www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অব্যক্ত

বাঁকুড়ার বর্ধিষ্ণু গ্রাম সোনাঝুড়ি । এখানেই হৈমন্তীর তিন পুরুষের বাস । বাবা চলে যাবার পর মা অপর্ণা দেবীকে নিয়ে প্রায় একবছর খুবই কষ্টে কাটাতে হয়েছে তাকে । পৈতৃক দোতলা বাড়িটার অবস্থাও প্রায় বেহাল । বি,এ, পাশ করার পর কয়েকটা টিউশনি করে কোনক্রমে দিন গুজরান করতে হয় তাদের । বাড়ির ভগ্নদশা কাটাবারও কোন উপায় ছিল না । বিষ্ণুপুর শহরে তাদের টেরাকোটা শিল্পের একটা দোকান ছিল । বাবাই দেখভাল করতেন সেটা । কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর অতদুরে ঐ দোকান চালানো তার আর তার মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিলনা । অতঃপর দোকানটা বন্ধই করে দিতে হয়েছিল । হৈমন্তীর এমতাবস্থায় একটা চাকরির খুবই প্রয়োজন ।

আজ প্রায় দু'মাস হল হৈমন্তীর একটা চাকরি জুটেছে । বিষ্ণুপুর পি,ডব্লু,ডি, অফিসে ক্যাজুয়াল কাজ । ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে আগামীতে পার্মানেন্ট হতেও পারে । গ্রামের এক সহৃদয় ব্যাক্তির মাধ্যমে স্থানীয় এম,এল,এ,-র সুপারিশেই তার এই চাকরি । সোনাঝুড়ি থেকে বাসে পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যেই সে তার কর্মস্থলে পৌঁছে যায় । এখন তার দুঃখের দিন শেষ । একটু একটু করে সে আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখতে পেল । অন্যদিকে অফিসের কাজকর্মেও কয়েকদিনের মধ্যে বেশ দক্ষ হয়ে উঠল । গত দু'মাসের মধ্যে সেরকম কোন অসুবিধার সম্মুখীন তাকে হতে হয়নি । বেশ ভালই চলছিল হৈমন্তীর । কিন্তু বাধ সাধল অফিসের নতুন হেড-বস । চিফ ইঞ্জিনিয়ার মিঃ রায় চৌধুরী বদলি হয়ে চলে যাবার পর তার জায়গায় এলেন মিঃ দাসগুপ্ত । বয়স প্রায় ছাপ্পান্ন সাতান্ন হবে । অবসর নেবার সময়ও সমাগত । ভদ্রলোক সেকশনের মধ্য দিয়ে যাবার সময় অদ্ভুত ভাবে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন । কারণে অকারণে যখন তখন তাকে তার ঘরে ডেকে পাঠান । হেড বসের এ-হেন আচরনে হৈমন্তী বেশ অস্বস্থি বোধ করতে থাকে । বেশ কিছুদিন এই ভাবে চলতে চলতে হৈমন্তী অতিষ্ঠ হয়ে উঠল । গ্রামের মেয়ে হৈমন্তী এ-রকম পরিবেশের মুখোমুখি কোন দিনই হয়নি, একেবারেই অনভ্যস্থ । সে বুঝেও উঠতে পারেনা এই রকম বিরক্তিকর পরিবেশে কি ভাবে নিজেকে মানিয়ে নেবে কিম্বা পরিত্রান পেতে কি উপায় অবলম্বন করবে ?

সেদিন অফিস থেকে বেরুতে বেশ দেরীই হয়ে গেল হৈমন্তীর । বাড়ি ফেরার জন্য সে বাস স্টপে এসে দাঁড়ায় । সন্ধ্যার সময় সোনাঝুড়ির বাস খুবই কম । আধ ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পর বাস । বাসের প্রতিক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে সে । হঠাৎই তার সামনে এসে দাঁড়ায় একটা সাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়ি । হৈমন্তী দেখল তাদের অফিসের হেড বস মিঃ দাসগুপ্তের গাড়ি । গাড়ির পিছনের সিট থেকে হেড বসের গলা ভেসে এল - " হৈমন্তী, আজ তোমার অনেক দেরী হয়ে গেছে । বাড়ি পৌছাতে তোমার অনেক রাত হয়ে যাবে । উঠে পড়ো গাড়িতে । তোমাকে পৌঁছে দেব ।"
হেড বসের গলা শুনে প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল হৈমন্তী । তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ইতঃস্তত করে বলল - " না, না স্যার । তার প্রয়োজন হবে না । এক্ষুনি বাস এসে যাবে । আমি ঠিক মতই চলে যাব ।" হেড বসের সাথে কথা বলতে বলতেই হৈমন্তীর বাস এসে পড়ল । সে বাসে উঠতে উঠতে দেখল ভদ্রলোক আর কোন কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভারকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন ।

প্রায় ছ'মাস ধরে এ-রকম বিরক্তিকর অস্বস্থিকর পরিবেশে চলতে লাগল হৈমন্তীর কাজকর্ম । এমন অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে অন্য স্টাফদের জানিয়ে দেবে বলেই সে একদিন মনঃস্থির করল ।ঙ্কিন্তু পরদিন অফিসে এসে তার সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল । সে জানতে পারল তাদের বড় সাহেব মিঃ দাসগুপ্ত সামনের সপ্তাহ থেকে আর অফিসে আসবেন না । এখানকার চাকরি ছেড়ে আমেরিকায় চলে যাচ্ছেন । সেখানে আরও ভালো একটা চাকরিতে যোগ দেবেন । এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচল হৈমন্তী । সামনের সপ্তাহ থেকে বিরক্ত করবার আর কেউ থাকবে না ।

অফিস ছেড়ে যাবার আগের দিন মিঃ দাসগুপ্ত হৈমন্তিকে তার চেম্বারে ডেকে পাঠালেন । হেড বস চলে যাচ্ছেন । সৌজন্য সাক্ষাৎ তো তাকে করতেই হবে । দরজা নক করে ঘরে ঢুকতেই মিঃ দাসগুপ্ত সামনের চেয়ারে হৈমন্তিকে বসতে বললেন । হৈমন্তী চেয়ারে বসে হেড বসের মুখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠল । হেড বসের চোখে জল । মৃদু স্বরে হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে মিঃ দাসগুপ্ত বললেন - " হৈমন্তী আমাকে তুমি ভুল বুঝো না । আজ আমার স্বাতী থাকলে তোমারই মত হোতো । তোমার চেহারার সাথে তার অনেক মিল খুঁজে পেয়েছি আমি । "
হেড বসের কথাগুলো শুনে হৈমন্তী বিস্বয়ে হতবাক । শান্ত স্বরে সে জিজ্ঞাসা করে - " স্বাতী কে স্যার ?"
-- " আমার একমাত্র কন্যা । দশ বছর আগে স্কুল থেকে ফেরার পথে এক পথ-দুর্ঘটনায় মারা যায় । মেয়ের অকাল-মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে ছয় মাসের মধ্যে ও-র মা-ও চলে গেল হার্ট-অ্যাটাকে ।"

হৈমন্তীর চোখে নেমে এল জলের ধারা । তার হেড-বসকে এতদিন সে সত্যিই ভুল বুঝে এসেছে । ভদ্রলোককে সে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি । এই মুহূর্তে তার নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে । এতদিন সে নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় দিয়েছে । হৈমন্তী মাথা হেঁট করে বলল - " আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার । এতদিন আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম । কিন্তু এ-কথা আগে কেন বলেননি স্যার ?"
-- " এ-কথা প্রকাশ করতে গেলে আমি খুবই কষ্ট পাই । এখান থেকে চলে যাবার আগে তোমাকে না জানিয়ে গেলে তুমি আমাকে ভুল বুঝতে । এখন আমি একা । এ-দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি, যদি সব কিছু ভুলে থাকা যায় ।"
হৈমন্তী তার চোখের জল আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না । ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল - " আরও একবার ক্ষমা করে দিন স্যার । আমিও পিতৃহারা । আপনি আমার বাবার মত ।"
হৈমন্তী ধীরে ধীরে মিঃ দাসগুপ্তের কাছে গিয়ে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল । মিঃ দাসগুপ্ত তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন । বললেন - " ভালো থেকো ।"
হৈমন্তী শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৫৯৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৭/১২/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast