www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অভুক্ত ভালবাসা

শ্যামবাজার থেকে বেহালা গামী বাসের ডান দিকের সিটে বসে শুভঙ্কর । বাসটা শিয়ালদহ ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে পাশের জানালা দিয়ে তাকাতেই চমকে উঠল সে । রুচিরা না ? আর এক বার মাথা ঘুরিয়ে ভালো করে দেখল শুভঙ্কর । হ্যাঁ, রুচিরাই তো । সম্ভবত বাস ধরবে বলে দাঁড়িয়ে আছে । চেহারার সেই চটক নেই । গায়ের টকটকে ফর্সা রঙও তামাটে হয়ে গেছে । তবুও দূর থেকে রুচিরাকে চিনতে এতটুকুও ভুল হল না তার । কালবিলম্ব না করে হাতের ব্যাগটা নিয়ে সে প্রায় লাফিয়েই বাস থেকে সেখানে নেমে গেল । এতদিন পর রুচিরাকে এখানে যে সে দেখতে পাবে শুভঙ্কর তা কল্পনাই করতে পারেনি । খুব তাড়াতাড়ি যানবাহন এড়িয়ে রাস্তা পার হয়ে  সে এসে দাঁড়ায় একেবারে রুচিরার মুখোমুখি । সময় নষ্ট না করে শুভঙ্কর বলে ওঠে - ' রুচিরা না ?'
শুভঙ্করের কথায় চমকে উঠল রুচিরা । বিস্ময়ে বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল । তারপর স্মিত হেসে বলল -
- ' আরে শুভদা না ? তুমি এখানে ? '
- ' চিনতে পেরেছ তাহলে । তোমার সাথে কতদিন পর দেখা । এতদিন পর হয়তঃ চিনতে পারবে না ভেবে একটু সংশয়ে ছিলাম । যাক, এখন সংশয়টা কাটল ।
- ' তা তো কাটল । কিন্তু ... '
- ' অফিসের কাজে দু'দিন হল এসেছি । বেহালায় মাসির বাড়িতে আছি । আগামী কাল চলে যাব । বাস থেকে তোমাকে দেখেই নেমে পড়লাম ।
- ' শুভদা, তোমরা কি এখনও আসানসোলেই আছ ? '
- ' হ্যাঁ, ঐ বাড়িতেই আছি । মা দু'বছর হল গত হয়েছেন । এখন দাদা, বৌদি আর আমি । '
- ' তুমি বিয়ে করনি ?'
রুচিরার কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল শুভঙ্করের ।
- ' মেয়ে আর পেলাম কোথায় ?'

কতদিন পর রুচিরার সাথে দেখা । রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে বেশীক্ষণ কথা বলা যায় না । কত কথা জমে আছে । শুভঙ্কর বলল - 'চলনা রুচিরা, তোমার যদি একটু সময় থাকে কাছেই কোন রেস্টুরেন্টে বসি । শুভঙ্করের অনুরোধ এড়াতে পারল না রুচিরা । তার মনে হল পুরানো স্মৃতি তাকে আঁকড়ে ধরেছে । কিছুক্ষণের জন্য যদি সেই স্মৃতি রোমন্থন করে কিছুটা শান্তি পাওয়া যায় । রুচিরা শুভঙ্করের কথায় সায় দিয়ে বলল - ' চল, তাই চল ।' ফ্লাইওভারের পাশেই একটা ফাঁকা রেস্টুরেন্টে ঢুকে বয়কে টোস্ট, ওমলেট আর চায়ের অর্ডার দিয়ে তারা একটা কেবিনে বসল । শুভঙ্কর বলল -
- ' হ্যাঁ রুচি...  তোমার তো শুনেছিলাম ... '
শুভঙ্করের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রুচিরা বলল -
-' হ্যাঁ ঠিকই শুনেছ । আসানসোল থেকে চলে এসে আমরা রাণাঘাটে আমাদের পৈতৃক বাড়িতে উঠেছিলাম । আসার পরের বছরেই বাবা মারা গেলেন । আঘাত সহ্য করতে না পেরে দু'মাসের মধ্যেই মা-ও হার্ট-অ্যাটাকে চলে গেলেন । এরকম অঘটনের জন্য আমারও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা আর দেওয়া হলনা । তুমি তো আমাদের আর কোন খোঁজ-খবরই নিলে না । '
শুভঙ্কর একটু বিষণ্ণ হয়ে পড়ল । আশ্চর্যজনিত ভাবে বলল -
- ' আমি ভাবতেই পারছি না কাকু কাকিমা নেই । প্রায় একই সাথে যাওয়া সত্যিই খুব বেদনাদায়ক । তবে রুচি বিশ্বাস কর তোমাদের খোঁজ করেছিলাম, কিন্তু আসানসোলে তোমরা যে রেল-কলোনিতে থাকতে সেখানে কেউই তোমাদের ঠিকানা দিতে পারেনি । শুধু এই টুকুই তারা জানিয়েছে যে কাকু রিটায়ার্ড হয়ে গেছেন । কিন্তু তোমার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেল কেন ?'
- ' বাবা-মায়ের বাৎসরিক কাজের পর দাদা বিয়ে করল । তখন আমার লেখাপড়া নিয়ে দাদার কোন মাথা ব্যাথা ছিল না । '
- ' আশ্চর্য, অসিতদা তোমার কথা একবারও ভাবল না ?'
- ' ভাবল, আমার মতামতের তোয়াক্কা না করে তড়িঘড়ি বিয়ে দিল । পাত্র খুব ভালো, সেলস-ম্যানের কাজ ।'
ইতিমধ্যে বয় টোস্ট, ওমলেট আর চা দিয়ে গেল । টোস্ট-ওমলেট  আর চা খেতে খেতে  রুচিরা আবার শুরু করল -
- ' আমার স্বামী অমলের সাথে ভালই মানিয়ে নিয়েছিলাম । ভালই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো । কোল জুড়ে দু'বছরের ব্যবধানে দুই সন্তান প্রীতম আর প্রিয়া এল । তখন প্রীতমের চার আর প্রিয়ার দুই বছর । মাসটা ছিল মে । প্রচণ্ড গরম । অমল কাজ থেকে ফিরে প্রতিদিনের মত ফ্রেস হয়ে বিছানায় বসেছিল । আমি রান্না ঘরে চা জলখাবার বানাচ্ছিলাম । হঠাৎ শাশুড়ির চিৎকারে ছুটে এসে দেখি অমল বুকে হাত বোলাতে বোলাতে বিছানায় ছটফট করছে । সারা শরীর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে । ডাক্তারকে ডাকলাম । ডাক্তার এল, কিন্তু তার আর কিছু করার ছিল না । হাসপাতালে নিয়ে যাবার আগেই হার্ট অ্যাটাকে সে চিরদিনের মত চলে গেল । শাশুরি, ছেলে মেয়ের কান্নায় বাড়িটা খানখান হয়ে গেল । আমাকে বুকে পাথর চাপা দিয়ে সব কাজ শেষ করতে হল । শাশুড়ি আর দু'টো বাচ্চাকে নিয়ে অকুল পাথারে পড়লাম । টেলারিং-এর কাজ করে সংসার চালাই । মাঝে মাঝে শ্যামবাজারে অর্ডার নিতে আসি । এখন এখান থেকে বাস ধরে যাব । কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে রুচিরা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল । রুচিরার কথা শুনতে শুনতে শুভঙ্কর একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল ।শুভঙ্কর নিজেকে সামলে নিয়ে বা হাতে রুচিরার চিবুকটা ধরল । ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে বলল -
- ' সত্যি ভাবতে পারছি না । সেই নিরীহ মেয়েটা আজ কি কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে ।'
- ' পরিস্থিতিই মানুষকে বদলে দেয় শুভদা । '
- ' রুচি, নতুন করে কি কিছু আর ভাবা যায় না ?'
- ' না শুভদা, সেটা আর সম্ভব নয় । আমি অমলের স্মৃতি আর ওর ছেলে মেয়েদের নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই । আমার শাশুড়ি ভীষণ ভাল মানুষ । সেও আমার আর তার নাতি-নাতনিদের মুখ চেয়ে বেঁচে আছেন । আমার হাতে আর সময় নেই । দেরী হয়ে গেলে অর্ডার গুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে । এখনই উঠতে হবে । '
শুভঙ্করের মন কিছতেই সায় দিচ্ছে না রুচিরাকে বিদায় জানাতে । পুরনো স্মৃতি তার মনটা ভারাক্রান্ত করে তুলেছে । তবুও তাকে উঠতে হল । তারপর দু'জনে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বাস স্টপে এল । হঠাৎ শ্যামবাজারের বাস আসতে দেখে রুচিরা বলল -' বাস আসছে। চলি শুভদা ।' রুচিরা বাসে উঠে জানালার পাশে সিটে বসে হাত নাড়ল । শুভঙ্কর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল চলন্ত বাসের দিকে । তার দু'চোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রু-ধারা ।।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৫১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২২/০৯/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • subhendu das ২৩/০৯/২০১৩
    besh hoyechhe....
  • suman ২৩/০৯/২০১৩
    Touchy ...ভীষন touchy!!!
  • Înšigniã Āvî ২৩/০৯/২০১৩
    প্রত্যহ প্রবাহমান জীবনের কিছু চিত্রণ
    মনের গভীরে নাড়া দেয় ।
  • ইব্রাহীম রাসেল ২৩/০৯/২০১৩
    --জয়শ্রী ভাবনাটা দারুণ। চলুক আরো গল্প---
  • Shubhajit majumdar ২৩/০৯/২০১৩
    Wow darun likha6o my sweet @jaya
  • সালমান মাহফুজ ২২/০৯/২০১৩
    অনবদ্য লিখেছো জয়শ্রী দিদি ।
  • সালমান মাহফুজ ২২/০৯/২০১৩
    অনবদ্য লিখেছো জয়শ্রী দিদি ।
  • দেবদাস মৈত্র ২২/০৯/২০১৩
    অসাধারন ভালবাসার গল্প । সত্যিই ভালবাসা অভুক্তই রয়ে গেল । চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ রইল ।
  • ভীষণ হৃদয়স্পর্শী
    • জয়শ্রী রায় ২২/০৯/২০১৩
      আপনার মন্তব্য খুব সংক্ষিপ্ত কিন্তু আকর্ষণীয় । ভালো লাগলো । ধন্যবাদ । ভালো থাকবেন ।
 
Quantcast