেননি। পেয়েছেন রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ। দেখেছেন স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরও ভাইয়ের হাতে বোন লাশ হতে। তা একবুক আশা নিয়ে কবি কলুষিত এই বাংলাদেশকে রক্ষা করার আহ্বান জানান-
আমরা নতুন প্রজন্ম
আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধ দেখিনি।
পেয়েছি স্বাধীনতার স্বাদ
আমরা বিজয় দেখিনি
পেয়েছি বিজয়ের স্বাদ
অর্জিত দেশে আবার কেন হানাহানি?
আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত
হবে কেন বাংলাদেশের মাটি?
কক্সবাজারের বংশোদ্ভূত উ মংছেনচীং (মংছিন) এর কন্যা উ এনু (প্রিয়াংকা) অল্পবয়সে রাখাইন স্বজাতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করে আসছেন। “আমার দেখা শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর” বিষয়ে হাইস্কুল পর্যায়ে রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারী হিসাবে অবদান রাখার জন্য ১ জানুয়ারী ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট হতে পুরস্কার লাভ করেন। তার পাশাপাশি তিনি কবিতা চর্চাও অব্যাহত রেখেছেন। তার কবিতায় ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রেম-বিরহ, দেশাত্মবোধ দারুণ শব্দ শিল্পের মাধ্যমে ফুটে উঠে।
উল্লেখিত কবিদের পাশাপাশি যে কয়েকজন কবির কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে পাওয়া যায় তা- উ থান সিন, এ থান ইয়ং, উক্যথিন, অংক্যচিন, উচিংসা রাখাইন কায়েস, উবাচং, মংহ্লামী, মংবাথোইন, মন্টিং প্রমুখ।
কক্সবাজারে রাখাইন কবিদের পাশাপাশি পটুয়াখালী জেলায় বসবাসকারী রাখাইন কবিরা কবিতা চর্চা করে থাকেন। এরকম কবিদের মধ্যে মাহিন্দা মহাথের, উসিমং, মংথান আই, থান নিউ, মংছেন ক্য, তাহান প্রমুখ রাখাইন কবিদের কবিতা দেখতে পায়।
আমি পটুয়াখালীর মংছেন ক্য এবং ওয়েনরি নামক দুজনের কবিতা পেয়েছি। তার মধ্যে মংছেন ক্য’র “প্রথা” কবিতাটি কবি হাফিজ রশিদ খান রচিত ‘‘ অরণ্যের সুভাসিত ফুল’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।





আধুনিক যুগের কয়েক জন রাখাইন কবিদের কবিতার কিয়দংশ তুলে ধরছি-
মংহ্লাপ্র“ পিন্টু
১. শৃংখলিত জন্মদাতার মু্িক্তর জন্য

আমি বারবার সম্মুখিন হই
একটি প্রশ্নের
“তোমার পিতৃ-পরিচয়?
এর জবাব জানা আছে আমার
বলে ফেলি পিতার আদ্যোপান্ত
যুগ যুগ ধরে
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে,
সেই ১৭৮৪ খৃষ্টাব্দ থেকে অদ্যাবধি
আমার পিতার পায়ে শিকল পরিয়ে
অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী করে রেখেছে
সভ্যতার অগ্রদূত(?) সাম্রাজ্যবাদী স্বৈরশাসক
এবং দোসর সমাজতন্ত্রী (?) একনায়কেরা।
তাই পিতৃ-সেèহ বঞ্চিত-
আমার অসংখ্য ভাই-বোন
আমি, আমরা সবাই।
অতএব, আমরা জারজ সন্তান নই।
আমাদের ধমনীতে যার রক্ত
তার পায়ের শৃংখল মুক্ত করাই
আমাদের মহান দায়িত্ব।
হে জন্ম দাতা
আমরা তোমার জন্য সুযোগ্য সন্তানেরা আসছি
স্বৈরাচারীর ঐ রক্তচক্ষু
আর বন্দুকের উত্তপ্ত সীসাকে উপেক্ষা করে
তোমার পায়ের শৃংখল মুক্ত করতে
এবং এখনই।

২. পাশাপাশি না মুখোমুখি

রক্ত কিংবা নৃতাত্ত্বিক সূত্রে
তুমি আমার নিকটজন বই কি
তবে আমার আত্মার আত্মীয় সেই
মনন আর জীবনাচরণে যার অবস্থান উত্তরে।

তাই বলি, ভেবে দেখো
সাম্য ও প্রগতির মানদন্ডে
তোমার যাপিত জীবন তোমাকে কোন
শিবিরের দাঁড় করায়-
শোষক না শোষিতে?
অতএব দেখতে আমার মতো হলেও
তারা সবাই আমার স্বজন নয়-
কিংবা অন্যরকম দেখালেও
চেতনায় তারা দূরে নয়!

৩. রাখাইন নাচ

রাখাইন, রাখাইন, রাখাইন অপুর্ব সুন্দর
ব্যথাভরা হাততালিতে
নাচলে কাকে সুন্দর দেখায়?
-শিশু নাচলে সুন্দর দেখায়।

এসো এসো সবাই এসো
ভরা জোছনা রাতে খেলতে চলি
কে কে যাবে চলো
ঘিলা বিচি খেলতে চলো
ও বৌদিগো মোদের আনন্দ লাগছে।





ওয়েনরি
সময়ই বলে দেবে

সময়ই বলে দেবে কার আদর্শের জোর বেশী
সেদিনের ঝড়ো হাওয়ার পক্ষ না বিপক্ষের
আজকাল কেউ আর অতোটা বোকা নয়
বারুদের ভয়ে, জীবন হারানোর ভয়ে পিছিয়ে যাবে
ন্যায়ের সংগ্রাম শোষণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্টার লক্ষ্য থেকে
সেদিনের ঝড়োহাওয়ার স্মৃতিগুলি
আজো মনে পড়ে, অনেকেরই যখন তখন
ভুক্তভোগীরা কখনো ভুলে না বেদনার কথা
পোড়া ঘরবাড়ি শ্লীলতা হানি
বুটেরতলায় পিষ্ট হওয়া
লূটতরাজের শিকারে পরিণত হওয়ার কথা
পৃথিবীর কতো দেশের সংগ্রামের ইতিহাস বলে
জুলুম বারুদের ঝলকানি লুটতরাজ
বেশিদিন টিকেনা
এক সময় নিজস্ব প্রয়োজনেই
ওরা সব এক প্লাটফর্মে প্রতিবাদী হতে পারে
ভেঙ্গে ফেলতে পারে কারাবাসের প্রাচীর
প্রতিষ্ঠা করতে পারে আগামীর জন্যে সুদিন
সর্বত্র সুস্থ পরিবেশ ঘৃণা ধিক্কার সংগ্রাম- প্রতিরোধ প্রতিবাদে।

মংছেন ক্য
প্রথা

মানুষেরা ছুুটছে দলে দলে
আজ উৎসব মানুষের আদি নিবাসে
নিয়মকি মানুষের আত্মিক কল্যাণের?
অবুঝ মানুষ।
মানুষের পূর্ব পুরুষ
সামাজিক নিয়ম কানুন
এ শুধুই প্রতিদ্বন্দ্বিতায়
লাল, নীল এবং সবুজ সজ্জা’র
মানুষ করে সে মানুষ হবে।
দুঃখীর প্রয়োজনে হবে দুঃখী
কুসংস্কার মুক্ত হওয়ার জন্যে
আড়াই হাজার বছর কি যথেষ্ট নয়?
হে মানুষ!
এসো, হই প্রকৃত মানুষ।
মংবা
১. সে যে আমারই

যেখানে জনম আমার,সেখানে মরণ আমি-
বঙ্গ ধরণীতে যুক্ত আনিল জোয়ার ধনধান্যে পুষ্পে,
শত নদ, সবুজ বন,পশুপক্ষী,সুন্দর পল্লবের বৃক্ষ
আমি যে তারই,সে যে আমার সম্পদ।
প্রত্যুসে রক্তিম রবি বাড়ে হিরন্নয় সোম
বিরতে বিচিত্র,প্রকৃতি সু সিèগ্ধ দৃশ্যের ক্রীড়া
আনন্দ অশ্রুতে ফলিত দরিদ্র কিষাণের ফসল
কোমল নিঠুরিয়া চিত্তের শত মন বিস্তারিয়া বঙ্গে
আমি যে তারই, সে যে আমারই সব।
যেখানে আরম্ভে সেখানে সমাপ্ত আমি
জন্মাবধি ভেবেছি প্রীতি দিয়ে অতি আপন যারে
হ্যাঁ, যদিও কুড়ে গৃহে তথাপি শত অহমিকার মন
আমি যে তারই,সে যে আমার স্বজন।


২. শুভ নববর্ষ

নীল গগনে ফুটেছে নবীন নবীন নক্ষত্র
ফুটাবে আলো, ভরাবে আনন্দ হৃদয়ে।
সারা বর্ষ, সারা মন হবে ধন্য তোমারই পূণ্যে।
নব নব সবুজ পল্লবে সাজাবো বৃক্ষ
পাখিরা গাইবে বহুল প্রতিক্ষিত গীত,
দক্ষিনের সমীরণ বইবে পরশ স্নিগ্ধে
কাননে কাননে ফুটবে বিচিত্র সুবাসের পুষ্প
মৌছাকের মৌমাছিরা ছুটবে সুবাস সন্ধানে
জেগে উঠবে নিমজ্জিত কীট-পতঙ্গেরা।
সাগরের উর্মীলা দোলাবে শান্ত ক্রীড়ায়
পুস্করিণীর মৎস্যগুলো উড়তে চাইবে
দোয়েল, কোয়েল, শাপলা থাকছেই থাকছে।
টাট্টা লাল-সবুজ শষ্যে ভরবে ক্ষেত
আলীঙ্গনের সুবন্ধন হবে শত্র“-মিত্রে।
সমস্ত জ্বালা-বেদনা ভূলবে বেদনার দল ।
হাসবে, খেলবে উৎফুল্ল চিত্তে নবীন প্রাণের দল
প্রেমিকেরা স্বপ্নে রচনা করবে সুখের নীড়
নববর্ষ সবারই হোক সুখের বর্ষ।

উ এনু প্রিয়াংকা
স্নায়ু মানচিত্র

পেরিয়ে এলাম দীর্ঘ শ্রদ্ধার মোড়কে
বুকের উষ্ণতা নেবো শ্র“তির প্রত্যয়ে
আলোক বিস্ময়ে মুগ্ধ বিলাস
অনাদি সৌরভে জেগে থাকি রাত-দিন
তোমার নন্দিত সুখ ভোরের গান শুনে
তোমার চোখ হবে সূনীল আকাশ
দুঃখের জাজিমে বসে জুড়াবে হৃদয়
বিপন্ন দিনের কথা তুলবো পুটলিতে
বুকের গহীনে ব্যথা, নিবিড় সংলাপ
নির্মম পাথরে ঢেকে গোলাপ ফুটাবো
বুকের কষ্ট রাখবো গোপনে
বিক্ষত জর্জর কান্না ধ্র“ব অভিরাম
অসাড় স্নায়ুতে শুধু মানচিত্র আঁকি।
প্রকাশ্য প্রতীকরূপে রক্ত বহমান
হৃদয় উৎসব তোমার আশায়।

মা হ্লা মে মালা
বিজয়ের দিনে পণ

আমরা নতুন প্রজন্ম
আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখি নি
পেয়েছি স্বাধীনতার স্বাদ
আমরা বিজয় দেখিনি
পেয়েছি বিজয়ের স্বাদ
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
অর্জিত দেশে আবার কেন হানাহানি?
আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত
হবে কেন বাংলার মাটি?
ভাইয়ের হাতে কেন হতে হয় লাশ?
দানবের কবলে পড়ে দেশের জন্য
হারিয়েছিল সম্ভ্রম লক্ষ মা ও বোনেরা
বিজয়ের পর কেন নিজভূমে হারাবে সম্ভ্রম?
রক্ত ঝরাতে হবে তো, ঝরবে পাশবিকতার রক্ত।
শত্র“র মোকাবিলায় আবার রচিত হবে যুদ্ধ
বুকের রক্ত দিয়ে পৃথিবীর বুকে
দিয়ে গেলো যারা একটি মানচিত্র।
কলুষিত হতে দেয়া যাবেনা তারে
দিতে হোক যত মূল্য
বিজয়ের দিন মোরা
করবো এ শপথ।


অংক্যচিন
ইতিহাস

জলকষ্টে পাখিরা, এই পূর্নিমায়
নদীকেও বিষাদ ভেবে,
যায় না, কাছে

ব্যথাতুর মেঘ, আকাশ থেকে
নির্বাসনে যেতে যেতে,
আমার পঙতিমালায় রাখে আলতার ছাপ

জলপাই কষ্টে জাগে চাঁদ;
বিরানে লাশের খোয়াব, কসাই সময়
ঘাসফ’লে বিষন্ন ইতিহাস কাঁদে।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১৩৮৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৯/০৭/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast