বই পরিচিতিঃ রক্তে ভেজা একাত্তর
বই এর নামঃ রক্তে ভেজা একাত্তর
বই এর ধরণঃ মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি, সম্মুখ সমরের স্মৃতিচারণ
লেখকের নামঃ মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম
প্রকাশকের নামঃ মফিদুল হক, সাহিত্য প্রকাশ, ৮৭, পুরানা পল্টন লাইন, ঢাকা-১০০০
প্রচ্ছদঃ অশোক কর্মকার
উৎসর্গঃ ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর প্রথম ব্যাটালিয়ন দি সিনিয়র টাইগার্স এর স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল সহযোদ্ধার উদ্দেশ্যে নিবেদিত
প্রথম প্রকাশঃ ফাল্গুন ১৪০৩, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭
দ্বিতীয় সংস্করণঃ ফাল্গুন ১৪১০, ফেব্রুয়ারী, ২০০৪
তৃতীয় সংস্করণঃ চৈত্র ১৪১৯, এপ্রিল ২০১৩
মূল্য: ২০০.০০ টাকা
লেখক পরিচিতিঃ
এক সময়ের দেশের ক্রীড়াঙ্গণের অতি পরিচিত মুখ মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম, যিনি মেজর হাফিজ নামেই সমধিক পরিচিত, ১৯৪৪ সালের ২৯শে অক্টোবর ভোলার লালমোহনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ অধ্যয়ন শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৬৮ সালে দ্য ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এ কমিশন লাভ করেন। তিনি ফুটবলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “ব্লু” ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের সদস্য নির্বাচিত হন এবং এর পরে পাকিস্তান জাতীয় দলের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এক সময় ঢাকা লীগে তিনি মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৮০ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারেও ভূষিত হন। তিনি ঢাকা ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি এবং এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের নির্বাচিত সহ সভাপতি ছিলেন। ভোলা-৩ আসন থেকে তিনি মোট ছয়বার বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। রাজনীতিক জীবনে তিনি পানিসম্পদ মন্ত্রীসহ অন্যান্য আরো কয়েকটি মন্ত্রকের মন্ত্রী হয়েছিলেন। তার পিতা ডা. আজহার উদ্দিন ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর পূর্বে তিনি প্রাদেশিক পরিষদেরও সদস্য ছিলেন। আব্দুল মালেক উকিল যখন প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী দলের নেতা, তার পিতা তখন উপনেতা ছিলেন। তার স্ত্রী দিলারা হাফিজ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা পরিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক।
আলোচনাঃ
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকজন সামরিক অফিসারের লেখা দিনলিপি তথা স্মৃতিকথা নিয়ে লিখিত বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম কর্তৃক রচিত “রক্তে ভেজা একাত্তর” এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করার মত একটা বই। এর মূল কারণ সম্ভবতঃ ঘটনাসমূহের আনুপূর্বিক বর্ণনা তিনি নির্মোহভাবে এবং বিশ্বস্ততার সাথে করেছেন এবং তা প্রাণবন্ত ভাষায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। বইটি পাঠকালে পাঠকগণ যুদ্ধক্ষেত্রের দামামা যেন নিজ কানে শুনতে পান। রণতূর্য, বিজয়োল্লাস, যুদ্ধাহতদের গগনবিদারী আর্তনাদ, সব কিছুই যেন বাস্তব হয়ে তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। লেখকের নিজের ভাষায়ঃ “ এ বইতে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনা সত্যি, এতে কোনপ্রকার রঙ চড়ানো হয় নি, নিজেকে জাহির করার চেষ্টাও করিনি”। বইটি পাঠ করার সময় বিবৃত ঘটনার পরম্পরা এবং সেই সাথে মাঝে মাঝে উল্লেখ করা লেখকের নিজস্ব মন্তব্যগুলো বিশ্লেষণকালে পাঠকগণ অতি সহজেই লেখকের উপরোক্ত ঘোষণার সাথে একাত্ম বোধ করেন। লেখক বলেছেন, “জনতার একজন হয়ে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি”। ইংরেজীতে একটা কথা আছে- “Fortune favours the brave”। আসলেই তিনি ভাগ্যবান, কারণ তিনি অদম্য সাহস, প্রজ্ঞা আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের বলে বলীয়ান হয়ে সঠিক সময়ে বিদ্রোহ করার সঠিক এবং সাহসী সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছিলেন। আর ঠিক একই কারণে তার অধিনায়ক লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিল ছিলেন একজন চরম অভাগা, কারণ বিদ্রোহ করার মত যথেষ্ট সাহস তিনি বুকে সঞ্চয় করতে পারেন নি। অথচ তিনি সঠিক সময়ে বিদ্রোহের সঠিক সিদ্ধান্তটি নিয়ে ১ ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নেতৃ্ত্ব দিতে পারলে বাংলাদেশের ইতিহাসে তার নাম আজ স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকতো। তার জন্য এটা চরম দূর্ভাগ্যজনক যে আজ তিনি আলোচিত হন সঙ্কটকালে ভয়ে সঙ্কোচে দোদুল্যমান একজন কাপুরুষ হিসেবে। ১ ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বাঙালী সদস্যদেরকে যখন অস্ত্রহীন (disarm) করার আদেশ এসেছিল, ঠিক তখনই বা তার কিছু আগে পরিস্থিতি আঁচ করে তিনি সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিলে বহু বাঙালী সৈনিক এবং অফিসার প্রাণে রক্ষা পেতেন এবং অবাঙালী অফিসারগণকে বন্দী করে আরো বেশী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করা যেত। অথচ তিনি ছিলেন “আমেরিকায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত দক্ষ অফিসার। রাশভারী, স্বল্পবাক, ক্যারীয়ার সচেতন”।
“গ্রামের নাম জগদীশপুর। ১৯৭১ সাল”। এই দুটি সংক্ষিপ্ত বাক্য দিয়ে বই এর শুরু। ক্রীড়ামোদী হাফিজ মূলতানে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী দলের সদস্য হিসেবে অংশ নিয়ে প্রতিযোগিতা শেষে নিজ ইউনিটের শীতকালীন প্রশিক্ষণ এলাকা যশোরের জগদীশপুরে যোগদান করেন। দেশের উত্তাল পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি মোটেই অবহিত ছিলেন না, কেবলমাত্র ১৬ মার্চ ৭১ তারিখে ঢাকা বিমান বন্দরে নেমেই তিনি পরিস্থিতি যে স্বাভাবিক নয়, তা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। ২৯ মার্চ ৭১ তারিখে হঠাৎ করে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে তার ইউনিটকে সেনানিবাসে ফেরত আসার নির্দেশ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ এলাকা থেকে সবাই পায়ে হেঁটে যশোর সেনানিবাসে ফেরত আসে। নিয়ম অনুযায়ী কোন প্রশিক্ষণ এলাকা থেকে সেনানিবাসে ফেরত আসার পরদিন যার যার অস্ত্র শস্ত্র পরিস্কার করার কথা। কিন্তু পরের দিন ৩০শে মার্চ ১ ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সৈনিকেরা অস্ত্র পরিস্কার করতে অস্ত্রাগারে গিয়ে জানতে পারে যে তাদেরকে অস্ত্রহীন করা হয়েছে এবং পাঞ্জাবি ব্রিগেড কমান্ডার প্রত্যুষে এসে অস্ত্রাগারের চাবি নিজেই নিয়ে গেছেন। তাদের পরিবর্তে ২৫ বালুচ রেজিমেন্টকে অস্ত্র দেয়া হবে। এই ঘটনায় ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধে অংশ নেয়া এবং প্রচুর বীরত্বসূচক খেতাবের অধিকারী ১ ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর গর্বিত সৈনিকরা অপমানিত বোধ করে এবং তাদের মধ্যে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। অচিরেই বিক্ষোভ থেকে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়, সৈনিকরা কারো আদেশের অপেক্ষা না করে অস্ত্রাগার ভেঙ্গে যার যার অস্ত্র নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। সুবেদার মজিদ লেখকের কাছে এসে বলেন, “.... স্যার, একটা কিছু করুন!” ‘কি করবো’? লেখকের এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “.... আমরা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি। বাঙালী অফিসার হিসেবে আপনি আমাদের নেতা। এখন এ যুদ্ধে আপনাকেই নেতৃত্ব নিতে হবে”। ‘আমি কেন, আমাদের কমান্ডিং অফিসার আছেন, তাঁর কাছে যান’- লেখকের পরামর্শ। “গিয়েছিলাম স্যার। ওনার বয়স হয়েছে। বিদ্রোহ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আমার অনুরোধ, আপনি আমাদের পরিচালনা করুন”।
এভাবেই ১ ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বিদ্রোহের সূচনা হয়। লেখক শেষবারের মত সিদ্ধান্তের জন্য অধিনায়কের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে হঠাৎ করে একজন পাঞ্জাবি অফিসার উপস্থিত হওয়ায় অধিনায়ক লেখককে কিছু একটা বলতে চেয়েও বলেন নি। তিনি নীরব থেকে যান। লেখক অগত্যা ফিরে আসেন অধিনায়কের অফিসের পেছনে ডোবার ধারে, ‘সেই আমবাগানে’। বাকীটা লেখকের ভাষায়ঃ “উপলব্ধি করলাম দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সারাদেশে কোথায় কী হচ্ছে কিছুই জানিনা। আমাদের বিদ্রোহকে দেশের জনগণ কিভাবে নেবে সে সম্পর্কেও কোন ধারণা নেই। শৃঙ্খ্লা রক্ষা করাই সৈনিক জীবনের মূল মন্ত্র। সেনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। মিনিটখানেক চিন্তা করে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম বিদ্রোহের পক্ষে। ... সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিলাম যুদ্ধ চলবে আমার নির্দেশে। ... সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা হলো, ফিরে এল শৃঙ্খ্লা। শুরু হলো এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের নতুন অধ্যায়”।
লেঃ আনোয়ার হচ্ছেন দ্বিতীয় বাঙালী অফিসার যিনি নির্দ্বিধায় লেখকের সাথে বিদ্রোহে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি প্রথম দিনেই, যশোর সেনানিবাস থেকে অকুতোভয়ে শত্রুপক্ষের গুলিবৃষ্টির মাঝ দিয়ে সৈনিকদের নিয়ে বের হবার সময় কোমরে মেশিনগানের একটি বার্স্টবিদ্ধ হন এবং প্রচুর রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে অকুস্থলেই শহীদ হন। সৈনিকরা তার মরদেহ বহন করে হযরতপুর গ্রামে নিয়ে আসে এবং সেখানে যশোর কুষ্টিয়া মহাসড়কের পাশে নজরুল ইসলাম কলেজের সামনে তাঁকে সমাহিত করা হয়। শিক্ষক পিতার প্রথম সন্তান, বুয়েটের (তখনকার EPUET) কৃতি এ্যাথলিট লেঃ আনোয়ার এর রক্তমাখা ওয়েব বেল্টটি যখন কেউ একজন লেখকের হাতে তুলে দিলেন, তখন তিনি ভীষণ বিষাদাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। নিজের বেল্টটি খুলে রেখে তিনি নীরবে শহীদের রক্তমাখা বেল্টটি পরে নিলেন এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যথোপযুক্ত প্রতিশোধ নেয়ার। পুনরায় লেখকের উদ্ধৃতিঃ “সবাই মিলে শপথ নিলাম বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে জনতার হয়ে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবো। আনোয়ার এবং অন্যান্য শহীদ সৈনিকরা তাদের অমূল্য জীবন দিয়ে যে সংগ্রামের সূচনা করেছে, তার সাফল্যের জন্য আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। ৩১ মার্চ তারিখে এভাবেই নবজন্ম লাভ করে প্রথম ব্যাটালিয়ন, দ্য ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট”।
সৌভাগ্যক্রমে, সে সময় পাকিস্তানের জাঁদরেল প্রশাশনিক ক্যাডার CSP এর তিনজন মেধাবী বাঙালী অফিসার বৃহত্তর যশোর অঞ্চলে একই সাথে মহকুমা প্রশাসক (SDO) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মেহেরপুরে ছিলেন তওফিক এলাহী, যিনি ১৭ এপ্রিল ৭১ তারিখে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (ঐ দিন থেকে মুজিবনগর) প্রথম স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্বে ছিলেন।ওয়ালী উল ইসলাম ছিলেন মাগুরার এসডিও এবং কামাল সিদ্দিকী ছিলেন নড়াইল এর এসডিও। এঁরা সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়া পাবনার জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের খান একজন সামরিক কর্মকর্তার মতই চৌকষভাবে প্রথম দিকের সামরিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেছিলেন। ঝিনাইদহের SDPO মাহবুবও তার ফোর্স নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বীর যোদ্ধারা শুধু যুদ্ধই করেন না, শত্রু হত্যাই তাদের একমাত্র কর্মযজ্ঞ নয়। তাদেরও একটা আবেগ প্রবণ মন আছে, যার পরিচয় পাওয়া যায় মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত লেখকের এসব কথায়ঃ “অনুষ্ঠানের পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর। মনে হচ্ছিল চলচ্চিত্রের কোন দৃশ্যপটের অভিনয় দেখছি। একটি জাতি, একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে, আমরা এ নাটকের কুশীলব। বসন্তের শেষ লগ্নে প্রকৃ্তি যেন তার নিজের হাতে আম্রকাননকে সাজিয়েছে, বাতাসে ভেসে আসছে ভেজা বাতাবী লেবুর সুঘ্রাণ। .... কমলা রঙের নরম রোদ সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে। কোকিলের ডাকও শুনতে পেলাম। পলাশীর আম্রকানন এখান থেকে বেশী দূরে নয়, দু’শতাধিক বছর পর মেহেরপুরের আরেক আম্রকাননে আজ আবার বাঙালীদের স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার সুযোগ পেয়ে আনন্দে, ভাবাবেগে বিহ্বল হয়ে পড়ি”।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক ভারতীয় সামরিক অফিসার এবং জওয়ানদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এবং নীরব নৈতিক সমর্থন ছিল। তাদের মধ্যে যেমন ছিলেন এ দেশে নাড়ী পোতা বাঙালী, যেমন ৭২ বিএসএফ এর কমান্ডার মুখার্জী (আদি নিবাস ফরিদপুর জেলায়), ভারতীয় সাঁজোয়া বাহিনীর ব্রিগেড মেজর শঙ্কর রায় চৌধুরী (পরবর্তীতে জেনারেল, ভারতীয় সেনা প্রধান) বা সিগন্যালস কোরের লেঃ কর্নেল রায়, তেমনি ছিলেন অবাঙালী, রাজস্থানে জন্ম নেয়া ভারতীয় “স্পেশাল ফোর্সেস” এর জনক লেঃ কর্নেল মেঘ সিং, ৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য যিনি ‘বীরচক্র’ (VC) পদক লাভ করেছিলেন। এই মেঘ সিং মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত হয়েছিলেন। তার প্রসঙ্গ যতবারই এসেছে, ততবারই তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক এবং সাহায্যকারী। প্রবল গোলা বর্ষণের মাঝেও তিনি কখনো জীপ চালিয়ে কখনো পায়ে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতেন শুধু বাঙালীদেরকে সাহস যোগানোর জন্যই নয়, তাদেরকে যথাসম্ভব অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি দিয়ে সাহায্য করতে এবং যুদ্ধাহতদেরকে তাঁর সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে। তিনি নিজ উদ্যোগে পেট্রাপোলে তাঁর দপ্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা সেখানে পরিদর্শনে আসেন এবং লেখককে তার বেনাপোল রক্ষণব্যুহ থেকে পেট্রাপোলে ডেকে নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধের তৎপরতায় ইতি টেনে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ শুরুর পরামর্শ দেন। জেনারেলের এই বক্তব্য শুনে লেখক যেমন একটু ইতস্ততঃ করছিলেন, মেঘ সিং এরও তেমনি তা পছন্দ হয়নি। লেখকের ভাষায়ঃ “(মেঘ সিং) স্যালুট করে ফ্ল্যাগস্টান্ডে উড্ডীয়মান বাংলাদেশের সবুজ পতাকাটি দেখিয়ে পরিষ্কার ইংরেজীতে জেনারেল অরোরাকে বললেন, ‘স্যার, আমি মুক্তিবাহিনীর এ অফিসারটিকে কথা দিয়েছি যে এই পতাকাটিকে আমার মৃতদেহের ওপর দিয়েই কেবল নীচে নামানো সম্ভব (This flag will come down only over my dead body)’”। লেঃ জেনারেলের সামনে লেঃ কর্নেলের এ মন্তব্য ঔদ্ধত্যের সামিল হলেও জেনারেল অরোরা কৌ্তুকভরে পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিলেন।
এ বই পড়ে পাঠক জানতে পারেন, পরাধীনতার শেকল ভাংগার এবং স্বাধীনতা অর্জনের নেশা যখন একটা জাতিকে পেয়ে বসে, তখন কিভাবে ধর্ম গোত্র নির্বিশেষে জাতির আবালবৃদ্ধবণিতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অসম সাহসী বীর যোদ্ধায় পরিণত হয়ে যায়। চৌগাছার, কুষ্টিয়ার, বেনাপোলের বীর জনগণ, মহেশপুরের ট্রাক্টর চালক আলী মিয়া, নাভারনের বার বছরের কিশোর তোতা মিয়া, যার পিতামাতাকে চোখের সামনে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করেছিল, এদের সবার কাহিনীই যেন একেকটা বীরত্বগাঁথা। ১ ইস্ট বেঙ্গলের ড্রাইভার কালা মিয়াকে অপর দুইজন চালকসহ লেখক কোটচাঁদপুরে পাঠিয়েছিলেন কয়েকটা জীপ আর বাস সংগ্রহ করে নিয়ে আসার জন্য। ওরা পথিমধ্যে খবর পেল যে পাক সেনাদের একটা কনভয় যশোর থেকে কালীগঞ্জ পৌঁছবে সেদিনই বিকেলে। মুহূর্তেই এই তিন ড্রাইভার যোদ্ধায় পরিণত হয়ে গেল। ওরা কোটচাঁদপুর থেকে দশজন রাইফেলধারী মুজাহিদ সংগ্রহ করে কালা মিয়ার নেতৃত্বে যশোর-কালীগঞ্জ সড়কে একটি পানের বরজের কাছে অ্যাম্বুশ (ফাঁদ) পাতে। কনভয় রেঞ্জের মধ্যে আসা মাত্র তাদের অস্ত্র গর্জে ওঠে। দুঃসাহসী যোদ্ধা কালা মিয়ার ছোঁড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণে পাক বাহিনীর মোট চারটি গাড়ী ভস্মীভূত হয় এবং এ অভিযানে মোট দশজন শত্রুসেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। তবে কালা মিয়াও এক সময় বুকে এলএমজি বার্স্ট বিদ্ধ হয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণে শহীদ হয়।
ইপিআর জওয়ানেরা সবসময় মান্ধাতার আমলের .৩০৩ রাইফেল ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। গোলন্দাজ সাপোর্টযুক্ত কনভেনশনাল যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাদের কখনো ছিলনা। বেনাপোলের সম্মুখবর্তী সেই ইপিআর অবস্থানের উপর যখন মুহুর্মুহু পাকিস্তানী কামানের গোলা এসে পড়ছিল, তখন সৈনিকেরা শেল-শকড হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছিল, কিন্তু ইপিআর হাবিলদার মুজিব চীৎকার করে সহযোদ্ধাদের সাহস যোগাচ্ছিলেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বীরত্বের সাথে লড়াই করে তিনি ট্রেঞ্চের মধ্যেই শহীদ হন। যদিও তারা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক আক্রমণকারীদেরকে বেশীক্ষণ প্রতিহত করতে পারেনি, তথাপি তাদের মরণপণ লড়াই এর ফলে শত্রুপক্ষের অন্ততঃ পঞ্চাশজন নিহত হয়। নিখাদ দেশপ্রেম ছাড়া এমন সাহস এমনি এমনি আসে না। সুবেদার আফতাব নামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জনৈক জেসিও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায় থেকে রৌমারী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে বিশাল এক এলাকা জুড়ে স্বাধীনভাবে সামরিক তৎপরতা চালাতে থাকেন। তার সম্পর্কে লেখকের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করিঃ “পরিস্থিতি অনেক ন্যাচারাল লীডার তৈরী করে, এ সাহসী সৈনিক তার এক বাস্তব উদাহরণ”।
১২ নং অধ্যায়টি পুরো বই এর মধ্যে সবচেয়ে লোমহর্ষক এবং বিষাদময়। শেরপুর জেলার কামালপুর বিওপি সরাসরি আক্রমণ করতে গিয়ে জান মালের সবচেয়ে বেশী ক্ষয়ক্ষতি হয়, ৩০ জন নিহত, ৬৬ জন আহত। নিহতদের মধ্যে ডেল্টা কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজও ছিলেন। তুমুল গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে শত্রু বাঙ্কারের সামনে থেকে তার লাশ উদ্ধার করার জন্য সৈনিক হায়াত আলী ও সিরাজ স্বেচ্ছায় জীবন বিসর্জন দেন। তবে তার লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, আরো অনেকের মত। লেখক নিজেও এ অভিযানে আহত হয়েছিলেন। এ্যাটাকিং ফোর্স কমান্ডারের সাথে সময় সমন্বয় ছাড়াই ভারতীয় আর্টিলারীর প্রি এইচ আওয়ার বোম্বার্ডমেন্ট শুরু হলে এ্যাটাকিং ফোর্স এর সারপ্রাইজ লস্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া একটি গোলাও শত্রু অবস্থানে পড়েনি, সবই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। মনটা খারাপ হয়ে যায় যখন জানতে পারি ঘাসীপুর রক্ষণব্যুহে নিহত সুবেদার মোজাম্মেলের ডায়েরীতে লেখকের উদ্দেশ্যে লেখা একটা চিরকুট পাওয়া যায়। তার শেষ অনুরোধ, তিনি মৃত্যুবরণ করলে লেখক যেন তার দৌলতখানের বাড়ীতে খবরটা পৌঁছে দেন। চারদিকে জঙ্গল বেষ্টিত একটা অসমতল মাঠে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় অস্ত্র পাশে রেখে ঈদুল ফিতরের মোনাজাতের পর কোলাকুলির সময় যখন সকল যোদ্ধাদের সমবেত সশব্দ ক্রন্দন শুরু হয়, সে দৃশ্য কল্পনা করেও মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। বিপদসঙ্কুল বর্তমান আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়ানো এসব যোদ্ধারা মারণাস্ত্রের ছোবলের মুখে নির্বিকার ও শঙ্কাহীন থাকতে পেরেছিল, কিন্তু পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনে মাতৃভূমিতে শত্রুবেষ্টিত প্রিয়জনদের কথা ভেবে অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। এতদিন তো তাদের কথা ভাবারও সময় তারা পায়নি। অবসরে এদের কেউ কেউ এসে লেখককে প্রশ্ন করতো, স্যার, দেশ কি আমাদের কথা মনে রাখবে? লেখক নিজেও বই এর কয়েকটি জায়গায় স্বগতোক্তি করেছেনঃ এরা নিজেদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছেন জাতির ভবিষ্যতের জন্যে। জাতি কি এদের কথা মনে রাখবে?
যুদ্ধের সময় অনেক নিরীহ মানুষও মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হয়ে থাকে। এমনই হয়েছিলেন তৎকালীন চুয়াডাঙ্গার মহকুমা প্রশাসক দম্পতি। লেখকের ভাষায়ঃ “এসডিও সাহেব এবং তার নব পরিণীতা স্ত্রী উভয়েই পাঞ্জাবি। মারমুখী জনতার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের দু’জনকে কয়েকদিন আগে হাজতে এনে রাখা হয়েছে। নবদম্পতির শয়নকক্ষে সুকোমল বিছানায় শুয়ে আমাদের চোখে ঘুম আসছিল না। তাদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মধুময় দাম্পত্য জীবনের ঊষালগ্নে তাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছে। তওফিক (মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক) মৃদুস্বরে জানালো, ভাই নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। এ বাসার গৃহকর্তা ছিলেন আমার বন্ধু। কতদিন এই দম্পতির আতিথেয়তা উপভোগ করেছি, আজ তাদের বাঁচিয়ে রাখাই মুশকিল। উন্মত্ত জনতা তাদের হত্যা করার জন্য হাজত ভেঙে ফেলতে চাইছে। অবশেষে একমত হ’লাম যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের দুস্তর বন্ধুর পথে অনেক বলিদান নিয়তির অমোঘ বিধান, এদের কেউ কেউ ঘটনার নির্দোষ শিকার মাত্র”। ইঙ্গিতপূর্ণ শেষ বাক্যটি, বিশেষ করে ‘নির্দোষ শিকার মাত্র’ শব্দ তিনটি মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। হায়, যুদ্ধ কতটা অন্ধ ও নির্মম হতে পারে!
স্বল্প পরিসরে হলেও বইটাতে কন্ঠ শিল্পী, শব্দ শিল্পী এবং খেলোয়াড়দের স্বতঃস্ফূর্ত অবদানের কথা উল্লেখ আছে দেখে খুশী হয়েছি। জাকারিয়া পিন্টুর অধীনে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল জায়গায় জায়গায় প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলে সংগৃহীত অর্থ অকাতরে সরকারের কল্যান তহবিলে দান করেছিলেন। কন্ঠ শিল্পী ও শব্দ শিল্পীরাও শরনার্থী শিবিরগুলোতে এবং মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে তাদের মনোবল উজ্জীবিত করতেন। তাছাড়া এঁরা অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিয়মিতভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান প্রচার করে মুক্তিযোদ্ধাদের তথা দেশবাসীর মনোবল চাঙ্গা রাখতেন। এম আর আখতারের “চরমপত্র” এর উল্লেখ না থাকলে বইটি অসম্পূর্ণ থেকে যেত, কেননা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা এবং সমগ্র দেশবাসী তাঁর এই অনুষ্ঠানটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতো এবং তা শোনার পর তারা নতুন উদ্যম, উচ্ছ্বাস আর সাহসে বলীয়ান হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিসটিক্স বিভাগের তৎকালীন শিক্ষক মাহমুদুর রহমান বেনু’র লেখকের ব্যাটালিয়নে ভর্তি হবার তথ্যটি বেশ চমকপ্রদ। আরো চমকপ্রদ যুদ্ধ চলাকালীন তার কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে দেশে এসে তার তৎকালীন প্রেমিকা নজরুল সঙ্গীত শিল্পী শাহীনকে (আজকের প্রখ্যাত শিল্পী শাহীন সামাদ, যিনি তখন বেনুকে বিয়ে করে শাহীন মাহমুদ নামে পরিচিত হয়েছিলেন) ‘গেরিলা কায়দায়’ বিয়ে করে সুকৌশলে কোলকাতায় নিয়ে আসার তথ্যটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদুর রহমান বেনুকে যখন প্রশিক্ষণের জন্য লেখক তার পাইওনিয়ার প্লাটুনে সংযুক্ত করলেন, যাদের কাজ বিস্ফোরক ব্যবহার, মাইন বিছানো, পুল ওড়ানো, ইত্যাদি, তখন তিনি স্বল্প শিক্ষিত সৈনিকদের সাথে একাত্ম হয়ে বেশ আন্তরিকতার সাথে কাজ শুরু করেছিলেন। তার সম্পর্কে লেখকের সাথে পাইওনিয়ার প্লাটুনের কমান্ডার হাবিলদার তাজুল ইসলামের একদিনের কথোপকথন এখানে তুলে ধরছিঃ “স্যার, নতুন দুই রিক্রুট (বেনু’র সাথে নাট্য জগতের তার এক বন্ধুও যোগ দিয়েছিলেন) নাকি আপনার বন্ধু? ... আর বেনু সাহেব নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক? ওনাকে অর্ডার দিতে শরম লাগে, কড়া কথাও বলতে পারিনা। ... স্যার, ওনাদের কষ্ট দেখে মায়া লাগে, তবে শেখার খুব আগ্রহ ওনাদের”।
লেখক বলেছেন, “এটি আমার প্রথম বই। তাড়াহুড়ো করে লিখেছি, সহৃদয় পাঠক ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন বলে আশা রাখি”। লেখককে আমি বলবো, যেমনই লিখুন, যেভাবেই লিখে থাকুন, আপনার এ বই স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় এক অমূল্য অবদান। ‘আজি হতে শত বর্ষ পরে’ যারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবে, তারা এ বই পড়তে পড়তে রোমাঞ্চিত, শিহরিত এবং গর্বিত বোধ করবে আপনার মত আরো অসংখ্য বীর বাঙালীর শৌর্য বীর্য আর দেশমাতৃকার জন্য আপনাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কথা ভেবে। সেই সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্মুখ সমরে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে এখনো যারা তাদের স্মৃতিকথা বা যুদ্ধের বয়ান লিখেন নি, তাদের প্রতি একটা অনুরোধ রাখছি। আপনারা যাই পারুন, যতটুকুই এখনো মনে আছে, সেসব লিখে যান। আপনাদের উত্তরসূরীরা এসব পড়ে একদিন গর্ব বোধ করবে।
(চেষ্টা করেও বইটির প্রচ্ছদের ছবিটা এখানে সংযোজন করতে পারলাম না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত)
ঢাকা
১০ এপ্রিল ২০১৭
বই এর ধরণঃ মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি, সম্মুখ সমরের স্মৃতিচারণ
লেখকের নামঃ মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম
প্রকাশকের নামঃ মফিদুল হক, সাহিত্য প্রকাশ, ৮৭, পুরানা পল্টন লাইন, ঢাকা-১০০০
প্রচ্ছদঃ অশোক কর্মকার
উৎসর্গঃ ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর প্রথম ব্যাটালিয়ন দি সিনিয়র টাইগার্স এর স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল সহযোদ্ধার উদ্দেশ্যে নিবেদিত
প্রথম প্রকাশঃ ফাল্গুন ১৪০৩, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭
দ্বিতীয় সংস্করণঃ ফাল্গুন ১৪১০, ফেব্রুয়ারী, ২০০৪
তৃতীয় সংস্করণঃ চৈত্র ১৪১৯, এপ্রিল ২০১৩
মূল্য: ২০০.০০ টাকা
লেখক পরিচিতিঃ
এক সময়ের দেশের ক্রীড়াঙ্গণের অতি পরিচিত মুখ মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম, যিনি মেজর হাফিজ নামেই সমধিক পরিচিত, ১৯৪৪ সালের ২৯শে অক্টোবর ভোলার লালমোহনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ অধ্যয়ন শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৬৮ সালে দ্য ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এ কমিশন লাভ করেন। তিনি ফুটবলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “ব্লু” ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের সদস্য নির্বাচিত হন এবং এর পরে পাকিস্তান জাতীয় দলের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এক সময় ঢাকা লীগে তিনি মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৮০ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারেও ভূষিত হন। তিনি ঢাকা ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি এবং এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের নির্বাচিত সহ সভাপতি ছিলেন। ভোলা-৩ আসন থেকে তিনি মোট ছয়বার বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। রাজনীতিক জীবনে তিনি পানিসম্পদ মন্ত্রীসহ অন্যান্য আরো কয়েকটি মন্ত্রকের মন্ত্রী হয়েছিলেন। তার পিতা ডা. আজহার উদ্দিন ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর পূর্বে তিনি প্রাদেশিক পরিষদেরও সদস্য ছিলেন। আব্দুল মালেক উকিল যখন প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী দলের নেতা, তার পিতা তখন উপনেতা ছিলেন। তার স্ত্রী দিলারা হাফিজ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা পরিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক।
আলোচনাঃ
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকজন সামরিক অফিসারের লেখা দিনলিপি তথা স্মৃতিকথা নিয়ে লিখিত বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম কর্তৃক রচিত “রক্তে ভেজা একাত্তর” এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করার মত একটা বই। এর মূল কারণ সম্ভবতঃ ঘটনাসমূহের আনুপূর্বিক বর্ণনা তিনি নির্মোহভাবে এবং বিশ্বস্ততার সাথে করেছেন এবং তা প্রাণবন্ত ভাষায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। বইটি পাঠকালে পাঠকগণ যুদ্ধক্ষেত্রের দামামা যেন নিজ কানে শুনতে পান। রণতূর্য, বিজয়োল্লাস, যুদ্ধাহতদের গগনবিদারী আর্তনাদ, সব কিছুই যেন বাস্তব হয়ে তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। লেখকের নিজের ভাষায়ঃ “ এ বইতে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনা সত্যি, এতে কোনপ্রকার রঙ চড়ানো হয় নি, নিজেকে জাহির করার চেষ্টাও করিনি”। বইটি পাঠ করার সময় বিবৃত ঘটনার পরম্পরা এবং সেই সাথে মাঝে মাঝে উল্লেখ করা লেখকের নিজস্ব মন্তব্যগুলো বিশ্লেষণকালে পাঠকগণ অতি সহজেই লেখকের উপরোক্ত ঘোষণার সাথে একাত্ম বোধ করেন। লেখক বলেছেন, “জনতার একজন হয়ে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি”। ইংরেজীতে একটা কথা আছে- “Fortune favours the brave”। আসলেই তিনি ভাগ্যবান, কারণ তিনি অদম্য সাহস, প্রজ্ঞা আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের বলে বলীয়ান হয়ে সঠিক সময়ে বিদ্রোহ করার সঠিক এবং সাহসী সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছিলেন। আর ঠিক একই কারণে তার অধিনায়ক লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিল ছিলেন একজন চরম অভাগা, কারণ বিদ্রোহ করার মত যথেষ্ট সাহস তিনি বুকে সঞ্চয় করতে পারেন নি। অথচ তিনি সঠিক সময়ে বিদ্রোহের সঠিক সিদ্ধান্তটি নিয়ে ১ ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নেতৃ্ত্ব দিতে পারলে বাংলাদেশের ইতিহাসে তার নাম আজ স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকতো। তার জন্য এটা চরম দূর্ভাগ্যজনক যে আজ তিনি আলোচিত হন সঙ্কটকালে ভয়ে সঙ্কোচে দোদুল্যমান একজন কাপুরুষ হিসেবে। ১ ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বাঙালী সদস্যদেরকে যখন অস্ত্রহীন (disarm) করার আদেশ এসেছিল, ঠিক তখনই বা তার কিছু আগে পরিস্থিতি আঁচ করে তিনি সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিলে বহু বাঙালী সৈনিক এবং অফিসার প্রাণে রক্ষা পেতেন এবং অবাঙালী অফিসারগণকে বন্দী করে আরো বেশী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করা যেত। অথচ তিনি ছিলেন “আমেরিকায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত দক্ষ অফিসার। রাশভারী, স্বল্পবাক, ক্যারীয়ার সচেতন”।
“গ্রামের নাম জগদীশপুর। ১৯৭১ সাল”। এই দুটি সংক্ষিপ্ত বাক্য দিয়ে বই এর শুরু। ক্রীড়ামোদী হাফিজ মূলতানে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী দলের সদস্য হিসেবে অংশ নিয়ে প্রতিযোগিতা শেষে নিজ ইউনিটের শীতকালীন প্রশিক্ষণ এলাকা যশোরের জগদীশপুরে যোগদান করেন। দেশের উত্তাল পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি মোটেই অবহিত ছিলেন না, কেবলমাত্র ১৬ মার্চ ৭১ তারিখে ঢাকা বিমান বন্দরে নেমেই তিনি পরিস্থিতি যে স্বাভাবিক নয়, তা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। ২৯ মার্চ ৭১ তারিখে হঠাৎ করে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে তার ইউনিটকে সেনানিবাসে ফেরত আসার নির্দেশ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ এলাকা থেকে সবাই পায়ে হেঁটে যশোর সেনানিবাসে ফেরত আসে। নিয়ম অনুযায়ী কোন প্রশিক্ষণ এলাকা থেকে সেনানিবাসে ফেরত আসার পরদিন যার যার অস্ত্র শস্ত্র পরিস্কার করার কথা। কিন্তু পরের দিন ৩০শে মার্চ ১ ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সৈনিকেরা অস্ত্র পরিস্কার করতে অস্ত্রাগারে গিয়ে জানতে পারে যে তাদেরকে অস্ত্রহীন করা হয়েছে এবং পাঞ্জাবি ব্রিগেড কমান্ডার প্রত্যুষে এসে অস্ত্রাগারের চাবি নিজেই নিয়ে গেছেন। তাদের পরিবর্তে ২৫ বালুচ রেজিমেন্টকে অস্ত্র দেয়া হবে। এই ঘটনায় ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধে অংশ নেয়া এবং প্রচুর বীরত্বসূচক খেতাবের অধিকারী ১ ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর গর্বিত সৈনিকরা অপমানিত বোধ করে এবং তাদের মধ্যে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। অচিরেই বিক্ষোভ থেকে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়, সৈনিকরা কারো আদেশের অপেক্ষা না করে অস্ত্রাগার ভেঙ্গে যার যার অস্ত্র নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। সুবেদার মজিদ লেখকের কাছে এসে বলেন, “.... স্যার, একটা কিছু করুন!” ‘কি করবো’? লেখকের এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “.... আমরা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি। বাঙালী অফিসার হিসেবে আপনি আমাদের নেতা। এখন এ যুদ্ধে আপনাকেই নেতৃত্ব নিতে হবে”। ‘আমি কেন, আমাদের কমান্ডিং অফিসার আছেন, তাঁর কাছে যান’- লেখকের পরামর্শ। “গিয়েছিলাম স্যার। ওনার বয়স হয়েছে। বিদ্রোহ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আমার অনুরোধ, আপনি আমাদের পরিচালনা করুন”।
এভাবেই ১ ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বিদ্রোহের সূচনা হয়। লেখক শেষবারের মত সিদ্ধান্তের জন্য অধিনায়কের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে হঠাৎ করে একজন পাঞ্জাবি অফিসার উপস্থিত হওয়ায় অধিনায়ক লেখককে কিছু একটা বলতে চেয়েও বলেন নি। তিনি নীরব থেকে যান। লেখক অগত্যা ফিরে আসেন অধিনায়কের অফিসের পেছনে ডোবার ধারে, ‘সেই আমবাগানে’। বাকীটা লেখকের ভাষায়ঃ “উপলব্ধি করলাম দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সারাদেশে কোথায় কী হচ্ছে কিছুই জানিনা। আমাদের বিদ্রোহকে দেশের জনগণ কিভাবে নেবে সে সম্পর্কেও কোন ধারণা নেই। শৃঙ্খ্লা রক্ষা করাই সৈনিক জীবনের মূল মন্ত্র। সেনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। মিনিটখানেক চিন্তা করে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম বিদ্রোহের পক্ষে। ... সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিলাম যুদ্ধ চলবে আমার নির্দেশে। ... সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা হলো, ফিরে এল শৃঙ্খ্লা। শুরু হলো এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের নতুন অধ্যায়”।
লেঃ আনোয়ার হচ্ছেন দ্বিতীয় বাঙালী অফিসার যিনি নির্দ্বিধায় লেখকের সাথে বিদ্রোহে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি প্রথম দিনেই, যশোর সেনানিবাস থেকে অকুতোভয়ে শত্রুপক্ষের গুলিবৃষ্টির মাঝ দিয়ে সৈনিকদের নিয়ে বের হবার সময় কোমরে মেশিনগানের একটি বার্স্টবিদ্ধ হন এবং প্রচুর রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে অকুস্থলেই শহীদ হন। সৈনিকরা তার মরদেহ বহন করে হযরতপুর গ্রামে নিয়ে আসে এবং সেখানে যশোর কুষ্টিয়া মহাসড়কের পাশে নজরুল ইসলাম কলেজের সামনে তাঁকে সমাহিত করা হয়। শিক্ষক পিতার প্রথম সন্তান, বুয়েটের (তখনকার EPUET) কৃতি এ্যাথলিট লেঃ আনোয়ার এর রক্তমাখা ওয়েব বেল্টটি যখন কেউ একজন লেখকের হাতে তুলে দিলেন, তখন তিনি ভীষণ বিষাদাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। নিজের বেল্টটি খুলে রেখে তিনি নীরবে শহীদের রক্তমাখা বেল্টটি পরে নিলেন এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যথোপযুক্ত প্রতিশোধ নেয়ার। পুনরায় লেখকের উদ্ধৃতিঃ “সবাই মিলে শপথ নিলাম বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে জনতার হয়ে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবো। আনোয়ার এবং অন্যান্য শহীদ সৈনিকরা তাদের অমূল্য জীবন দিয়ে যে সংগ্রামের সূচনা করেছে, তার সাফল্যের জন্য আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। ৩১ মার্চ তারিখে এভাবেই নবজন্ম লাভ করে প্রথম ব্যাটালিয়ন, দ্য ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট”।
সৌভাগ্যক্রমে, সে সময় পাকিস্তানের জাঁদরেল প্রশাশনিক ক্যাডার CSP এর তিনজন মেধাবী বাঙালী অফিসার বৃহত্তর যশোর অঞ্চলে একই সাথে মহকুমা প্রশাসক (SDO) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মেহেরপুরে ছিলেন তওফিক এলাহী, যিনি ১৭ এপ্রিল ৭১ তারিখে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (ঐ দিন থেকে মুজিবনগর) প্রথম স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্বে ছিলেন।ওয়ালী উল ইসলাম ছিলেন মাগুরার এসডিও এবং কামাল সিদ্দিকী ছিলেন নড়াইল এর এসডিও। এঁরা সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়া পাবনার জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের খান একজন সামরিক কর্মকর্তার মতই চৌকষভাবে প্রথম দিকের সামরিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেছিলেন। ঝিনাইদহের SDPO মাহবুবও তার ফোর্স নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বীর যোদ্ধারা শুধু যুদ্ধই করেন না, শত্রু হত্যাই তাদের একমাত্র কর্মযজ্ঞ নয়। তাদেরও একটা আবেগ প্রবণ মন আছে, যার পরিচয় পাওয়া যায় মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত লেখকের এসব কথায়ঃ “অনুষ্ঠানের পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর। মনে হচ্ছিল চলচ্চিত্রের কোন দৃশ্যপটের অভিনয় দেখছি। একটি জাতি, একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে, আমরা এ নাটকের কুশীলব। বসন্তের শেষ লগ্নে প্রকৃ্তি যেন তার নিজের হাতে আম্রকাননকে সাজিয়েছে, বাতাসে ভেসে আসছে ভেজা বাতাবী লেবুর সুঘ্রাণ। .... কমলা রঙের নরম রোদ সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে। কোকিলের ডাকও শুনতে পেলাম। পলাশীর আম্রকানন এখান থেকে বেশী দূরে নয়, দু’শতাধিক বছর পর মেহেরপুরের আরেক আম্রকাননে আজ আবার বাঙালীদের স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার সুযোগ পেয়ে আনন্দে, ভাবাবেগে বিহ্বল হয়ে পড়ি”।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক ভারতীয় সামরিক অফিসার এবং জওয়ানদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এবং নীরব নৈতিক সমর্থন ছিল। তাদের মধ্যে যেমন ছিলেন এ দেশে নাড়ী পোতা বাঙালী, যেমন ৭২ বিএসএফ এর কমান্ডার মুখার্জী (আদি নিবাস ফরিদপুর জেলায়), ভারতীয় সাঁজোয়া বাহিনীর ব্রিগেড মেজর শঙ্কর রায় চৌধুরী (পরবর্তীতে জেনারেল, ভারতীয় সেনা প্রধান) বা সিগন্যালস কোরের লেঃ কর্নেল রায়, তেমনি ছিলেন অবাঙালী, রাজস্থানে জন্ম নেয়া ভারতীয় “স্পেশাল ফোর্সেস” এর জনক লেঃ কর্নেল মেঘ সিং, ৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য যিনি ‘বীরচক্র’ (VC) পদক লাভ করেছিলেন। এই মেঘ সিং মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত হয়েছিলেন। তার প্রসঙ্গ যতবারই এসেছে, ততবারই তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক এবং সাহায্যকারী। প্রবল গোলা বর্ষণের মাঝেও তিনি কখনো জীপ চালিয়ে কখনো পায়ে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতেন শুধু বাঙালীদেরকে সাহস যোগানোর জন্যই নয়, তাদেরকে যথাসম্ভব অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি দিয়ে সাহায্য করতে এবং যুদ্ধাহতদেরকে তাঁর সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে। তিনি নিজ উদ্যোগে পেট্রাপোলে তাঁর দপ্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা সেখানে পরিদর্শনে আসেন এবং লেখককে তার বেনাপোল রক্ষণব্যুহ থেকে পেট্রাপোলে ডেকে নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধের তৎপরতায় ইতি টেনে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ শুরুর পরামর্শ দেন। জেনারেলের এই বক্তব্য শুনে লেখক যেমন একটু ইতস্ততঃ করছিলেন, মেঘ সিং এরও তেমনি তা পছন্দ হয়নি। লেখকের ভাষায়ঃ “(মেঘ সিং) স্যালুট করে ফ্ল্যাগস্টান্ডে উড্ডীয়মান বাংলাদেশের সবুজ পতাকাটি দেখিয়ে পরিষ্কার ইংরেজীতে জেনারেল অরোরাকে বললেন, ‘স্যার, আমি মুক্তিবাহিনীর এ অফিসারটিকে কথা দিয়েছি যে এই পতাকাটিকে আমার মৃতদেহের ওপর দিয়েই কেবল নীচে নামানো সম্ভব (This flag will come down only over my dead body)’”। লেঃ জেনারেলের সামনে লেঃ কর্নেলের এ মন্তব্য ঔদ্ধত্যের সামিল হলেও জেনারেল অরোরা কৌ্তুকভরে পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিলেন।
এ বই পড়ে পাঠক জানতে পারেন, পরাধীনতার শেকল ভাংগার এবং স্বাধীনতা অর্জনের নেশা যখন একটা জাতিকে পেয়ে বসে, তখন কিভাবে ধর্ম গোত্র নির্বিশেষে জাতির আবালবৃদ্ধবণিতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অসম সাহসী বীর যোদ্ধায় পরিণত হয়ে যায়। চৌগাছার, কুষ্টিয়ার, বেনাপোলের বীর জনগণ, মহেশপুরের ট্রাক্টর চালক আলী মিয়া, নাভারনের বার বছরের কিশোর তোতা মিয়া, যার পিতামাতাকে চোখের সামনে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করেছিল, এদের সবার কাহিনীই যেন একেকটা বীরত্বগাঁথা। ১ ইস্ট বেঙ্গলের ড্রাইভার কালা মিয়াকে অপর দুইজন চালকসহ লেখক কোটচাঁদপুরে পাঠিয়েছিলেন কয়েকটা জীপ আর বাস সংগ্রহ করে নিয়ে আসার জন্য। ওরা পথিমধ্যে খবর পেল যে পাক সেনাদের একটা কনভয় যশোর থেকে কালীগঞ্জ পৌঁছবে সেদিনই বিকেলে। মুহূর্তেই এই তিন ড্রাইভার যোদ্ধায় পরিণত হয়ে গেল। ওরা কোটচাঁদপুর থেকে দশজন রাইফেলধারী মুজাহিদ সংগ্রহ করে কালা মিয়ার নেতৃত্বে যশোর-কালীগঞ্জ সড়কে একটি পানের বরজের কাছে অ্যাম্বুশ (ফাঁদ) পাতে। কনভয় রেঞ্জের মধ্যে আসা মাত্র তাদের অস্ত্র গর্জে ওঠে। দুঃসাহসী যোদ্ধা কালা মিয়ার ছোঁড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণে পাক বাহিনীর মোট চারটি গাড়ী ভস্মীভূত হয় এবং এ অভিযানে মোট দশজন শত্রুসেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। তবে কালা মিয়াও এক সময় বুকে এলএমজি বার্স্ট বিদ্ধ হয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণে শহীদ হয়।
ইপিআর জওয়ানেরা সবসময় মান্ধাতার আমলের .৩০৩ রাইফেল ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। গোলন্দাজ সাপোর্টযুক্ত কনভেনশনাল যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাদের কখনো ছিলনা। বেনাপোলের সম্মুখবর্তী সেই ইপিআর অবস্থানের উপর যখন মুহুর্মুহু পাকিস্তানী কামানের গোলা এসে পড়ছিল, তখন সৈনিকেরা শেল-শকড হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছিল, কিন্তু ইপিআর হাবিলদার মুজিব চীৎকার করে সহযোদ্ধাদের সাহস যোগাচ্ছিলেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বীরত্বের সাথে লড়াই করে তিনি ট্রেঞ্চের মধ্যেই শহীদ হন। যদিও তারা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক আক্রমণকারীদেরকে বেশীক্ষণ প্রতিহত করতে পারেনি, তথাপি তাদের মরণপণ লড়াই এর ফলে শত্রুপক্ষের অন্ততঃ পঞ্চাশজন নিহত হয়। নিখাদ দেশপ্রেম ছাড়া এমন সাহস এমনি এমনি আসে না। সুবেদার আফতাব নামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জনৈক জেসিও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায় থেকে রৌমারী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে বিশাল এক এলাকা জুড়ে স্বাধীনভাবে সামরিক তৎপরতা চালাতে থাকেন। তার সম্পর্কে লেখকের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করিঃ “পরিস্থিতি অনেক ন্যাচারাল লীডার তৈরী করে, এ সাহসী সৈনিক তার এক বাস্তব উদাহরণ”।
১২ নং অধ্যায়টি পুরো বই এর মধ্যে সবচেয়ে লোমহর্ষক এবং বিষাদময়। শেরপুর জেলার কামালপুর বিওপি সরাসরি আক্রমণ করতে গিয়ে জান মালের সবচেয়ে বেশী ক্ষয়ক্ষতি হয়, ৩০ জন নিহত, ৬৬ জন আহত। নিহতদের মধ্যে ডেল্টা কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজও ছিলেন। তুমুল গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে শত্রু বাঙ্কারের সামনে থেকে তার লাশ উদ্ধার করার জন্য সৈনিক হায়াত আলী ও সিরাজ স্বেচ্ছায় জীবন বিসর্জন দেন। তবে তার লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, আরো অনেকের মত। লেখক নিজেও এ অভিযানে আহত হয়েছিলেন। এ্যাটাকিং ফোর্স কমান্ডারের সাথে সময় সমন্বয় ছাড়াই ভারতীয় আর্টিলারীর প্রি এইচ আওয়ার বোম্বার্ডমেন্ট শুরু হলে এ্যাটাকিং ফোর্স এর সারপ্রাইজ লস্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া একটি গোলাও শত্রু অবস্থানে পড়েনি, সবই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। মনটা খারাপ হয়ে যায় যখন জানতে পারি ঘাসীপুর রক্ষণব্যুহে নিহত সুবেদার মোজাম্মেলের ডায়েরীতে লেখকের উদ্দেশ্যে লেখা একটা চিরকুট পাওয়া যায়। তার শেষ অনুরোধ, তিনি মৃত্যুবরণ করলে লেখক যেন তার দৌলতখানের বাড়ীতে খবরটা পৌঁছে দেন। চারদিকে জঙ্গল বেষ্টিত একটা অসমতল মাঠে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় অস্ত্র পাশে রেখে ঈদুল ফিতরের মোনাজাতের পর কোলাকুলির সময় যখন সকল যোদ্ধাদের সমবেত সশব্দ ক্রন্দন শুরু হয়, সে দৃশ্য কল্পনা করেও মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। বিপদসঙ্কুল বর্তমান আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়ানো এসব যোদ্ধারা মারণাস্ত্রের ছোবলের মুখে নির্বিকার ও শঙ্কাহীন থাকতে পেরেছিল, কিন্তু পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনে মাতৃভূমিতে শত্রুবেষ্টিত প্রিয়জনদের কথা ভেবে অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। এতদিন তো তাদের কথা ভাবারও সময় তারা পায়নি। অবসরে এদের কেউ কেউ এসে লেখককে প্রশ্ন করতো, স্যার, দেশ কি আমাদের কথা মনে রাখবে? লেখক নিজেও বই এর কয়েকটি জায়গায় স্বগতোক্তি করেছেনঃ এরা নিজেদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছেন জাতির ভবিষ্যতের জন্যে। জাতি কি এদের কথা মনে রাখবে?
যুদ্ধের সময় অনেক নিরীহ মানুষও মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হয়ে থাকে। এমনই হয়েছিলেন তৎকালীন চুয়াডাঙ্গার মহকুমা প্রশাসক দম্পতি। লেখকের ভাষায়ঃ “এসডিও সাহেব এবং তার নব পরিণীতা স্ত্রী উভয়েই পাঞ্জাবি। মারমুখী জনতার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের দু’জনকে কয়েকদিন আগে হাজতে এনে রাখা হয়েছে। নবদম্পতির শয়নকক্ষে সুকোমল বিছানায় শুয়ে আমাদের চোখে ঘুম আসছিল না। তাদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মধুময় দাম্পত্য জীবনের ঊষালগ্নে তাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছে। তওফিক (মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক) মৃদুস্বরে জানালো, ভাই নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। এ বাসার গৃহকর্তা ছিলেন আমার বন্ধু। কতদিন এই দম্পতির আতিথেয়তা উপভোগ করেছি, আজ তাদের বাঁচিয়ে রাখাই মুশকিল। উন্মত্ত জনতা তাদের হত্যা করার জন্য হাজত ভেঙে ফেলতে চাইছে। অবশেষে একমত হ’লাম যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের দুস্তর বন্ধুর পথে অনেক বলিদান নিয়তির অমোঘ বিধান, এদের কেউ কেউ ঘটনার নির্দোষ শিকার মাত্র”। ইঙ্গিতপূর্ণ শেষ বাক্যটি, বিশেষ করে ‘নির্দোষ শিকার মাত্র’ শব্দ তিনটি মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। হায়, যুদ্ধ কতটা অন্ধ ও নির্মম হতে পারে!
স্বল্প পরিসরে হলেও বইটাতে কন্ঠ শিল্পী, শব্দ শিল্পী এবং খেলোয়াড়দের স্বতঃস্ফূর্ত অবদানের কথা উল্লেখ আছে দেখে খুশী হয়েছি। জাকারিয়া পিন্টুর অধীনে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল জায়গায় জায়গায় প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলে সংগৃহীত অর্থ অকাতরে সরকারের কল্যান তহবিলে দান করেছিলেন। কন্ঠ শিল্পী ও শব্দ শিল্পীরাও শরনার্থী শিবিরগুলোতে এবং মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে তাদের মনোবল উজ্জীবিত করতেন। তাছাড়া এঁরা অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিয়মিতভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান প্রচার করে মুক্তিযোদ্ধাদের তথা দেশবাসীর মনোবল চাঙ্গা রাখতেন। এম আর আখতারের “চরমপত্র” এর উল্লেখ না থাকলে বইটি অসম্পূর্ণ থেকে যেত, কেননা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা এবং সমগ্র দেশবাসী তাঁর এই অনুষ্ঠানটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতো এবং তা শোনার পর তারা নতুন উদ্যম, উচ্ছ্বাস আর সাহসে বলীয়ান হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিসটিক্স বিভাগের তৎকালীন শিক্ষক মাহমুদুর রহমান বেনু’র লেখকের ব্যাটালিয়নে ভর্তি হবার তথ্যটি বেশ চমকপ্রদ। আরো চমকপ্রদ যুদ্ধ চলাকালীন তার কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে দেশে এসে তার তৎকালীন প্রেমিকা নজরুল সঙ্গীত শিল্পী শাহীনকে (আজকের প্রখ্যাত শিল্পী শাহীন সামাদ, যিনি তখন বেনুকে বিয়ে করে শাহীন মাহমুদ নামে পরিচিত হয়েছিলেন) ‘গেরিলা কায়দায়’ বিয়ে করে সুকৌশলে কোলকাতায় নিয়ে আসার তথ্যটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদুর রহমান বেনুকে যখন প্রশিক্ষণের জন্য লেখক তার পাইওনিয়ার প্লাটুনে সংযুক্ত করলেন, যাদের কাজ বিস্ফোরক ব্যবহার, মাইন বিছানো, পুল ওড়ানো, ইত্যাদি, তখন তিনি স্বল্প শিক্ষিত সৈনিকদের সাথে একাত্ম হয়ে বেশ আন্তরিকতার সাথে কাজ শুরু করেছিলেন। তার সম্পর্কে লেখকের সাথে পাইওনিয়ার প্লাটুনের কমান্ডার হাবিলদার তাজুল ইসলামের একদিনের কথোপকথন এখানে তুলে ধরছিঃ “স্যার, নতুন দুই রিক্রুট (বেনু’র সাথে নাট্য জগতের তার এক বন্ধুও যোগ দিয়েছিলেন) নাকি আপনার বন্ধু? ... আর বেনু সাহেব নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক? ওনাকে অর্ডার দিতে শরম লাগে, কড়া কথাও বলতে পারিনা। ... স্যার, ওনাদের কষ্ট দেখে মায়া লাগে, তবে শেখার খুব আগ্রহ ওনাদের”।
লেখক বলেছেন, “এটি আমার প্রথম বই। তাড়াহুড়ো করে লিখেছি, সহৃদয় পাঠক ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন বলে আশা রাখি”। লেখককে আমি বলবো, যেমনই লিখুন, যেভাবেই লিখে থাকুন, আপনার এ বই স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় এক অমূল্য অবদান। ‘আজি হতে শত বর্ষ পরে’ যারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবে, তারা এ বই পড়তে পড়তে রোমাঞ্চিত, শিহরিত এবং গর্বিত বোধ করবে আপনার মত আরো অসংখ্য বীর বাঙালীর শৌর্য বীর্য আর দেশমাতৃকার জন্য আপনাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কথা ভেবে। সেই সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্মুখ সমরে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে এখনো যারা তাদের স্মৃতিকথা বা যুদ্ধের বয়ান লিখেন নি, তাদের প্রতি একটা অনুরোধ রাখছি। আপনারা যাই পারুন, যতটুকুই এখনো মনে আছে, সেসব লিখে যান। আপনাদের উত্তরসূরীরা এসব পড়ে একদিন গর্ব বোধ করবে।
(চেষ্টা করেও বইটির প্রচ্ছদের ছবিটা এখানে সংযোজন করতে পারলাম না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত)
ঢাকা
১০ এপ্রিল ২০১৭
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সোহেল রানা আশিক ২৩/০৪/২০১৭শুভ কামনারইল
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ২২/০৪/২০১৭দারুণ অভিজ্ঞতা।
-
মধু মঙ্গল সিনহা ২২/০৪/২০১৭অপরিসীম ভালো লাগলো।ধন্যবাদ।
-
সাঁঝের তারা ২২/০৪/২০১৭অনেক ভাল আলোচনা। শুভেচ্ছা ...