মন-জানালা
দেওয়াল ঘড়িটায় ঢং ঢং করে চারটে বাজল । দখিনের খোলা জানালায় এসে দাঁড়াল ইমন । বাইরে চোখ পড়তেই ইমন চমকে উঠল । এক রাশ কালো মেঘের প্রলেপে সারা আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে গেছে । মনে হচ্ছে এক্ষুনি ঝড় উঠবে । কালবৈশাখীর ঝড় । মুহূর্তের মধ্যে উঠল ঝড় । ঝড়ের দাপটে ঘরের জানালার খোলা পাল্লাগুলো নৃত্য শুরু করে দিতেই নীচের ঘর থেকে ইরার ঘুম জড়ানো গলা শোনা গেল – “প্লিজ জানালাগুলো বন্ধ করে দাও”। ইমন তাড়াতাড়ি সামনের খোলা জানালাটা বন্ধ করে নীচের ঘরে এসে নৃত্যরত জানালাগুলো বন্ধ করে দিয়ে ইরার দিকে তাকাতেই দেখল ইরা ঈশানকে কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুমোচ্ছে । সারা সপ্তাহে বাচ্চার স্কুল, নিজের কাজ, সংসারের কাজ নিয়ে ইরা এত ব্যস্ত থাকে যে ভাল ভাবে ঘুমোবার একটুও ফুরসৎ পায় না । আজ ঈশানের স্কুল নেই । তাই চুটিয়ে ঘুমিয়ে নেবার দিন হিসাবে আজকের দিনটাই বেছে নিয়েছে ইরা । ইরাকে বিরক্ত না করে ইমন সোজা উপরের ঘরে ফিরে এল । ঝড়ের মাঝে বৃষ্টি শুরু হল । পাশের সেনেদের বাগানে ধুপ ধাপ আম পড়ার আওয়াজ কানে এল ইমনের । তারপর পাশের নারকেল গাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙ্গে পড়ল । ইমনের মন ছুটে গেল বন্ধ জানালায় । জানালা খুলতেই এক ঝলকা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল তার সারা শরীর । একটা ঠাণ্ডা হিমেল পরশে মনটা উচাটান হয়ে উঠল । বাইরের তাণ্ডব দেখতে দেখতে তার শৈশব-কৈশোরের মোহমাখা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল । বড় আম গাছটার নীচে একদল ছোট ছেলেমেয়ে ঝড়ের মধ্যেই আম কুড়োচ্ছে । ইতিমধ্যে ওদের নিজেদের মধ্যে আম কুড়ানো নিয়ে মারপিট শুরু হয়ে গেছে । কে কার থেকে বেশী আম কোঁচড়ে ভরবে তাই নিয়ে প্রতিযোগিতা । ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাণ্ডকারখানা দেখতে দেখতে ইমনের চোখের সামনে ভেসে উঠল তার ছেলেবেলার সেই দিনগুলো । তার বাবা জামসেদপুরে বদলি হয়ে চলে যাবার আগে তার ঠাকুরদার বানানো বারাসাতের এই বাড়িটায় বাবা-মায়ের সাথে সে থাকত । এই ঝড় বৃষ্টির দিনে ইমনও বাড়ির নিষেধ অমান্য করে পালিয়ে আম কুড়ানোর ছেলেমেয়েদের দলে যোগ দিত । বাবার কাছে বেদম বকুনি খাওয়া সত্ত্বেও ঝড়-বৃষ্টির সময়ে সে ছুটবেই ঐ আম গাছের নীচে । সে সময় তার কত বন্ধু আসত আম কুড়োতে । এখনও সে সব বন্ধুদের নাম তার মনে আছে । প্রীতম, শঙ্কর, তপন, দেবাশিস, তনিমা, মায়া, সুমতি, প্রিতি, দোলা । ওদের মুখগুলো তার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে । তাদের মধ্যে দু’একজন এখানে আছে । বাকীদের মধ্যে কেউ কেউ চাকরি নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে । মেয়ে বন্ধুরা ঘর সংসার করছে ।
বাইরে ঝড়ের গতি এখন অনেকটা কমে এসেছে । এত বছর পর সেই বড় আম গাছটাকে দেখে ইমন একটা অদ্ভুত শূন্যতায় ডুবে গেল । তার মন-জানালায় ফিরে এল এমনই এক ঝড়-বৃষ্টির দিনের ঘটনা । ইমন তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র । সবে উঠতি কিশোর-স্বত্বাগুলো দেহ-মনে জেগে উঠেছে । সম-বয়সী বন্ধুদের মধ্যে ইমন একটু বেশীই দুরন্ত ছিল । ঝড়-বৃষ্টি তুচ্ছ করে আম কুড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছিল । আম কুড়োতে কুড়োতে ইমনের চোখে পড়ল প্রীতির ফ্রকের কোঁচড়ে আম উপচে পড়ছে । প্রীতির কাছে অত আম দেখে ইমনের হিংসা হল । সে দৌড়ে গিয়ে প্রীতির জামার কোঁচড় ধরে জোরে এক টান মারল । প্রীতির আমগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল । সেও ছাড়বার পাত্রী নয় । সেও ইমনের জামা ধরে মারল টান । ইমনের গায়ে কিল-ঘুষি মারতে মারতে তার প্যান্টের দু’পকেটে হাত ঢুকিয়ে দু’পকেটে রাখা কয়েকটা আম একে একে ছুড়ে ফেলে দিল । এতে ইমন আরও রেগে গেল । এবার দু’জনের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল । এরকম বেশ কিছুক্ষন হাত ছোঁড়াছুড়ি হতে হতে অজান্তেই প্রীতি চলে এল ইমনের বুকে । হঠাৎ সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল ইমনের । এক না-জানা আনন্দের পরশে তার মনটা ভরে গেল । সে সময়ে প্রীতির কি অনুভূতি হচ্ছিল সেটা ইমনের জানা নেই । তবে সে ইমনের বাহু-বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য ছটফট করে নি । কোঁচড় থেকে আম পড়ে যাবার জন্য সে আক্ষেপও করেনি । দু’জনেরই সারা শরীর তখন অসাড় । এই ভাবে কতক্ষণ যে কেটে গেছে তারা দু’জনে ভ্রুক্ষেপও করেনি । তপনের চিৎকারে তাদের সম্বিৎ ফিরে এল – “এই ইমন হচ্ছেটা কি ? ছাড় প্রীতিকে । ও যে মরে যাবে”। তপনের উপর ইমন রেগে গিয়ে কিছু বলতে যেতেই ইমনের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল । প্রীতিও ছিটকে সরে গেল । প্যান্টের পকেটের বাকী কয়েকটা আম বের করে ইমন প্রীতির সামনে রেখে বলল – “তোর আমগুলো তো আমি ফেলে দিয়েছি । নে আমার আমগুলো তুই নিয়ে নে”। প্রত্যুত্তরে প্রীতি রাগত স্বরে শুধু বলল – “না আমার একটা আমেরও দরকার নেই । পাজি দুষ্টু কোথাকার”। বৃষ্টির গতি একটু কমতেই প্রীতি ভিজতে ভিজতে বাড়ির দিকে ছুট দিয়েছিল । ওর চলে যাওয়ার দিকে ইমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল । সেদিন বাড়ি ফিরে গা হাত পা ধুয়ে পড়তে বসে পড়ায় একটুও মন বসেনি ইমনের । রাতে বিছানায় শুয়ে ভোর রাতে ঘুম এসেছিল । সারা রাত প্রীতি তার মনে অনুভূতির খেলা খেলে গিয়েছিল । প্রীতির কথা মনে পড়লেই তার মন এখনও কেমন যেন আকুল হয়ে ওঠে । কিন্তু সেই প্রীতি কি তার মুম্বাইয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে স্মৃতির সরণি বেয়ে তার কথা, আম কুড়নোর কথা মনে করতে পারছে ?
পিছন থেকে ইরার চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে এল ইমনের – “কি গো হল কি তোমার ? ঘর যে জলে ভিজে যাচ্ছে”। বেশ ঘাবড়ে গিয়ে ইমন আমতা আমতা করে বলল – “একটু বৃষ্টি দেখছিলাম । বাচ্চাগুলো আম কুড়োচ্ছিল । দেখতে খুব ভালো লাগছিল”। আর একটু কাছে এসে ইরা বলে উঠল – “তোমার কি ভীমরতি ধরেছে ? বুড়ো খোকা এখন আম কুড়োনো দেখছে । খুব হয়েছে । এদিকে এসো । ঘরের জলটা তো মুছতে হবে”। রাগে গজ গজ করতে করতে ইরা সামনের জানালাটা দরাম করে বন্ধ করে দিল । তারপর ঘুরে তার দিকে তাকাতেই সে চমকে উঠল । ইরা তীব্র স্বরে বলল - “একি, তুমি নিজেও তো ভিজে গেছ । যাও ভিজে জামা কাপড় ছেড়ে শুকনো জামা কাপড় পড়ে এসো”। ইমন কাঁচুমাচু করে বলল – “হ্যাঁ হ্যাঁ ম্যাডাম, যথা আজ্ঞা”।
বাইরে ঝড়ের গতি এখন অনেকটা কমে এসেছে । এত বছর পর সেই বড় আম গাছটাকে দেখে ইমন একটা অদ্ভুত শূন্যতায় ডুবে গেল । তার মন-জানালায় ফিরে এল এমনই এক ঝড়-বৃষ্টির দিনের ঘটনা । ইমন তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র । সবে উঠতি কিশোর-স্বত্বাগুলো দেহ-মনে জেগে উঠেছে । সম-বয়সী বন্ধুদের মধ্যে ইমন একটু বেশীই দুরন্ত ছিল । ঝড়-বৃষ্টি তুচ্ছ করে আম কুড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছিল । আম কুড়োতে কুড়োতে ইমনের চোখে পড়ল প্রীতির ফ্রকের কোঁচড়ে আম উপচে পড়ছে । প্রীতির কাছে অত আম দেখে ইমনের হিংসা হল । সে দৌড়ে গিয়ে প্রীতির জামার কোঁচড় ধরে জোরে এক টান মারল । প্রীতির আমগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল । সেও ছাড়বার পাত্রী নয় । সেও ইমনের জামা ধরে মারল টান । ইমনের গায়ে কিল-ঘুষি মারতে মারতে তার প্যান্টের দু’পকেটে হাত ঢুকিয়ে দু’পকেটে রাখা কয়েকটা আম একে একে ছুড়ে ফেলে দিল । এতে ইমন আরও রেগে গেল । এবার দু’জনের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল । এরকম বেশ কিছুক্ষন হাত ছোঁড়াছুড়ি হতে হতে অজান্তেই প্রীতি চলে এল ইমনের বুকে । হঠাৎ সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল ইমনের । এক না-জানা আনন্দের পরশে তার মনটা ভরে গেল । সে সময়ে প্রীতির কি অনুভূতি হচ্ছিল সেটা ইমনের জানা নেই । তবে সে ইমনের বাহু-বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য ছটফট করে নি । কোঁচড় থেকে আম পড়ে যাবার জন্য সে আক্ষেপও করেনি । দু’জনেরই সারা শরীর তখন অসাড় । এই ভাবে কতক্ষণ যে কেটে গেছে তারা দু’জনে ভ্রুক্ষেপও করেনি । তপনের চিৎকারে তাদের সম্বিৎ ফিরে এল – “এই ইমন হচ্ছেটা কি ? ছাড় প্রীতিকে । ও যে মরে যাবে”। তপনের উপর ইমন রেগে গিয়ে কিছু বলতে যেতেই ইমনের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল । প্রীতিও ছিটকে সরে গেল । প্যান্টের পকেটের বাকী কয়েকটা আম বের করে ইমন প্রীতির সামনে রেখে বলল – “তোর আমগুলো তো আমি ফেলে দিয়েছি । নে আমার আমগুলো তুই নিয়ে নে”। প্রত্যুত্তরে প্রীতি রাগত স্বরে শুধু বলল – “না আমার একটা আমেরও দরকার নেই । পাজি দুষ্টু কোথাকার”। বৃষ্টির গতি একটু কমতেই প্রীতি ভিজতে ভিজতে বাড়ির দিকে ছুট দিয়েছিল । ওর চলে যাওয়ার দিকে ইমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল । সেদিন বাড়ি ফিরে গা হাত পা ধুয়ে পড়তে বসে পড়ায় একটুও মন বসেনি ইমনের । রাতে বিছানায় শুয়ে ভোর রাতে ঘুম এসেছিল । সারা রাত প্রীতি তার মনে অনুভূতির খেলা খেলে গিয়েছিল । প্রীতির কথা মনে পড়লেই তার মন এখনও কেমন যেন আকুল হয়ে ওঠে । কিন্তু সেই প্রীতি কি তার মুম্বাইয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে স্মৃতির সরণি বেয়ে তার কথা, আম কুড়নোর কথা মনে করতে পারছে ?
পিছন থেকে ইরার চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে এল ইমনের – “কি গো হল কি তোমার ? ঘর যে জলে ভিজে যাচ্ছে”। বেশ ঘাবড়ে গিয়ে ইমন আমতা আমতা করে বলল – “একটু বৃষ্টি দেখছিলাম । বাচ্চাগুলো আম কুড়োচ্ছিল । দেখতে খুব ভালো লাগছিল”। আর একটু কাছে এসে ইরা বলে উঠল – “তোমার কি ভীমরতি ধরেছে ? বুড়ো খোকা এখন আম কুড়োনো দেখছে । খুব হয়েছে । এদিকে এসো । ঘরের জলটা তো মুছতে হবে”। রাগে গজ গজ করতে করতে ইরা সামনের জানালাটা দরাম করে বন্ধ করে দিল । তারপর ঘুরে তার দিকে তাকাতেই সে চমকে উঠল । ইরা তীব্র স্বরে বলল - “একি, তুমি নিজেও তো ভিজে গেছ । যাও ভিজে জামা কাপড় ছেড়ে শুকনো জামা কাপড় পড়ে এসো”। ইমন কাঁচুমাচু করে বলল – “হ্যাঁ হ্যাঁ ম্যাডাম, যথা আজ্ঞা”।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আকাশ চট্টোপাধ্যায় ২০/০৬/২০১৬
-
গোপেশ দে ১০/০৬/২০১৬খুব ভাল
-
শান্তনু ব্যানার্জ্জী ০৮/০৬/২০১৬সুন্দর হয়েছে
-
পরশ ০৮/০৬/২০১৬সুন্দর
-
পরশ ০৭/০৬/২০১৬সুন্দর
-
পরশ ০৫/০৬/২০১৬অতুলনীয়
-
গোপেশ দে ০৪/০৬/২০১৬অসাধারণ অনুভুতি
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ০৪/০৬/২০১৬ইচ্ছেটুক পূরন হবে, আবার যদি পাই তবে।
অপূর্ব, বিমোহিত!!! -
দেবজ্যোতিকাজল ০৪/০৬/২০১৬ভাল
কিঃ হ্যাঁ কিংবা না (যাবে কি? খাবে কি? তোমার কি ভীমরতি ধরেছে?)
কীঃ পরিমান, ঘটনা, অবয়ব (কী বিশাল, ব্যাপার কী, কী-ই যে বলি, কী গো হল কী তোমার)
আমার মতে প্যারা ভেঙে লিখলে ভাবনাকে আরও সাজানোর চিন্তা চলে আসে, সেই ফাঁকে সুন্দর সুন্দর কথা জায়গা পেয়ে যায়। ভাল লিখুন। ভাল হোক। ধন্যবাদ