www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গভীর রাতের ট্যাক্সি

তখন রাত গভীর । প্রায় একটা-সওয়া একটা হবে । একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল বিশ্বনাথের। হঠাৎ কাঁচের জানলায় টক টক আওয়াজ হতেই ঘুমের রেশ কেটে গেল । ধড়ফড় করে উঠে জানলার কাঁচ নামিয়ে দেখল মাঝ বয়সী সুন্দরী এক মেম সাহেব তার ট্যাক্সির কাছে দাঁড়িয়ে । আপাদমস্তক নীল গাউনে ঢাকা । মাথায় বিশাল নীল রঙের টুপি । ইংরাজি-বাংলা মিশিয়ে জড়ানো গলায় বলল – “ট্যাক্সি যাইবে ?”
- “কোথায় যাবেন”?
- “আগে ট্যাক্সিতে বসি, তারপর বলিতেছি”।  
জড়ানো গলা শুনে বিশ্বনাথ বোঝে ম্যাডাম প্রকৃতিস্থ নেই । বিশ্বনাথ এতক্ষণ তো এই রকম যাত্রীর জন্যই অপেক্ষা করছিল । এই বড়দিনের সময় রং-বেরঙের আলোর মালায় সুসজ্জিত পার্কষ্ট্রীটে অনেক রাত পর্যন্ত চলে নাচ-গানের আসর । হোটেল, নাইট-ক্লাবগুলো থেকে বেরিয়ে অনেকেই গন্তব্যের জন্য ট্যাক্সি ধরে । আকণ্ঠ মদ্যপান করাতে অনেক যাত্রী নিজের সত্ত্বা হারিয়ে ফেলে । অপ্রকৃতিস্থ থাকায় সঠিক ঠিকানা বলতে না পারায় এবং রাস্তা চিনতে না পারায় তাদেরকে নিয়ে সারা রাত কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হয় । অনেক সময় গন্তব্যে পৌঁছোতে ভোর রাত হয়ে যায় । একটু ঝুঁকি নিতে হয় ঠিকই তবে পারিশ্রমিক বেশ ভালোই পাওয়া যায় । সাথে বকশিসও । ম্যাডাম নিশ্চয়ই ভাল পে করবে । আর দেরী না করে বিশ্বনাথ বলে-  
- “সাবধানে উঠুন”।
ট্যাক্সির পিছনের দরজা খুলে সিটে বসতে বসতে মেম-সাহেব বলল -
- “নো টেনশন ব্রাদার । আই অ্যাম কোয়াইট ফিট । আজ নাইটে ক্যালকাটাকে কেমন লাগে দেখব । যেখানে যেখানে যেতে চাইব নিয়ে যাবে তো ব্রাদার?”
বিশ্বনাথের আর কি ? যত ঘুরবে তত পারিশ্রমিক । সারাদিন ট্যাক্সি চালিয়ে ক্লান্ত হলেও সে এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না । মেম-সাহেবের কথায় সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সে বলল – “ম্যাডাম এখন কোথায় যাব ?”  
- “মাই ফার্স্ট চয়েস ইজ প্রিন্সেপ ঘাট । আমার ফ্রেন্ড ফিলিপ আছে ওখানে । একটু উইশ করবো ওকে । আর রাজি থাকলে ওকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নেব । তারপর দু’জনে মিলে নাইট ক্যালকাটা  দেখে এনজয় করবো । দু’জনা ঘুরবো”। কথাগুলো বলেই মেম-সাহেব হো হো করে হেসে উঠল। বিশ্বনাথ মেম-সাহেবের কথা শুনে সুযোগের সদব্যাবহার করল -
- “দু’জনে ঘুরলে আরও বেশী টাকা লাগবে ম্যাডাম”।
- “ডোন্ট ওরি । চল এখন”।
বিশ্বনাথ গাড়ি স্টার্ট করল । পার্কষ্ট্রীট ছাড়িয়ে মেয়ো রোড ধরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল রোড হয়ে প্রিন্সেপ ঘাট । ট্যাক্সি রাস্তার ধারে একটা পার্কের পাশে দাঁড় করাতেই ট্যাক্সির মধ্যেই মেম-সাহেব আনন্দে চিৎকার করে বলতে লাগল – “ফিলিপ ফিলিপ, কাম মাই ডিয়ার”। প্রিন্সেপ ঘাট তখন শুনশান ।  কেউ কোথাও নেই । অথচ ভদ্রমহিলা ক্রমাগত চেঁচিয়ে যাচ্ছে ।  সত্যি, আকণ্ঠ মদ গিলে মহিলা পাগল হয়ে গেছে । এই বয়সে প্রেমিক নিয়ে ছুটবে । কিছুক্ষণ পর রাস্তার লাইটের মৃদু আলোয়  বিশ্বনাথ দেখল এক সাহেব পার্কের দিক থেকে হেঁটে আসছে । দীর্ঘ দেহী । পরনে নীল রঙের স্যুট । তার মনে হল নিশ্চয়ই এই সাহেব ম্যাডামের ফ্রেন্ড ফিলিপ । হ্যাঁ বিশ্বনাথের আন্দাজ একদম ঠিক । সাহেব ভদ্রলোক ট্যাক্সির কাছে আসতেই মেম-সাহেবের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল । দুজনে দুজনকে উইশ করল । তারপর ট্যাক্সির দরজা খুলে মেম-সাহেব বন্ধু ফিলিপের হাত ধরে গাড়ির ভেতরে  টেনে নিল । তারপর বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে বলল – “চল ব্রাদার, এবার সোজা হেসটিংস হাউস”।

দূরে চার্চের ঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বাজলো । কিছুটা দূর গিয়ে মেন রোড ছেড়ে শর্টকার্ট যাবার জন্য এক গলির রাস্তা ধরল বিশ্বনাথ ।  গলির রাস্তাটা বেশ অন্ধকার । রাস্তায় কোন ল্যাম্প পোষ্ট চোখে পড়ছে না । শুধু গাড়ির হেড লাইটের আলোয় রাস্তা দেখা যাচ্ছে ।  দূরের কোন গাছের মগ ডাল থেকে হুতুম পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে । সে ডাক বড় কর্কশ । গাড়ির সামনে দিয়ে হঠাৎ একটা বাদুড় ডানা ঝটপট করতে করতে উড়ে গেল । খুব অস্বস্তি হচ্ছিল বিশ্বনাথের । এর আগে সে বার কয়েক এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছে কিন্তু দিনের বেলায় । রাতে কখনও সে এই রাস্তায় আসেনি । রাতের কলকাতায় রাস্তার এ-রকম পরিবেশের অভিজ্ঞতা তার আগে কখনও হয়নি । সকালে কার মুখ দেখে যে সে আজ উঠেছিল ! এমন সওয়ারি তার ভাগ্যে আজ পর্যন্ত জোটে নি । পাঁচ মিনিট পর সে মেন রোডে উঠে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল । পিছনের সিট থেকে দুই সওয়ারির হাস্যরোল আসছে । সে হাস্যরোল এত জোরালো যে কানে তালা লেগে যাবার উপক্রম । দু’জনের কথোপকথন থেকে মেম-সাহেবের নাম জানা গেল । মেম-সাহেবের নাম মেরি । গাড়ি চালাতে চালাতে ওদের কথাবার্তা বিশ্বনাথের কানে এল । মেম-সাহেবের বন্ধু ফিলিপ বলল -
- “ডু ইউ রিমেম্বার দিস ওয়ে মেরি”?
- “ইয়েস ফিলিপ, আই ক্লিয়ারলি রিমেম্বার । বাট দেয়ার ওয়াজ নো কমপ্লিটনেস ইন আওয়ার লাইফ” । -কথাগুলো বলে মেম-সাহেব হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল ।
বিশ্বনাথ সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মেরি মেম-সাহেবের মাথা ফিলিপ সাহেবের বক্ষবন্দী হয়ে আছে । সাহেব তার হাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে মেম-সাহেবের মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে সান্ত্বনা দিতে লাগল -  - “প্লিজ বি কুল ডার্লিং । ওয়ান্স ইন এ ইয়ার উই মিট টুগেদার অনলি অন দিজ ডে । অফ কোর্স, ইন দ্য লং রান, কমপ্লিটনেস উইল কাম । বিলিভ মি ডার্লিং, আই উইল বি ওয়েটিং ফর ইউ ফরএভার” ।  

   ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি বেশ জোরেই চালাচ্ছিল বিশ্বনাথ । ন্যাশনাল লাইব্রেরীর কাছে আসতেই হঠাৎ গাড়ি দাড় করাতে বলল ফিলিপ সাহেব । বিশ্বনাথ জোরে ব্রেক কষতেই বিকট আওয়াজ হল । গাড়ির দরজা খুলে দুজনেই নামলো । মেম-সাহেব লম্বা লম্বা পা ফেলে আগে এগিয়ে যেতে লাগলো । সাহেব পিছন পিছন তাকে অনুসরন করতে লাগলো । তারপর তারা লাইব্রেরীর পাশে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ালো । চাঁদেরও আলো নেই, গাড়ি স্টার্টিং অবস্থায় না থাকাতে গাড়ির হেড লাইটও জ্বলছে না । চারিদিকে আলো-আঁধারি পরিবেশ । বিশ্বনাথ আবছা আলোয় দেখল ফিলিপ সাহেব তার কোটের পকেট থেকে একটা গোলাপ ফুল বের করে মেরি মেম-সাহেবের হাতে দিল । মেম-সাহেব গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে সাহেবকে উইস করে পাশের সরু রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো । আস্তে আস্তে মেম-সাহেব অন্ধকারে মিশে গেল । ফিলিপ সাহেব তার যাবার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল । এই দৃশ্য দেখে বিশ্বনাথ ভয় পেয়ে গেল । তাকে যে এ-রকম দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হবে একটু আগেও সে ভাবতে পারেনি । আজ কাদের খপ্পরে যে সে পড়ল !  তার সারা শরীরের লোমগুলো খাঁড়া হয়ে উঠতে লাগলো । বুকের মধ্যে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল । এই মুহূর্তে সে কি করবে ? গাড়ি নিয়ে ব্যাক করে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই । কিন্তু বিশ্বনাথ স্টিয়ারিং ধরতে পারছে না । হাত কাঁপতে লাগল ।  তবুও মন শক্ত করে গাড়ি স্টার্ট দেবার চেষ্টা করতে লাগল । এমন সময় ফিলিপ সাহেব চোখের জল মুছতে মুছতে প্রায় দৌড়ে এসে ট্যাক্সির দরজা খুলে পিছনের সিটে বসে পড়ল । তারপর বিশ্বনাথকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল –
“ব্রাদার তুমি হয়তঃ ভয় পেয়ে গেছ । ভয়ের কোন কারণ নেই । মেরি চলে গেছে । কিন্তু আমি তো আছি । তুমি আমাকে কাইন্ডলি প্রিন্সেপঘাট পৌঁছে দাও” । বিশ্বনাথের গলা তখন শুকিয়ে কাঠ । উত্তর দেবার চেষ্টা করেও সে উত্তর দিতে পারল না । তখনও তার বুকের মধ্যে হাতুরি পেটার শব্দ ক্রমাগত বেজে চলছে । তার যে আর টাকার দরকার নেই, সে এখন বাড়ির পথ ধরতে চায় সেটা কোনক্রমেই তার মুখ থেকে উচ্চারিত হল না । বিশ্বনাথ কেমন যেন আচ্ছন্নতায় ডুবে  গেল । গিয়ারে হাত লাগাতে হাত রীতিমতো কাঁপতে শুরু করল । তবুও কোন উপায় নেই । তাকে কোন রকমে লোকটিকে পৌঁছে দিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে । গাড়ি স্টার্ট করে কাঁপতে কাঁপতে বিশ্বনাথ আবার প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে রওনা দিল । পিছন থেকে ফিলিপ সাহেব বলতে লাগলো –
“শোন ব্রাদার, আমি ফিলিপ । মেরি ছিল আমার খুব ভালো বন্ধু । আমরা দু’জনে দু’জনকে খুব ভালবাসতাম । ২৫ বছর আগের এক বড়দিনের পরে ২৮শে ডিসেম্বর পার্কস্ট্রীটের এক হোটেলে মেরির জন্মদিনের পার্টি ছিল । সেই পার্টিতে আমাদের বিয়ের এনগেজমেন্ট হয়েছিল । সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত আনন্দ হুল্লোড় করে ঠিক করলাম আমরা দু’জনে হোল নাইট ক্যালকাটা ঘুরবো । ক্যালকাটা ন্যাশনাল লাইব্রেরী ছিল মেরির খুব প্রিয় জায়গা । তাই সেদিন অনেক জায়গা ঘুরে ন্যাশনাল লাইব্রেরীর কাছে আমার গাড়ি পার্ক করলাম । ২০ বছরের মেরি আনন্দে টগবগ করছে । রাস্তার মধ্যে ছেলেমানুষের মত ছুটোছুটি করছে । হঠাৎ কোথা থেকে একটা মোটর বাইক এসে সশব্দে ধাক্কা মারলো মেরিকে । আমি হসপিটালে নিয়ে গিয়ে চেষ্টা করেছিলাম । কিন্তু পারলাম না । ডক্টর বললেন “সি ইজ ডেড” । ব্যাস আমাদের আশা আকাঙ্খা সব শেষ হয়ে গেল” ।  

গাড়ি চালাতে চালাতে বিশ্বনাথের মনে হল তার শরীরের প্রত্যেকটি লোমকূপ খাঁড়া হয়ে উঠছে । সারা দেহে একটা হিমবাহ প্রবাহিত হচ্ছে । বুকের মধ্যে সমানে চলছে ধুকপুকানি ।  আজ বোধ হয় সে আর বাড়িতে পৌঁছতে পারবে না । কম্পমান ভয়ার্ত চোখে একবার গাড়ির সামনে আর একবার পিছনের দিকে তাকিয়ে চলেছে । গাড়ি কত স্পিডে চলছে, কোন রাস্তা দিয়ে চলছে সেদিকে তার খেয়ালই নেই । কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চেনা সেই পার্ক আর স্মৃতি স্তম্ভ দেখে তার হুঁশ এল । প্রিন্সেপ ঘাট এসে গেছে । সশব্দে ব্রেক কষে দাঁড় গাড়ি করাতেই ফিলিপ সাহেব দরজা খুলে নেমে সামনের বা দিকের দরজার কাছে এল ।দুটো পাঁচশো টাকার নোট বিশ্বনাথের পাশের সিটে রেখে দিতে দিতে বলল –
বাট ব্রাদার, এখনও আমরা দু’জনা দু’জনকে ভালোবাসি । প্রতি বছর এই ২৮শে ডিসেম্বরের রাতে পার্ক স্ট্রীট থেকে মেরি আমার কাছে চলে আসে । তারপর আমরা দু’জনে ডিপ নাইট ক্যালকাটা উপভোগ করি । গত বছর পর্যন্ত আমার নিজের গাড়ি ব্যাবহার করেছিলাম । এখন আমার আর গাড়ি নেই । তাই এবার তোমার ট্যাক্সি করে এসেছিল ।  আজ আমাদের ঘোরাবার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ”। কথাগুলো বলে ফিলিপ সাহেব আস্তে আস্তে পার্কের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো । তারপর হঠাৎ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল । বিশ্বনাথের সারা শরীর তখন অবসন্ন হয়ে পড়েছে । চোখের সামনে সব ঝাপছা লাগছে তার । তারপর জ্ঞান হারিয়ে সে স্টিয়ারিং-এর উপর ঢলে পড়ল ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮০৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৩/০৪/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast