www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সেই দিন

শ্রাবণ মাস । সকাল থেকেই আজ আকাশের মুখ ভার । মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মুষলধারে বৃষ্টি নামবে । শ্রেয়ার মনে আজ ভীষণ কষ্ট । আজ আর কিচ্ছু ভাল লাগছে না তার । তার মাসীর এই আগরপাড়ার বাড়িতে এর আগেও সে অনেকবার এসেছে কিন্তু মাসতুতো বোন এষার বিয়ে উপলক্ষে এবার এসে তার অনুভুতি যেন একেবারেই আলাদা লাগছে । সকাল থেকেই বিয়ে বাড়িতে সকলেই ব্যস্ত । এষাকে নিয়ে বাড়ির সবাই টানাটানি শুরু করেছে । হবু শ্বশুর বাড়ি থেকে গায়ে হলুদের তত্ত্ব এসেছে । এয়োতিরা হাসি-ঠাট্টা করতে করতে এষাকে স্নান করাতে চলেছে । উলু আর শঙ্খ-ধ্বনিতে সারা বাড়ি গমগম করছে । শ্রেয়া নিজেকে আর সামলাতে পারল না । ব্যাথায় বুকটা টনটন করে উঠল । সবার অলক্ষে শ্রেয়া তাড়াতাড়ি বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে চলে এল । এবার ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল । বৃষ্টির জোর এতটাই বেড়ে গেল যে যেদিকে তাকানো যায় শুধুই ঝাপসা । বৃষ্টির দৈত্য-রূপ দেখতে দেখতে শ্রেয়া যেন কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ল । তার চোখের সামনে ছবির মত ভেসে উঠল তার জীবনের এই দিনটির কথা ।

চোদ্দ বছর আগে ঠিক এই দিনটিতে সেও গায়ে হলুদ মেখেছিল । সেদিন তার বিয়ে উপলক্ষ্যে কত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এসেছিল । এয়োতিরা তার সারা শরীর হলুদের তত্ত্ব মাখাতে মাখাতে কত ইয়ার্কি- ফাজলামি করেছিল । সবার কথা মনে না পড়লেও তার পিসতুতো দিদি স্বপ্নালির কথা আজও মনে আছে শ্রেয়ার । স্বপ্নালিদি বলেছিল - "শ্রেয়া তুই তো এমনিতেই ফর্সা সুন্দরী । হলুদ মাখানোর পর তোর সারা শরীরে  সোনার প্রলেপে ঢেকে গেল যে । দেখবি তোর বর তোকে সোনায় মুড়ে রাখবে ।" স্বপ্নালিদির কথাটা মনে পড়তেই শ্রেয়া ডুকরে কেঁদে ফেলল । এই দিনেই সেও প্রতীক্ষায় ছিল তার হবু বর অরিন্দমের জন্য ।  অরিন্দম ছিল এক নামী কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার । দেখতেও সুদর্শন । বিয়ের কয়েক বছর বেশ রঙিন ভাবেই কেটে যাচ্ছিল তার জীবনের রোমান্টিক দিনগুলো । দেড় বছরের মধ্যে কোল আলো করে এলো তার জীবনের সব চেয়ে বড় পাওয়া বিপাশ । বিপাশের প্রথম জন্মদিন তাদের লেক-গার্ডেনসের সুন্দর সাজানো ফ্লাটে ধুমধাম করে তারা পালন করেছিল । হঠাৎ কোথা থেকে যে কি ঘটে গেল ! পুরানো বন্ধু দীপের সাথে তার দেখা হওয়াটাই তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ালো । সেদিন যদি নিউ মার্কেট থেকে সপিং সেরে গাড়িতে ফেরার পথে দীপকে লিফট না দিত আর তার মোবাইল নাম্বার না দিত তা হলে আজ হয়তঃ তাকে এই অবস্থায় পড়তে হত না । দীপকে সে কোন দোষ দিতে পারে না । কারণ শ্রেয়ার অনুরোধেই সে কয়েকবার তাদের ফ্লাটে এসেছে । মাঝে মাঝে মোবাইলেও কথা বলেছে । দীপের সাথে তার সম্পর্কটা ছিল নেহাতই বন্ধুত্বের । কিন্তু অরিন্দম তাদের সম্পর্কটা একদমই মেনে নিতে পারেনি । তাকে বিশ্বাসও করতে পারেনি । সর্বদাই তার মন সন্দেহের ঘূর্ণাবর্তে আচ্ছন্ন থাকত । দু'জনের দাম্পত্য-জীবনে চরম অশান্তি দেখা দিল । অশান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে অরিন্দম শ্রেয়ার গায়ে হাত তুলতেও কুণ্ঠা বোধ করেনি । অরিন্দমের হাতে মারধোর খেতে খেতে শ্রেয়ারও জেদ বেড়ে গিয়েছিল । শ্রেয়া অরিন্দমকে বলেছিল - " বেশ করেছি, দীপ আমার বন্ধু । ও নিশ্চয়ই আমার ফ্লাটে আসবে ।" অরিন্দম বলেছিল - " না, দীপ এবার এলে তোদের দুটোকে একসাথে জীবন্ত কবর দেব ।" এরপর শ্রেয়া আর দেরী করেনি । অনন্যোপায় হয়ে বিপাশকে নিয়ে তার মায়ের কাছে চলে এসেছিল । এখন সে একা । জীবিকা নির্বাহের জন্য স্কুলের একটা চাকরি সে পেয়ে গেছে । কারসিয়াং কনভেন্ট স্কুলে পড়ুয়া ছেলে বিপাশকে নিয়েই তার বর্তমান জীবন । তাকে মানুষ করে তোলাই এখন তার একমাত্র লক্ষ্য ।

হঠাৎ নীচ থেকে মাসীর গলা শোনা গেল - "শ্রেয়া কোথায় গেলি ? আয়, এষাকে আশীর্বাদ করে যা ।" সম্বিত ফিরে পেতেই শ্রেয়া দেখল তার শাড়ির সামনের অংশটা চোখের জলে ভিজে গেছে । বাইরে তখনও অঝোরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে । দু'হাতের আঙ্গুল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে গেল শ্রেয়া ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৬৩৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৫/০২/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast