অভিশপ্ত পিয়ানো
ছোটবেলা থেকেই গান বাজনার খুব শখ আমার । কর্মব্যস্ততার মধ্যে এখনও সেটাকে হাতছাড়া করিনি আমি । হারমনিয়াম, তবলা, সেতার সবই আছে । নেই শুধু একটা ইন্সট্রুমেনট । সেটা পিয়ানো । পিয়ানো বাজানোর শখ আমার সেই ছেলেবেলা থেকে । কিন্তু কেনা সম্ভব হয়নি । তার অন্যতম কারণ অর্থ । একটা পিয়ানোর দাম নেহাত কম নয় । বাবার যা আয় ছিল তাতে একটা পিয়ানো কেনা তার পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল । না পাবার জন্যই পিয়ানোর শখটা দীর্ঘ দিন মনের কোনে দানা বেঁধে আছে । সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বিশেষ একটা কাজে পার্কস্ট্রীট এলাকায় গিয়েছিলাম । কাজ সেরে সন্ধ্যার পর পার্ক স্ট্রীট ধরে হাঁটছিলাম । পার্ক সার্কাস থেকে বাস ধরব । ওখান থেকে কালিকাপুরের বাসে বসে চলে আসব । রাস্তার দুপাশের দোকান গুলো সন্ধ্যার আলোয় বেশ সুন্দর আর রোমাঞ্চকর লাগছিল । যেতে যেতে হঠাৎ চোখে পড়ল পুরানো মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেনট কেনা বেচার একটা দোকান । রাস্তা থেকে চোখে পড়ল পুরানো আমলের একটা পিয়ানো । দোকানটার সামনে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম । ঢুকবো কি ঢুকবোনা ভাবতে লাগলাম । এত দিনের শখ চোখের সামনে দিয়ে পালিয়ে যাবে ? সাত পাঁচ আর না ভেবে ঢুকেই পড়লাম দোকানের ভেতরে ।
পিয়ানোর কাছে যেতেই দোকানের এক কর্মচারী বলে উঠল - ' দাদা পিয়ানোটা দেখবেন ?' আমি বললাম - 'দেখব বলেই তো এলাম ।' এরপর পাশে রাখা টুলে বসে পিয়ানোর রিডগুলোতে হাত রাখলাম । মনে হল কন্ডিশন বেশ ভালই আছে । মনটা আনন্দে ভরে গেল । কিছুক্ষন বাজানোর পর সোজা দোকান-মালিকের কাছে এলাম । জিজ্ঞাসা করলাম - 'এই পিয়ানোর দাম কত হবে ?' দোকান-মালিক যে দাম বলল সেটা কমই মনে হল । আমার সাধ্যের মধ্যেই । আমি বললাম - 'দাদা এই পিয়ানোটা আমি কিনতে চাই ।' দোকান-মালিক আমার মুখের দিকে চেয়ে একটু উদাস ভাবে বলল - ' বেশ তো পছন্দ যখন হয়েছে নিয়ে যান । ঘরে রাখতে পারলে তো ভালই ।' মালিক ভদ্রলোক এমন হেঁয়ালির সুরে কথাগুলো বললেন তাতে একটু বিরক্ত বোধ করলাম । পয়সা দিয়ে জিনিষ কিনব তাতে ওনার এভাবে কথা বলার কি আছে ? আর কথা না বাড়িয়ে বললাম - ' হ্যাঁ আমি নেব । কত এডভান্স করতে হবে বলুন, কালই ডেলিভারি নেব ।' ভদ্রলোক একটু মুচকি হেসে বললেন - 'অ্যাডভান্স কিছু করতে হবে না । সরাসরি টাকা দিয়ে নিয়ে যাবেন । ডেলিভারির যাবতীয় বন্দোবস্ত আমিই করে দেব ।'
বেশ খোশ মেজাজেই দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম । পার্ক সার্কাস থেকে কালিকাপুরের বাসে উঠে জানালার ধারের সিটে বসলাম । বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে বারে বারে মনে পরে যাচ্ছিল পিয়ানোর কথা । কত দিনের পোষা শখ মিটতে চলেছে ভেবে ভীষণ আনন্দ পাচ্ছিলাম । বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে ন'টা হয়ে গেল । কাছাকাছি একটা দোকান থেকে রুটি তরকা এনে রাতের খাবার সাঙ্গ করলাম । ছোট্ট দোতলা বাড়িটাতে আমি একাই থাকি । দেশের বাড়ি বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থেকে মা মাঝে মাঝে এসে থাকেন । বাড়িতে একটা ঘর রেখেছি শুধু গান বাজনার জন্য । শোবার আগে ঢুকলাম সেই ঘরে । ঘরের নতুন অতিথিকে কোথায় বসাব সেটা দেখে নিলাম । জানালার ধারে জায়গাটা পছন্দ হল । মন খুশীতে ভরে গেল এই ভেবে যে এই খোলা জানালার কাছে বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে পিয়ানোয় সুর তুলব । পিয়ানোর আনন্দে কিছুতেই ঘুম আসছিল না । বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম । খোলা আকাশের দিকে চাইলাম । পরিস্কার আকাশ । দু'দিন পরেই পূর্ণিমা । মিষ্টি চাঁদের আলোর ছটায় সারা পরিবেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে । আকাশময় তারাদের দল আল্পনা এঁকে চলেছে । গলা দিয়ে গুন গুন করে বেরিয়ে এল রবি ঠাকুরের " আমার মনের মাঝে সুধা আছে চাইগো ... "
পরের দিন সকালে সে কি আনন্দ ! আজ সে আসবে আমার ঘর আলো করে । অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সোজা পার্কস্ট্রীটের সেই দোকান । পেমেন্ট করতে করতেই দেখলাম রাস্তার ধারে দাঁড়ানো ছোট ম্যাটাডোরে আমার প্রিয় পিয়ানো উঠে গিয়েছে । সঙ্গে দুটো ছেলেকেও দিয়ে দিয়েছে দোকানী । আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলাম । হু হু করে গাড়ি ছুটে চলল । আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে গেলাম । আমার নতুন অতিথি তার যোগ্য মর্যাদার সাথে গান-বাজনার ঘরে নির্দিষ্ট জায়গাতেই জায়গা পেল । আমার আনন্দ আর ধরে না । যখন মিশনারি স্কুলে পড়তাম তখন থেকেই পিয়ানো বাজানোর শখ । স্কুলের বিভিন্ন ফাংশানে ফাদার যখন পিয়ানো বাজাতেন আমি মন দিয়ে শুনতাম । এত মিষ্টি লাগত সেই সুর তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না । আজ আমার প্রিয় সুরের যন্ত্র আমারই সামনে এটা ভেবে মনে হয় আমি স্বপ্ন দেখছি না তো ? দেরি না করে হাত মুখ ধুয়ে এসে টুলটা টেনে নিয়ে পিয়ানোর সামনে বসলাম । ঢাকনা খুলে রিডে হাত রাখলাম । অপূর্ব ধ্বনিতে সারা ঘর মুখরিত হয়ে উঠল । সত্যিই পুরানো জিনিষের কদরই আলাদা । পুরানো চাল ভাতে বাড়ে । প্রায় দুঘণ্টা পিয়ানোয় সুর তুললাম । তারপর পাশের বেডরুমে গিয়ে তন্দ্রালু চোখে গা এলিয়ে দিলাম ।
পরের দিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে এসেই বসে গেলাম আমার প্রিয় সুরেলা বাদ্য যন্ত্রের সামনে । সুরের মূর্ছনায় ভাসিয়ে ফেললাম নিজেকে । বাড়ির আবহ ভরপুর হয়ে উঠল মধুর শব্দ-সঙ্গীতে । রাতের খাবার খেতে বেশ দেরিই হয়ে গেল । আবার বেশ কিছুক্ষন পিয়ানো বাজিয়ে ঘুমোতে গেলাম । গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল । মনে হল ঘরের মধ্যে কে যেন হাঁটা চলা করছে । ঘুম চোখে ভাবলাম নিশ্চয়ই বিড়াল ঢুকেছে ঘরের খোলা জানালা দিয়ে । উঠতে ইচ্ছে করল না । বিড়াল ঢুকলে সকালে বের করে দিলেই হবে । আবার ঘুমিয়ে পড়লাম । সকালে ঘুম থেকে উঠে সারা ঘর খুঁজে দেখলাম বিড়াল কোথাও নেই । তাহলে বিড়াল গেল কোথায় ? নিশ্চয়ই খোলা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেছে ।
দুদিন পর অফিস থেকে ফিরে পিয়ানো নিয়ে বেশ সময় কেটে গেল । রাতের খাবার খেয়ে শোবার পর ঘুম এসে গেল । হঠাৎ একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল । মনে হল আমার ঘরের মধ্যে কে যেন হাঁটা-চলা করে বেড়াচ্ছে । আজ একটু চমকে গেলাম । দুদিন আগে যে রকম আওয়াজ পেয়েছিলাম আজও ঘরের মধ্যে ঠিক সেরকমই একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ । হঠাৎই শুনতে পেলাম মৃদু স্বরে এক নারীকণ্ঠের কান্না । এবার একটু ভয় পেয়ে গেলাম । ভাবলাম তাহলে কি ঘরে কেউ ঢুকে বসে আছে ? কিন্তু সদর দরজা তো অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছি । তাহলে ঘরে কিভাবে কে ঢুকল ? মনে একটু সাহস আনবার চেষ্টা করলাম । আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে টিউব লাইটের সুইচটা অন করলাম । কোথায় কে ? ঘর একদম ফাঁকা । নাঃ তাহলে নিশ্চয়ই ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছি । মনকে সান্ত্বনা দিয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম । মাঝরাতে আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমার মিউজিক রুম থেকে পিয়ানোর আওয়াজ ভেসে আসছে । কানটা একটু খাড়া করলাম । হ্যাঁ ঠিকই । মনে হল ঐ ঘরে কে যেন পিয়ানোয় ওয়েসটার্ন মিউজিকের সুর বাজিয়ে চলেছে । বেশ ঘাবড়ে গেলাম । সাহসে ভর করে তাড়াতাড়ি পাশের মিউজিক রুমের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম । কোন বাজনার আওয়াজ নেই । লাইটের সুইচটা অন করলাম । নাঃ কোথাও কেউ নেই ! কি ব্যাপার ঘটে গেল কিছু বুঝতে পারলাম না । তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখলাম ? চারিদিক ভালভাবে লক্ষ্য করে বিছানায় ফিরে এলাম । বাকি রাতে আর ঘুম এল না । জেগেই কাটালাম ।
সারাদিনের কর্মব্যাস্ততায় রাতের ঘটনা ভুলেই গিয়েছিলাম । সন্ধ্যাবেলা যথারীতি বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে আবার পিয়ানোটা নিয়ে বসলাম । একমনে পিয়ানো বাজাচ্ছি । হঠাৎ এক নারীকণ্ঠের খিলখিল হাসিতে চমকে উঠলাম । হৃদ-যন্ত্রে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল । পিয়ানোর বাজনা থামিয়ে ঘরের চারপাশ দেখলাম । কাউকেই দেখতে পেলাম না । কিন্তু এখন তো আমি কোন স্বপ্ন দেখছি না, জেগেই আছি । তাড়াতাড়ি পাশের ঘরগুলো দেখে নিচে নেমে সদর দরজাও দেখে এলাম । কেউ কোথাও নেই । আজ মুডটাই অফ হয়ে গেল । বাড়িতে এসব যে কি হচ্ছে বোধগম্য হল না । ভুতের ভয় আমার কোন দিনই নেই । কিন্তু এটা সত্যি আমি স্পষ্ট এক নারীকণ্ঠের হাসির শব্দ শুনেছি । পিয়ানোর কাছে আর যেতে ইচ্ছে করল না । শোবার ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকলাম ।
পর পর দুদিন এই ভাবে কেটে গেল । বাড়িতে কি যে হচ্ছে বুঝতে না পেরে দোদুল্যমান চিত্তে কাটাতে হচ্ছে । তৃতীয় দিন রাতে কিছুক্ষন পিয়ানোয় সুরের ঝংকার তুললাম । তারপর রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম । রাত তখন বেশ গভীর । হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমার কপালের উপর কার যেন একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল । আমি চমকে উঠলাম । ঘুম-চোখে কিছু ঠাহর করতে পারলাম না । তারপর অনুভব করলাম আমার কপালে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল পড়ল । আমার মত সাহসী এবার খুবই ভয় পেয়ে গেলাম । ঘরের দক্ষিন দিকের জানালাটা খোলাই থাকে । সেই জানালা দিয়ে অর্ধ চাঁদের আলো ঘরের ভিতর এক আলো-আঁধারি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে । হঠাৎ মাথার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম । এক সুন্দরী বিদেশিনী আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে । ভয়ে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল । হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি দ্বিগুণ বেড়ে গেল । ভেবে পেলাম না কে এই মহিলা ? কি ভাবে আমার ঘরে ঢুকল ? কিন্তু জিজ্ঞাসা করার সাহস হারিয়ে ফেললাম । গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোল না । কি করব বুঝে উঠতে পারলাম না । উঠে বসার ক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেললাম । মনে হল সারা শরীর শিথিল হয়ে যাচ্ছে । কে যেন বিছানার সঙ্গে আমার শরীরটা বেঁধে ফেলছে । তবুও বিছানার পাশের সুইচ বোর্ডে লাইটের সুইচটা অন করতে হাত বাড়াতেই নারী মূর্তি হাত নাড়িয়ে নিষেধ করল - ' নো নো সিস্টার, ডোন্ট লাইট '। সঙ্গে সঙ্গে হাতটা সরিয়ে নিয়ে আমি আরও কুঁকড়ে গেলাম । এরপর আধা ইংরাজি আধা বাংলাতে বলল - ' ভয় পাবেন না । আমি আপনার কোন ক্ষতি করব না । শুধু একটা অনুরোধ আপনাকে রাখতে হবে । যে পিয়ানো আপনি বাড়িতে নিয়ে এসেছেন সেটা আর বাজাবেন না । ঐ দোকানে ফেরত দিয়ে আসবেন ।' নারী-মূর্তির কথায় মনে একটু সাহস এল । ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললাম - ' কে আপনি ? এখানে এলেন কি করে ? আর কেনই বা আমি পিয়ানোটা দোকানে ফেরত দেব ? রীতিমত পয়সা খরচা করে আমি পিয়ানোটা কিনেছি ।'
- 'আমি সব বলব আপনাকে । কিন্তু ঐ পিয়ানোটা আমার ।'
- 'আমার মানে ? আমি সেকেন্ড সপ থেকে কিনে এনেছি ।'
- ' তবু বলব ঐ পিয়ানোটা একান্তই আমার । আমি ঐ পিয়ানো বাজাতাম । এখনও বাজাই । অন্য কেউ আমার পিয়ানো ব্যবহার করুক সেটা আমি চাই না ।'
- ' আমি আপনার কথা কিচ্ছু বুঝতে পারছি না । '
- ' বুঝবেন, বুঝবেন, সব বুঝবেন । আগে মিউজিক রুমে চলুন, একটু পিয়ানো বাজাবো । কিন্তু প্লিজ লাইট জ্বালাবেন না ।'
নারীমূর্তি আমার আগেই পাশের মিউজিক রুমের দিকে পা বাড়াল । আমি খুব কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠে কোনক্রমে দাঁড়ালাম । তারপর আস্তে আস্তে সাহসে ভর করে দুর্বল শরীরে পাশের মিউজিক রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালাম । আবছা আলোয় দেখলাম ঐ নারীমূর্তি খুব সুন্দর এক মেমসাহেব । সারা শরীর সাদা গাউনে ঢাকা । মাথার চুলগুলো লালচে । পিয়ানোর সামনে রাখা টুলে বসে পিয়ানো বাজাতে শুরু দিয়েছে । একটা ওয়েস্টার্ন মিউজিক । কি অপূর্ব তার হাত, কি মনোমুগ্ধকর তার সুর । আমি সুরের ঝঙ্কারে বিমোহিত হয়ে গেলাম । কিছুক্ষন পরে ঐ নারীমূর্তির কথায় আমার সুর-মূর্ছনা ভাঙল । নারীমূর্তিটি এবার পিয়ানোর রিড থেকে হাত উঠিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল -
আমার নাম ক্লারা ক্রিস্টোফার । হাজব্যান্ডের নাম জন ক্রিস্টোফার । আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের কথা । আমরা থাকতাম কারসিয়াং-এ । আমরা খুব সুখেই ছিলাম । ছেলেবেলা থেকেই গান বাজনার প্রতি আমার খুব আকর্ষণ । আর পিয়ানো বাজিয়ে সুর তুলে গান করব এটা আমার ভীষণ শখ । হাজব্যান্ড কোনদিন বাধাও দেননি । একদিন দুজনে দোকানে গিয়ে একটা পিয়ানো কিনে আনলাম । কিন্তু শেখাবে কে ? মাস্টারের খোঁজ চলল । ভাগ্যক্রমে একদিন এক পার্টিতে আমার হাজব্যান্ডের বন্ধু বেঞ্জামিন গোমেজের সাথে পরিচয় হল । উনি খুব ভাল পিয়ানো বাজাতে পারতেন । আমার হাজব্যান্ডের অনুরোধে উনি আমাকে পিয়ানো শেখাতে রাজি হয়ে গেলেন । ওনার কাছে পিয়ানো বাজানো শিখতে শিখতে কখন যে আমি ওনাকে আমার মনটা দিয়ে ফেললাম আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারিনি । আমাদের দু'জনের মধ্যে খুব ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেল । আর এই প্রিয় পিয়ানোটা হয়ে রইল সাক্ষী । বেশ কয়েকটা পার্টিতে আমরা দু'জনে ফাংশনও করলাম । কাজের চাপে আমার হাজব্যান্ড সব ফাংশান অ্যাটেনড করতে পারতেন না । কিছুদিন পর থেকেই বেঞ্জামিনকে নিয়ে আমাকে সন্দেহ করতে লাগল আমার হাজব্যান্ড । আমারও জেদ বেড়ে গেল । আরও বেশি ফাংশন করতে শুরু করলাম । রাত করে বাড়ি ফিরতাম । মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্ট থেকে বেঞ্জামিনের সাথে ডিনার করে আসতাম । প্রথম প্রথম এ-সব নিয়ে হাজব্যান্ডের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হত । কিন্তু এরপর কথা কাটাকাটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছাল । হাজব্যান্ড আমার গায়ে হাত তুলতে শুরু করল । আমার মন কেমন যেন চেঞ্জ হয়ে গেল । আমি আর বেঞ্জামিন বিয়ে করব বলে ঠিক করলাম । কিন্তু তার আগে জনকে তো ডিভোর্স দিতে হবে । একদিন জনের সঙ্গে ঝগড়া চরমে উঠতেই ওকে ডিভোর্সের কথা বললাম । ডিভোর্সের কথা শুনে জনের লাল মুখ আরও লাল হয়ে গেল । জন আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল - " হ্যাঁ, এবারে তোমাকে আমি একেবারেই ডিভোর্স দিয়ে দেব ।" কাঁদতে কাঁদতে আমি বললাম - " হ্যাঁ, তাই দাও । তোমার হাত থেকে রেহাই পাই "। কথাটা শুনে জন একদৃষ্টিতে গম্ভীর ভাবে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল । তারপর শোবার ঘরে চলে গেল ।
আমি আমার শোবার ব্যবস্থা আমার মিউজিক রুম সংলগ্ন একটা ঘরে করেছিলাম । ডিনারের পর অনেক রাত পর্যন্ত পিয়ানো বাজাতাম । তারপর সেই ঘরে একাই শুয়ে পড়তাম । জনের সাথে কথা তখন প্রায় বন্ধ । ও আমাকে আর কিছুই বলে না । আমার মাথায় তখন শুধু ডিভোর্সেরই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে । কয়েকদিন এভাবেই চলছিল । কিন্তু হঠাৎ একদিন রাতে যে ঘটনা জন ঘটালো তা আমার কাছে আজও অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় । সেদিন পর্যন্তও বুঝতে পারিনি জন এত কঠোর, এত নিষ্ঠুর । আমার প্রিয় পিয়ানো থেকে আমাকে এত দূরে সরিয়ে দেবে । সেদিন রাতে বেঞ্জামিনের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে ডিনার করে বাড়ি ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা হয়ে গেল । বেঞ্জামিন বাড়ির সামনেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল । আমি সোজা আমার ঘরে চলে গেলাম । তারপর ফ্রেস হয়ে পিয়ানো নিয়ে বসলাম । একমনে বাজিয়ে চলেছি । কোনদিকে খেয়াল নেই । হঠাৎ একটা জোর আওয়াজ । আমি ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লাম । তারপর আরও একটা আওয়াজ । আমার হাজব্যান্ড তার লাইসেন্সড রিভলভার থেকে আমাকে গুলি করে নিজেকেও গুলি করে শেষ করে দিল । কিছুক্ষন ছটপট করতে করতে দুটো দেহই নিথর হয়ে গেল ।"
নিজের অজান্তেই আমার মুখ থেকে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল । সারা শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল । মনে হল মাথা থেকে পা পর্যন্ত কে যেন বরফ দিয়ে ঘষে দিল । আমি আরও সিঁটিয়ে গেলাম । ভাবলাম এ কার খপ্পরে পড়লাম ? কি যে হবে ভেবে কুল-কিনারা পেলাম না । মহিলা বলে চলল - " আমাদের বাড়িটা নিলাম হয়ে যাবার পর আমার প্রিয় পিয়ানোটা হাত বদল হতে হতে ঐ দোকানে ঠাই পায় । আপনার আগে কয়েকজন এটা কম দামে কিনেছিল । কিন্তু দুঃখের বিষয় কেউই এটাকে ধরে রাখতে পারেনি । কম দামে আবার ঐ দোকানেই সেল করে দিয়েছে । আমি আজও আমার শখের পিয়ানোটাকে ভুলতে পারিনি । রোজ রাতে না বাজালে আমি শান্তি পাই না । এটার স্থান পরিবর্তন হোক সেটা আমি চাই না । আমি ঐ দোকানেই বাসা বেঁধে আছি । দোকানের লোকজন চলে গেলে মনের আনন্দে পিয়ানো বাজাই । আপনার ক্ষতি হোক আমি চাই না । যেভাবেই হোক কালকেই আপনি এটা ঐ দোকানে দিয়ে আসবেন । আমার কথা না শুনলে ফল খুব খারাপ হবে । " দুর্বল ভাবে দেখলাম কথাগুলো বলার পর ক্লারার চোখদুটো থেকে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে । তারপর পিয়ানোর রিডগুলো টুংটাং আওয়াজ করে থেমে গেল আর ক্লারার মূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল । ভয়ে আমি স্থবিরের মত দাঁড়িয়ে রইলাম ।
পূবের জানালা দিয়ে সদ্য ওঠা সূর্যের আবছা আলো ঘরের দেওয়ালে পড়েছে । আস্তে আস্তে আমি স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম । আজ আর আমি অফিসে যাব না । আজই আমার শখের পিয়ানোটা আরও কম দামে ঐ দোকানেই রি-সেল করে দিতে হবে ।।
...........................
পিয়ানোর কাছে যেতেই দোকানের এক কর্মচারী বলে উঠল - ' দাদা পিয়ানোটা দেখবেন ?' আমি বললাম - 'দেখব বলেই তো এলাম ।' এরপর পাশে রাখা টুলে বসে পিয়ানোর রিডগুলোতে হাত রাখলাম । মনে হল কন্ডিশন বেশ ভালই আছে । মনটা আনন্দে ভরে গেল । কিছুক্ষন বাজানোর পর সোজা দোকান-মালিকের কাছে এলাম । জিজ্ঞাসা করলাম - 'এই পিয়ানোর দাম কত হবে ?' দোকান-মালিক যে দাম বলল সেটা কমই মনে হল । আমার সাধ্যের মধ্যেই । আমি বললাম - 'দাদা এই পিয়ানোটা আমি কিনতে চাই ।' দোকান-মালিক আমার মুখের দিকে চেয়ে একটু উদাস ভাবে বলল - ' বেশ তো পছন্দ যখন হয়েছে নিয়ে যান । ঘরে রাখতে পারলে তো ভালই ।' মালিক ভদ্রলোক এমন হেঁয়ালির সুরে কথাগুলো বললেন তাতে একটু বিরক্ত বোধ করলাম । পয়সা দিয়ে জিনিষ কিনব তাতে ওনার এভাবে কথা বলার কি আছে ? আর কথা না বাড়িয়ে বললাম - ' হ্যাঁ আমি নেব । কত এডভান্স করতে হবে বলুন, কালই ডেলিভারি নেব ।' ভদ্রলোক একটু মুচকি হেসে বললেন - 'অ্যাডভান্স কিছু করতে হবে না । সরাসরি টাকা দিয়ে নিয়ে যাবেন । ডেলিভারির যাবতীয় বন্দোবস্ত আমিই করে দেব ।'
বেশ খোশ মেজাজেই দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম । পার্ক সার্কাস থেকে কালিকাপুরের বাসে উঠে জানালার ধারের সিটে বসলাম । বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে বারে বারে মনে পরে যাচ্ছিল পিয়ানোর কথা । কত দিনের পোষা শখ মিটতে চলেছে ভেবে ভীষণ আনন্দ পাচ্ছিলাম । বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে ন'টা হয়ে গেল । কাছাকাছি একটা দোকান থেকে রুটি তরকা এনে রাতের খাবার সাঙ্গ করলাম । ছোট্ট দোতলা বাড়িটাতে আমি একাই থাকি । দেশের বাড়ি বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থেকে মা মাঝে মাঝে এসে থাকেন । বাড়িতে একটা ঘর রেখেছি শুধু গান বাজনার জন্য । শোবার আগে ঢুকলাম সেই ঘরে । ঘরের নতুন অতিথিকে কোথায় বসাব সেটা দেখে নিলাম । জানালার ধারে জায়গাটা পছন্দ হল । মন খুশীতে ভরে গেল এই ভেবে যে এই খোলা জানালার কাছে বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে পিয়ানোয় সুর তুলব । পিয়ানোর আনন্দে কিছুতেই ঘুম আসছিল না । বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম । খোলা আকাশের দিকে চাইলাম । পরিস্কার আকাশ । দু'দিন পরেই পূর্ণিমা । মিষ্টি চাঁদের আলোর ছটায় সারা পরিবেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে । আকাশময় তারাদের দল আল্পনা এঁকে চলেছে । গলা দিয়ে গুন গুন করে বেরিয়ে এল রবি ঠাকুরের " আমার মনের মাঝে সুধা আছে চাইগো ... "
পরের দিন সকালে সে কি আনন্দ ! আজ সে আসবে আমার ঘর আলো করে । অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সোজা পার্কস্ট্রীটের সেই দোকান । পেমেন্ট করতে করতেই দেখলাম রাস্তার ধারে দাঁড়ানো ছোট ম্যাটাডোরে আমার প্রিয় পিয়ানো উঠে গিয়েছে । সঙ্গে দুটো ছেলেকেও দিয়ে দিয়েছে দোকানী । আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলাম । হু হু করে গাড়ি ছুটে চলল । আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে গেলাম । আমার নতুন অতিথি তার যোগ্য মর্যাদার সাথে গান-বাজনার ঘরে নির্দিষ্ট জায়গাতেই জায়গা পেল । আমার আনন্দ আর ধরে না । যখন মিশনারি স্কুলে পড়তাম তখন থেকেই পিয়ানো বাজানোর শখ । স্কুলের বিভিন্ন ফাংশানে ফাদার যখন পিয়ানো বাজাতেন আমি মন দিয়ে শুনতাম । এত মিষ্টি লাগত সেই সুর তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না । আজ আমার প্রিয় সুরের যন্ত্র আমারই সামনে এটা ভেবে মনে হয় আমি স্বপ্ন দেখছি না তো ? দেরি না করে হাত মুখ ধুয়ে এসে টুলটা টেনে নিয়ে পিয়ানোর সামনে বসলাম । ঢাকনা খুলে রিডে হাত রাখলাম । অপূর্ব ধ্বনিতে সারা ঘর মুখরিত হয়ে উঠল । সত্যিই পুরানো জিনিষের কদরই আলাদা । পুরানো চাল ভাতে বাড়ে । প্রায় দুঘণ্টা পিয়ানোয় সুর তুললাম । তারপর পাশের বেডরুমে গিয়ে তন্দ্রালু চোখে গা এলিয়ে দিলাম ।
পরের দিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে এসেই বসে গেলাম আমার প্রিয় সুরেলা বাদ্য যন্ত্রের সামনে । সুরের মূর্ছনায় ভাসিয়ে ফেললাম নিজেকে । বাড়ির আবহ ভরপুর হয়ে উঠল মধুর শব্দ-সঙ্গীতে । রাতের খাবার খেতে বেশ দেরিই হয়ে গেল । আবার বেশ কিছুক্ষন পিয়ানো বাজিয়ে ঘুমোতে গেলাম । গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল । মনে হল ঘরের মধ্যে কে যেন হাঁটা চলা করছে । ঘুম চোখে ভাবলাম নিশ্চয়ই বিড়াল ঢুকেছে ঘরের খোলা জানালা দিয়ে । উঠতে ইচ্ছে করল না । বিড়াল ঢুকলে সকালে বের করে দিলেই হবে । আবার ঘুমিয়ে পড়লাম । সকালে ঘুম থেকে উঠে সারা ঘর খুঁজে দেখলাম বিড়াল কোথাও নেই । তাহলে বিড়াল গেল কোথায় ? নিশ্চয়ই খোলা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেছে ।
দুদিন পর অফিস থেকে ফিরে পিয়ানো নিয়ে বেশ সময় কেটে গেল । রাতের খাবার খেয়ে শোবার পর ঘুম এসে গেল । হঠাৎ একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল । মনে হল আমার ঘরের মধ্যে কে যেন হাঁটা-চলা করে বেড়াচ্ছে । আজ একটু চমকে গেলাম । দুদিন আগে যে রকম আওয়াজ পেয়েছিলাম আজও ঘরের মধ্যে ঠিক সেরকমই একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ । হঠাৎই শুনতে পেলাম মৃদু স্বরে এক নারীকণ্ঠের কান্না । এবার একটু ভয় পেয়ে গেলাম । ভাবলাম তাহলে কি ঘরে কেউ ঢুকে বসে আছে ? কিন্তু সদর দরজা তো অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছি । তাহলে ঘরে কিভাবে কে ঢুকল ? মনে একটু সাহস আনবার চেষ্টা করলাম । আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে টিউব লাইটের সুইচটা অন করলাম । কোথায় কে ? ঘর একদম ফাঁকা । নাঃ তাহলে নিশ্চয়ই ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছি । মনকে সান্ত্বনা দিয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম । মাঝরাতে আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমার মিউজিক রুম থেকে পিয়ানোর আওয়াজ ভেসে আসছে । কানটা একটু খাড়া করলাম । হ্যাঁ ঠিকই । মনে হল ঐ ঘরে কে যেন পিয়ানোয় ওয়েসটার্ন মিউজিকের সুর বাজিয়ে চলেছে । বেশ ঘাবড়ে গেলাম । সাহসে ভর করে তাড়াতাড়ি পাশের মিউজিক রুমের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম । কোন বাজনার আওয়াজ নেই । লাইটের সুইচটা অন করলাম । নাঃ কোথাও কেউ নেই ! কি ব্যাপার ঘটে গেল কিছু বুঝতে পারলাম না । তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখলাম ? চারিদিক ভালভাবে লক্ষ্য করে বিছানায় ফিরে এলাম । বাকি রাতে আর ঘুম এল না । জেগেই কাটালাম ।
সারাদিনের কর্মব্যাস্ততায় রাতের ঘটনা ভুলেই গিয়েছিলাম । সন্ধ্যাবেলা যথারীতি বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে আবার পিয়ানোটা নিয়ে বসলাম । একমনে পিয়ানো বাজাচ্ছি । হঠাৎ এক নারীকণ্ঠের খিলখিল হাসিতে চমকে উঠলাম । হৃদ-যন্ত্রে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল । পিয়ানোর বাজনা থামিয়ে ঘরের চারপাশ দেখলাম । কাউকেই দেখতে পেলাম না । কিন্তু এখন তো আমি কোন স্বপ্ন দেখছি না, জেগেই আছি । তাড়াতাড়ি পাশের ঘরগুলো দেখে নিচে নেমে সদর দরজাও দেখে এলাম । কেউ কোথাও নেই । আজ মুডটাই অফ হয়ে গেল । বাড়িতে এসব যে কি হচ্ছে বোধগম্য হল না । ভুতের ভয় আমার কোন দিনই নেই । কিন্তু এটা সত্যি আমি স্পষ্ট এক নারীকণ্ঠের হাসির শব্দ শুনেছি । পিয়ানোর কাছে আর যেতে ইচ্ছে করল না । শোবার ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকলাম ।
পর পর দুদিন এই ভাবে কেটে গেল । বাড়িতে কি যে হচ্ছে বুঝতে না পেরে দোদুল্যমান চিত্তে কাটাতে হচ্ছে । তৃতীয় দিন রাতে কিছুক্ষন পিয়ানোয় সুরের ঝংকার তুললাম । তারপর রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম । রাত তখন বেশ গভীর । হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমার কপালের উপর কার যেন একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল । আমি চমকে উঠলাম । ঘুম-চোখে কিছু ঠাহর করতে পারলাম না । তারপর অনুভব করলাম আমার কপালে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল পড়ল । আমার মত সাহসী এবার খুবই ভয় পেয়ে গেলাম । ঘরের দক্ষিন দিকের জানালাটা খোলাই থাকে । সেই জানালা দিয়ে অর্ধ চাঁদের আলো ঘরের ভিতর এক আলো-আঁধারি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে । হঠাৎ মাথার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম । এক সুন্দরী বিদেশিনী আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে । ভয়ে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল । হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি দ্বিগুণ বেড়ে গেল । ভেবে পেলাম না কে এই মহিলা ? কি ভাবে আমার ঘরে ঢুকল ? কিন্তু জিজ্ঞাসা করার সাহস হারিয়ে ফেললাম । গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোল না । কি করব বুঝে উঠতে পারলাম না । উঠে বসার ক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেললাম । মনে হল সারা শরীর শিথিল হয়ে যাচ্ছে । কে যেন বিছানার সঙ্গে আমার শরীরটা বেঁধে ফেলছে । তবুও বিছানার পাশের সুইচ বোর্ডে লাইটের সুইচটা অন করতে হাত বাড়াতেই নারী মূর্তি হাত নাড়িয়ে নিষেধ করল - ' নো নো সিস্টার, ডোন্ট লাইট '। সঙ্গে সঙ্গে হাতটা সরিয়ে নিয়ে আমি আরও কুঁকড়ে গেলাম । এরপর আধা ইংরাজি আধা বাংলাতে বলল - ' ভয় পাবেন না । আমি আপনার কোন ক্ষতি করব না । শুধু একটা অনুরোধ আপনাকে রাখতে হবে । যে পিয়ানো আপনি বাড়িতে নিয়ে এসেছেন সেটা আর বাজাবেন না । ঐ দোকানে ফেরত দিয়ে আসবেন ।' নারী-মূর্তির কথায় মনে একটু সাহস এল । ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললাম - ' কে আপনি ? এখানে এলেন কি করে ? আর কেনই বা আমি পিয়ানোটা দোকানে ফেরত দেব ? রীতিমত পয়সা খরচা করে আমি পিয়ানোটা কিনেছি ।'
- 'আমি সব বলব আপনাকে । কিন্তু ঐ পিয়ানোটা আমার ।'
- 'আমার মানে ? আমি সেকেন্ড সপ থেকে কিনে এনেছি ।'
- ' তবু বলব ঐ পিয়ানোটা একান্তই আমার । আমি ঐ পিয়ানো বাজাতাম । এখনও বাজাই । অন্য কেউ আমার পিয়ানো ব্যবহার করুক সেটা আমি চাই না ।'
- ' আমি আপনার কথা কিচ্ছু বুঝতে পারছি না । '
- ' বুঝবেন, বুঝবেন, সব বুঝবেন । আগে মিউজিক রুমে চলুন, একটু পিয়ানো বাজাবো । কিন্তু প্লিজ লাইট জ্বালাবেন না ।'
নারীমূর্তি আমার আগেই পাশের মিউজিক রুমের দিকে পা বাড়াল । আমি খুব কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠে কোনক্রমে দাঁড়ালাম । তারপর আস্তে আস্তে সাহসে ভর করে দুর্বল শরীরে পাশের মিউজিক রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালাম । আবছা আলোয় দেখলাম ঐ নারীমূর্তি খুব সুন্দর এক মেমসাহেব । সারা শরীর সাদা গাউনে ঢাকা । মাথার চুলগুলো লালচে । পিয়ানোর সামনে রাখা টুলে বসে পিয়ানো বাজাতে শুরু দিয়েছে । একটা ওয়েস্টার্ন মিউজিক । কি অপূর্ব তার হাত, কি মনোমুগ্ধকর তার সুর । আমি সুরের ঝঙ্কারে বিমোহিত হয়ে গেলাম । কিছুক্ষন পরে ঐ নারীমূর্তির কথায় আমার সুর-মূর্ছনা ভাঙল । নারীমূর্তিটি এবার পিয়ানোর রিড থেকে হাত উঠিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল -
আমার নাম ক্লারা ক্রিস্টোফার । হাজব্যান্ডের নাম জন ক্রিস্টোফার । আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের কথা । আমরা থাকতাম কারসিয়াং-এ । আমরা খুব সুখেই ছিলাম । ছেলেবেলা থেকেই গান বাজনার প্রতি আমার খুব আকর্ষণ । আর পিয়ানো বাজিয়ে সুর তুলে গান করব এটা আমার ভীষণ শখ । হাজব্যান্ড কোনদিন বাধাও দেননি । একদিন দুজনে দোকানে গিয়ে একটা পিয়ানো কিনে আনলাম । কিন্তু শেখাবে কে ? মাস্টারের খোঁজ চলল । ভাগ্যক্রমে একদিন এক পার্টিতে আমার হাজব্যান্ডের বন্ধু বেঞ্জামিন গোমেজের সাথে পরিচয় হল । উনি খুব ভাল পিয়ানো বাজাতে পারতেন । আমার হাজব্যান্ডের অনুরোধে উনি আমাকে পিয়ানো শেখাতে রাজি হয়ে গেলেন । ওনার কাছে পিয়ানো বাজানো শিখতে শিখতে কখন যে আমি ওনাকে আমার মনটা দিয়ে ফেললাম আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারিনি । আমাদের দু'জনের মধ্যে খুব ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেল । আর এই প্রিয় পিয়ানোটা হয়ে রইল সাক্ষী । বেশ কয়েকটা পার্টিতে আমরা দু'জনে ফাংশনও করলাম । কাজের চাপে আমার হাজব্যান্ড সব ফাংশান অ্যাটেনড করতে পারতেন না । কিছুদিন পর থেকেই বেঞ্জামিনকে নিয়ে আমাকে সন্দেহ করতে লাগল আমার হাজব্যান্ড । আমারও জেদ বেড়ে গেল । আরও বেশি ফাংশন করতে শুরু করলাম । রাত করে বাড়ি ফিরতাম । মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্ট থেকে বেঞ্জামিনের সাথে ডিনার করে আসতাম । প্রথম প্রথম এ-সব নিয়ে হাজব্যান্ডের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হত । কিন্তু এরপর কথা কাটাকাটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছাল । হাজব্যান্ড আমার গায়ে হাত তুলতে শুরু করল । আমার মন কেমন যেন চেঞ্জ হয়ে গেল । আমি আর বেঞ্জামিন বিয়ে করব বলে ঠিক করলাম । কিন্তু তার আগে জনকে তো ডিভোর্স দিতে হবে । একদিন জনের সঙ্গে ঝগড়া চরমে উঠতেই ওকে ডিভোর্সের কথা বললাম । ডিভোর্সের কথা শুনে জনের লাল মুখ আরও লাল হয়ে গেল । জন আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল - " হ্যাঁ, এবারে তোমাকে আমি একেবারেই ডিভোর্স দিয়ে দেব ।" কাঁদতে কাঁদতে আমি বললাম - " হ্যাঁ, তাই দাও । তোমার হাত থেকে রেহাই পাই "। কথাটা শুনে জন একদৃষ্টিতে গম্ভীর ভাবে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল । তারপর শোবার ঘরে চলে গেল ।
আমি আমার শোবার ব্যবস্থা আমার মিউজিক রুম সংলগ্ন একটা ঘরে করেছিলাম । ডিনারের পর অনেক রাত পর্যন্ত পিয়ানো বাজাতাম । তারপর সেই ঘরে একাই শুয়ে পড়তাম । জনের সাথে কথা তখন প্রায় বন্ধ । ও আমাকে আর কিছুই বলে না । আমার মাথায় তখন শুধু ডিভোর্সেরই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে । কয়েকদিন এভাবেই চলছিল । কিন্তু হঠাৎ একদিন রাতে যে ঘটনা জন ঘটালো তা আমার কাছে আজও অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় । সেদিন পর্যন্তও বুঝতে পারিনি জন এত কঠোর, এত নিষ্ঠুর । আমার প্রিয় পিয়ানো থেকে আমাকে এত দূরে সরিয়ে দেবে । সেদিন রাতে বেঞ্জামিনের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে ডিনার করে বাড়ি ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা হয়ে গেল । বেঞ্জামিন বাড়ির সামনেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল । আমি সোজা আমার ঘরে চলে গেলাম । তারপর ফ্রেস হয়ে পিয়ানো নিয়ে বসলাম । একমনে বাজিয়ে চলেছি । কোনদিকে খেয়াল নেই । হঠাৎ একটা জোর আওয়াজ । আমি ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লাম । তারপর আরও একটা আওয়াজ । আমার হাজব্যান্ড তার লাইসেন্সড রিভলভার থেকে আমাকে গুলি করে নিজেকেও গুলি করে শেষ করে দিল । কিছুক্ষন ছটপট করতে করতে দুটো দেহই নিথর হয়ে গেল ।"
নিজের অজান্তেই আমার মুখ থেকে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল । সারা শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল । মনে হল মাথা থেকে পা পর্যন্ত কে যেন বরফ দিয়ে ঘষে দিল । আমি আরও সিঁটিয়ে গেলাম । ভাবলাম এ কার খপ্পরে পড়লাম ? কি যে হবে ভেবে কুল-কিনারা পেলাম না । মহিলা বলে চলল - " আমাদের বাড়িটা নিলাম হয়ে যাবার পর আমার প্রিয় পিয়ানোটা হাত বদল হতে হতে ঐ দোকানে ঠাই পায় । আপনার আগে কয়েকজন এটা কম দামে কিনেছিল । কিন্তু দুঃখের বিষয় কেউই এটাকে ধরে রাখতে পারেনি । কম দামে আবার ঐ দোকানেই সেল করে দিয়েছে । আমি আজও আমার শখের পিয়ানোটাকে ভুলতে পারিনি । রোজ রাতে না বাজালে আমি শান্তি পাই না । এটার স্থান পরিবর্তন হোক সেটা আমি চাই না । আমি ঐ দোকানেই বাসা বেঁধে আছি । দোকানের লোকজন চলে গেলে মনের আনন্দে পিয়ানো বাজাই । আপনার ক্ষতি হোক আমি চাই না । যেভাবেই হোক কালকেই আপনি এটা ঐ দোকানে দিয়ে আসবেন । আমার কথা না শুনলে ফল খুব খারাপ হবে । " দুর্বল ভাবে দেখলাম কথাগুলো বলার পর ক্লারার চোখদুটো থেকে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে । তারপর পিয়ানোর রিডগুলো টুংটাং আওয়াজ করে থেমে গেল আর ক্লারার মূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল । ভয়ে আমি স্থবিরের মত দাঁড়িয়ে রইলাম ।
পূবের জানালা দিয়ে সদ্য ওঠা সূর্যের আবছা আলো ঘরের দেওয়ালে পড়েছে । আস্তে আস্তে আমি স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম । আজ আর আমি অফিসে যাব না । আজই আমার শখের পিয়ানোটা আরও কম দামে ঐ দোকানেই রি-সেল করে দিতে হবে ।।
...........................
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
Malay Mondal ২০/০৭/২০১৪asadharan....