মৃণ্ময়ের কাব্য
'মন খারাপ হলে কিছু দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস খামবন্ধি করে পাঠিয়ে দেবো।
তুমি লালখামে ভরে- কিছু রোদ্দুর দিও
একঝাক প্রজাপতি দিও
একটা কবিতা দিও.... '
ব্রেকেটে ''৩২১১। নূহা। নারায়ণ ছড়া''
মৃন্ময় এক নিমিষে চিরকুট'টা পড়ে নূহার দিকে তাকিয়ে মেঘচোখে মাথা ঝাঁকাল। ট্রেনটা তখন মধ্যখানের দূরত্ব অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। তবুও মনে হলো নূহা মৃন্ময়ের 'মেঘচোখ' 'মাথা ঝাঁকানো' স্পষ্ট পড়তে পেরেছে। ভেতরে ভালোবাসার থাকলে দূরে থেকেও অনেক কিছুই দেখা যায়। নৈঃশব্দ্যের ভাষা পড়া যায়।
আস্তে আস্তে অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হতে থাকলো নূহার মুখ, ট্রেনের দরজায় ঝুলে থাকা কিংবা উপরে বসে থাকা মানুষদের মাথা.... ট্রেন।
অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে 'ট্রেনটি অদৃশ্য হওয়ার পথে মৃন্ময়ের নির্বাক তাকিয়ে থাকা' দেখলাম আর মনে মনে অনুধাবনের চেষ্টা করলাম 'ভালোবাসার নেশা একটা মানুষকে কতটা টালমাটাল করে দিতে পারে'। কতটা টালমাটাল হলে একজন প্রেমিক 'একটা ব্যস্ত স্টেশন, শতশত মানুষ, ষ্টেশনারী দোকান.... সব ভুলে যায়। ভুলে যায় বাড়ি ফেরার কথা!
হাত ঘড়ি দেখলাম। ঘন্টার কাটা ২০ মিনিট পূর্বে'ই ২ টা'র ঘর অতিক্রম করেছে। আমাদের বাস ছাড়বার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাই মৃন্ময়কে ধাক্কা দিলেম- 'চল্ ব্যাটা! আর কতক্ষণ তাকাই থাকবি?!' মৃন্ময় মৃদু হেসে বললো, চল্। দুজন বাস স্ট্যান্ডের পথে পা বাড়ালাম।
বাস ছেড়েছে ঘন্টাখানেক পূর্বে। মৃন্ময় চোখেমুখে এক সমুদ্র অন্ধকার জমিয়ে চুপচাপ বসে আছে। বাড়ি থেকে হোস্টেলে ফেরার সেই দুঃখি সময়টাতেও যে ছেলেটা বেহুদা কথা বলে বলে বিরক্ত করে তার এই নীরবতা ভালো লাগছিলো না। তাই বললাম, 'নূহাকে বলে দিলেই তো পারিস। বলছিস না কেন?'
জবাবে রোম্যান্টিক নাটকের নায়কের মতো মৃন্ময় বললো- 'বলতে হবে কেন? ও ত জানে, বুঝে; আমিও জানি, বুঝি। প্রেম-প্রণয়ের জন্য এতোটুকুই এনাফ।'
তাহলে মন খারাপ করে দেবদাস স্টাইলে বসে আছিস কেনো?
মৃন্ময়ের এক বাক্যে জবাব, 'যে কারণে বাড়ি থেকে হোস্টেলে ফিরতে তোর মন খারাপ থাকে।'
আর কথা বাড়াতে চাইলাম না। বুঝতে পারলাম- হোস্টেলে ফেরার সময় ফাহমির জন্যই যে আমার মন খারাপ থাকে মৃন্ময় ব্যাপার'টা টের পায়। সবুঝ গাছপালা, গ্রাম, ছোটবড় বাজার পিছনে ফেলে বাস এগুতে থাকলো নির্ধারিত গন্তব্যে।
২
মৃন্ময়কে কলেজ লাইব্রেরির দিকে হাটতে দেখে ধারনা করলাম, প্রেমিক এবার একগাদা লালখাম আর চিঠি লিখার একটা চমৎকার প্যাড কিনবে। ধারনা সত্য হলো। মৃন্ময় লালখাম, কলম ও প্যাড কিনলো।
কলেজ লাইব্রেরির মুহাইমিনুল ভাই আমার দিকে উপন্যাসের মতো একটা বই এগিয়ে দিতে দিতে বললেন- সাবুল স্যার আপনাকে দিতে বলেছেন।
হাতে নিলাম। উপন্যাসটা সাবুল ভাই'র লেখা। নাম 'বসন্তের কোকিল'। সাদা কালোরঙ্গের মিশ্রণে আকা প্রচ্ছদ। রিকশায় বসে বসে প্রচ্ছদটা নিয়ে ভাবছিলাম। কোনোএক আড্ডায় সাবুল ভাই বলেছিলেন, উপন্যাসের সারমর্ম মলাটের প্রচ্ছদে এঁকে দেবেন।
তিনি প্রচ্ছদে এঁকেছেন- "একটা মেয়েলি ছবি, একটা কোকিল এবং তিনটে ঝরাপাতা"
মানে কি? ছবিগুলোর মাধ্যমে কি বুঝাতে চাইছেন? একটা মেয়ে। একটা সুসময়ের বন্ধু। তিনটে ঝরা স্বপ্ন। নাকি.....
মৃন্ময়কে জিজ্ঞাস করলাম- দোস্ত 'একটা মেয়ে, একটা কোকিল আর তিনটে ঝরাপাতার' মানে কি হতে পারে?! মৃন্ময় দুই বাক্যে বললো, "অনেক কিছুই হতে পারে। হতে পারে একটি মেয়েকে ঘিরে তিনটে ব্যর্থ প্রেমের উপাখ্যান।"
মৃন্ময়ের জবাব পছন্দ হলো। বললাম, কবিদের ভাষা কবিরা সহজে বুঝতে পারেন।
শুনে মৃণ্ময় শব্দ করে হাসলো।
আকাশে মেঘরা উড়ছে। মৃদু হাওয়া বইছে। লণ্ঠনের একপশলা আলো নিয়ে একটা রিকশা চলছে গ্রামের পথে..... প্যাডেলের খিক খক বাতাসে মিশে হারিয়ে যাচ্ছে ধানের মাঠে।
৩
'একবিকেল' ফাহমিদের পাড়ায় ঘুরাঘুরি করে জানালাম 'ফাহমি মামার বাড়ি বিয়ে খেতে গেছে। দুই তিনদিন পর ফিরবে।'
মন খারাপ করে বাসায় এসে সাবুল ভাই উপন্যাস খুলে বসলাম। এবং দুইদিনে পুরুটা শেষ করলাম, মৃন্ময়ের ধারণা ঠিক ছিলো- ত্রিমুখী প্রেমের গল্প। দুই বন্ধু এক বান্ধবীকে ভালোবাসে। কিন্তু বান্ধবী ভালোবাসে অন্যএকটা ছেলেকে। তারপর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়, বিভিন্ন মোড় ভ্রমণ শেষে তিনজনই একা।
উপন্যাসের শেষটা পড়ে সাবুল ভাই'র বিয়ে না করার কারণ বুঝতে পারলাম। উপন্যাসের তিনজনের একজন স্বয়ং সাবুল ভাই।
গল্পটা মৃন্ময়ের সাথে শেয়ার করা দরকার।
ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে পৃথিবীতে, জোনাকিপোকারা মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মৃন্ময়ের আজ সেদিকে খেয়াল নেই; রিডিংটেবিলে বসে বসে সে লিখছে-
"বুকপকেটে একগাদা লালখাম নিয়ে
আমি কবিতায় রোদ্দুর আর প্রজাপতি আঁকার ভাষা শিখছি
প্রহর গুনছি ডাকপিয়নের
তিলোত্তমা,
তুমি দীর্ঘশ্বাস পাঠাওনি। আমাকে ভেবে তোমার মন খারাপ হয়নি।"....
(চলবে)
তুমি লালখামে ভরে- কিছু রোদ্দুর দিও
একঝাক প্রজাপতি দিও
একটা কবিতা দিও.... '
ব্রেকেটে ''৩২১১। নূহা। নারায়ণ ছড়া''
মৃন্ময় এক নিমিষে চিরকুট'টা পড়ে নূহার দিকে তাকিয়ে মেঘচোখে মাথা ঝাঁকাল। ট্রেনটা তখন মধ্যখানের দূরত্ব অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। তবুও মনে হলো নূহা মৃন্ময়ের 'মেঘচোখ' 'মাথা ঝাঁকানো' স্পষ্ট পড়তে পেরেছে। ভেতরে ভালোবাসার থাকলে দূরে থেকেও অনেক কিছুই দেখা যায়। নৈঃশব্দ্যের ভাষা পড়া যায়।
আস্তে আস্তে অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হতে থাকলো নূহার মুখ, ট্রেনের দরজায় ঝুলে থাকা কিংবা উপরে বসে থাকা মানুষদের মাথা.... ট্রেন।
অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে 'ট্রেনটি অদৃশ্য হওয়ার পথে মৃন্ময়ের নির্বাক তাকিয়ে থাকা' দেখলাম আর মনে মনে অনুধাবনের চেষ্টা করলাম 'ভালোবাসার নেশা একটা মানুষকে কতটা টালমাটাল করে দিতে পারে'। কতটা টালমাটাল হলে একজন প্রেমিক 'একটা ব্যস্ত স্টেশন, শতশত মানুষ, ষ্টেশনারী দোকান.... সব ভুলে যায়। ভুলে যায় বাড়ি ফেরার কথা!
হাত ঘড়ি দেখলাম। ঘন্টার কাটা ২০ মিনিট পূর্বে'ই ২ টা'র ঘর অতিক্রম করেছে। আমাদের বাস ছাড়বার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাই মৃন্ময়কে ধাক্কা দিলেম- 'চল্ ব্যাটা! আর কতক্ষণ তাকাই থাকবি?!' মৃন্ময় মৃদু হেসে বললো, চল্। দুজন বাস স্ট্যান্ডের পথে পা বাড়ালাম।
বাস ছেড়েছে ঘন্টাখানেক পূর্বে। মৃন্ময় চোখেমুখে এক সমুদ্র অন্ধকার জমিয়ে চুপচাপ বসে আছে। বাড়ি থেকে হোস্টেলে ফেরার সেই দুঃখি সময়টাতেও যে ছেলেটা বেহুদা কথা বলে বলে বিরক্ত করে তার এই নীরবতা ভালো লাগছিলো না। তাই বললাম, 'নূহাকে বলে দিলেই তো পারিস। বলছিস না কেন?'
জবাবে রোম্যান্টিক নাটকের নায়কের মতো মৃন্ময় বললো- 'বলতে হবে কেন? ও ত জানে, বুঝে; আমিও জানি, বুঝি। প্রেম-প্রণয়ের জন্য এতোটুকুই এনাফ।'
তাহলে মন খারাপ করে দেবদাস স্টাইলে বসে আছিস কেনো?
মৃন্ময়ের এক বাক্যে জবাব, 'যে কারণে বাড়ি থেকে হোস্টেলে ফিরতে তোর মন খারাপ থাকে।'
আর কথা বাড়াতে চাইলাম না। বুঝতে পারলাম- হোস্টেলে ফেরার সময় ফাহমির জন্যই যে আমার মন খারাপ থাকে মৃন্ময় ব্যাপার'টা টের পায়। সবুঝ গাছপালা, গ্রাম, ছোটবড় বাজার পিছনে ফেলে বাস এগুতে থাকলো নির্ধারিত গন্তব্যে।
২
মৃন্ময়কে কলেজ লাইব্রেরির দিকে হাটতে দেখে ধারনা করলাম, প্রেমিক এবার একগাদা লালখাম আর চিঠি লিখার একটা চমৎকার প্যাড কিনবে। ধারনা সত্য হলো। মৃন্ময় লালখাম, কলম ও প্যাড কিনলো।
কলেজ লাইব্রেরির মুহাইমিনুল ভাই আমার দিকে উপন্যাসের মতো একটা বই এগিয়ে দিতে দিতে বললেন- সাবুল স্যার আপনাকে দিতে বলেছেন।
হাতে নিলাম। উপন্যাসটা সাবুল ভাই'র লেখা। নাম 'বসন্তের কোকিল'। সাদা কালোরঙ্গের মিশ্রণে আকা প্রচ্ছদ। রিকশায় বসে বসে প্রচ্ছদটা নিয়ে ভাবছিলাম। কোনোএক আড্ডায় সাবুল ভাই বলেছিলেন, উপন্যাসের সারমর্ম মলাটের প্রচ্ছদে এঁকে দেবেন।
তিনি প্রচ্ছদে এঁকেছেন- "একটা মেয়েলি ছবি, একটা কোকিল এবং তিনটে ঝরাপাতা"
মানে কি? ছবিগুলোর মাধ্যমে কি বুঝাতে চাইছেন? একটা মেয়ে। একটা সুসময়ের বন্ধু। তিনটে ঝরা স্বপ্ন। নাকি.....
মৃন্ময়কে জিজ্ঞাস করলাম- দোস্ত 'একটা মেয়ে, একটা কোকিল আর তিনটে ঝরাপাতার' মানে কি হতে পারে?! মৃন্ময় দুই বাক্যে বললো, "অনেক কিছুই হতে পারে। হতে পারে একটি মেয়েকে ঘিরে তিনটে ব্যর্থ প্রেমের উপাখ্যান।"
মৃন্ময়ের জবাব পছন্দ হলো। বললাম, কবিদের ভাষা কবিরা সহজে বুঝতে পারেন।
শুনে মৃণ্ময় শব্দ করে হাসলো।
আকাশে মেঘরা উড়ছে। মৃদু হাওয়া বইছে। লণ্ঠনের একপশলা আলো নিয়ে একটা রিকশা চলছে গ্রামের পথে..... প্যাডেলের খিক খক বাতাসে মিশে হারিয়ে যাচ্ছে ধানের মাঠে।
৩
'একবিকেল' ফাহমিদের পাড়ায় ঘুরাঘুরি করে জানালাম 'ফাহমি মামার বাড়ি বিয়ে খেতে গেছে। দুই তিনদিন পর ফিরবে।'
মন খারাপ করে বাসায় এসে সাবুল ভাই উপন্যাস খুলে বসলাম। এবং দুইদিনে পুরুটা শেষ করলাম, মৃন্ময়ের ধারণা ঠিক ছিলো- ত্রিমুখী প্রেমের গল্প। দুই বন্ধু এক বান্ধবীকে ভালোবাসে। কিন্তু বান্ধবী ভালোবাসে অন্যএকটা ছেলেকে। তারপর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়, বিভিন্ন মোড় ভ্রমণ শেষে তিনজনই একা।
উপন্যাসের শেষটা পড়ে সাবুল ভাই'র বিয়ে না করার কারণ বুঝতে পারলাম। উপন্যাসের তিনজনের একজন স্বয়ং সাবুল ভাই।
গল্পটা মৃন্ময়ের সাথে শেয়ার করা দরকার।
ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে পৃথিবীতে, জোনাকিপোকারা মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মৃন্ময়ের আজ সেদিকে খেয়াল নেই; রিডিংটেবিলে বসে বসে সে লিখছে-
"বুকপকেটে একগাদা লালখাম নিয়ে
আমি কবিতায় রোদ্দুর আর প্রজাপতি আঁকার ভাষা শিখছি
প্রহর গুনছি ডাকপিয়নের
তিলোত্তমা,
তুমি দীর্ঘশ্বাস পাঠাওনি। আমাকে ভেবে তোমার মন খারাপ হয়নি।"....
(চলবে)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৪/০৪/২০২০পড়তে থাকি।
-
দীপঙ্কর বেরা ০৪/০৪/২০২০ভাল
-
ফয়জুল মহী ০৪/০৪/২০২০নন্দিত উপস্থাপন ।
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ০৪/০৪/২০২০চমৎকার
-
লেখক : মেহেদী হাসান রনি ০৪/০৪/২০২০অফুরন্ত প্রকাশ একগুচ্ছ ভালোবাসা রইলো
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ০৪/০৪/২০২০অনবদ্য উপস্থাপনা।