www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ধূসর

এখন আশ্বিন মাস । নব যৌবনের উচ্ছলতায় স্রোতস্বিনী গঙ্গা ভরাডুবিতে আচ্ছন্ন । ধুলিয়ানের গঙ্গার পারে ফেরি ঘাটে দাঁড়িয়ে অভিজিৎ বাবু । তাঁর দৃষ্টি গঙ্গার ওপারে ।  গঙ্গার ওপারে দেখা যাচ্ছে “দিয়ার” । দিয়ারের গোটা পরিবেশ বেশ প্রাকৃতিক এবং মনোমুগ্ধকর । চারিদিকে সবুজের সমারোহ ।  ওপারে নদীর কোল ঘেঁষে সাজানো গোছানো এক মন্দির । এপারের জেলা মুর্শিদাবাদ আর ওপারের জেলা মালদহ । মাঝে বয়ে চলেছে গঙ্গা । অভিজিৎ বাবুর বারবার মনে হতে লাগল দিয়ার যেন তাঁকে ডাকছে । তাঁর মনে হতে লাগল তাঁর ফেলে আসা দিনগুলোর মধ্যে কোন লুকনো স্মৃতি তাঁকে আজ পুনরায় মনে করে দিতে চাইছে ।

           ধুলিয়ান হাই স্কুলে যখন তিনি শিক্ষকতা করতেন তখন যৌবনের বেশ কয়েকটা বছর তিনি এখানে কাটিয়েছেন । তারপর কৃষ্ণনগর হাই স্কুলে বদলি হয়ে যাবার পর ধুলিয়ানের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না । এখন তিনি রিটায়ার্ড । এখন অনেক সময় । শিক্ষকতার জীবনে প্রথম কর্মস্থল ধুলিয়ানের স্মৃতি তাঁর কাছে এখনও অমলিন । তাই প্রায় ত্রিশ বছর পর এক আত্মীয়ের বাড়িতে পৈতের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁর ধুলিয়ানে আসা । গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে অভিজিৎ বাবু তাঁর পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগলেন ।  কত ছাত্র ছাত্রী পড়তে আসত তার কাছে । দিয়ার থেকে নদী পার হয়েও অনেকে আসত । তারা এখন কোথায় কে জানে ? সব ছাত্র ছাত্রীকে মনে না পড়লেও একজনকে তাঁর এখনও মনে পড়ে । সে তাঁরই ছাত্রী সুমিতা । সেও দিয়ার থেকে নৌকায় নদী পার করে আসত । ফর্সা গায়ের রঙ । ছিপছিপে গড়ন । এক মাথা চুল । চোখ দুটো ছিল ভারী সুন্দর । সব মিলিয়ে বেশ সুশ্রী । অভিজিৎ বাবুর তখন বয়স কম । শিক্ষক হিসাবে নতুন জয়েন করেছেন । বারো ক্লাসের ছাত্রী সুমিতা তাঁর মনের মণিকোঠার দরজা প্রথম উন্মুক্ত করেছিল । তিনি সুমিতাকে ভালবেসে ফেলেছিলেন ।  কিন্তু মনের মনিকোঠায় জমানো কথা তিনি কোনদিনই তাঁর প্রিয় ছাত্রীকে ভাষায় ব্যক্ত করতে পারেননি । সব কিছু ছিল মনের অন্দরেই । বারো ক্লাস শেষ করে সুমিতা চলে যায় তাঁর টিউটোরিয়াল হোম থেকে । তারপর বেশ কিছু দিন পর কলেজে পড়া কালিন শেষ বারের মত তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। বিয়ের কার্ড হাতে নিয়ে মাস্টার মশাইকে নেমন্তন্ন করতে । সেদিন মুখে কিছু না বললেও তাঁর বুকের ভিতরটা কেঁদে উঠেছিল । ছলছল করা চোখ দুটো লুকিয়ে মুছতে হয়েছিল । সুমিতা উচ্ছলতার সাথে বলেছিল – “ স্যার, আপনাকে যেতেই হবে । কোন কথা আমি শুনবো না”। ছলছল করা চোখ দুটো লুকিয়ে মুছতে মুছতে তিনি বলেছিলেন – “সম্ভব হলে নিশ্চয়ই যাব । তুমি ভালো থেকো সুমিতা”।  সুমিতা তার মাস্টার মশায়কে প্রণাম করে চলে যাবার পর সেদিন অভিজিৎ বাবু ভালো করে খেতে পারেননি । রাতে ঘুমাতেও পারেননি । কোথা থেকে যেন একটা ঝড় ঘূর্ণাবর্ত হয়ে তার বুকের উপর আছড়ে পড়েছিল ।  পরের দিন ভোরে নিদ্রাহীন চোখে এই গঙ্গার পাড়েই তিনি এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন আর গঙ্গার ওপারে প্রাকৃতিক শোভায় শোভিত সবুজ দিয়ারের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন । মুখে ছিল না কোন ভাষা । শুধু চোখের কোল বেয়ে নেমে এসেছিল জলের ধারা ।  

               সূর্য তাঁর রক্তিম আভা ছড়িয়ে মুখ লুকিয়েছে । সন্ধ্যার ধূসর চাদরে আচ্ছন্ন চারিধার । কয়েকদিন পর পূর্ণিমা । অর্ধ থালার চাঁদের মায়াবি আলোয় আকাশ সুরভিত ।  ওপারের মন্দিরে আলো জ্বলে উঠেছে ।  গঙ্গার জলে তার প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়ে এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে । দুটো নৌকা যাত্রী নিয়ে এপার ওপার করে চলেছে । অভিজিৎ বাবুর খুব ইচ্ছা হল নৌকা চেপে দিয়ারে যেতে । যেমনি ভাবা অমনি কাজ । অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে দিয়ারে যাবার নৌকায় চেপে বসলেন । নৌকা চলতে শুরু হতেই অভিজিৎ বাবু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন । গঙ্গার জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দের মাঝে তিনি হারিয়ে গেলেন বেশ কয়েক বছর আগে ফেলে আসা দিন গুলোতে । স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকদের ও ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে নৌকায় চেপে গঙ্গা পার হয়ে কতবার তিনি পিকনিক করতে এসেছেন এই দিয়ারে । মনে পড়ে গেল শুভঙ্করের কথা । একবার পিকনিকে এসে সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছিল । খুব ভালো কবিতা লিখত । আবৃত্তিও করত দারুণ । তিনি ইংরাজি পড়াতেন আর শুভঙ্কর বাংলা । শুভঙ্কর এখন কোথায় কে জানে ? এখান থেকে যাবার পর কয়েক বছর তার সাথে যোগাযোগ ছিল । তারপর সময়ের সাথে সাথে সব বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল । এখন সেও তো তাঁরই মত একজন বৃদ্ধ । সেও তো রিটায়ার্ড । ওঁকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করে । এর মধ্যে সম্ভব হলে তার খোঁজ নেবেন ।

            নৌকা ঘাটে ভিড়তেই তাঁর সম্বিৎ ফিরে এল । দিয়ার এসে গিয়েছে । অভিজিৎ বাবু নৌকার পাল ধরে মাঝির সাহায্য নিয়ে সাবধানে ঘাটে নামলেন । তারপর আস্তে আস্তে গ্রামের দিকে এগিয়ে চললেন । প্রথমেই তাঁকে আকর্ষণ করল ছোট্ট একচালার মন্দিরটা । বাঁশের বেড়ার দরজা খুলে এগিয়ে গেলেন মন্দির চত্বরে । একে একে শিবমূর্তি, রাধা-মাধব, নিতাই-গৌর দর্শন করলেন । মন্দিরের পুরোহিত রাধা-গোবিন্দর আরতিতে ব্যস্ত । অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আরতি দেখলেন । ভক্তি ভরে প্রণাম করে মন্দিরে রাখা দান পাত্রে একশো টাকার একটা নোট দিলেন । তারপর মন্দিরের সামনে ঘাস বিছানো গালিচাতে বসলেন । পরিবেশ খুব সুন্দর ও উপভোগ্য লাগছে । নির্জন পরিবেশে একদিকে স্রোতস্বিনী গঙ্গা আর অন্য দিকে সুন্দর সবুজের  মাঝে মন্দিরের আরতি অতি দুর্লভ চিত্র । তাঁর মনে হল এ-রকম দৃশ্যপট তাঁর জীবনে এই প্রথম । কিন্তু পরিবেশ যতই উপভোগ্য হোক না কেন ঘুরে ফিরে তাঁর মাথায় সুমিতার কথাই মনে পড়ছে । মনের কোণায় লুকিয়ে থাকা ইচ্ছা বার বার উঁকি দিচ্ছে । সে এখন কোথায়  আছে কেমন আছে কে জানে ? সে-ও তো এখন প্রৌঢ়া । ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার । তাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে তাঁর।  দিয়ারে যখন তিনি এসেছেন তখন সুমিতার সংবাদ তিনি নিয়েই যাবেন ।

            মন্দির চত্বরে প্রায় এক ঘণ্টা কাটিয়ে অভিজিৎ বাবু এবার গ্রামের পথ ধরলেন । মাথার উপরে অর্ধ চন্দ্রের আলো । সেই আলোতে গ্রামের পরিবেশ এক সুন্দর মোহময়ী রূপ পেয়েছে । চলতে চলতে তাঁর মনে হল তাঁর জীবন সত্যিই সার্থক । আলো আঁধারীর মধ্য দিয়ে নির্জন গ্রামের পথ ধরে চলা তাঁর এক চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা, এক পরম প্রাপ্তি । কিছুটা হাঁটবার পর তাঁর চোখে পড়ল রাস্তার দু’পাশে কয়েকটি ছোট ছোট দোকানের সারি । দোকান গুলোতে টিম টিম করে আলো জ্বলছে । একটা তেলেভাজা আর চায়ের দোকান দেখে তাঁর সিঙ্গারা আর চা খেতে ইচ্ছে হল । ধুলিয়ানের আত্মীয়ের বাড়ি থেকে সেই কখন বেরিয়েছেন । হাল্কা খিদেও পেয়েছে । অভিজিৎ বাবু দোকানের সামনে পাতা বাঁশের বেঞ্চিতে বসে পড়লেন ।  দোকানিকে এক কাপ চা আর সঙ্গে একটা সিঙ্গারা দিতে বললেন ।  দোকানিটি কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ছোট ট্রে-তে করে এক গ্লাস চা আর সঙ্গে দুটো সিঙ্গারা অভিজিৎ বাবুর সামনে নিয়ে এল । ট্রে অভিজিৎ বাবুর হাতে দিতে গিয়ে হঠাতই দোকানিটি একটু হতবম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল । দোকানিটি বলল – “স্যার আপনি ! চিনতে পারছেন স্যার ? আমি স্বপন । আপনার কাছে পড়তে যেতাম”। অভিজিৎ বাবু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানিটিকে ভালো ভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন । কত দিন আগেকার কথা । কত ছাত্র-ছাত্রী তাঁর কাছে পড়তে আসত । এখন হয়তঃ সবাইকে তিনি নাম ধরে চিনতেও পারবেন না । তবুও তিনি অতীত হাতড়াতে হাতড়াতে স্বপনকে চিনতে পারলেন । এখন বয়স হয়েছে । চেহারারও পরিবর্তন হয়েছে । কিন্তু মুখের আদল খুব একটা পাল্টায়নি । অভিজিৎ বাবু এবার ধীর কণ্ঠে বললেন – “হ্যাঁ, এবার চিনতে পেরেছি । গ্রামার ভুল করতে বলে আমার কাছে কত বকুনি খেয়েছ । মনে আছে ?” স্বপন হাসতে হাসতে বলল – “হ্যাঁ স্যার সব মনে আছে”।  স্বপন এবার অভিজিৎ বাবুর হাতে  চায়ের ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বলল – “স্যার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে । আগে খেয়ে নিন । তারপর কথা বলব”। স্বপন দোকানের মধ্যে চলে গেলে অভিজিৎ বাবু চা সিঙ্গারা খেয়ে নিলেন । গ্রামের দোকান । লোকজন বিশেষ নেই । কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বপন তাঁর মাস্টার মশাইয়ের সামনে উপস্থিত হল । অভিজিৎ বাবু বললেন – “তোমার খবর কি বল”। স্বপন বলতে লাগল – “স্যার মাধ্যমিক পাশ করার পর আর পড়াশুনা করতে পারিনি । বাবা মারা গেলেন । বাবার এই চা-তেলেভাজার দোকানটাই সেই থেকে চালাচ্ছি । এক ছেলে আর এক মেয়ে । মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি । থাকে ধুলিয়ানে । খুব কষ্টের সংসারে ছেলেকে পড়াশুনা শিখিয়েছি । এখন ও কোলকাতায় সি,এ, পড়ছে । একই সঙ্গে একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজও করছে”। স্বপনের কথা শুনে অভিজিৎ বাবু বিহ্বল । এত কষ্টের মধ্যে থেকেও ছেলেকে মানুষ করে তোলার যে আপ্রাণ চেষ্টা তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্বপন । অভিজিৎ বাবু খুব খুশী হয়ে বললেন – “বাঃ স্বপন, ভেরি গুড । আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তোমার ছেলে নিশ্চয়ই আরও বড় হবে, আরও উন্নতি করবে । তোমার কষ্ট, তোমার সৎ চেষ্টা বিফলে যাবেনা”।  স্বপন স্বপ্নেও কোনদিন ভাবেনি তার স্যারের সঙ্গে এতদিন পরে এই দিয়ারে এই ভাবে তার চায়ের দোকানে দেখা হবে ! স্বপন অভিজিৎ বাবুকে জিজ্ঞাসা করল – “স্যার, এতদিন পর আপনি এলেন ! শুনেছিলাম আপনি এখান থেকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে গিয়েছিলেন । এখন কোথায় আছেন ?” অভিজিৎ বাবু বললেন – “হ্যাঁ ঠিকই শুনেছিলে । আমি ট্রান্সফার নিয়ে কৃষ্ণনগর চলে গিয়েছিলাম । এখন আমি রিটায়ার্ড । ওখানেই একটা ছোট ভাড়া বাড়িতে থাকি । একাই আছি । সংসার করার সময় আর পাইনি । এখন এই ভাবেই চলছে । এত দিন ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে থেকেছি ।  কোন অবসর পাইনি । এখন অফুরন্ত সময় । পুরনো ছাত্র-ছাত্রীদের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে । ধুলিয়ানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছি এক অনুষ্ঠান উপলক্ষে । গঙ্গার ধারে বেড়াতে এসে নৌকা করে দিয়ারে আসার লোভ সামলাতে পারলাম না”। এতক্ষন স্বপন মন দিয়ে তার স্যারের কথা শুনছিল । অভিজিৎ বাবুর কথা শেষ হলে স্বপন বলল – “স্যার আমার বাড়িতে চলুন । কাছেই আমার বাড়ি । পাঁচ মিনিটের পথ । আপনার কোন অসুবিধা হবে না”। অভিজিৎ বাবু বললেন – “না গো স্বপন আজ হবে না । রাত হয়ে গেছে । ধুলিয়ানের বাড়িতে কোন খবর না দিয়েই আমি এদিকে চলে এসেছি । এখন উঠতে হবে । ওরা সবাই হয়তঃ চিন্তা করছে । এখন তো আমার অবসর সময় । আবার পরে একদিন আসব । তখন নিশ্চয়ই তোমার বাড়িতে যাব”। এক্ষেত্রে পরিস্থিতির চাপে স্বপনের জোরাজুরি খাটল না । সে শুধু তার মাস্টার মশাইয়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল । রাত হয়ে গেছে । অভিজিৎ বাবুকে এখন ধুলিয়ানে ফিরতে হবে । রাত নটা পর্যন্ত ফেরি সার্ভিস । তিনি তাঁর হাত ঘড়িটা দেখলেন । আটটা বেজে কুড়ি মিনিট । অভিজিৎ বাবুর মনে হল তিনি দিয়ারে এলেন ঠিকই কিন্তু এই আসার মধ্যে কোথায় যেন এক অসম্পূর্ণতা থেকে গেল । তাঁর একদা প্রিয় ছাত্রী সুমিতার সংবাদ না নিয়ে তিনি কি করে যাবেন ! স্বপনকে সামনে পেয়ে তিনি যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেলেন । তিনি স্বপনকে জিজ্ঞাসা করলেন – “আচ্ছা স্বপন, সুমিতা নামে একটি মেয়ে এই দিয়ার থেকে আমার কাছে পড়তে যেত । আমার স্কুলেরও ছাত্রী ছিল । ওর এখানেই বিয়ে হয়েছিল । তুমি কি ওর কিছু খবর জান ? বর্তমানে কোথায় আছে, কেমন আছে বলতে পার ?” স্বপন তার স্যারের কথায় সায় দিয়ে বলল – “হ্যাঁ স্যার ঠিকই বলেছেন । সুমিতা তো আমাদের ব্যাচেই পড়ত । কিন্তু স্যার, সুমিতা আর নেই । দু’বছর আগে ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে”। স্বপনের কথা কানে যেতেই অভিজিতের মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠল । দুটো চোখ জলে ভরে গেল । চোখ দুটো বন্ধ করে খুলতেই সামনেটা ঝাপসা হয়ে গেল । স্বপনের কথার প্রতি-উত্তরে কোন ভাষা তিনি খুঁজে পেলেন না । পরনের ধুতির খোঁটায় চোখ মুছে কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ালেন । পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বার করে স্বপনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন – “স্বপন চা –সিঙ্গারার দামটা রেখে দাও”। স্বপন জিভ কেটে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলল – “স্যার এ কি করছেন ! ছি ছি, আপনার কাছ থেকে চায়ের দাম নিতে পারি ? কত যুগ পরে আপনি আমাদের দিয়ারে এলেন । আপনাকে আপ্যায়ন করা আমার কর্তব্য”। অভিজিৎ বাবু বিমর্ষ ভাবে বললেন – “স্বপন তুমি এই ছোট্ট দোকান চালাও । কত আর হয় এতে । তোমারও তো সংসার আছে। তোমার বাড়িতে যখন যাব তখন তো আর দেব না । এখন রাখ”। স্বপন কিছুতেই তার মাস্টার মশাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিল না । স্বপনের জেদের কাছে অভিজিৎ বাবুকে হার মানতেই হল । স্বপন তার মাস্টার মশাইয়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল । অভিজিৎ বাবু তাঁর ছাত্রের মাথায় দুহাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন – “ ভালো থেকো স্বপন”। স্বপনের চোখে তখন জল । তার প্রিয় মাস্টারমশাই চলে যাচ্ছেন । এখন তিনি বৃদ্ধ । আর হয়তঃ আসতে পারবেন না । তবুও চোখের জল সংবরণ করে স্বপন বলল – “আপনিও ভালো থাকবেন স্যার । আবার আসবেন। এবার এসে আমার বাড়িতে কয়েকদিন থেকে যাবেন । নিরিবিলি জায়গা । আপনার বেশ ভালো লাগবে । চলুন স্যার আপনাকে নৌকায় তুলে দিয়ে আসি”। অভিজিৎ বাবু তাঁর প্রাক্তন ছাত্রের ব্যাবহারে অভিভুত হয়ে গেলেন । স্বপনকে তিনি বললেন – “না না স্বপন দোকান ছেড়ে তোমাকে যেতে হবে না । আমি যেতে পারব”। কিন্তু স্বপন নাছোড়বান্দা । এই অন্ধকার রাতে সে কি করে তার বৃদ্ধ স্যারকে একা যেতে দিতে পারে ? গঙ্গার ঘাটে নৌকা আছে কিনা এবং ঠিকমত নৌকায় উঠতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারেও তার সংশয় রয়েছে । সে পাশের দোকানিকে তার দোকানটাকে দেখতে বলে তার স্যারকে নিয়ে গঙ্গার পারে ফেরি ঘাটে চলে এল । ধুলিয়ান যাবার শেষ নৌকায় স্বপন তার স্যারকে সাবধানে হাত ধরে তুলে দিল ।

            নৌকা চলতে শুরু করল । স্বপন পাড়ে দাঁড়িয়ে বিদায় জানিয়ে হাত নাড়িয়ে চলল । নৌকা ধীরে ধীরে ভরা গঙ্গার উপর দিয়ে এগিয়ে চলল । অভিজিৎ বাবু দেখলেন স্বপন ক্রমশঃ অস্পষ্ট হয়ে এল । তারপর আস্তে আস্তে  স্বপনের সাথে সাথে দিয়ারও মিলিয়ে গেল । শুধু অন্ধকারের মধ্যে টিমটিম করে জ্বলছিল ওপারের মন্দিরের আলো । ওপরের অর্ধ চাঁদের মায়াবী আলোর দিকে তাকাতেই তাঁর কানে ভেসে এল – “স্যার আপনি দিয়ারে এলেন । কিন্তু আমার ভাগ্য খারাপ । আপনার সাথে দেখা হল না” ।  অভিজিৎ বাবু চমকে উঠলেন । সুমিতার গলা । তাহলে সুমিতাও তাঁকে ... । নিজেকে তিনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না । সুমিতার টানেই তো তিনি এতবছর পরেও দিয়ারে এসেছিলেন । তবে তিনি কি এই সংবাদ শুনতে এসেছিলেন ? চশমাটা খুলে চোখ দুটো রুমালে মুছে নিলেন । চাঁদের মায়াবী আলো তাঁর কাছে এখন মলিন লাগছে । গঙ্গার জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তাঁর বহু বছরের স্বপ্নকে ছিন্ন করে দিয়েছে। মনের অগোচরে তাঁর হৃদয় থেকে শুধু একটা কথা বেরিয়ে এল – “সুমিতা তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো”।


**************
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮৩৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/০৫/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast