অসম-সম
ফাল্গুনের শুরু । সবে বসন্তের বাতাস বইতে শুরু করেছে । সকালের প্রাতরাশ সেরে শুভময় তিনতলার বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে নিউজ পেপারে চোখ বোলাচ্ছিল । হঠাৎ সুন্দর এক দখিনে বাতাস মনকে উদাস করে দিল । অদ্ভুত এক অনুভূতি তার মনের মধ্যে উঁকি দিতে লাগল । সামনের দিকে তাকিয়ে অলস ভঙ্গিতে শুভময় উপভোগ করতে লাগল প্রাক বসন্তের রূপরেখা । এ-সময় প্রকৃতি নতুন রূপে সেজে উঠছে । সামনের পলাশ গাছটা আসন্ন যৌবনের উচ্ছাসে রুপময় । অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে কোকিলের কুহু কুহু রব । বারান্দা থেকে সামনের রাস্তাটা দেখা যায় । প্রতিভা রাস্তায় নেমে উপরের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে লাগল । মেয়ে শুভমিতা কোচিন ক্লাসে গিয়েছে । সে তাকে আনতে যাচ্ছে । রাস্তার বাঁকে প্রতিভা অদৃশ্য হতেই মৃদু হেসে শুভময় আবার সামনের প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে পিছনে ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিমেদুরতায় ডুবে গেল ।
আমেদাবাদে এক প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করত সে । অনেকদিন ধরেই বাড়ির কাছাকাছি চাকরি নিয়ে চলে আসার চেষ্টা করছিল । হঠাৎ সুযোগও পেয়ে গেল । ঝাড়খণ্ডে ই,সি,এল,-এর শ্যামপুর মাইন্স-এ জুনিয়র ম্যানেজারের চাকরি । শ্যামপুরে জয়েন করার পরই শুভময় খুব অসুবিধার মধ্যে পড়ে গেল । কোয়ার্টার না পাওয়ায় কোলিয়ারির কাছাকাছি তাকে ছোট্ট একটা বাড়ি ভাড়া করতে হল । রান্নাবান্না গৃহস্থালির কাজকর্মের জন্য তার এক সহকর্মী ঠিক করে দিল একটি বছর বাইশের দেহাতি মেয়েকে । মেয়েটির নাম সোনামুনি । মুখে কথা নেই । সুন্দর কাজ করে । বাজার-হাট সবই করে দেয় সে । কিছু জিজ্ঞাসা করলে তার উত্তরটা দেয় শুধু । স্বামী কোলিয়ারিতে ঠিকা কাজ করতো । খুব নেশা করত । একদিন রাতে ডিউটি থেকে ফেরার পথে ট্রাকে চাপা পড়ে প্রাণটা চলে যায় । তখন তিন বছরের মেয়ে ফুলিকে নিয়ে সোনামুনি অকুলপাথারে । ঠিকাদারের কাছ থেকে সামান্য যা টাকা সে পেয়েছিল তা ধার শোধ করতেই লেগে যায় । তারপর জা-ভাসুরের আশ্রয়ে থেকে নিজেই খেটে খায় । জা-ভাসুরের কাছে যে খুব একটা ভালো থাকে তাও দেখে মনে হয় না । মেয়েটার উপর অজান্তে কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গেল শুভময়ের । ভিতরে ভিতরে একটু ভালোবাসাও । ভালোই চলছিল । হঠাৎ কোন খবর না দিয়ে সোনামুনি পরপর দু’দিন কামাই করে বসল । মনে মনে একটু রেগেই গেল শুভময় । সত্যি মানুষকে একটুও বিশ্বাস নেই । নিজে না আসতে পারলে কাউকে দিয়ে তো খবর পাঠাতে পারত । তৃতীয় দিন একটু দেরী করেই কাজে এল সোনামুনি । চোখে মুখে কালশিটে পড়েছে । হাতে পোড়া দাগ । কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল সোনামুনি । শুভময় হতভম্ব । এবার শুভময় বুঝতে পারল সোনামুনির বাড়িতে নিশ্চয়ই কোন অশান্তি হয়েছে ।
- তোমার কি হয়েছে সোনামুনি ? গায়ে মুখে কালশিটে কেন ? হাতই বা পুড়ল কি করে ?
- বাবু, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে আমার মরে যাওয়াই ভাল গো ।
- কেন কি হয়েছে ?
- তুমাকে কি বলব বাবু । তুমার এখানে কাজ করে বিড়ি বেঁধে কোন রকমে আমাদের মা মেয়ের দিন চলে যায় । তারপর জায়ের বাড়ির অনেক কাজ করে দিই । ভগবান আমার এ কষ্টের জীবনও সহ্য করতে পারছে না ।
- আসল ঘটনা কি বলতো ।
- তুমাকে ওসব কথা বলতে পারব না ।
সোনামুনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল । তারপর কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল । আর কিছু বলতে চাইল না । অনেক জোরাজুরি করার পর মুখ খুলল ।
- কি বলব বাবু । আমার কপাল খুব খারাপ । প্রথম মেয়ে সন্তান হওয়াতে শাশুড়ি, মদোমাতাল স্বামীর কাছ থেকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করেছি । তারপর স্বামী চলে যাবার পর জা-ভাসুরের মনও পেলাম না । তারপর গত পরশুর আগের রাতের ঘটনা আশ্রয়ও কেড়ে নিল । এখন পাড়ার একজনের গোয়ালে থাকি ।
সোনামুনি চুপ করে গেল । শুভময় সোনামুনির দিকে তাকিয়ে দেখল সোনামুনির দু’চোখ জলে ভরে গেছে । শুভময়ের খুব কষ্ট হল । সোনামুনি এত ভালো মেয়ে আর শেষপর্যন্ত তার এই হাল । শুভময়ের অদম্য কৌতূহল হল আসল ঘটনা জানার জন্য । গত পরশুর আগের রাতে কি এমন ঘটনা ঘটেছিল যে তার জন্য তাকে জা-ভাসুরের আশ্রয় হারাতে হল । একজন যুবতি মেয়ের পক্ষে ছোট্ট সন্তান নিয়ে এ-ভাবে অভিভাবক এবং আত্মীয়-স্বজন ছাড়া নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখা কত সমস্যাবহুল সেটা ভেবে শুভ আঁতকে উঠল । সেই রাতের ঘটনার কথা শুনতে চাইলে সোনামুনি বলতে চাইল না । শুভময় সোনামুনিকে আশ্বস্ত করে বলল –
- দেখ সোনামুনি আমাকে বিশ্বাস করে বলতে পার । তোমাকে যদি কোনভাবে সাহায্য করতে পারি । তোমার কোন ক্ষতি হবে না ।
সোনামুনি বলল –
- দেখ বাবু তুমাকে বিশ্বাস করে বলছি । এ-কথা যেন কেউ জানতে না পারে । ওরা যদি জানতে পারে যে এ-সব কথা আমি তুমাকে বুলেছি তাহলে ওরা আমাকে আর আস্ত রাখবে না ।
- না না, কেউ জানতে পারবে না । তুমি বল ।
- ভাসুরের বিয়ের যুগ্যি একটা ছেলে আছে । কারখানায় কাজ করে । চাচার মত নেশা করে । বেশ কিছু দিন হল বাবু আমার দিকে খারাপ নজর দিচ্ছিল । আমি অনেক কষ্টে নিজেকে বাঁচিয়ে চলছিলাম । সে দিন রাতে মেয়ে নিয়ে দাওয়ায় শুয়েছিলাম । গভীর রাতে একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল । দেখি ছেলেটা আমার বিছানায় । ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম । মেয়ে ফুলি কেঁদে উঠল । আমাকে ও শক্ত হাতে ধরল । বলল চুপ করে থাক । কেউ জানলে মা মেয়েকে জানে খতম করে দেব । আমার ও মেয়ের কান্নায় ঘুম ভেঙ্গে গেল ভাসুর জায়ের । ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে জা বলল – কি হয়েছে রে সনাতন ? সনাতন বলল – মা, আমি কারখানার কাজ সেরে ফিরছি । ঘরে ঢুকতে যাব । চাচি খারাপ প্রস্তাব দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরল ।
সনাতন মিথ্যে কথা বলে জা-কে কব্জা করছে দেখে আমি বললাম - না না দিদি, সনাতন মিথ্যে বলছে । তুমি বিশ্বাস কর । এত রাতে ওকে আমার বিছানায় দেখে আমি আঁতকে উঠেছি । ওকে আমি ছেলে বলে মানি । জা আমার কথা বিশ্বাস করল না । ছেলের পক্ষ নিয়ে বলে উঠল – চুপ কর শালি । আমার ছেলে মিথ্যে বলছে ? এই করে দেওরটাকে খেয়েছিস । এখন আমার ছেলের দিকে হাত বাড়িয়েছিস । শয়তানি । নষ্ট মেয়ে মানুষ । যা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়া । দুটো পয়সা পাবি । দাঁড়া তোর দেখাচ্ছি মজা । - এই কথা বলে বাবু তিনজন মিলে আমায় খুব মারধর করল । তারপর জা খুন্তি গরম করে ছেঁকা দিয়ে দিল হাতে । ধাক্কা মেরে ঐ রাতে আমাকে বার করে দিল বাবু । তুমার এখানে কাজে আসি তাও সন্দেহ করে ।
শুভময় সোনামুনির মুখ থেকে কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে গেল । সত্যিই পৃথিবীতে কত রকম সমাজ আর বেঁচে থাকার কত রকম ব্যাবস্থা যে তার কোন কূলকিনারা পাওয়া যায় না । সোনামুনির ঘটনা সে জানতে পারছে । কিন্তু সারা পৃথিবীতে এ-রকম সোনামুনি কত যে ছড়িয়ে আছে তা হয়তঃ হাতে গোনা যাবে না । শুভময় সেদিন সোনামুনিকে সান্ত্বনা দিয়ে কাজ করতে নিষেধ করে শুধু বলল –
- তোমার বাচ্চা মেয়েটা একা আছে । ফিরে যাও । কাল এসো । আমার উপর ভরসা রাখো ।
সেদিন ছিল ছুটির দিন । সারাদিন সোনামুনির ব্যাপারটা শুভময়ের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল । কিন্তু সোনামুনিকে নিয়ে সে এত চিন্তা করছে কেন ? সে একটা কাজের লোক । তাকে কাজের লোক হিসাবেই দেখা উচিৎ । এ-সমস্ত ঝুট-ঝামেলায় জড়ানোর কি দরকার ? সে তো আর শ্যামপুরে বেশি দিন নেই । তার ট্রান্সফারের অ্যাপ্লিকেশন গ্রান্ট হয়ে গিয়েছে । কোলকাতা হেড কোয়ার্টারে জয়েন করবে । রাতের খাবার খেয়ে শুভময় শুয়ে পড়ল । কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসছে না । সোনামুনির কথা সে কিছুতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না । সোনামুনিকে সে ভালবেসে ফেলেছে । শেষ পর্যন্ত শুভময় একটা চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল । সে সোনামুনিকে বিয়ে করবে । সমাজে প্রতিষ্ঠা দেবে । মেয়েকে নিজের মেয়ের পরিচয় দেবে ।
পরদিন সোনামুনি কাজে এল । শুভময় তার প্রস্তাব জানাতেই সোনামুনি আঁতকে উঠল ।
- তুমি বলছো কি বাবু ! এটা হয় না । তুমি কোথায় আর আমি কোথায় !
- তোমাকে আমি আমার মত করে গড়ে তুলবো । মেয়েটাকে তো মানুষ করতে হবে !
- বাবু, আমার জা ভাসুর আমায় মেরে ফেলবে । তোমারও ক্ষতি করে দেবে ।
- আমায় কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবে না । পরের মাসেই তো আমি বদলি হয়ে কোলকাতায় চলে যাচ্ছি ।
শুভময় অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে সোনামুনিকে রাজি করালো । কোলকাতায় যাবার দিন সকাল বেলায় শ্যামপুর কালী মন্দিরে গিয়ে শুভময় সোনামুনির সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিল । শুভময়ের এক অফিস কলিগ অবিনাশ আর কোলকাতার ছোট বেলার বন্ধু জীবনের উপস্থিতিতে রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেলে সন্ধ্যায় ট্রেন ধরে সোজা কোলকাতা ।
কোলকাতায় এসে শুভময়ের শুরু হল এক নতুন জীবন । আত্মীয়-স্বজন কেউই ব্যাপারটাকে ভাল ভাবে নিল না । ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করল শুভ । অফিসের কাজকর্মের পাশাপাশি সোনামুনিকে লেখাপড়া করার দায়িত্ব পালন করতে লাগল । সোনামুনি হয়ে উঠল এখনকার প্রতিভা । দু’বছর এ-ভাবে কাটিয়ে শুভময় সোনারপুরের এক তিন কামরার ফ্লাটে চলে এল । মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে দিল । সেই মেয়ে ফুলি এখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী শুভমিতা । প্রতিভা আর শুভমিতাকে নিয়ে শুভ এখন খুব সুখী ।
হঠাৎ ক্যাঁচ করে ফ্লাটের দরজা খোলায় আওয়াজে শুভময়ের সম্বিত ফিরে এল । সে এতক্ষণ খেয়ালই করেনি প্রতিভা বেরিয়ে যাবার পর ফ্লাটের মেন দরজার ছিটকিনিটা লাগানোই হয়নি । কোচিন থেকে শুভমিতাকে নিয়ে প্রতিভা ফিরে এসেছে । শুভমিতা ছুটে এসে শুভময়ের গলা জড়িয়ে ধরল । শুভর চুলে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলল –
- বাপি, কাল তো বুদ্ধপূর্ণিমা । তোমার ছুটি । আমারও ছুটি । কাল চিড়িয়াখানায় যাব ।
- তথাস্তু মা । আমার মা চিড়িয়াখানায় যেতে চেয়েছে । আর আমি নিয়ে যাব না, তা কি হয় ? এখন যে মা তোমার হাতে একটু গরম চা খাব ।
- - এক্ষুনি আসছি । আমার সুইট বাপী ।
রান্না ঘরের দিকে ছুট লাগাল শুভমিতা । প্রতিভার দিকে তাকিয়ে দু’জনে হেসে ফেলল ।
আমেদাবাদে এক প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করত সে । অনেকদিন ধরেই বাড়ির কাছাকাছি চাকরি নিয়ে চলে আসার চেষ্টা করছিল । হঠাৎ সুযোগও পেয়ে গেল । ঝাড়খণ্ডে ই,সি,এল,-এর শ্যামপুর মাইন্স-এ জুনিয়র ম্যানেজারের চাকরি । শ্যামপুরে জয়েন করার পরই শুভময় খুব অসুবিধার মধ্যে পড়ে গেল । কোয়ার্টার না পাওয়ায় কোলিয়ারির কাছাকাছি তাকে ছোট্ট একটা বাড়ি ভাড়া করতে হল । রান্নাবান্না গৃহস্থালির কাজকর্মের জন্য তার এক সহকর্মী ঠিক করে দিল একটি বছর বাইশের দেহাতি মেয়েকে । মেয়েটির নাম সোনামুনি । মুখে কথা নেই । সুন্দর কাজ করে । বাজার-হাট সবই করে দেয় সে । কিছু জিজ্ঞাসা করলে তার উত্তরটা দেয় শুধু । স্বামী কোলিয়ারিতে ঠিকা কাজ করতো । খুব নেশা করত । একদিন রাতে ডিউটি থেকে ফেরার পথে ট্রাকে চাপা পড়ে প্রাণটা চলে যায় । তখন তিন বছরের মেয়ে ফুলিকে নিয়ে সোনামুনি অকুলপাথারে । ঠিকাদারের কাছ থেকে সামান্য যা টাকা সে পেয়েছিল তা ধার শোধ করতেই লেগে যায় । তারপর জা-ভাসুরের আশ্রয়ে থেকে নিজেই খেটে খায় । জা-ভাসুরের কাছে যে খুব একটা ভালো থাকে তাও দেখে মনে হয় না । মেয়েটার উপর অজান্তে কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গেল শুভময়ের । ভিতরে ভিতরে একটু ভালোবাসাও । ভালোই চলছিল । হঠাৎ কোন খবর না দিয়ে সোনামুনি পরপর দু’দিন কামাই করে বসল । মনে মনে একটু রেগেই গেল শুভময় । সত্যি মানুষকে একটুও বিশ্বাস নেই । নিজে না আসতে পারলে কাউকে দিয়ে তো খবর পাঠাতে পারত । তৃতীয় দিন একটু দেরী করেই কাজে এল সোনামুনি । চোখে মুখে কালশিটে পড়েছে । হাতে পোড়া দাগ । কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল সোনামুনি । শুভময় হতভম্ব । এবার শুভময় বুঝতে পারল সোনামুনির বাড়িতে নিশ্চয়ই কোন অশান্তি হয়েছে ।
- তোমার কি হয়েছে সোনামুনি ? গায়ে মুখে কালশিটে কেন ? হাতই বা পুড়ল কি করে ?
- বাবু, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে আমার মরে যাওয়াই ভাল গো ।
- কেন কি হয়েছে ?
- তুমাকে কি বলব বাবু । তুমার এখানে কাজ করে বিড়ি বেঁধে কোন রকমে আমাদের মা মেয়ের দিন চলে যায় । তারপর জায়ের বাড়ির অনেক কাজ করে দিই । ভগবান আমার এ কষ্টের জীবনও সহ্য করতে পারছে না ।
- আসল ঘটনা কি বলতো ।
- তুমাকে ওসব কথা বলতে পারব না ।
সোনামুনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল । তারপর কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল । আর কিছু বলতে চাইল না । অনেক জোরাজুরি করার পর মুখ খুলল ।
- কি বলব বাবু । আমার কপাল খুব খারাপ । প্রথম মেয়ে সন্তান হওয়াতে শাশুড়ি, মদোমাতাল স্বামীর কাছ থেকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করেছি । তারপর স্বামী চলে যাবার পর জা-ভাসুরের মনও পেলাম না । তারপর গত পরশুর আগের রাতের ঘটনা আশ্রয়ও কেড়ে নিল । এখন পাড়ার একজনের গোয়ালে থাকি ।
সোনামুনি চুপ করে গেল । শুভময় সোনামুনির দিকে তাকিয়ে দেখল সোনামুনির দু’চোখ জলে ভরে গেছে । শুভময়ের খুব কষ্ট হল । সোনামুনি এত ভালো মেয়ে আর শেষপর্যন্ত তার এই হাল । শুভময়ের অদম্য কৌতূহল হল আসল ঘটনা জানার জন্য । গত পরশুর আগের রাতে কি এমন ঘটনা ঘটেছিল যে তার জন্য তাকে জা-ভাসুরের আশ্রয় হারাতে হল । একজন যুবতি মেয়ের পক্ষে ছোট্ট সন্তান নিয়ে এ-ভাবে অভিভাবক এবং আত্মীয়-স্বজন ছাড়া নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখা কত সমস্যাবহুল সেটা ভেবে শুভ আঁতকে উঠল । সেই রাতের ঘটনার কথা শুনতে চাইলে সোনামুনি বলতে চাইল না । শুভময় সোনামুনিকে আশ্বস্ত করে বলল –
- দেখ সোনামুনি আমাকে বিশ্বাস করে বলতে পার । তোমাকে যদি কোনভাবে সাহায্য করতে পারি । তোমার কোন ক্ষতি হবে না ।
সোনামুনি বলল –
- দেখ বাবু তুমাকে বিশ্বাস করে বলছি । এ-কথা যেন কেউ জানতে না পারে । ওরা যদি জানতে পারে যে এ-সব কথা আমি তুমাকে বুলেছি তাহলে ওরা আমাকে আর আস্ত রাখবে না ।
- না না, কেউ জানতে পারবে না । তুমি বল ।
- ভাসুরের বিয়ের যুগ্যি একটা ছেলে আছে । কারখানায় কাজ করে । চাচার মত নেশা করে । বেশ কিছু দিন হল বাবু আমার দিকে খারাপ নজর দিচ্ছিল । আমি অনেক কষ্টে নিজেকে বাঁচিয়ে চলছিলাম । সে দিন রাতে মেয়ে নিয়ে দাওয়ায় শুয়েছিলাম । গভীর রাতে একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল । দেখি ছেলেটা আমার বিছানায় । ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম । মেয়ে ফুলি কেঁদে উঠল । আমাকে ও শক্ত হাতে ধরল । বলল চুপ করে থাক । কেউ জানলে মা মেয়েকে জানে খতম করে দেব । আমার ও মেয়ের কান্নায় ঘুম ভেঙ্গে গেল ভাসুর জায়ের । ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে জা বলল – কি হয়েছে রে সনাতন ? সনাতন বলল – মা, আমি কারখানার কাজ সেরে ফিরছি । ঘরে ঢুকতে যাব । চাচি খারাপ প্রস্তাব দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরল ।
সনাতন মিথ্যে কথা বলে জা-কে কব্জা করছে দেখে আমি বললাম - না না দিদি, সনাতন মিথ্যে বলছে । তুমি বিশ্বাস কর । এত রাতে ওকে আমার বিছানায় দেখে আমি আঁতকে উঠেছি । ওকে আমি ছেলে বলে মানি । জা আমার কথা বিশ্বাস করল না । ছেলের পক্ষ নিয়ে বলে উঠল – চুপ কর শালি । আমার ছেলে মিথ্যে বলছে ? এই করে দেওরটাকে খেয়েছিস । এখন আমার ছেলের দিকে হাত বাড়িয়েছিস । শয়তানি । নষ্ট মেয়ে মানুষ । যা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়া । দুটো পয়সা পাবি । দাঁড়া তোর দেখাচ্ছি মজা । - এই কথা বলে বাবু তিনজন মিলে আমায় খুব মারধর করল । তারপর জা খুন্তি গরম করে ছেঁকা দিয়ে দিল হাতে । ধাক্কা মেরে ঐ রাতে আমাকে বার করে দিল বাবু । তুমার এখানে কাজে আসি তাও সন্দেহ করে ।
শুভময় সোনামুনির মুখ থেকে কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে গেল । সত্যিই পৃথিবীতে কত রকম সমাজ আর বেঁচে থাকার কত রকম ব্যাবস্থা যে তার কোন কূলকিনারা পাওয়া যায় না । সোনামুনির ঘটনা সে জানতে পারছে । কিন্তু সারা পৃথিবীতে এ-রকম সোনামুনি কত যে ছড়িয়ে আছে তা হয়তঃ হাতে গোনা যাবে না । শুভময় সেদিন সোনামুনিকে সান্ত্বনা দিয়ে কাজ করতে নিষেধ করে শুধু বলল –
- তোমার বাচ্চা মেয়েটা একা আছে । ফিরে যাও । কাল এসো । আমার উপর ভরসা রাখো ।
সেদিন ছিল ছুটির দিন । সারাদিন সোনামুনির ব্যাপারটা শুভময়ের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল । কিন্তু সোনামুনিকে নিয়ে সে এত চিন্তা করছে কেন ? সে একটা কাজের লোক । তাকে কাজের লোক হিসাবেই দেখা উচিৎ । এ-সমস্ত ঝুট-ঝামেলায় জড়ানোর কি দরকার ? সে তো আর শ্যামপুরে বেশি দিন নেই । তার ট্রান্সফারের অ্যাপ্লিকেশন গ্রান্ট হয়ে গিয়েছে । কোলকাতা হেড কোয়ার্টারে জয়েন করবে । রাতের খাবার খেয়ে শুভময় শুয়ে পড়ল । কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসছে না । সোনামুনির কথা সে কিছুতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না । সোনামুনিকে সে ভালবেসে ফেলেছে । শেষ পর্যন্ত শুভময় একটা চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল । সে সোনামুনিকে বিয়ে করবে । সমাজে প্রতিষ্ঠা দেবে । মেয়েকে নিজের মেয়ের পরিচয় দেবে ।
পরদিন সোনামুনি কাজে এল । শুভময় তার প্রস্তাব জানাতেই সোনামুনি আঁতকে উঠল ।
- তুমি বলছো কি বাবু ! এটা হয় না । তুমি কোথায় আর আমি কোথায় !
- তোমাকে আমি আমার মত করে গড়ে তুলবো । মেয়েটাকে তো মানুষ করতে হবে !
- বাবু, আমার জা ভাসুর আমায় মেরে ফেলবে । তোমারও ক্ষতি করে দেবে ।
- আমায় কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবে না । পরের মাসেই তো আমি বদলি হয়ে কোলকাতায় চলে যাচ্ছি ।
শুভময় অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে সোনামুনিকে রাজি করালো । কোলকাতায় যাবার দিন সকাল বেলায় শ্যামপুর কালী মন্দিরে গিয়ে শুভময় সোনামুনির সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিল । শুভময়ের এক অফিস কলিগ অবিনাশ আর কোলকাতার ছোট বেলার বন্ধু জীবনের উপস্থিতিতে রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেলে সন্ধ্যায় ট্রেন ধরে সোজা কোলকাতা ।
কোলকাতায় এসে শুভময়ের শুরু হল এক নতুন জীবন । আত্মীয়-স্বজন কেউই ব্যাপারটাকে ভাল ভাবে নিল না । ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করল শুভ । অফিসের কাজকর্মের পাশাপাশি সোনামুনিকে লেখাপড়া করার দায়িত্ব পালন করতে লাগল । সোনামুনি হয়ে উঠল এখনকার প্রতিভা । দু’বছর এ-ভাবে কাটিয়ে শুভময় সোনারপুরের এক তিন কামরার ফ্লাটে চলে এল । মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে দিল । সেই মেয়ে ফুলি এখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী শুভমিতা । প্রতিভা আর শুভমিতাকে নিয়ে শুভ এখন খুব সুখী ।
হঠাৎ ক্যাঁচ করে ফ্লাটের দরজা খোলায় আওয়াজে শুভময়ের সম্বিত ফিরে এল । সে এতক্ষণ খেয়ালই করেনি প্রতিভা বেরিয়ে যাবার পর ফ্লাটের মেন দরজার ছিটকিনিটা লাগানোই হয়নি । কোচিন থেকে শুভমিতাকে নিয়ে প্রতিভা ফিরে এসেছে । শুভমিতা ছুটে এসে শুভময়ের গলা জড়িয়ে ধরল । শুভর চুলে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলল –
- বাপি, কাল তো বুদ্ধপূর্ণিমা । তোমার ছুটি । আমারও ছুটি । কাল চিড়িয়াখানায় যাব ।
- তথাস্তু মা । আমার মা চিড়িয়াখানায় যেতে চেয়েছে । আর আমি নিয়ে যাব না, তা কি হয় ? এখন যে মা তোমার হাতে একটু গরম চা খাব ।
- - এক্ষুনি আসছি । আমার সুইট বাপী ।
রান্না ঘরের দিকে ছুট লাগাল শুভমিতা । প্রতিভার দিকে তাকিয়ে দু’জনে হেসে ফেলল ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শেখ আজিম উদ্দীন ০৯/০৫/২০১৭বাহ্,দারুণ।
-
Tanju H ০৪/০৫/২০১৭অনেক ভাল লিখেছেন
-
মধু মঙ্গল সিনহা ০৪/০৫/২০১৭বাহ্,সুন্দর।