www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সিলেট ভ্রমণ

ভ্রমণপিপাসু আমরা বেশ কয়েকজন পরিবার-পরিজন এবং বন্ধু-বান্ধবসহ গত ২৮ অক্টোবর, ২০২১, বৃহস্পতিবার সিলেট দর্শনের উদ্দেশ্যে আনন্দভ্রমণে যাই। ইউনিক পরিবহনের ঢাকার ফকিরাপুল বাস কাউন্টার থেকে রাত ১২-৩০ মিনিটে বাসে করে যাত্রা শুরু করি। ইউনিক পরিবহন বাসটি নন-এসি হলেও, মোটামুটি আরামদায়ক এবং সার্ভিস ভালো ছিলো। দীর্ঘ সময় চলার পর রাত প্রায় ৩-০০ টায় আশুগঞ্জ পৌঁছি। রাস্তার পাশে বিশাল চত্বরসম্মৃদ্ধ রেস্ট্রুরেন্ট 'উজান-ভাটি'তে গাড়ি থামে। ২০ মিনিটের বিরতি পর যাত্রা শুরু হয় দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেটের উদ্দেশ্যে। বিস্তৃত শস্য-শ্যামল মাঠের বুক চিরে তৈরী করা আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে আমাদের বাস সকালে গিয়ে পৌঁছলো সিলেট শহরের জল্লারপাড়ের স্বনামধন্য পানসি রেস্টুরেন্টের সামনে। পানসীতে মুরগীর মাংসসহ খিচুরি দিয়ে নাস্তা গ্রহণ করি। অতঃপর, অনতিদূর জিন্দাবাজারস্থ বারুতখানা এলাকায় অবস্থিত হোটেল গ্রাণ্ড ভিউতে উঠি।

প্রাতঃকর্মাদি সমাপন এবং গোসল শেষে আমরা ১০-৩০ মিনিটে আবার বাসে জাফলং-এর উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করি। এবারের বাহন, 'সাদা পাথর পরিবহন' নামক মিনিবাস। জাফলং যাওয়ার পথে হযরত শাহ পরান (রঃ)-এর মাঝার। শাহ পরাণের মাজার সিলেট শহরের একটি পুণ্য তীর্থভূমি বা আধ্যাতিক স্থাপনা। বাংলাদেশে আসা ইসলাম ধর্ম প্রচারক হযরত শাহ জালাল (রঃ)-এর অন্যতম সঙ্গী শাহ পরাণের সমাধি। এটি সিলেট শহরের পূর্ব দিকে খাদিম নগর এলাকায় অবস্থিত। আমরা বাস থেকেই তা দেখলাম। বাসে কিছু অল্পবয়সী এবং আমোদি সহযাত্রী বাসের সিটে তাল তুলে গান গাচ্ছিলো। যদিও, কোন গানেরই সম্পূর্ণ লিরিক গাওয়া হচ্ছিলো না। যখন যেটা মনে পড়ে শুধুমাত্র আস্থায়িটা গাচ্ছিলো, আবার কখনোবা একটি অন্তরা। তবুও, আনন্দভ্রমণে তাদের এহেন উচ্ছ্বাসিত আবেগ আমাকেও ভালো লাগার আমেজ ছুঁয়ে গেলো। হঠাৎ একজন সহযাত্রী বলেন, গান থামাতে। এ এলাকায় কোন গান-বাজনা চলে না। এমনকি এ এলাকার কোন বাড়িতে নাকি টেলিভিশনও চলে না। সমাজের মাথারা এ নিয়ম চালু করেছেন। ঐ এলাকাটির নাম হরিপুর। হায়রে, হরিপুর! ধর্মের দোহাই দিয়ে এ সমাজকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে কতোদূর?

জাফলং যাওয়ার পথেই তামাবিল। সিলেটের সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলায় তামাবিল অবস্থিত। তামাবিল হচ্ছে সিলেট-শিলং সড়কের একটি সীমান্ত চৌকি। এটি বাংলাদেশ এবং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত। তামাবিল বাংলাদেশের একটি স্থলবন্দর। যা জাফলং যাবার পথের চার কিলোমিটার আগে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১২৭৫ নম্বর পিলারটি এখানে অবস্থিত। সীমান্ত-পিলারটিকে রং করে বাংলাদেশ ও ভারতে পতাকা এঁকে রাখা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশ-ভারতে মৈত্রী গেইট করা হয়েছে। ভারত থেকে ভারতীয় ট্রাকে করে সারিবদ্ধভাবে পাথর নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আমরা অনেকেই গাড়ি থেকে নামলাম। সীমান্ত রেখা পার হয়ে ভারতের মাটির উপর পা রেখে ছবিও তুললাম। এ স্থলবন্দর দেখার জন্য কয়েকজন ভারতীয় সপরিবারে আসেন। তাদের সাথে আমাদের সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে আলাপ-আলোচনা এবং কথা-বার্তা হয়। আমরা আবার বাসে করে উদ্দিষ্ট গন্তবস্থল জাফলং উদ্দেশ্য গাড়িতে উঠি।

জাফলং বাংলাদেশের প্রকৃতি কন্যা হিসাবে পরিচিত। খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে দৃষ্টিনন্দন। বাংলাদেশের সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকা জাফলং। এর অপর পাশে ভারতের ডাওকি অঞ্চল। মূলতঃ পিয়াইন নদীর অববাহিকায় জাফলং অবস্থিত। সিলেট জেলার জাফলং-তামাবিল অঞ্চলে রয়েছে পাহাড়ী উত্তলভঙ্গ। যদিও অধিকাংশ পাহাড়ী অঞ্চল ভারতের সীমানায় অবস্থিত। পাহাড় কেটে সিঁড়ি তৈরী করা হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে দীর্ঘপথ হেঁটে আমরা সমতলভূমি নামি। কঙ্করযুক্ত বালুময় পথের শেষে পাথর ছড়ানো কিছুটা পথ মাড়িয়ে পাহাড়ের পাদদেশ প্রবাহিত স্বচ্ছতোয়া নালার ন্যায় পিয়াইন নদীর বরফ-ঠাণ্ডা শীতল পানি। হাত দিয়ে ছোঁয়া মাত্র শরীরের অনুভূতিতে সুখময় শীতল আমেজ সৃষ্টি করে। কেউ কেউ ও রকম পরিস্কার ও ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে সতেজ হয়েছেন। কিন্তু নদীটি ভারতীয় এলাকায়। তাই, দেখলাম, একজন শিখ সম্প্রদায়ের (মুখে দাড়ি এবং মাথায় পাগড়ি দেখে অনুমান করলাম) বিএসএফ সদস্য হুইসেল বাজিয়ে হিন্দিতে বলছেন, দ্রুততার সাথে জল থেকে উঠে আসার জন্য। সিঁড়ি বেয়ে পাহারের উপর থেকে নামা যতোটা সহজ ছিলো, উঠার সময় ততটাই কঠিন ও কষ্টদায়ক মনে হলো। প্রায় ৩-০০ টা বেজে গেলো। দীর্ঘপথ ভ্রমণ, কঙ্করময় ও পাথুরে পথ পরিভ্রমণ এবং গোসলে পর খিদে নিয়ে সবাই ফিরে আসে। ৩-১৫ মিনিটে রাস্তার পাশে গাছগাছালিময় একটি স্থানে বাস থামিয়ে সকলকে প্যাকেট লাঞ্চ দেয়া হলো। ভাত-মুরগী-শবজি-ডিম। লাঞ্চের পর আমরা ৩-৩০ মিনিটে বাস ফিরে চললো।

আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা জৈন্তার লালাখাল এলাকায় পৌঁছলাম। লালাখাল নদীটি ভারতের চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখানে সংক্ষিপ্ত সময়ের একটি নৌকাভ্রমণ হয়। খালের ওপারে চা-বাগান। অনেকেই চা-বাগান ঘুরে দেখেছেন এবং ছবি তুলেছেন। নৌকাভ্রমণ শেষে মাগরিবের পর আমরা সকলেই বাসে উঠি এবং হোটেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। হোটেলে এসে ফ্রেশ হই। এমন সময় সিলেট বিমান বন্দর শাখার ডিজিএম মহোদয় (দুঃখিত নামখানা স্মরণে নেই) এসে গোলাপ ফুল ও আপেল দিয়ে আমাদেরকে সিলেটে ভ্রমণের জন্য স্বাগত ও অভিনন্দন জানান। রাতের খাবারের সাথে সাথে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আনন্দ ভোগ করি।

দ্বিতীয় দিন, ৩০ অক্টোবর, ২০২১। আমি ভোর ৬-০০ টায় রিক্সায় করে হয়রত শাহ জালাল (রঃ)-এর দরগাহ শরীফ জিয়ারত করতে যাই। হযরত শাহজালাল (জন্ম তুরস্কে, ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৩৪১ খ্রিস্টাব্দে) ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি দরবেশ। সিলেট অঞ্চলে তার মাধ্যমেই ইসলামের প্রসার ঘটে। কথিত আছে, সিলেটের প্রথম মুসলিম শেখ বুরহান উদ্দিনের ওপর রাজা গৌর গোবিন্দের অত্যাচারের প্রেক্ষিতে হযরত শাহ জালাল(র:) ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়াসহ সিলেটে আগমন করেন। সিলেট অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে তা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কিছুক্ষণ মাঝারের অন্যান্য দর্শণীয় স্থান- গজার মাছের পুকুর, কূপ (কথিত আছে, মক্কার কাবার জমজম কুপের সাথে এ কুপের সংযোগ আছে) এবং কবরস্থান ঘুরে দেখে ফিরে আসি হোটেলে। ৯-৩০ মিনিটে সকালের নাস্তা গ্রহণ করে আমরা রাতারগুলের উদ্দেশ্য 'সাদা পাথর পরিবহন' নামের বাসে করে রওয়ানা দেই।

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট হিসাবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। রাতারগুল জলাবন সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন। বর্ষাকালে এ জলাবন অপূর্ব সৌন্দর্য্যমণ্ডিত হয়ে উঠে। যেহেতু, আমরা শুকনোকালে গিয়েছি, তাই প্রকৃতির অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যভোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। চিরসবুজ এই বন গোয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত। গাছ-গাছালিময় গ্রাম্য আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে যাই। ছোট ছোট নৌকায় করে (এক নৌকায় ৬ জন) খাল বেয়ে রাতারগুল জলবনে পৌঁছি। ছায়াঘন পরিবেশে বেশ কিছুক্ষন ঘুরে বেড়াই। এখানেই ভ্রমণে অংশগ্রহণকারী নারী-পুরুষ ও শিশুদের বিভিন্ন প্রতিযোগীতামূলক খেলা ও দৌঁড় প্রতিযোগীতা আয়োজন করা হয়। অবশ্য, তখন আমি কিশোর বয়সে চলে গিয়ে বৈঠায় নৌকা চালাচ্ছিলাম রাতারগুলের অগভীর জলে।

১২-৩০ মিনিটে রাতারগুল থেকে যাত্রা শুরু করি ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরের উদ্দেশ্য। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর ভোলাগঞ্জ পৌঁছি। ২-০০ টার সময় বাসে বসেই প্যাকেট লাঞ্চ গ্রহণ করার পর নৌকাযোগে (প্রতি নৌকায় ৮ জন) ২০/২৫ মিনিটে সাদা পাথর এলাকায় যাই। কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ কোয়ারির জিরো পয়েন্টের ওপারে উঁচু পাহাড়ে ঘেরা সবুজের মায়াজাল। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার অশান্ত শীতল পানির অস্থির বেগে এসে মিশে যায় ধলাই নদীর বুকে। স্বচ্ছ নীল জল আর পাহাড়ের সবুজ মিলেমিশে একাকার। নদীর বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাথর নদীটির শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। সাদা পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ঝরনার পানির তীব্র স্রোতে নয়ন জুড়ায় আর শীতল জলের স্পর্শে প্রাণ জুড়িয়ে যায় নিমিষেই। যতদূর চোখ যায় দুইদিকে কেবল সাদা পাথর। মন চাইবে দুই হাতে জড়িয়ে প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করতে। যেন অপরূপ এক স্বর্গরাজ্য। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের ক্যানভাস। প্রবাহমান স্বচ্ছ ও শীতল পানির স্পর্শে অন্যরকম ভালো লাগার শিহরণ আনলো মনে। কেউ কেউ গোসল করলো, কেউ কেউ পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে ঠাণ্ডা পানির স্রোতকে উপভোগ করতে করতে হেঁটে ছোট নদী (পাহাড়ি ছড়া) পাড় হলো। অনেক ভ্রমণ পিপাসুদের কলরবে মুখরিত ছিলো সাদা পাথর এলাকা। বেলা ডোবার আগেই আমরা নৌকা করে ফিরে আসি ভোলাগঞ্জ।

অতঃপর, মাগরিবের শেষে ৬-০০ টায় রওনা দিলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। ঘণ্টাখানেক যাত্রার পর বাস থেকে নেমে হোটেল গ্রাণ্ড ভিউ-২ এর বলরুমে পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান এবং রেফেল ড্র সম্পাদন করা করা হয়। অতঃপর, হোটেল থেকে চেকআউট হয়ে পানসি রেস্ট্রুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি, তখন রাত ১০-৩৫ মিনিট।

টিএসবি কর্তৃক সিলেট ট্যুর প্রোগ্রামে আরও যে সকল দর্শনীয় স্থান দেখার কথা ছিলো সেখানে যাওয়া হয়নি। তার মাঝে, মঙ্গোলিয় টি-গার্ডেন, মায়াবী ঝর্ণা, বিছানাকান্দি, পান্থুমাই ইত্যাদি। তারপরেও, সবকিছু মিলে এবং সোনালী পরিবারের সকলের আনন্দমূখর এবং পরস্পর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সম্পর্কের মাঝে দীর্ঘসময় একসাথে কাটানোর সময়টা সত্যিই দারুণ ছিলো।

০৪/১১/২০২১
চর বাউশিয়া, গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৪৮৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৫/১১/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast