www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

কমলি

ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে বাস । কোলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে বাস চলেছে মুর্শিদাবাদের দিকে । দীর্ঘদিন পর ডঃ সৌম্যজিত সান্যাল আজ তার দেশের বাড়ি মুর্শিদাবাদ যাচ্ছেন , যেখানে শৈশব কৈশোরের বর্ণময় দিনগুলো কাটিয়েছিলেন তিনি । তার মনটা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠছে । কতদিন পর জন্মভূমিকে দেখবেন । দশবছর ইউ, এস, এ, থেকে গত-সপ্তাহে তিনি দেশে ফিরেছেন । তার স্ত্রী অণ্বেষা আর ছেলে অরিজিৎ তার সাথে আসেনি । তারা আমেরিকাতেই সেটেল্ড , ওখানেই থাকতে চায় । কিন্তু ডঃ সান্যাল পারেননি । দুমাসের ছুটি নিয়ে এসেছেন মনের টানে, প্রাণের টানে, দেশের টানে । প্রথমে কোলকাতায় পৌঁছে তার ঢাকুরিয়ার বাড়িতে উঠেছিলেন । ঢাকুরিয়ার বিশাল বাড়িটা কেয়ারটেকার-এর তত্বাবধানেই থাকে । একা একা ঐ বাড়িতে আর কতো দিন ভালো লাগে ? বেরিয়ে পড়লেন তার জন্মভূমির উদ্দেশ্যে । মুর্শিদাবাদে তাদের পৈত্রিক বাড়িতে তার কাকা, কাকিমা, খুড়তুতো ভাইয়েরা, ভাইবউয়েরা, ভাইপো, ভাইঝিরা আছে । ছুটন্ত বাসের জানালার বাইরে চোখ যেতেই দেখলেন দিগন্তবিস্তৃত সবুজ প্রান্তর । গাছগাছালি, ধানের ক্ষেত দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় । মনের অজান্তে উপলব্ধি করতে লাগলেন ছেলেবেলার সেইসব সোনালী দিনগুলো । মনে পড়ে গেল কমলি মানে কমললতাকে । ছেলেবেলায় কত রাগিয়েছেন তাকে । কথায় কথায় ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলত কমলি, আবার রাগ পড়লেই খিলখিল করে হেসে উঠত । একটু বড় হতেই দুজন দুজনকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন । সে ভালবাসা বেশীদিন স্থায়ী হয়নি । সৌম্যজিৎ-এর বাবা বহরমপুরে ব্যাঙ্কে উচ্চপদস্থ কর্মী ছিলেন । প্রমোশন নিয়ে পরে কোলকাতায় চলে যান ।ঢাকুরিয়ার বাড়িটা খুব কম দামেই কিনেছিলেন বাবা । বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সৌম্যজিৎ পড়াশোনাতে বরাবরই ভালো । মাধ্যমিক থেকে শুরু করে এম,এস,সি পর্যন্ত অসাধারন রেজাল্ট । এরপর পি, এইচ, ডি, করে কেন্দ্রীয় সরকারের এক বৈজ্ঞানিক-সংস্থায় যোগ দেন ডঃসান্যাল । বাবা-মায়ের পছন্দ মত অন্বেষাকে বিয়ে করার এক বছরের মধ্যে ছেলে অরিজিতের জন্ম । অরিজিতের যখন দুবছর বয়স তখন পর পর বাবা মা - দুজনেই চলে গেলেন । তারপর সৌম্যজিৎও কোলকাতার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ইউ,এস,এ-তে পাড়ি দিলেন । এত ঘটনায় পরিবৃত হয়ে ধীরে ধীরে মুর্শিদাবাদের স্মৃতি তার কাছে আবছা হয়ে আসে । হটাৎই বাসের জোর হর্নে তার স্মৃতি রোমন্থনের জাল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল । চমকে উঠলেন তিনি । কৃষ্ণনগর এসে গিয়েছে । পনেরো মিনিটের হল্ট । বাস থেকে নেমে তিনি একটু চা খেয়ে নিলেন । বাস আবার ছুটতে শুরু করলো । ধুবুলিয়া, বেথুয়াডহরী, পলাশী পার করে মুর্শিদাবাদের পথে । জানালার ধারে বসে বাসে যেতে যেতে দারুণ লাগছিল তার । সবে পূজো কেটেছে । কালী পূজোর আর কয়েকটা দিন মাত্র বাকী । দূরের নীল আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যের বিদায় বেলার রক্তিম আভা আর তার ভিতর মনের আনন্দে খেলে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মেঘ। কাশফুলের ঝাড় সবুজ মাঠে হিমেল হাওয়ায় সুখে দোল খাচ্ছে ।

ডঃ সান্যাল যখন নির্দিষ্ট বাসস্টপে পৌঁছালেন তখন রাত প্রায় আটটা । বাস থেকে নেমে বুকভরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি । রাধাকান্তপুর গ্রামের বাতাসের বহুদিনের পুষণ্গণ ন্ধটা নতুন করে তার মনটাকে ভরিয়ে দিল । - ওই তো সেই দীঘিটা ! যার পাড়ে লোকনাথ বাবার মেলা বসতো জ্যৈষ্ঠ মাসে । কত রঙবেরঙের জিনিষ আসতো সেই মেলায়। মেলায় যাওয়া নিয়ে কত বকুনি খেয়েছেন ছোটবেলায় । পুরনো দিনের কথাগুলো মনে পড়তেই ডঃ সান্যাল হেসে ফেললেন । দীঘির পাড়ের সেই বকুলগাছটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে । শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে । হঠাৎই আলো-আঁধারিতে দেখলেন বকুল গাছটার নীচে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে । কাছে আসতেই চমকে উঠলেন ডঃ সান্যাল । আরে এ-তো কমলি,মানে কমললতা । এতো বছর পরেও কমলিকে চিনতে এতটুকুও কষ্ট হোল না তার । কিন্তু তার চেহারার সেই লাবণ্য আর নেই । অনেক রোগা আর কালো হয়ে গিয়েছে । পেঁচিয়ে শাড়ি পরা, সিঁথিতে সিঁদুর ।
-- আরে, কমলি না ?
-- সুমুদা তুমি ? এত বছর বাদে আমাদের মনে পড়ল ? আমি জানতাম গো তুমি একদিন আসবেই । কেমন আছো সুমুদা ?
-- ওই কেটে যাচ্ছে । তুই কেমন আছিস ? তোর শ্বশুর বাড়ি তো শুনেছি অনেক দূরে , এখন বাপের বাড়ি এসেছিস ?
-- হ্যাঁ, এখন এখানেই আছি । ঘর করতে আর পারলাম কোথায় ?
-- তোর কথা সব শুনব । চল এখন আমাদের বাড়ি । চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে ।
সৌম্যজিৎ-এর কথার কোন জবাব না দিয়ে কমলি বলল - সুমুদা তোমার কিছু মনে পড়ে না ? এই দীঘির পাড়ে মেলা বসত । ছেলেবেলায় তোমার সাথে কত এসেছি এখানে ।
-- খুব মনে আছে । হ্যাঁরে কমলি জ্যৈষ্ঠ মাসে এখনও এখানে মেলা বসে ?
-- হ্যাঁ বসে, তবে একটু দূরে, ওই বটতলায় । দুবছর আগে ঐ মেলাটা ভেঙ্গে যাবার পরই এখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায় । তারপর থেকেই মেলাটা ঐ বটতলাতেই বসে ।
-- কতদিন পর তোর সাথে দেখা হল বলত ?
-- তা প্রায় বিশ বছর হবে ।
-- তুই খুব কালো আর রোগা হয়ে গিয়েছিস । ছেলেমেয়ে কটা তোর ?
কমলি একতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল - সে গুড়ে বালি । নেই গো । - কথাটা বলেই কমলি কেমন যেন উদাস হয়ে গেল ।
ডঃ সান্যাল কমলিকে স্বান্তনা দিয়ে বলল - ও নিয়ে মন খারাপ করিস না । কত জনেরই তো হয় না ।
কমলি বলল - ওসব কথা থাক । সুমুদা এই কদম গাছের নীচে একটু বস না, দুজনে একটু গল্প করি । কথাটা বলেই কমললতা সেখানে বসে পড়ল ।
সৌম্যজিৎ কমললতার কথা ফেলতে পারলেন না । হাতের বড় ব্যাগটা পাশে রেখে কমলির গা ঘেঁসে বসলেন । কমলিকে দেখে মনে হল ও খুব খুশী হয়েছে ।
সৌম্য এবার কমলির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন - " এবার বল তোর কথা ।"
কমলি হঠাৎই মুখ বিষণ্ণ করে বলতে শুরু করল - " বালুরঘাটে আমার বিয়ে হয়েছিল । আমার বরের ঘড়ির দোকান ছিল । ভালই চলত । তোমরা এখান থেকে চলে যাবার কিছুদিন পরই সম্বন্ধটা আসে । তখন বিয়ের উপযুক্ত বয়সও আমার হয়নি । ছেলেবেলায় মাকে হারিয়েছি । বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়ল । দাদাদের উপর ভরসা না করে বাবা বিয়েটা দিয়ে দিল ।
সৌম্য কমলিকে একটু থামিয়ে বললেন - " হ্যাঁ, কাকার চিঠিতে জেনেছিলাম তোর বিয়ে হয়ে গিয়েছে ।"
-- পাত্রপক্ষ বেশ কিছু যৌতুক চেয়েছিল, বাবা সাধ্যমত দিয়েওছিল । কিন্তু তাদের দাবিমত মোটরবাইক আর দিতে পারেনি । প্রথম প্রথম আমার স্বামীর স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে বুঝতে পারিনি । কিছুদিন যেতেই সেটা টের পেলাম । মদ, গাঁজা থেকে শুরু করে সব নেশাই ছিল তার । আমাকে প্রায়ই অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করত, মারধরও করত ।
-- শ্বশুর বাড়িতে তোর কে কে ছিল ?
-- শাশুড়ি আর অবিবাহিতা এক ননদ । তারাও কথায় কথায় আমাকে খোঁটা দিত । বাবার কাছ থেকে টাকা, মোটরবাইক নিয়ে আসার জন্য চাপ দিত, মারধোর করত । ওদের ছেলের খারাপ স্বভাবের জন্য আমাকেই দায়ী করত । অবস্থা আরও চরমে উঠল যখন বিয়ের তিন বছর পরেও আমার সন্তান হলনা ।
-- তোর বাবা দাদা কিছু বলত না ?
-- বাবা কি করবে বল ? অসুস্থ মানুষ, দাদার উপরই নির্ভরশীল । আর তা ছাড়া তখন দাদারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে । দাদা বৌদির কথায় চলত । বিবাহিত ননদের দায় আর কটা বৌদি নেয় বল ?
-- এত কষ্ট ছিল তোর কপালে ?
-- এরই মধ্যে বাবা হঠাৎ সেরিব্রাল অ্যাটাকে চলে গেলেন । সে খবর শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছাতেই আমার এক দেওরের সাথে আমাকে শাশুড়ি এখানে পাঠিয়ে দিল । আসবার সময় বলে দিল আমি যেন আর শ্বশুরবাড়ি না ফিরি । বংশরক্ষার জন্য ওরা ছেলের আবার বিয়ে দেবে ।
ডঃ সান্যাল কমলির কথা শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন । কমলির দাম্পত্য জীবনের এ কি পরিণতি ? মনে কষ্ট নিয়ে বললেন - " তারপর " ?
-- বাবার কাজ মিটল । দাদা আমাকে শ্বশুরবাড়িতে ফিরিয়ে দেবার অনেক চেষ্টা করল, আমার শাশুড়ির সাথে বালুরঘাটে গিয়ে দেখাও করল । ওরা দাদাকে খুব অপমান করে ফিরিয়ে দিল । এরপর তো বুঝতেই পারছ । দাদার সব রাগ এসে পড়ল আমার উপর । ঘর-সংসারের সব কাজ করেও বৌদির মন যোগাতে পারলাম না ।
-- তাহলে তুই এইভাবে জীবন চালাচ্ছিস ?
-- চালাতে আর পারলাম কোথায় সমুদা । যাও সমুদা বাড়ি যাও এবার, রাত হয়ে যাচ্ছে ।
-- তুইও চলনা আমার সাথে ?
-- না গো তুমিই যাও । আমি এখানটায় একটু বসি, এখানটায় আমার খুব ভালো লাগে । দীঘির হাওয়া আর ঠাণ্ডা জলে পরানটা জুড়িয়ে যায় গো । তুমি আর দেরী কোরনা । বাড়ির সবাই তোমার জন্য নিশ্চয়ই চিন্তা করছে । কমলির কথায় হুঁশ এলো ডঃ সান্যালের । হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত নটা বেজে গেছে । সত্যিই অনেক রাত হয়ে গেছে । বাড়ির সকলে নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। কমললতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন । বাড়িতে ঢুকতেই সবাই হৈ হৈ করে ছুটে এল । খুড়তুতো ভাই মনিষ বলল - " আমাদের খুব চিন্তা হচ্ছিল । শেষ বাসটাও চলে গেল , তারপর তোমার মোবাইলের সুইচও অফ । ---- " বোধহয় চার্জ ফুরিয়ে গেছে ।" মনিষ বলল - বাসে এলে তো ? ডঃ সান্যাল বললেন - "হ্যা।" এবার কাকা মুখ খুললেন - তা বাবা এত দেরী হল কেন ? কাকার পাশে রাখা একটা টুলে বসতে বসতে ডঃ সান্যাল বললেন - " বাস থেকে নেমে সবে হাঁটা শুরু করেছি, দেখি দীঘির পাড়ে বকুল গাছটার নীচে কমলি দাঁড়িয়ে । ওর দুঃখের কথা শুনতে শুনতে এত দেরী হল । কাকা বিস্বয়ের সাথে বলে উঠলেন - কি বললি ? কমলি মানে কমললতার কথা বলছিস ? তুই ঠিক দেখেছিস ?
- হ্যাঁ গো । আমি মিথ্যে বলব কেন ? ওর শ্বশুরবাড়ির দুর্দশার কথা শুনতে শুনতেই তো এত দেরী হয়ে গেল । এত করে বললাম - কমলি তোর সাথে এতদিন পর দেখা, চল আমাদের বাড়ি চল, চা খেতে খেতে গল্প করব । ও কিছুতেই এলনা ।
কাকা আবারও বললেন - আমার মনে হচ্ছে সমু তুই ভুল দেখেছিস ।
- না গো না । আমি ঠিকই দেখেছি । এতক্ষণ তো ওর সাথেই গল্প করে এলাম ।
এবার কাকিমা এগিয়ে এলেন । কাকাকে একটু বকুনির সুরেই বললেন - আচ্ছা তুমি কি শুরু করলে বলতো । আগে ওকে হাতমুখ ধুয়ে কিছু মুখে দিতে দাও ।
কাকা-কাকিমার কথাবার্তা শুনে ডঃ সান্যাল অবাক হয়ে গেলেন । তিনি ভেবে পেলেন না যে কমলির সাথে কিছুক্ষণ আগে রাস্তায় দেখা হল, কত গল্প হল, সেই কমলির কথা শুনে এরা এমন আশ্চর্য হচ্ছে কেন ? সামনেই মনিষের বারো বছরের মেয়ে পৌলমি দাড়িয়ে ছিল । হুট করে সে বলে উঠলো - জ্যেঠু, কমলি পিসি তো দু'বছর আগে দীঘির জলে ডুবে মারা গেছে । ওর মা ওকে ধমকে উঠল । মায়ের ধমকে পৌলমি থতমত খেয়ে চুপ করে গেল ।
পৌলমির কথাটা কানে যেতেই ডঃ সান্যালের হৃৎপিণ্ডটা কেঁপে উঠল । মাথাটা অসম্ভব ঘুরতে লাগল । হাত কেঁপে ব্যাগটা মাটিতে পড়ে গেল । তার চোখে তখন সব আবছা লাগছে । টাল সামলাতে না পেরে তিনি টলে পড়ে যাচ্ছিলেন । মনিষ জাপটে ধরে কোনরকমে তাকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসালো । কাকিমা ঘটি করে জল এনে চোখে মুখে ঝাপটা দিলেন । আধঘণ্টা বিশ্রাম নেবার পর ডঃ সান্যাল একটু সুস্থ বোধ করলেন । কাকিমার দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বললেন - "কাকিমা কি ব্যাপার বলবে ? কাকিমা কিছু বলতেই চাইলেন না । মুখে কুলূপ এঁটে বসে রইলেন । কিন্তু ডঃ সান্যাল ছাড়বার পাত্র নন, তিনি খুবই পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন । সৌম্যজিতের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে যাচ্ছে দেখে কাকিমা বলতে শুরু করলেন -
কমলির বিয়ে হয়েছিল বালুরঘাটে । শ্বশুরবাড়ি একদম ভালো হয়নি । স্বামীর একটা ঘড়ির দোকান ছিল । একটা মদ্যপ দুশ্চরিত্র লোক । ওদের চাহিদা মত পণ দিতে না পারায় স্বামী, শাশুড়ি আর ননদ ওর উপর অকথ্য অত্যাচার করত । অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়ল যখন বিয়ের তিন বছর পরেও কমলির সন্তান হল না । কমলির বাবা মারা যেতেই ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সেই যে বাপের বাড়ি পাঠাল আর ওকে ফেরত নিল না । নানা অপবাদও দিল তারা । এদিকে দাদা-বৌদিও ভাল নয় । দাদা বৌদির কথায় উঠতো বসতো । সংসারের সব কাজ করেও তাদের মন পেত না মেয়েটা । বৌদি কারণে অকারণে গালমন্দ করত । নিছক কথা-বার্তায় দাদার কান ভারী করত । দু'বছর আগে যষ্টি মাসে লোকনাথ বাবার মেলা সবে শেষ হয়েছে, একদিন সন্ধ্যাবেলা সামান্য ব্যাপারে দাদা-বৌদির সাথে কমলির প্রচণ্ড ঝগড়া হয় । দাদা-বৌদি দু'জনেই সেদিন অপমান করেই ক্ষান্ত হয়নি, ওর গায়েও হাত তোলে । সেদিনের অপমান ও আর সহ্য করতে পারেনি । সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থেকে বার হয়ে আর ফেরে নি । পরদিন সকালে পাড়ার মনির মা দীঘিতে স্নান করতে গিয়ে দেখে কমলির মৃতদেহ দীঘির জলে ভাসছে । পরের বছর থেকে লোকনাথ বাবার মেলাটা আর দীঘির পাড়ে হয় না । সন্ধ্যাবেলা সাধারণত কেউ দীঘির ওদিকটায় যায় না । অনেকে ভয়ও পেয়েছে ।
ডঃ সান্যালের মুখ থেকে আর কোন কথা বেরোল না । তার দু'চোখ দিয়ে নেমে এল জলের ধারা । শুধু একটা প্রশ্নই তার মনে ঘুরে ফিরে আসছিল কেন কমলি এভাবে তাকে দেখা দিল ? কোন সদুত্তর না মনে এলেও একটা ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত কমলি তাকে সত্যিই ভালবাসত, আর সে জন্যই সে তারই প্রতীক্ষায় ছিল ।
ডঃ সান্যাল সাতদিন গ্রামের বাড়িতে থাকবেন বলে ভেবেছিলেন । কিন্তু কোনরকমে দুদিন কাটিয়ে কলকাতার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলেন । যাবার পথে তার একটা কথাই বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে তাকে - " কমলি তাকে এতো ভালবাসত"?



……………………
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৭২৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৬/০৯/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast