www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অন্ধকারে আলোর জ্যোতি- নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ

নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ ঢাকার নওয়াব পরিবারে ১৮৭১ সালের ৭ জুন জন্মগ্রহণ করেন। সলিমুল্লাহর জন্ম ঢাকা শহরে এবং তাঁর জীবন কেটেছে এই শহরেই। এই শহর ও পূর্ববঙ্গের অগ্রগতির চিন্তা যে তাঁকে তাড়িত করেছে, সে বিষয়ে প্রমাণের অভাব নেই। তাঁর পিতার নাম নওয়াব আহসানউল্লার এবং মাতার নাম ওয়াহিদুননেসা। তাঁর পূর্বপূরুষগণ মোগল আমলে অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশকে কাশ্মীর থেকে এসে বাংলায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিল। বৃটিশ শাসনকালীন মুসলিম সমাজের ইংরেজি শিক্ষায় অনাগ্রহের বিপরীতে এই পরিবার ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক শিক্ষার প্রতি উৎসাহী ছিল। নওয়াব আবদুল গণি ছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ-এর দাদা। তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রথম সরকারি ইংরেজি স্কুল ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।

আধুনিক ঢাকার গোড়াপত্তনঃ
নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর বাবা আহসানউল্লা ১৯০১ সালের প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে ঢাকায় প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিলেন। ঢাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং ঢাকার রাস্তায় গ্যাসবাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রথম বিজলি বাতির আলো জ্বলেছিল আহসান মঞ্জিলে। এই বাড়িতেই জন্ম হয়েছিল সলিমুল্লাহর।

নওয়াব উপাধিঃ
ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৫ সালে আবদুল গণিকে নওয়াব উপাধি দেন। এরপর থেকেই তাঁদের বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। স্যার সলিমুল্লাহ ইংরেজি, জার্মান, আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং তাঁর প্রধান শিক্ষাগ্রহণ পর্বটি ছিল গৃহশিক্ষকের কাছে। নওয়ার স্যার সলিমুল্লাহ বলতেন, ‘’যে কোনো রাজনীতির চেয়ে তার দেশের জনগোষ্ঠীর জন্য অনেক জরুরি প্রয়োজন শিক্ষার বিস্তার’’।তাই, নওয়াব হিসেবে দায়িত্ব পালনের শুরুতেই ঢাকার সব মহল্লায় তিনি স্থাপন করেছিলেন নৈশ বিদ্যালয়। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯০২ সালে তিনি এক লাখ ২০ হাজার টাকা দান করেছিলেন। সেই টাকায় এবং তাঁর দান করা জমিতে স্থাপিত হয়েছিল আহসানউল্লা স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৯২২ সালে যা আহসানউল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ১৯৬০ সালে আহসানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে উন্নীত হয়। সেটিই বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট।

মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাঃ
নওয়ার স্যার সলিমুল্লাহ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন অন্যতম সদস্য ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রিয়। ফলে অভিজাত পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি অবস্থান করতেন। সাধারণ মানুষের দুঃখকে তিনি নিজের দুঃখ মনে করতেন। তিনি অকাতরে দান-খয়রাত করতেন। সলিমুল্লাহর আগ পর্যন্ত এ পরিবারের কেউ প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসেননি। তবে, ঊনবিংশ শতকের বাংলার শাসক সম্প্রদায় অর্থাৎ ইংরেজদের সঙ্গে আবদুল গণি ও আহসানউল্লার সুসম্পর্ক ছিল।

বঙ্গভঙ্গ এবং নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহঃ
১৯০৩ সালে বৃটিশ-ভারতের তৎকালীন বড় লাট লর্ড কার্জন ঢাকায় সফরে এলে নওয়াব সলিমুল্লাহ তার কাছে পূর্ব বাংলার সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। আসামের উৎপাদিত চা ও অন্যান্য পণ্য বিদেশে রপ্তানীর ব্যাপারে পরিবহন ব্যয় হ্রাসের উদ্দেশ্যে কলকাতার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের চিন্তা করে বৃটিশরা। এই সাথে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের ভাবনাও চলতে থাকে। বৃটিশদের বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং নবাবের আবেদন যুক্ত হয়ে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বাংলা বিভাজনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর প্রেক্ষিতে কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী ব্যবসায়ীদের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৯০৫ সালে বঙ্গদেশকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও আসাম নিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠনে প্রভূত ভূমিকা রাখেন স্যার সলিমুল্লাহ। বঙ্গভঙ্গ নিয়ে কলকাতার বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলেও ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। ঢাকাকে রাজধানী করে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' প্রদেশ গঠিত হয়। বঙ্গভঙ্গের পর সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায় ব্রিটিশ সরকারকে ধন্যবাদ জানায়। নতুন প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমান বাংলাদেশ, অবিভক্ত দিনাজপুর, মালদহ ও জলপাইগুড়ি জেলা, আসাম, মণিপুর ও ত্রিপুরা।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ রহিতকরণের ঘটনায়নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। কিন্তু শাসকদের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে আবেদন-অনুরোধের পথেই থাকেন তিনি। তিনি অবিভক্ত বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য, ইম্পেরিয়াল কাউন্সিলের সদস্য এবং পূর্ববঙ্গ ও আসামের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন। বঙ্গভঙ্গের পর স্যার সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ বরাবর পূর্ববঙ্গ ও ঢাকার অমর্যাদার কথা তুলে ধরে হতাশা ব্যক্ত করেন। নওয়াব আলী চৌধুরী, এ কে ফজলুল হকসহ পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতাদের নিয়ে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জোর দাবি তোলেন। সরকার এই দাবি ১৯১২ সালে মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিলে এর বিরুদ্ধেও যে প্রবল আন্দোলন হয়েছিল, সে কথা সুবিদিত। তবে শেষ পর্যন্ত ১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও; তিনি নিজে এর প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেননি।

মুসলিম লীগ গঠনঃ
বৃটিশ শাসন ক্ষমতায় অবহেলিত মুসলিম জনগোষ্ঠির কথা চিন্তা করে ১৮৭৭ সালে সৈয়দ আমীর আলীর উদ্যোগে ‘সেন্ট্রাল মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করা হয়। অপরদিকে, ১৮৮৮ সালে কংগ্রেস আত্মপ্রকাশ করার পর মুসলমানদের স্বার্থের ব্যাপারে সচেতন হয়ে সৈয়দ আহমদ-এর নেতৃত্বে ১৮৮৯ সালে ‘ইউনাইটেড ন্যাশনাল ডিফেন্স এ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করা হয়। এদিকে বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র ভারত জুড়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদ এবং মুসলিম বিদ্বেষের ঝড় বয়ে যাওয়ায় স্যার সলিমুল্লাহকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তোলে। তিনি সর্বভারতীয় পর্যায়ে মুসলিম ঐক্যের কথা ভাবতে শুরু করেন। নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর সাহসী পদক্ষেপে ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিমলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের দোসরদের ক্রমাগত আক্রমন থেকে মুসলমানদের নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য এবং ধর্ম রক্ষায় নবাব স্যার সলিমুল্লাহর একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঢাকার শাহবাগের 'এশরাত মঞ্জিলে' সম্মেলন আহবান করেন। সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার জন্য তৎকালীন ভারতবর্ষের সকল মুসলিম মনীষীদের কাছে দাওয়াত পত্র পৌঁছান। দীর্ঘ ৬ মাস যাবত নৌকায়, ঘোড়ায় ও ট্রেনে করে দূত পাঠিয়ে এ দাওয়াত পত্র পৌঁছান। এ সময় শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক সহ প্রায় আট হাজার মনীষীর নিকট আমন্ত্রন পত্র পৌঁছে দেয়া হয় । সমগ্র ভারতের বিশিষ্ট মুসলিম নেতৃবৃন্দের নিকট পত্রালাপে নিজের অভিপ্রায় তুলে ধরেন এবং সর্বভারতীয় মুসলিম সংঘের প্রস্তাব রাখেন। ১৯০৬ সালের ২৮-৩০শে ডিসেম্বর সর্বভারতীয় সম্মেলন আহুত হয়। শাহবাগে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে সমগ্র ভারতের প্রায় ৮ হাজার প্রতিনিধি যোগ দেন। নবাব সলিমুল্লাহ ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফেডারেন্সী’ অর্থাৎ সর্বভারতীয় মুসলিম সংঘ গঠনের প্রস্তাব দেন। কিছু প্রতিনিধির আপত্তির প্রেক্ষিতে কনফেডারেন্সী শব্দটি পরিত্যাগ করে 'লীগ' শব্দটিকে গ্রহণ করা হয়। অবশেষে নওয়াব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে 'অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ' গঠিত হয়। ঢাকায় এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে বঙ্গভঙ্গ সমর্থন এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নিন্দা করা হয়। এ সংগঠনের ব্যাপারে শুরু থেকেই হিন্দু জনগোষ্ঠী বিরূপ অবস্থান নেয়। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী সম্পাদিত দি বেঙ্গলী পত্রিকা নবগঠিত মুসলিম লীগকে সলিমুল্লাহ লীগ হিসেবে অভিহিত করেন। খাজা সুলিমুল্লাহ একটি মুসলিম রাষ্ট্রের চিন্তা করতেন। সেই চিন্তা থেকেই আজকের বাংলাদেশ। আজকের যে শিক্ষিত বাঙ্গালী মুসলমান দেখি, তাদের সকলের ওপরই অবদান আছে নওয়াব সলিমুল্লাহর।

শিক্ষা বিস্তারঃ
ঢাকার নওয়াব আহসানউল্লাহ ১৯০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করার পর, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ৩০ বছর বয়সী সলিমুল্লাহ নওয়াব পদে অধিষ্ঠিত হন। বাস্তববাদী এই তরুণ যথার্থভাবে উপলব্ধি করেন যে, বাংলার পশ্চাৎপদ ও দরিদ্র মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষায় উন্নতি না হলে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আসবে না। তাই তিনি মুসলমানদের শিক্ষাবিস্তারে মনোযোগী হন বিশেষভাবে। নওয়াব সলিমূল্লাহ ১৯১১ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার কার্জন হলে ল্যান্সলট হেয়ারের বিদায় এবং চার্লস বেইলির যোগদান উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নওয়াব আলী চৌধুরীকে নিয়ে পৃথক দুটি মানপত্র নিয়ে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা খাজা সলিমুল্লাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তিনি ঢাকার রমনা এলাকায় নিজের ৬০০ একর জমি দান করেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ৬০০ একর জমিই শুধুমাত্র দান করেননি, প্রধান অর্থদানকারীও ছিলেন। যার দান করা জমির উপর দা‌ড়িয়ে আছে আজকের- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ। তাঁর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (বর্তমানে বুয়েট) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাংলার মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে গড়ে তোলার জন্য ঢাকা আলিয়া মাদরাসা, সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা ঢাকার নওয়াবদের গড়া এমনি একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এ এতিমখানাটি এদেশে সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ অনাথ আশ্রম। এ দেশের অনুন্নত মুসলমান সমাজকে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তার অবদান অবিস্মরণীয়। উত্তর প্রদেশের অনুন্নত মুসলমানদের জন্য স্যার সৈয়দ আহমদের যে অবদান রাখেন, তাঁর সাথে নবাব সলিমুল্লাহর অবদানের তুলনা করা যায় সহজেই।

তিনি জীবনের প্রথম দিকে জনগণের কথা চিন্তা করে নবাবীর লোভ না করে মোমেনশাহীর ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের চক্রান্তে বিট্রিশ সামাজ্যবাদে শত বছরের অধিক চাষাভূষা, কোচয়ান-দাঁরোয়ান ও গোলাম বানিয়ে রাখা মুসলিমদের কথা ভেবে প্রথম জেগে উঠেন। তারপর মুসলিমদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। নওয়াব সলিমূল্লাহ সাধারণ মানুষের প্রতি খুবই দরদী ছিলেন।

নওয়াব সলিমুল্লহ অকাতরে দান করতেন এবং এতে তাঁর অর্থভাণ্ডারে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। শেষে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মহাজনদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল। ব্রিটিশ যুগে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। দেনার দায়ে সরকারের হেফাজতে এসেছিল তাঁর পারিবারিক হীরক খণ্ড ‘দরিয়া-এ নূর’ ও আরো ১০৯ প্রকার স্বর্ণালংকারসহ নওয়াবদের ভূসম্পদ। হীরা ও স্বর্ণালংকারগুলো এখন ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন রক্ষিত আছে সরকারি মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের স্থানীয় কার্যালয়ের ভল্টে।
সরকারের নথি থেকে জানা যায়, ঢাকার নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ আর্থিক সংকটে পড়লে ১৯০৮ সালে নবাব পরিবার ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ৩০ বছরে পরিশোধযোগ্য বার্ষিক ৩% সুদে ১৪ লাখ রুপি ঋণ গ্রহণ করে। ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক পত্রে বলা হয়, “ঢাকা নওয়াব স্টেটের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি যা ১৯০৮ সালের ৬ আগস্ট পূর্ববঙ্গ-আসাম সরকারের পক্ষে কমিশনার ঢাকা বিভাগ এবং নওয়াব সলিমুল্লাহ বাহাদুর সিএসআইয়ের মধ্যে সম্পাদিত বন্ধকী চুক্তি অনুসারে অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে পাঁচ লাখ রুপি মূল্যের ‘দরিয়া-এ নূর’ হীরক খণ্ড ও ১০৯ প্রকারের স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া যায়।”

ভূমি সংস্কার বোর্ডের নথিপত্র থেকে জানা যায়, ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় সম্পদগুলো ব্রিটিশ সরকার সেফ ডিপোজিট হিসেবে তৎকালীন স্টেট ব্যাংকে জমা রাখে, সেই ধারাবাহিকতায় এ সম্পদ বর্তমানে সোনালী ব্যাংকে জমা আছে। দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ভূমি সংস্কার বোর্ড।
সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক এমডি প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন এমন কোনো নথি সোনালী ব্যাংকে আমার সময় দেখিনি। তবে, নওয়াব পরিবারের অজনা কিছু অস্থাবর সম্পদ বাক্সবন্দি অবস্থায় সোনালী ব্যাংকে আছে সেফ ডিপোজিট হিসেবে;এটা ঋণের বিপরীতে বন্ধকী সম্পদ হিসেবে নয়। এর মধ্যে হীরক খণ্ড বা অন্য কী আছে সেটা ব্যাংকের জানার কথা নয়। কারণ সেফ ডিপোজিট 'আননোন কনন্টেট' হিসেবে থাকে।’ তিনি বলেন, ‘ঋণের বিষয়টি লিপিবদ্ধ থাকলে হয়তো ঋণমুক্তির প্রশ্ন আসত'।

এখানে একটি কথা বলে রাখি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছে তুমুলভাবে। তিনি তৎকালীন বড় লাট লর্ড কার্জনের কা‌ছে বিশ্ব‌বিদ্যালয় প্র‌তি‌ষ্ঠিত না করার জন্যও বলেছিলেন। এমনকি তিনি বঙ্গভ‌ঙ্গের বি‌রো‌ধিতা ক‌রে‌ছেন। কিন্তু আজ আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথে জন্মদিন মৃত্যুদিন খুবই জাঁকজমকের সাথে পালন করলেও, নওয়াব সলিমুল্লাহ-এর জন্মদিন তেমনভাবে পালন করি না।

রহস্যজনক মৃত্যুঃ
ঢাকার নওয়াব সলিমুল্লাহর পূর্ব পুরুষ ইংরেজদের দালালি করলেও নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে ততকালীন হিন্দু সমাজ এবং লাটের সাথে তার বাদানুবাদ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বড় লাট লর্ড কার্জনের সাথে নওয়াব সলিমুল্লাহর তীব্র বিতর্ক হয়। নওয়াব সলিমুল্লাহ সবসময় একটা ছড়ি নিয়ে ঘুরতেন। যখন বড়লাট রাজী হচ্ছেন না ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে; তখন, কথা কাটা কা‌টির এক পর্যায়ে তিনি রেগে গিয়ে ছড়ি দিয়ে বড়লাট লর্ড কার্জনের টেবিলে সজোরে আঘাত করেন এবং বড়লাটের দিকে এগিয়ে আসেন। তখন বড়লাটের হুকুমে বড়লাটের হিন্দু দেহরক্ষী নওয়াব সলিমুল্লাহকে গুলি করেন। পরে প্রচার করা হয় যে তিনি হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন।

মতান্তরে, কলকাতায় বৃটিশ ষড়যন্ত্রে তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় বলে জনশ্রুতি আছে। মৃত্যুর পর নদী পথে স্যার সলিমুল্লাহর লাশ সদরঘাট আনা হলেও কাউকে দেখতে দেওয়া হয়নি। এমকি তার স্ত্রী সন্তানকেও দেখতে দেওয়া হয়নি। বেগম বাজার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করার পর দীর্ঘ ৬ মাস যাবৎ বৃটিশ বাহিনী তার কবর ঘিরে পাহারা বসায়।
সাধারণ পাঠকরা তার মৃত্যুকে নিছকই মৃত্যু হিসেবেই জানে। কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষ্য-প্রমাণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে, সেটা ছিল একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বর্ণহিন্দুরা তাকে বারবার হত্যা করার চেষ্টা চালায়। হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে, গুলি করে। ইতিহাস গবেষক মরহুম সরকার শাহাবুদ্দিন আহমেদ তার 'আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল' প্রথম খণ্ড বইতে তথ্যভিত্তিক আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, বঙ্গভঙ্গ আইন বহাল রাখার দাবিতে কুমিল্লার এক জনসভায় খাজা সলিমুল্লাহর ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। পথিমধ্যে এক হিন্দুবাড়ি থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। ফলে জনসভা পণ্ড হয়ে যায়। নওয়াব বাহাদুর ঢাকা ফিরে আসেন। নওয়াব সলিমুল্লাহকে হত্যার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় অন্যপন্থা অবলম্বন করা হলো। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাঁধানো হলো। হিন্দুরা সশস্ত্র, মুসলমানরা নিরস্ত্র, তাই মুসলমান বেঘোরে প্রাণ হারাতে লাগল।

মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারী নওয়াব সলিমুল্লাহ মারা যান। তার ঘটনাবহুল জীবনে নওয়াব সলিমুল্লাহ সর্বভারতীয় পর্যায়ে যতটুকু প্রভাব ফেলতে পেরেছিলেন; তা তাঁর উত্তর ও পূর্বপুরুষদের কেউই পারেননি। তিনি নিজ জনগোষ্ঠী ও পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন। যে রাজনীতির সূচনা তিনি করেছিলেন, তা শিক্ষা বিস্তার আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছিল। তিনি একটি জনগোষ্ঠীকে অনগ্রসর বিবেচনা করে সেটির স্বার্থের কথা বলেছিলেন। তবে কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর অধিকারে আঘাত দেওয়ার পক্ষে তাঁর সমর্থন থাকার কথা জানা যায়নি।
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ১৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৯/০১/২০২৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

 
Quantcast