মোহজাল
কাজ সেরে সৌম্য যখন বড় রাস্তায় এলো তখন রাত প্রায় দশটা । রাস্তাঘাট জনশূন্য । সন্ধ্যা থেকে আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি থামতে বেশ রাতই হয়ে গেল । এমনিতেই বিহারের মুঙ্গেরে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ঠাণ্ডা পড়ে যায় । আজ আবার তার উপর অ-সময়ের বৃষ্টি ঠাণ্ডাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে । প্রায় আধ ঘণ্টা হয়ে গেল সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে । কিন্তু স্টেশনে যাবার কোন যানবাহনের দেখা নেই । আজ তাকে কোলকাতায় ফিরতেই হবে । আজকের রাতের ট্রেনের রিজার্ভেশন সে অনেক আগেই করে রেখেছে । এদিকে খিদেয় পেট চো-চো করছে । সেই দুপুর বেলা হোটেলের ভাত-ডাল-সবজির পর এপর্যন্ত তার কপালে আর কিছুই জোটেনি । আশপাশের দোকান সব বন্ধ । এই পরিস্থিতিতে সে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সৌম্য । ব্যবসার কাজে ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় সে গিয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্তও এ-রকম পরিস্থিতিতে সে আগে কখনও পড়েছে বলে মনে করতে পারছে না । চারিদিকে যা অন্ধকার তাতে মনে হচ্ছে আজ নিশ্চয়ই অমাবস্যা । দূরে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা । হঠাৎ নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে একটা মানুষ রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে বলে তার ঠাহর হল । লোকটি কাছে আসতেই সৌম্য দেখল একজন গ্রাম্য লোক, হাতে একটা বড় ঝোলা । সৌম্য তাকে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল – “ভাইয়া আভি ষ্টেশন যানে কা বস মিলেগি ?” সৌম্যর কথা শুনে লোকটি দাঁড়িয়ে পড়ল । সে জবাব দিল – “আরে সাহাব, আভি ক্যাসে মিলেগি ? লাস্ট বস তো সাড়ে ন বজে থি, উ তো বহুত পহেলিহি চলি গয়ি ।“ লোকটির কথা শুনে সৌম্যর মাথায় হাত । এখন সে কি করবে ? লোকটিকে সৌম্য আবার জিজ্ঞাসা করল – “আচ্ছা ভাইয়া, ইহাসে স্টেশন যানে কি লিয়ে অউর কুছ মিলেগি ?” লোকটি বলল – “নেহি সাহাব, আজ রাতকো অউর কুছ নেহি মিলেগি । কাল শুভে ফির মিলেগি”। লোকটি কথাটা বলেই সৌম্যর আপাদমস্তক একটু দেখে হাঁটা দিল । এখন সৌম্য কি করবে ? এখন তার হেঁটে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই । কিন্তু স্টেশনের দূরত্বও তো কম নয় । প্রায় কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা । ঠাণ্ডার মধ্যে শ্রান্ত ক্লান্ত শরীর নিয়ে এতটা রাস্তা হেঁটে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব । আজ রাতের ট্রেন ধরাও তার পক্ষে অসম্ভব । এখন তার প্রয়োজন একটু খাবার আর একটু আশ্রয় । চারিদিক নিস্তব্ধ, অন্ধকার । শ্রান্ত-ক্লান্ত সৌম্য বড় রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল । বেশ খানিকটা যাবার পর সে দেখল রাস্তার দু-পাশে ঘন জঙ্গল । নিশুতি রাতের ঝি-ঝি পোকার আওয়াজ মাঝে মাঝে কানে আসছে । এই পরিবেশে সৌম্য একেবারে আনকোরা । বেশ ভয় করতে লাগলো তার। এখন আরও বেশি ঠাণ্ডা লাগছে তার । পকেট থেকে রুমাল বের করে কানে বেঁধে দুটো হাত প্যান্টের দুদিকের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটতে লাগলো । প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জমে যাবার উপক্রম । চলার গতি ক্রমশঃ মন্থর হতে শুরু করল । সে আর হাঁটতে পারছে না । এইভাবে প্রায় পনেরো বিশ মিনিট চলার পর রাস্তার ধারে একটা বড় গাছের নীচে সৌম্য বসে পড়ল । কতক্ষনে যে সে গন্তব্যস্থলে পৌঁছবে কে জানে ? হঠাৎ রাস্তার ডান দিকে চোখ পড়তেই তার বুকে একটু জোর এল । জঙ্গল ভেদ করে অনেক দূর থেকে আসা একটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে । সৌম্য ভাবল নিশ্চয়ই ওখানে লোকবসতি আছে । রাতের আশ্রয়ের কথা চিন্তা করে বড় রাস্তা ছেড়ে সে জঙ্গলের পথ ধরল । জঙ্গলের মধ্যে রাতের অন্ধকার বীভৎস আকার ধারণ করল । জংলী পথ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না । সৌম্যর বেশ ভয় করতে লাগল । তবুও সাহসে ভর দিয়ে আলোর বিন্দুকে অনুসরণ করে সে এগোতে লাগল ।
আলোর কাছাকাছি পৌঁছতেই সৌম্য দেখল এক বিরাট বড় বাড়ির মধ্য থেকে আলো আসছে । বাড়িটা দেখে সৌম্য অবাক হয়ে গেল । জঙ্গলের মধ্যে এ-রকম বাড়ি ? বাড়ি তো নয়, এ-যেন প্রাসাদ । কিন্তু ভগ্নপ্রায় । বাড়িই হোক আর প্রাসাদই হোক সৌম্যর এখন দরকার একটু আশ্রয়ের । তার শরীর আর চলছে না । দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সরিয়ে রেখে সে বাড়ির সদর দরজা আস্তে ঠেলল । ঠেলতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে দরজা খুলে গেল । বাড়ির ভিতরে তাকাতেই সে আরও অবাক হয়ে গেল । কিছুটা দূরে সামনের প্রকাণ্ড বারান্দায় বাতিদানের আলোয় এক অপরূপ সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে । রোমান্টিক তার চাহনি । বেশ কিছুক্ষণ সে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল । প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে সৌম্যর ভালো লেগে গেল। কিন্তু মুখে তার কোন কথা সরছিল না । সে তাকে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না । এক অদ্ভুত না-বলা অনুভূতিতে সে আবিষ্ট হয়ে গেল । মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠে বলল – “কি গো, পথ ভুলে ? এস ভিতরে এস । এরপর সামনের ঘরে রাখা এক বিরাট পালঙ্ক দেখিয়ে মেয়েটি বলল – “ঐ খাটে বস”। সৌম্য চুপচাপ সেদিকে এগিয়ে যেতেই মেয়েটি আবার বলে উঠল – “আহারে মুখটা একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে । অনেকক্ষণ পেটে কিছু পড়েনি নিশ্চয়ই । এক কাজ কর, বাইরে ইঁদারা আছে, পাশে বালতিতে জল তোলা আছে । হাতমুখ ধুয়ে এস, আমি খাবারের ব্যবস্থা করি”। সৌম্য বেশ ইতস্ততঃ বোধ করছিল । এত রাতে তার আগমনের কারণ না জেনেও মেয়েটির আতিথেয়তার প্রশংসা মনে মনে না করে সে পারল না । সৌম্যর মৌনতা দেখে মেয়েটি হেসে উঠল । এবার সৌম্য মুখ না খুলে পারল না । সারাদিন যা ধকল গেছে । শরীর তার অবসন্ন । খাবার আর আশ্রয় এই দুটোই তো তার এখন প্রয়োজন । আমতা আমতা করে সে বলল – “রাতে এখানে একটু থাকার জায়গা হবে?” হাসতে হাসতে মেয়েটি বলল – “সত্যিই তুমি দেখছি খুব ছেলেমানুষ”। তোমাকে কি আমি এমনি বসতে বললাম ? রাতে কি খাবে বল ?” মেয়েটির কথায় সৌম্য যেন প্রাণ ফিরে পেল । সৌম্য মেয়েটিকে বলল – “আপনার দয়ায় রাতের আশ্রয় পাচ্ছি । আর খাবার ? সামান্য কিছু হলেই চলবে”।
সৌম্য ইঁদারার পাশে রাখা বালতির জলে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে আসতেই সুন্দরী মেয়েটি একটা নতুন গামছা আর একটা পরিস্কার ধুতি তার হাতে ধরিয়ে দিল । তারপর একটু ইঙ্গিত করে হেসে বলল – “জামা-প্যান্ট ছেড়ে রেডি হয়ে নাও । আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি”। পাশের ঘরের দিকে যেতে যেতে খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটি । মেয়েটির যাওয়ার দিকে সৌম্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল । সত্যিই মেয়েটির আতিথেয়তার কোন তুলনা হয় না । কিন্তু মাঝে মাঝে এ-রকম খিলখিল হাসি তার কাছে বেশ রহস্যময় লাগছে । জামাপ্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গীর মত করে ধুতি পরে সে পালঙ্কের উপর চুপ করে বসে ভাবতে লাগল । তার মনে হল মেয়েটির হয়তঃ এরকমই স্বভাব । এক-একজনের হাসি এক-একরকম । মেয়েটি হয়তঃ এভাবেই হাসতে ভালবাসে । কিছুক্ষনের মধ্যেই সুন্দরী মেয়েটি খাবার নিয়ে হাজির । ঝকঝকে কাঁসার থালায় বেশ কয়েকখানা ফুলকো লুচি, থালার উপরে রাখা কাঁসার বাটিতে ধোঁয়া ওঠা মাংস । সঙ্গে একটা রেকাবে চারখানা কড়াপাকের তালশাঁস-সন্দেশ । সব আইটেমই সৌম্যর খুব প্রিয় । ক্ষিদে যে-রকম পেয়েছে তাতে তার পক্ষে আর দেরী করা সম্ভব নয় । সে গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করে দিল। খেতে খেতে হঠাৎ মেয়েটির দিকে নজর পড়তেই সে দেখল মেয়েটি তার সামনে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তার খাওয়া লক্ষ্য করছে আর পরনের কাপড়ের আঁচল দিয়ে খিলখিল হাসি চাপা দেবার চেষ্টা করছে । খাবার পর্ব শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে এসে গামছায় হাত-মুখ মুছতে মুছতে সৌম্য মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল – “আপনাদের বাড়িতে আর কেউ নেই ? আপনি এখানে একাই থাকেন”? মোহময় চোখ দুটো সৌম্যর দিকে মেলে ধরে সুন্দরী উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলল – “না, আজ তো একা নেই”। সৌম্য আর কথা বাড়াল না । কথা বাড়িয়ে তার লাভ কি? তার প্রয়োজন ছিল একটু আহার আর একটু আশ্রয়ের । দুটো জিনিষই যখন সে পেয়ে গেছে তখন চুপচাপ রাতটা কোন রকমে কাটিয়ে সকাল সকাল রওনা দেওয়াই ভাল । আর তাছাড়া এই পরিস্থিতিতে এত কৌতুহল থাকাটাও সমীচীন নয় । মেয়েটি এঁটো থালা বাটি গ্লাস নিতে নিতে আবার হো হো করে হাসতে লাগল । তারপর হাসি খানিকটা থামিয়ে বলল – “সেই থেকে তুমি আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করে যাচ্ছ । আপনি সম্বোধনটা আমার একদম পছন্দ হয়না । আমাকে তুমি বলেই ডেকো । আমার নাম ফুলমতি”। মেয়েটির কথা শুনে সৌম্য একটু লজ্জাই পেল । সৌম্য বলল – “আচ্ছা ঠিক আছে”। সৌম্য মেয়েটির দিকে তাকাতেই দেখল মেয়েটি তার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে । তার চোখে সৌন্দর্য মাখানো এক রোমান্টিক চাহনি । সৌম্য মেয়েটির চোখে চোখ রাখতে পারল না । সে চোখের জ্যোতি এতই তীব্র যে সৌম্যর চোখ ধাঁধিয়ে যাবার উপক্রম । মেয়েটি বলল – “মনে হচ্ছে তুমি খুব চিন্তা করছ । কোন চিন্তা না করে এবার শুয়ে পড় । একটু পরে এসে বাতিদানের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যাচ্ছি”। এরপর ফুলমতি এঁটো বাসনগুলো নিয়ে চলে গেল । সৌম্য বিছানায় গা এলিয়ে দিল । কিছুক্ষণ পর ফুলমতি আবার ফিরে এল । সৌম্যর দিকে মিষ্টি ভাবে একটু তাকিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে আবার খিলখিল করে হাসতে হাসতে চলে গেল ।
বিশাল পালঙ্কে শুয়ে সৌম্যর কিছুতেই ঘুম আসছে না । সারাদিন যা ধকল গেছে তাতে তার শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়ার কথা । নতুন জায়গা বলেই হয়তঃ ব্যতিক্রম ঘটছে । অন্ধকার ঘরে পুরনো আমলের বিশাল ঝাড়বাতিটার কাঁচগুলো থেকে আবছা আলো ঘরটাকে স্বল্প আলোকিত করে তুলেছে । চারিদিক নিস্তব্ধ । এ-রকম পরিবেশে থাকার অভিজ্ঞতা সৌম্যর এই প্রথম । বেশ রোমাঞ্চকর লাগছে তার । তবে কৌতূহল প্রকাশ না করলেও মনে মনে তার একটা রেশ থেকেই যায় । শুয়ে শুয়ে সে ভাবে এই বাড়ির মালিক নিশ্চয়ই খুব বড়লোক । জঙ্গলের মধ্যে এই বাড়ি নিশ্চয়ই তার প্রমোদ বাড়ি । কিন্তু এখন পর্যন্ত সে শুধু ঐ মেয়েটিকেই দেখেছে । তাহলে মেয়েটি কি এই বাড়িতে একা থাকে ? কিন্তু এই পরিবেশে এত বড় বাড়িতে একা একটি মেয়ের পক্ষে থাকা কি করে সম্ভব ? নিশ্চয়ই পরিবারের অন্য সদস্যরা উপর তলায় থাকে । এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সৌম্য ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল । রাত তখন গভীর । হঠাৎ একটা আওয়াজে সৌম্যর ঘুম ভেঙ্গে গেল । তার মনে হল ঘরের মধ্যে কেউ দাঁড়িয়ে আছে । সৌম্য অস্ফুট গলায় বলে উঠল – “কে ? কে ?” মুহূর্তে সারা ঘর নারী কণ্ঠের খিল খিল হাসির শব্দে কেঁপে উঠল । হাসতে হাসতে নারী কণ্ঠ বলে উঠল – “আমি গো আমি । ফুলমতি । ভয় করছে ?” সৌম্য বেশ ভয় পেয়ে গেল । এই গভীর রাতে ফুলমতি এখানে কেন? তার উদ্দেশ্য কি ? এই মুহূর্তে সে কি করবে ভেবে পায় না । ভীত-সন্ত্রস্ত সৌম্য বলল – “এ-ভাবে হাসছ কেন ? আর এত রাতে একজন অপরিচিত পুরুষের ঘরে তোমার একা আসা কি ঠিক ?” ফুলমতি এবার হাসি থামিয়ে আস্তে আস্তে পালঙ্কে সৌম্যর গা ঘেসে বসল । তারপর সৌম্যর দিকে মিষ্টি করে তাকিয়ে বলল – “কেন বলতো ? তুমি কি আমাকে ভালবেসে ফেলনি ?” সৌম্যকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে হঠাৎ সপাটে ফুলমতি তাকে জড়িয়ে ধরল । মুখের কাছে মুখ রেখে বলল – “কি, আমাকে খারাপ লাগছে ? বিয়ে করবে আমাকে ?” সৌম্য ফুলমতির বাহুদুটো ছাড়াতে ছাড়াতে বলল – “ ছাড় বলছি, আমার লাগছে ।“ ফুলমতি বলল – “ভয় নেই, বেশিক্ষন লাগবে না ।“ সৌম্য ফুলমতির মুখটা ভালো ভাবে দেখল । সত্যিই ফুলমতি সুন্দরী । আবছা আলোয় অপরূপ লাস্যময়ী দেখাচ্ছে । এড়িয়ে যাবার কথা মুখে বললেও সৌম্য কেমন যেন মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ল । নিঝুম গভীর রাতে কোন সুন্দরী নারী কোন পুরুষকে এভাবে জড়িয়ে ধরলে কোন পুরুষ ঠিক থাকতে পারে ? সৌম্যও ঠিক থাকতে পারল না । ফুলমতির শরীরের সৌন্দর্য তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করল । ফুলমতির মুখ একেবারে সৌম্যর মুখের উপর । দুজনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দুজনের মুখের উপর পড়তে লাগল । নিরাভরণ দুটি শরীর নিমেষের মধ্যেই একাত্ম হয়ে গেল । কতক্ষণ যে এভাবে কেটে গেল সে খেয়াল কারও নেই । সমস্ত অপরাধবোধ ছিন্ন হয়ে গেল সৌম্যর । তার সারা শরীর তৃপ্ত । অসাড় দেহে সে চোখ বুজে শুয়ে রইল পালঙ্কের বিছানায় । পাশে বস্ত্রহীন ফুলমতি । কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাবার পর হঠাৎ সৌম্য তার গলায় একটা চাপ অনুভব করল । চোখ খুলতেই সে দেখল পাশে শোয়া ফুলমতির নরম দুটো হাতের দশটা আঙ্গুল তার গলায় চেপে বসেছে । সৌম্য নিজেকে বাঁচাতে তার নিজের দুহাত দিয়ে ফুলমতির হাতদুটো গলা থেকে ছাড়িয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল । অস্ফুট গলায় সে বলে উঠল – “ছাড়, ছাড় বলছি । আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি ?’ ফুলমতির চেহারা এখন বীভৎস দেখাচ্ছে । যে ফুলমতিকে সৌম্য দেখেছিল এ সেই ফুলমতি নয় । তার চোখ দুটো দিয়ে তখন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে । ফুলমতি আবার তার সেই পুরনো খিলখিল হাসি হেসে উঠল । তার হাসির মাত্রা এত বেড়ে গেল মনে হল সারা জঙ্গল জুড়ে একটা পিশাচ হাসছে । কোথা থেকে এক বাদুড় ডানা ঝটপট করতে করতে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে । এবার বজ্রকঠিন গলায় ফুলমতি বলল – “তোর মত একজন আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দিনের পর দিন ভোগ করেছে । শেষ পর্যন্ত এই আমার নিষ্ঠুর পরিণতি । তোদের মত মোহগ্রস্থ পুরুষের দেখা পেলেই তার এরকমই হাল করি । তোদের মত মরদদের এই ভাবেই মারব”।
***
সেই আমাবস্যার দিনে বৃষ্টির রাতে স্বামী অতুলানন্দ তার ভক্তবৃন্দদের সাথে মুঙ্গেরের আঙ্গারা গ্রামে ধর্মসভা করে যাত্রা করবেন কিছুটা দূরের অজয়নগর গ্রামে । পরদিন ভোরে সেখানকার বাসিন্দাদের নিয়ে নগর-সংকীর্তনে বের হবেন । প্রায় কুড়ি বছর পর এই এলাকায় ধর্মসভা পরিক্রমায় তিনি বেরিয়েছেন । বেশ কয়েকটি সভা তাঁকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে । তাই হাতে তাঁর একদম সময় নেই । রাত প্রায় দুটো । অত রাতে যানবাহনের সুবিধা না থাকায় স্বামীজি পদব্রজে যাওয়াই মনস্থ করলেন । তা না হলে ভোরের আগে অজয়নগরে পৌঁছানো তার পক্ষে সম্ভব হবে না । স্থানীয় কয়েকজনকে এ-ব্যাপারে সাহায্য করতে বললেন । তারা বলল ভোরের আলো ফুটবার আগেই পদব্রজে যদি তাদের অজয়নগর গ্রামে পৌঁছতে হয় তাহলে বড় রাস্তা দিয়ে নয়, কোন সংক্ষিপ্ত রাস্তা দিয়ে যেতে হবে । আর সে রাস্তা হল দুটো গ্রামের মাঝে বিশাল জঙ্গল শেঠ বাগান দিয়ে । স্থানীয় ভক্তবৃন্দ স্বামীজীকে এ-কথাও বলল যে তারা জঙ্গলের রাস্তা কোনদিন ব্যবহার করেনা । তার কারণ শেঠ বাগানকে নিয়ে তাদের ভীষণ ভয় । জঙ্গলের মধ্যে অনেকদিন আগে দু’জন গ্রামবাসী রহস্যজনক ভাবে মারা যাওয়ায় তারা ও-পথ মাড়ায় না । তবে স্বামী অতুলানন্দের কথা আলাদা । অকুতোভয়, ধার্মিক মানুষ । ওই সব ভয় বশ করা তাঁর কাছে কোন ব্যাপারই নয় । স্বামীজি স্থানীয় ভক্তবৃন্দের কথা শুনে তাঁদের অভয় দিয়ে বললেন – “ তোমাদের কোন ভয় নেই । আমি আছি । আর তা ছাড়া কোন উপায়ও নেই । ভোরের নগর-সঙ্কীর্তনে যোগদান করতেই হবে”। তিনি নির্দেশ দিলেন – “ভক্তগণ, বৃষ্টি বেশ কমে এসেছে । এখনই রওনা না দিলে ভোর চারটের মধ্যে গন্তব্যস্থলে আমরা পৌঁছতে পারব না” । স্বামীজীর নির্দেশ পাওয়া মাত্রই ভক্তরা কাল বিলম্ব না করে “ জয় রামজী কি জয়, জয় রামজী কি জয়” ধ্বনি দিতে দিতে গুরুজীকে অনুসরণ করে জঙ্গল-পথে রওনা দিল । ভক্তবৃন্দের মধ্য থেকে একজন প্রজ্জলিত মশাল নিয়ে পথ প্রদর্শন করে চলল ।
টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে । আকাশের বুক চিরে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে । ভক্তবৃন্দের জয়ধ্বনিতে সারা জঙ্গল মুখরিত হয়ে উঠল । বনপথ দিয়ে স্বামীজী তাঁর ভক্তদের সাথে মনের আনন্দে চলতে লাগলেন । রাতের জঙ্গল দেখতে দেখতে হঠাৎ অনেকদিন আগের এক ঘটনার স্মৃতি তাঁর মনে এল । তাঁর মনে পড়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে এক রহস্যজনক বাড়ির কথা । এত বছর পরে এখনও কি বাগানের মধ্যে সেই বাড়িটা আছে ? এখনও কি অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড-কারখানা ঘটে চলেছে সেখানে ? পুরনো দিনের সে-সব কথা ভাবতে ভাবতে স্বামীজী এগিয়ে চললেন । এ-ভাবে বেশ খানিকটা চলার পর সামনে তাকাতেই তিনি চমকে উঠলেন । সামনেই দেখা যাচ্ছে সেই ভগ্নপ্রায় বাড়িটা । প্রজ্জলিত মশালের আলো আর ঘুটঘুটে অন্ধকারের খেলায় বাড়িটাকে ভীষণ রোমাঞ্চকর লাগছে । বাড়িটা দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন । বাড়ির বাইরের চেহারা প্রায় একই আছে । স্বামীজী নিজেকে সামলাতে পারলেন না । ভক্তদের দাঁড়াতে বললেন । তারপর কৌতুহল বশতঃ তিনি একাই বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলেন । বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই ভিতর থেকে এক মহিলা কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ ভেসে এল । পরক্ষনেই সেই পূর্ব পরিচিত খিলখিলানি হাসির শব্দ কানে এল । এদিকে অকস্মাৎ পথ-প্রদর্শক ভক্তের হাতে থাকা মশাল এক দমকা হাওয়ায় নিভে গেল । চারিদিক তখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন । স্বামীজী ভয় পাবার লোক নন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তাঁর একটু চিত্ত-চাঞ্চল্য ঘটল । তিনি ভাবলেন এখনও কি এই বাড়িটায় সেই আগের মত পৈশাচিক কাণ্ড-কারখানা ঘটে চলেছে ! এত বছর পরেও কি ফুলমতি তার হিংসার লোলুপতা থেকে মুক্তি পায় নি ? আবারও কি কোন মোহবিস্ট অজানা যুবকের প্রাণ নিয়ে খেলা চলছে ? না, এর একটা শেষ দরকার । এত বছর ধরে কতজনের প্রাণ নিয়ে সে খেলা করেছে কে জানে ? মশাল নিভে যাওয়াতে ভক্তরা পুনরায় মশাল জ্বালাবার জন্য নিজেদের মধ্যে চেঁচামেচি শুরু করে দিল । তাদের চেঁচামেচি শুনে স্বামীজী তাদের কাছে ফিরে এলেন । ভক্তদের বললেন – “এখন মশাল জ্বালাবার প্রয়োজন নেই । তোমরা আমাকে অনুসরণ করে সামনের ঐ বাড়িটার দিকে এগোও”। ভক্তদের একজন বলে উঠল – “গুরুজী, এ-ভাবে পথ পরিবর্তন করলে ভোর চারটের মধ্যে অজয়নগরে পৌঁছে আমরা কি প্রভাত-ফেরিতে যোগদান করতে পারব”? স্বামীজী কিছুটা ধমকের সুরে বললেন – “ সে দায়িত্ব আমার । এখন যা বলছি শোন । একটা তরতাজা প্রাণের দাম অনেক । শুনতে পাচ্ছনা নারী কণ্ঠের কান্না, খিলখিলানি হাসির আওয়াজ । আজই এর শেষ চাই”। স্বামীজির কথা ভক্তদের কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারল না । স্বামীজির মুখের উপর কথা বলার সাহস কারও নেই । স্বামীজির কথাই শিরোধার্য । আলো-আঁধারি পথ ধরে স্বামীজীকে অনুসরণ করে ভক্তবৃন্দ বাগান বাড়ির দিকে এগোতে লাগল ।
বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই ভিতর থেকে এক মহিলা কণ্ঠের ভয়ঙ্কর অট্টহাসিতে ভক্তদের হিম হয়ে যাবার যোগাড় । অনেকেই ভয়ে কুঁকড়ে গেল । স্বামীজী ভক্তদের বাইরে অপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে একাই বাড়ির ভিতরে ঢুকলেন । সামনের দরজায় পা রাখতেই তিনি চমকে উঠলেন । এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য তাঁর চোখের সামনে । এক সৌম্যকান্তি যুবক সামনের পালঙ্কে অচৈতন্য অবস্থায় শুয়ে । আর এক গজ দূরে দাঁড়িয়ে বিশ বছর আগে দেখা সেই সুন্দরী নারী ফুলমতি । তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে । মুখমণ্ডলে প্রতিহিংসার ছবি । লম্বা চুলগুলো অবিন্যস্ত । পৈশাচিক হাসির আওয়াজে বাতিহীন সাবেকি বিশাল ঝাড়লন্ঠনটা দুলছে । ঘরের এককোণে রাখা ছোট্ট বাতিদানে টিমটিম করে আলো জ্বলছে । প্রবল প্রতিহিংসায় ফুলমতি দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যুবকের দিকে । হি...হি... করে হাসতে হাসতে বলছে – “এখনও বেঁচে আছিস ? আজ তোকে শেষ করেই ছাড়বো”। স্বামীজী আর দেরী না করে এবার প্রবল হুঙ্কার ছাড়লেন । পিছন ফিরে তাকিয়ে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীজীকে দেখে ফুলমতি বিস্ময়ে চমকে ওঠে । স্বামীজী বেশ চড়া গলায় বলে ওঠেন – “তোর প্রতিহিংসা কি কোনদিনও শেষ হবে না ? একজনের পাপের শাস্তি কেন দিচ্ছিস এই রকম নিরপরাধ যুবকদের”? ফুলমতি স্বামীজীর কথায় রুষ্ট হয়ে ওঠে । দ্বিগুণ আগুন ঝরানো চোখে স্বামীজীকে বলে – “তুমি এখানে কেন এসেছ ?” স্বামীজী বললেন – “পরমেশ্বরই আজ এই পথে আমাকে টেনে এনেছেন । আজই তোর শেষ রজনী”। ফুলমতি এবার স্বামীজীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে – “না না, আমি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না”। “যেতে তোকে হবেই” – স্বামীজীর হুঙ্কারে ফুলমতি কেমন যেন নিস্তেজ হতে শুরু করল । তারপর ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ল । স্বামীজী পালঙ্কের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন । হাতের কমণ্ডলু থেকে জল ছিটিয়ে দিলেন যুবকটির চোখে মুখে । গলার রুদ্রাক্ষের মালাটা হাতে ছুঁয়ে মন্ত্র উচ্চারন করে গায়ের নামাবলীখানা ছুঁইয়ে দিলেন তার গায়ে মাথায় । কিছুক্ষনের মধ্যেই যুবকটি চোখ মেলে তাকালো স্বামীজীর দিকে । স্বামীজী তাকে অভয় দিয়ে বললেন – “ভয় নেই বাবা । তুমি বিপদ-মুক্ত । কিন্তু বাবা, তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি একজন সৎ-বংশজাত । নারী সঙ্গের মোহে কেন এভাবে আবিষ্ট হও? এ-রকম ভুল কেন কর”? যুবকটির মুখ থেকে কোন কথা বেরোল না । সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বামীজীর দিকে চেয়ে রইল । তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জলের ধারা । স্বামীজী এবার এগিয়ে গেলেন ফুলমতির কাছে । ফুলমতির চোখের আগুন তখন অনেকটাই নিভে গিয়েছে । কিছুটা শান্ত ও স্বাভাবিক । স্বামীজী কাছে আসতেই ফুলমতি তাঁর দিকে চেয়ে হাতজোড় করে বলল – “আমাকে এ-বাড়িতে থাকতে দাও । আমি আর কারও ক্ষতি করবো না । সন্দীপকে অনেক ভালোবেসে এই বাড়িতে এসেছিলাম”। স্বামীজী গম্ভীরভাবে উচ্চস্বরে বললেন – “সন্দীপ কি তোর ভালবাসার মর্যাদা দিয়েছিল ? তার জন্য কি এরা কোনোভাবে দায়ী ? অসহায় যুবকেরা যখন পথভ্রান্ত হয়ে এই পথে আসে তখন তাদের তোর মোহিনী রূপের যাদু দেখিয়ে তুই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিস । আজই তোকে এ-বাড়ি থেকে তাড়াব”। স্বামীজীর কথা শুনে ফুলমতি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আবার বলে – “তোমার দুটি পায়ে পড়ি । আমাকে এখানে থাকতে দাও”। স্বামীজী তাঁর কাঁধের ঝুলিতে হাত রাখলেন । তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফুলমতিকে নিরীক্ষণ করতে করতে বললেন –“বিশ বছর আগে আমার বয়স কম ছিল, বুঝিনি । আমাকেও তো তোর মোহজালে আবিষ্ট করার চেষ্টা করেছিলি । আমার ভাগ্য ভালো যে তন্ত্রবিদ্যা তখন কিছুটা রপ্ত করেছিলাম। তাই সেবার পালাতে পেরেছিলাম । এবার আমি পালাবো না । তোকে এখান থেকে উৎখাত করেই আমি যাব”।
স্বামীজী কাঁধের ঝুলি থেকে এক নরকঙ্কালের মাথার খুলি আর দুটো হাড় বার করে ফুলমতির সামনে রাখলেন । এবার ফুলমতির বাকশক্তি রহিত হয়ে গেল । চক্ষুগোলক একজায়গায় স্থির হল । স্বামীজী তাঁর ঝুলি থেকে একটা ছোট্ট মোড়ক বার করলেন । মোড়ক খুলে লাল রঙের গুড়ো পদার্থ বার করে ফুলমতির গায়ে নিক্ষেপ করলেন । স্বামীজীর কি সাংঘাতিক রূপ তখন ! রাগে তাঁর শরীর থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে । গুরুকে স্মরণ করে মন্ত্রচ্চারন করতে লাগলেন । সেই মন্ত্রচ্চারনের আওয়াজে বাড়িটা কাঁপতে লাগল । প্রায় অর্ধমৃত যুবকটিও ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল । ধীরে ধীরে ফুলমতির শরীর ছোট হতে হতে একটা মাংসপিণ্ডে পরিনত হল । স্বামীজী সেই মাংসপিণ্ডকে নরকঙ্কালের খুলিতে ধারন করিয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে এলেন । বাইরে এসে দেখলেন তাঁর ভক্তরা তাঁর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে । তাদের উদ্দেশ্যে বললেন – “আমার ভক্তরা সবাই এদিকে এস । ধুনি জ্বালাও”। স্বামীজীর নির্দেশ পাওয়া মাত্র কালবিলম্ব না করে এক ভক্ত ধুনি প্রজ্জলন করল । আগুনের লেলিহান শিখায় সারা বন শিহরিত হয়ে উঠল । স্বামীজী গুরুগম্ভীর মন্ত্রচ্চারনের সাথে ফুলমতির শেষ মাংসপিণ্ড ধুনির আগুনে নিক্ষেপ করলেন । আগুনের লেলিহান শিখায় চিরদিনের মত হারিয়ে গেল ফুলমতির শেষ চিহ্ন । স্বামীজী রুদ্রাক্ষের মালা জপ করতে লাগলেন । ভক্তবৃন্দ স্তব্ধ । কারও মুখে কোন কথা নেই । ধীরে ধীরে ধুনির আগুন নিভে গেল । হঠাৎই সকলের মাথার উপর দিয়ে একটা বাদুড় ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে অন্ধকারে মিশে গেল । স্বামীজী এক ভক্তের কাছ থেকে গঙ্গা জল নিয়ে ধুনির ভস্মে নিক্ষেপ করলেন । বিড় বিড় করে বললেন – “তোর জ্বালা আমি জানি ফুলমতি । কিন্তু কি করব বল ? এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না”। বাইরের কাজ শেষ করে তিনি তাড়াতাড়ি আবার বাগান-বাড়িতে ঢুকলেন । পালঙ্কে শায়িত যুবকটির কাছে এসে তার মাথায় হাত রাখলেন – “বাবা, আর কোন ভয় নেই । বিপদ কেটে গিয়েছে । এই বাড়িতে আর কখনও এমনটি হবেনা”। সৌম্য অপলক দৃষ্টিতে স্বামীজীর দিকে তাকিয়ে রইল ।
স্বামীজী বাড়ির সদর দরজার বাইরে এসে অপেক্ষারত ভক্তদের বললেন – “ভোরের আলো ফুটতে আর বেশি দেরী নেই । কাল বিলম্ব কোরনা । স্বত্বর যাত্রা কর । প্রভাত ফেরির সমস্ত দায়িত্ব জিতেনের উপর রইল । বাড়ির ভিতরে এক অসুস্থ যুবক রয়েছে । তাকে এ-ভাবে ফেলে রেখে যাওয়াটা ঠিক নয় । আমি তাকে একটু সুস্থ করে এবং বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে সোজা আশ্রমেই ফিরব । আমার সাথে শুধু অপরেশ থাকবে । ছেলেটি সুস্থ হলে ও ওকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে”। স্বামীজীর আদেশে শুধুমাত্র অপরেশ থেকে গেল । বাকী ভক্তরা স্বামীজীর জয়ধ্বনি দিতে দিতে তাদের গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হল ।
স্বামীজী অপরেশকে সাথে নিয়ে আবার বাড়ির ভিতর ঢুকলেন । সামনের ঘরে ঢুকে দেখলেন যুবকটি একই ভাবে পালঙ্কে শুয়ে আছে । স্বামীজী তার পাশে বসলেন । অপরেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইল । মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন – “তোমাকে দেখে তো বাঙালী বলে মনে হচ্ছে । তা বাবা কোথা থেকে আসছো”? ধীর কণ্ঠে সে বলল – “আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি বাঙালী । আমার নাম সৌম্য দত্ত । বাড়ি বর্ধমানের মেমারিতে”। স্বামীজী আবার জিজ্ঞাসা করলেন – “তা বাবা এখানে এলে কিভাবে”? সৌম্য আস্তে আস্তে বলতে লাগল –“আমি মেডিসিন-ইন্সট্রুমেনট সাপ্লাইয়ের কাজ করি । কলকাতার হেড অফিস থেকে নির্দেশ পেয়ে মুঙ্গেরে কয়েকটা কাস্টোমারের কাছ থেকে সাপ্লাই-অর্ডার নেবার উদ্দেশ্যে এসেছিলাম । কাজ সম্পূর্ণ করতে রাত হয়ে গেল । যানবাহন না পাওয়াতে স্টেশনে যেতে পারলাম না । বৃষ্টি ভেজা রাতে অজানা অচেনা জায়গায় ক্লান্ত শরীরে একটু আশ্রয় আর একটু খাবার খুঁজছিলাম । দিশেহারা হয়ে কোন দিকে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি । জনশূন্য রাস্তা থেকে এক মৃদু আলোকে অনুসরন করে এই বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলাম শুধুমাত্র রাতের আশ্রয়ের জন্য । তারপর......”। স্বামীজী সৌম্যকে বাধা দিয়ে বললেন – “আর তোমাকে বলতে হবে না । সব বুঝতে পেরেছি । তবে করুণাময়ের অশেষ দয়ায় প্রাণটা ফিরে পেলে । তুমি তো এই বাড়ির আসল ঘটনাটা জানো না । আসল ঘটনা হোল – অনেক বছর আগে এই বাগান-বাড়িটা ছিল রঘুবীর সিংহ নামে এক জমিদারের । তার এক সুদর্শন লম্পট পুত্র ছিল, সন্দীপ । এই তোমার বয়সীই হবে । কিন্তু তার গুণের অন্ত ছিলনা । অসাধারণ সুন্দরী ফুলমতিকে মুঙ্গেরের এক গ্রাম থেকে তুলে সে এই বাড়িতে নিয়ে আসে । বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেয় । তোমাকে আর কি বলব বাবা ! প্রতি রাতে জমিদার-পুত্রের কাছে ফুলমতি হয়ে ওঠে এক ভোগ্য বস্তু । ইতিমধ্যে ওর গর্ভে জমিদার-পুত্রের সন্তান আসে । কিন্তু লম্পট জমিদার-পুত্র সন্দীপ তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এক গভীর রাতে গলা টিপে খুন করে ফুলমতিকে । কিন্তু ফুলমতি অভিমানে ক্রোধে এই বাড়ি ছেড়ে যায়নি । তার অ-শরীরী আত্মা এই বাড়িতে এতদিন ঘোরা-ফেরা করেছে । কিছুদিনের মধ্যেই সে অপমানের বদলা নিয়েছিল । জমিদার-পুত্রের মৃতদেহ এই জঙ্গলেই পাওয়া গিয়েছিল । শুধু জমিদার-পুত্রের উপর প্রতিশোধ নিয়েই ও ক্ষান্ত থাকেনি । ওর মনে পুরুষ মানুষের প্রতি ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। যার ফলে তোমাদের মত বয়সের কোন সুদর্শন যুবককে বাগে পেলে ওর লিপ্সা চরিতার্থ করতো । এর আগে কত যুবক যে ওর শিকার হয়েছে তার ঠিক ঠিকানা নেই । প্রায় বিশ বছর আগে এই অঞ্চলে ধর্মসভার কাজে যখন প্রথম এসেছিলাম সে সময় তোমার মত অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছিল। গুরুজির শেখানো মন্ত্রের বলে সে যাত্রায় আমি ওর মোহজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম । সে-সময় আজকের এই মন্ত্র আমার জানা ছিল না । যখন দেখলাম ফুলমতি নিজেকে পরিবর্তিত করতে পারেনি তখন এই মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ না করে পারলাম না। যদি এবারেও ওকে ছেড়ে দিতাম সমাজের সর্বনাশ ঘটেই চলতো । আর কোনদিন ফুলমতি কারও সর্বনাশ করতে পারবে না । তবে বেচারির জন্য খুব দুঃখ হয় । আমি ওর আত্মার শান্তি কামনা করি”।
সৌম্য একটু সুস্থ হতেই ধীরে ধীরে উঠে বসল । পালঙ্ক থেকে নেমে স্বামীজীর পায়ে গড় হয়ে প্রণাম করল । স্বামীজী তার মাথায় হাত রাখলেন । এরপর শিস্য অপরেশকে সাথে দিয়ে সৌম্যকে তার বাড়ির পথে রওনা করিয়ে দিলেন এবং তিনি আশ্রমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
***************
আলোর কাছাকাছি পৌঁছতেই সৌম্য দেখল এক বিরাট বড় বাড়ির মধ্য থেকে আলো আসছে । বাড়িটা দেখে সৌম্য অবাক হয়ে গেল । জঙ্গলের মধ্যে এ-রকম বাড়ি ? বাড়ি তো নয়, এ-যেন প্রাসাদ । কিন্তু ভগ্নপ্রায় । বাড়িই হোক আর প্রাসাদই হোক সৌম্যর এখন দরকার একটু আশ্রয়ের । তার শরীর আর চলছে না । দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সরিয়ে রেখে সে বাড়ির সদর দরজা আস্তে ঠেলল । ঠেলতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে দরজা খুলে গেল । বাড়ির ভিতরে তাকাতেই সে আরও অবাক হয়ে গেল । কিছুটা দূরে সামনের প্রকাণ্ড বারান্দায় বাতিদানের আলোয় এক অপরূপ সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে । রোমান্টিক তার চাহনি । বেশ কিছুক্ষণ সে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল । প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে সৌম্যর ভালো লেগে গেল। কিন্তু মুখে তার কোন কথা সরছিল না । সে তাকে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না । এক অদ্ভুত না-বলা অনুভূতিতে সে আবিষ্ট হয়ে গেল । মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠে বলল – “কি গো, পথ ভুলে ? এস ভিতরে এস । এরপর সামনের ঘরে রাখা এক বিরাট পালঙ্ক দেখিয়ে মেয়েটি বলল – “ঐ খাটে বস”। সৌম্য চুপচাপ সেদিকে এগিয়ে যেতেই মেয়েটি আবার বলে উঠল – “আহারে মুখটা একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে । অনেকক্ষণ পেটে কিছু পড়েনি নিশ্চয়ই । এক কাজ কর, বাইরে ইঁদারা আছে, পাশে বালতিতে জল তোলা আছে । হাতমুখ ধুয়ে এস, আমি খাবারের ব্যবস্থা করি”। সৌম্য বেশ ইতস্ততঃ বোধ করছিল । এত রাতে তার আগমনের কারণ না জেনেও মেয়েটির আতিথেয়তার প্রশংসা মনে মনে না করে সে পারল না । সৌম্যর মৌনতা দেখে মেয়েটি হেসে উঠল । এবার সৌম্য মুখ না খুলে পারল না । সারাদিন যা ধকল গেছে । শরীর তার অবসন্ন । খাবার আর আশ্রয় এই দুটোই তো তার এখন প্রয়োজন । আমতা আমতা করে সে বলল – “রাতে এখানে একটু থাকার জায়গা হবে?” হাসতে হাসতে মেয়েটি বলল – “সত্যিই তুমি দেখছি খুব ছেলেমানুষ”। তোমাকে কি আমি এমনি বসতে বললাম ? রাতে কি খাবে বল ?” মেয়েটির কথায় সৌম্য যেন প্রাণ ফিরে পেল । সৌম্য মেয়েটিকে বলল – “আপনার দয়ায় রাতের আশ্রয় পাচ্ছি । আর খাবার ? সামান্য কিছু হলেই চলবে”।
সৌম্য ইঁদারার পাশে রাখা বালতির জলে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে আসতেই সুন্দরী মেয়েটি একটা নতুন গামছা আর একটা পরিস্কার ধুতি তার হাতে ধরিয়ে দিল । তারপর একটু ইঙ্গিত করে হেসে বলল – “জামা-প্যান্ট ছেড়ে রেডি হয়ে নাও । আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি”। পাশের ঘরের দিকে যেতে যেতে খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটি । মেয়েটির যাওয়ার দিকে সৌম্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল । সত্যিই মেয়েটির আতিথেয়তার কোন তুলনা হয় না । কিন্তু মাঝে মাঝে এ-রকম খিলখিল হাসি তার কাছে বেশ রহস্যময় লাগছে । জামাপ্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গীর মত করে ধুতি পরে সে পালঙ্কের উপর চুপ করে বসে ভাবতে লাগল । তার মনে হল মেয়েটির হয়তঃ এরকমই স্বভাব । এক-একজনের হাসি এক-একরকম । মেয়েটি হয়তঃ এভাবেই হাসতে ভালবাসে । কিছুক্ষনের মধ্যেই সুন্দরী মেয়েটি খাবার নিয়ে হাজির । ঝকঝকে কাঁসার থালায় বেশ কয়েকখানা ফুলকো লুচি, থালার উপরে রাখা কাঁসার বাটিতে ধোঁয়া ওঠা মাংস । সঙ্গে একটা রেকাবে চারখানা কড়াপাকের তালশাঁস-সন্দেশ । সব আইটেমই সৌম্যর খুব প্রিয় । ক্ষিদে যে-রকম পেয়েছে তাতে তার পক্ষে আর দেরী করা সম্ভব নয় । সে গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করে দিল। খেতে খেতে হঠাৎ মেয়েটির দিকে নজর পড়তেই সে দেখল মেয়েটি তার সামনে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তার খাওয়া লক্ষ্য করছে আর পরনের কাপড়ের আঁচল দিয়ে খিলখিল হাসি চাপা দেবার চেষ্টা করছে । খাবার পর্ব শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে এসে গামছায় হাত-মুখ মুছতে মুছতে সৌম্য মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল – “আপনাদের বাড়িতে আর কেউ নেই ? আপনি এখানে একাই থাকেন”? মোহময় চোখ দুটো সৌম্যর দিকে মেলে ধরে সুন্দরী উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলল – “না, আজ তো একা নেই”। সৌম্য আর কথা বাড়াল না । কথা বাড়িয়ে তার লাভ কি? তার প্রয়োজন ছিল একটু আহার আর একটু আশ্রয়ের । দুটো জিনিষই যখন সে পেয়ে গেছে তখন চুপচাপ রাতটা কোন রকমে কাটিয়ে সকাল সকাল রওনা দেওয়াই ভাল । আর তাছাড়া এই পরিস্থিতিতে এত কৌতুহল থাকাটাও সমীচীন নয় । মেয়েটি এঁটো থালা বাটি গ্লাস নিতে নিতে আবার হো হো করে হাসতে লাগল । তারপর হাসি খানিকটা থামিয়ে বলল – “সেই থেকে তুমি আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করে যাচ্ছ । আপনি সম্বোধনটা আমার একদম পছন্দ হয়না । আমাকে তুমি বলেই ডেকো । আমার নাম ফুলমতি”। মেয়েটির কথা শুনে সৌম্য একটু লজ্জাই পেল । সৌম্য বলল – “আচ্ছা ঠিক আছে”। সৌম্য মেয়েটির দিকে তাকাতেই দেখল মেয়েটি তার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে । তার চোখে সৌন্দর্য মাখানো এক রোমান্টিক চাহনি । সৌম্য মেয়েটির চোখে চোখ রাখতে পারল না । সে চোখের জ্যোতি এতই তীব্র যে সৌম্যর চোখ ধাঁধিয়ে যাবার উপক্রম । মেয়েটি বলল – “মনে হচ্ছে তুমি খুব চিন্তা করছ । কোন চিন্তা না করে এবার শুয়ে পড় । একটু পরে এসে বাতিদানের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যাচ্ছি”। এরপর ফুলমতি এঁটো বাসনগুলো নিয়ে চলে গেল । সৌম্য বিছানায় গা এলিয়ে দিল । কিছুক্ষণ পর ফুলমতি আবার ফিরে এল । সৌম্যর দিকে মিষ্টি ভাবে একটু তাকিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে আবার খিলখিল করে হাসতে হাসতে চলে গেল ।
বিশাল পালঙ্কে শুয়ে সৌম্যর কিছুতেই ঘুম আসছে না । সারাদিন যা ধকল গেছে তাতে তার শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়ার কথা । নতুন জায়গা বলেই হয়তঃ ব্যতিক্রম ঘটছে । অন্ধকার ঘরে পুরনো আমলের বিশাল ঝাড়বাতিটার কাঁচগুলো থেকে আবছা আলো ঘরটাকে স্বল্প আলোকিত করে তুলেছে । চারিদিক নিস্তব্ধ । এ-রকম পরিবেশে থাকার অভিজ্ঞতা সৌম্যর এই প্রথম । বেশ রোমাঞ্চকর লাগছে তার । তবে কৌতূহল প্রকাশ না করলেও মনে মনে তার একটা রেশ থেকেই যায় । শুয়ে শুয়ে সে ভাবে এই বাড়ির মালিক নিশ্চয়ই খুব বড়লোক । জঙ্গলের মধ্যে এই বাড়ি নিশ্চয়ই তার প্রমোদ বাড়ি । কিন্তু এখন পর্যন্ত সে শুধু ঐ মেয়েটিকেই দেখেছে । তাহলে মেয়েটি কি এই বাড়িতে একা থাকে ? কিন্তু এই পরিবেশে এত বড় বাড়িতে একা একটি মেয়ের পক্ষে থাকা কি করে সম্ভব ? নিশ্চয়ই পরিবারের অন্য সদস্যরা উপর তলায় থাকে । এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সৌম্য ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল । রাত তখন গভীর । হঠাৎ একটা আওয়াজে সৌম্যর ঘুম ভেঙ্গে গেল । তার মনে হল ঘরের মধ্যে কেউ দাঁড়িয়ে আছে । সৌম্য অস্ফুট গলায় বলে উঠল – “কে ? কে ?” মুহূর্তে সারা ঘর নারী কণ্ঠের খিল খিল হাসির শব্দে কেঁপে উঠল । হাসতে হাসতে নারী কণ্ঠ বলে উঠল – “আমি গো আমি । ফুলমতি । ভয় করছে ?” সৌম্য বেশ ভয় পেয়ে গেল । এই গভীর রাতে ফুলমতি এখানে কেন? তার উদ্দেশ্য কি ? এই মুহূর্তে সে কি করবে ভেবে পায় না । ভীত-সন্ত্রস্ত সৌম্য বলল – “এ-ভাবে হাসছ কেন ? আর এত রাতে একজন অপরিচিত পুরুষের ঘরে তোমার একা আসা কি ঠিক ?” ফুলমতি এবার হাসি থামিয়ে আস্তে আস্তে পালঙ্কে সৌম্যর গা ঘেসে বসল । তারপর সৌম্যর দিকে মিষ্টি করে তাকিয়ে বলল – “কেন বলতো ? তুমি কি আমাকে ভালবেসে ফেলনি ?” সৌম্যকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে হঠাৎ সপাটে ফুলমতি তাকে জড়িয়ে ধরল । মুখের কাছে মুখ রেখে বলল – “কি, আমাকে খারাপ লাগছে ? বিয়ে করবে আমাকে ?” সৌম্য ফুলমতির বাহুদুটো ছাড়াতে ছাড়াতে বলল – “ ছাড় বলছি, আমার লাগছে ।“ ফুলমতি বলল – “ভয় নেই, বেশিক্ষন লাগবে না ।“ সৌম্য ফুলমতির মুখটা ভালো ভাবে দেখল । সত্যিই ফুলমতি সুন্দরী । আবছা আলোয় অপরূপ লাস্যময়ী দেখাচ্ছে । এড়িয়ে যাবার কথা মুখে বললেও সৌম্য কেমন যেন মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ল । নিঝুম গভীর রাতে কোন সুন্দরী নারী কোন পুরুষকে এভাবে জড়িয়ে ধরলে কোন পুরুষ ঠিক থাকতে পারে ? সৌম্যও ঠিক থাকতে পারল না । ফুলমতির শরীরের সৌন্দর্য তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করল । ফুলমতির মুখ একেবারে সৌম্যর মুখের উপর । দুজনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দুজনের মুখের উপর পড়তে লাগল । নিরাভরণ দুটি শরীর নিমেষের মধ্যেই একাত্ম হয়ে গেল । কতক্ষণ যে এভাবে কেটে গেল সে খেয়াল কারও নেই । সমস্ত অপরাধবোধ ছিন্ন হয়ে গেল সৌম্যর । তার সারা শরীর তৃপ্ত । অসাড় দেহে সে চোখ বুজে শুয়ে রইল পালঙ্কের বিছানায় । পাশে বস্ত্রহীন ফুলমতি । কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাবার পর হঠাৎ সৌম্য তার গলায় একটা চাপ অনুভব করল । চোখ খুলতেই সে দেখল পাশে শোয়া ফুলমতির নরম দুটো হাতের দশটা আঙ্গুল তার গলায় চেপে বসেছে । সৌম্য নিজেকে বাঁচাতে তার নিজের দুহাত দিয়ে ফুলমতির হাতদুটো গলা থেকে ছাড়িয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল । অস্ফুট গলায় সে বলে উঠল – “ছাড়, ছাড় বলছি । আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি ?’ ফুলমতির চেহারা এখন বীভৎস দেখাচ্ছে । যে ফুলমতিকে সৌম্য দেখেছিল এ সেই ফুলমতি নয় । তার চোখ দুটো দিয়ে তখন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে । ফুলমতি আবার তার সেই পুরনো খিলখিল হাসি হেসে উঠল । তার হাসির মাত্রা এত বেড়ে গেল মনে হল সারা জঙ্গল জুড়ে একটা পিশাচ হাসছে । কোথা থেকে এক বাদুড় ডানা ঝটপট করতে করতে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে । এবার বজ্রকঠিন গলায় ফুলমতি বলল – “তোর মত একজন আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দিনের পর দিন ভোগ করেছে । শেষ পর্যন্ত এই আমার নিষ্ঠুর পরিণতি । তোদের মত মোহগ্রস্থ পুরুষের দেখা পেলেই তার এরকমই হাল করি । তোদের মত মরদদের এই ভাবেই মারব”।
***
সেই আমাবস্যার দিনে বৃষ্টির রাতে স্বামী অতুলানন্দ তার ভক্তবৃন্দদের সাথে মুঙ্গেরের আঙ্গারা গ্রামে ধর্মসভা করে যাত্রা করবেন কিছুটা দূরের অজয়নগর গ্রামে । পরদিন ভোরে সেখানকার বাসিন্দাদের নিয়ে নগর-সংকীর্তনে বের হবেন । প্রায় কুড়ি বছর পর এই এলাকায় ধর্মসভা পরিক্রমায় তিনি বেরিয়েছেন । বেশ কয়েকটি সভা তাঁকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে । তাই হাতে তাঁর একদম সময় নেই । রাত প্রায় দুটো । অত রাতে যানবাহনের সুবিধা না থাকায় স্বামীজি পদব্রজে যাওয়াই মনস্থ করলেন । তা না হলে ভোরের আগে অজয়নগরে পৌঁছানো তার পক্ষে সম্ভব হবে না । স্থানীয় কয়েকজনকে এ-ব্যাপারে সাহায্য করতে বললেন । তারা বলল ভোরের আলো ফুটবার আগেই পদব্রজে যদি তাদের অজয়নগর গ্রামে পৌঁছতে হয় তাহলে বড় রাস্তা দিয়ে নয়, কোন সংক্ষিপ্ত রাস্তা দিয়ে যেতে হবে । আর সে রাস্তা হল দুটো গ্রামের মাঝে বিশাল জঙ্গল শেঠ বাগান দিয়ে । স্থানীয় ভক্তবৃন্দ স্বামীজীকে এ-কথাও বলল যে তারা জঙ্গলের রাস্তা কোনদিন ব্যবহার করেনা । তার কারণ শেঠ বাগানকে নিয়ে তাদের ভীষণ ভয় । জঙ্গলের মধ্যে অনেকদিন আগে দু’জন গ্রামবাসী রহস্যজনক ভাবে মারা যাওয়ায় তারা ও-পথ মাড়ায় না । তবে স্বামী অতুলানন্দের কথা আলাদা । অকুতোভয়, ধার্মিক মানুষ । ওই সব ভয় বশ করা তাঁর কাছে কোন ব্যাপারই নয় । স্বামীজি স্থানীয় ভক্তবৃন্দের কথা শুনে তাঁদের অভয় দিয়ে বললেন – “ তোমাদের কোন ভয় নেই । আমি আছি । আর তা ছাড়া কোন উপায়ও নেই । ভোরের নগর-সঙ্কীর্তনে যোগদান করতেই হবে”। তিনি নির্দেশ দিলেন – “ভক্তগণ, বৃষ্টি বেশ কমে এসেছে । এখনই রওনা না দিলে ভোর চারটের মধ্যে গন্তব্যস্থলে আমরা পৌঁছতে পারব না” । স্বামীজীর নির্দেশ পাওয়া মাত্রই ভক্তরা কাল বিলম্ব না করে “ জয় রামজী কি জয়, জয় রামজী কি জয়” ধ্বনি দিতে দিতে গুরুজীকে অনুসরণ করে জঙ্গল-পথে রওনা দিল । ভক্তবৃন্দের মধ্য থেকে একজন প্রজ্জলিত মশাল নিয়ে পথ প্রদর্শন করে চলল ।
টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে । আকাশের বুক চিরে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে । ভক্তবৃন্দের জয়ধ্বনিতে সারা জঙ্গল মুখরিত হয়ে উঠল । বনপথ দিয়ে স্বামীজী তাঁর ভক্তদের সাথে মনের আনন্দে চলতে লাগলেন । রাতের জঙ্গল দেখতে দেখতে হঠাৎ অনেকদিন আগের এক ঘটনার স্মৃতি তাঁর মনে এল । তাঁর মনে পড়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে এক রহস্যজনক বাড়ির কথা । এত বছর পরে এখনও কি বাগানের মধ্যে সেই বাড়িটা আছে ? এখনও কি অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড-কারখানা ঘটে চলেছে সেখানে ? পুরনো দিনের সে-সব কথা ভাবতে ভাবতে স্বামীজী এগিয়ে চললেন । এ-ভাবে বেশ খানিকটা চলার পর সামনে তাকাতেই তিনি চমকে উঠলেন । সামনেই দেখা যাচ্ছে সেই ভগ্নপ্রায় বাড়িটা । প্রজ্জলিত মশালের আলো আর ঘুটঘুটে অন্ধকারের খেলায় বাড়িটাকে ভীষণ রোমাঞ্চকর লাগছে । বাড়িটা দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন । বাড়ির বাইরের চেহারা প্রায় একই আছে । স্বামীজী নিজেকে সামলাতে পারলেন না । ভক্তদের দাঁড়াতে বললেন । তারপর কৌতুহল বশতঃ তিনি একাই বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলেন । বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই ভিতর থেকে এক মহিলা কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ ভেসে এল । পরক্ষনেই সেই পূর্ব পরিচিত খিলখিলানি হাসির শব্দ কানে এল । এদিকে অকস্মাৎ পথ-প্রদর্শক ভক্তের হাতে থাকা মশাল এক দমকা হাওয়ায় নিভে গেল । চারিদিক তখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন । স্বামীজী ভয় পাবার লোক নন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তাঁর একটু চিত্ত-চাঞ্চল্য ঘটল । তিনি ভাবলেন এখনও কি এই বাড়িটায় সেই আগের মত পৈশাচিক কাণ্ড-কারখানা ঘটে চলেছে ! এত বছর পরেও কি ফুলমতি তার হিংসার লোলুপতা থেকে মুক্তি পায় নি ? আবারও কি কোন মোহবিস্ট অজানা যুবকের প্রাণ নিয়ে খেলা চলছে ? না, এর একটা শেষ দরকার । এত বছর ধরে কতজনের প্রাণ নিয়ে সে খেলা করেছে কে জানে ? মশাল নিভে যাওয়াতে ভক্তরা পুনরায় মশাল জ্বালাবার জন্য নিজেদের মধ্যে চেঁচামেচি শুরু করে দিল । তাদের চেঁচামেচি শুনে স্বামীজী তাদের কাছে ফিরে এলেন । ভক্তদের বললেন – “এখন মশাল জ্বালাবার প্রয়োজন নেই । তোমরা আমাকে অনুসরণ করে সামনের ঐ বাড়িটার দিকে এগোও”। ভক্তদের একজন বলে উঠল – “গুরুজী, এ-ভাবে পথ পরিবর্তন করলে ভোর চারটের মধ্যে অজয়নগরে পৌঁছে আমরা কি প্রভাত-ফেরিতে যোগদান করতে পারব”? স্বামীজী কিছুটা ধমকের সুরে বললেন – “ সে দায়িত্ব আমার । এখন যা বলছি শোন । একটা তরতাজা প্রাণের দাম অনেক । শুনতে পাচ্ছনা নারী কণ্ঠের কান্না, খিলখিলানি হাসির আওয়াজ । আজই এর শেষ চাই”। স্বামীজির কথা ভক্তদের কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারল না । স্বামীজির মুখের উপর কথা বলার সাহস কারও নেই । স্বামীজির কথাই শিরোধার্য । আলো-আঁধারি পথ ধরে স্বামীজীকে অনুসরণ করে ভক্তবৃন্দ বাগান বাড়ির দিকে এগোতে লাগল ।
বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই ভিতর থেকে এক মহিলা কণ্ঠের ভয়ঙ্কর অট্টহাসিতে ভক্তদের হিম হয়ে যাবার যোগাড় । অনেকেই ভয়ে কুঁকড়ে গেল । স্বামীজী ভক্তদের বাইরে অপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে একাই বাড়ির ভিতরে ঢুকলেন । সামনের দরজায় পা রাখতেই তিনি চমকে উঠলেন । এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য তাঁর চোখের সামনে । এক সৌম্যকান্তি যুবক সামনের পালঙ্কে অচৈতন্য অবস্থায় শুয়ে । আর এক গজ দূরে দাঁড়িয়ে বিশ বছর আগে দেখা সেই সুন্দরী নারী ফুলমতি । তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে । মুখমণ্ডলে প্রতিহিংসার ছবি । লম্বা চুলগুলো অবিন্যস্ত । পৈশাচিক হাসির আওয়াজে বাতিহীন সাবেকি বিশাল ঝাড়লন্ঠনটা দুলছে । ঘরের এককোণে রাখা ছোট্ট বাতিদানে টিমটিম করে আলো জ্বলছে । প্রবল প্রতিহিংসায় ফুলমতি দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যুবকের দিকে । হি...হি... করে হাসতে হাসতে বলছে – “এখনও বেঁচে আছিস ? আজ তোকে শেষ করেই ছাড়বো”। স্বামীজী আর দেরী না করে এবার প্রবল হুঙ্কার ছাড়লেন । পিছন ফিরে তাকিয়ে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীজীকে দেখে ফুলমতি বিস্ময়ে চমকে ওঠে । স্বামীজী বেশ চড়া গলায় বলে ওঠেন – “তোর প্রতিহিংসা কি কোনদিনও শেষ হবে না ? একজনের পাপের শাস্তি কেন দিচ্ছিস এই রকম নিরপরাধ যুবকদের”? ফুলমতি স্বামীজীর কথায় রুষ্ট হয়ে ওঠে । দ্বিগুণ আগুন ঝরানো চোখে স্বামীজীকে বলে – “তুমি এখানে কেন এসেছ ?” স্বামীজী বললেন – “পরমেশ্বরই আজ এই পথে আমাকে টেনে এনেছেন । আজই তোর শেষ রজনী”। ফুলমতি এবার স্বামীজীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে – “না না, আমি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না”। “যেতে তোকে হবেই” – স্বামীজীর হুঙ্কারে ফুলমতি কেমন যেন নিস্তেজ হতে শুরু করল । তারপর ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ল । স্বামীজী পালঙ্কের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন । হাতের কমণ্ডলু থেকে জল ছিটিয়ে দিলেন যুবকটির চোখে মুখে । গলার রুদ্রাক্ষের মালাটা হাতে ছুঁয়ে মন্ত্র উচ্চারন করে গায়ের নামাবলীখানা ছুঁইয়ে দিলেন তার গায়ে মাথায় । কিছুক্ষনের মধ্যেই যুবকটি চোখ মেলে তাকালো স্বামীজীর দিকে । স্বামীজী তাকে অভয় দিয়ে বললেন – “ভয় নেই বাবা । তুমি বিপদ-মুক্ত । কিন্তু বাবা, তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি একজন সৎ-বংশজাত । নারী সঙ্গের মোহে কেন এভাবে আবিষ্ট হও? এ-রকম ভুল কেন কর”? যুবকটির মুখ থেকে কোন কথা বেরোল না । সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বামীজীর দিকে চেয়ে রইল । তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জলের ধারা । স্বামীজী এবার এগিয়ে গেলেন ফুলমতির কাছে । ফুলমতির চোখের আগুন তখন অনেকটাই নিভে গিয়েছে । কিছুটা শান্ত ও স্বাভাবিক । স্বামীজী কাছে আসতেই ফুলমতি তাঁর দিকে চেয়ে হাতজোড় করে বলল – “আমাকে এ-বাড়িতে থাকতে দাও । আমি আর কারও ক্ষতি করবো না । সন্দীপকে অনেক ভালোবেসে এই বাড়িতে এসেছিলাম”। স্বামীজী গম্ভীরভাবে উচ্চস্বরে বললেন – “সন্দীপ কি তোর ভালবাসার মর্যাদা দিয়েছিল ? তার জন্য কি এরা কোনোভাবে দায়ী ? অসহায় যুবকেরা যখন পথভ্রান্ত হয়ে এই পথে আসে তখন তাদের তোর মোহিনী রূপের যাদু দেখিয়ে তুই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিস । আজই তোকে এ-বাড়ি থেকে তাড়াব”। স্বামীজীর কথা শুনে ফুলমতি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আবার বলে – “তোমার দুটি পায়ে পড়ি । আমাকে এখানে থাকতে দাও”। স্বামীজী তাঁর কাঁধের ঝুলিতে হাত রাখলেন । তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফুলমতিকে নিরীক্ষণ করতে করতে বললেন –“বিশ বছর আগে আমার বয়স কম ছিল, বুঝিনি । আমাকেও তো তোর মোহজালে আবিষ্ট করার চেষ্টা করেছিলি । আমার ভাগ্য ভালো যে তন্ত্রবিদ্যা তখন কিছুটা রপ্ত করেছিলাম। তাই সেবার পালাতে পেরেছিলাম । এবার আমি পালাবো না । তোকে এখান থেকে উৎখাত করেই আমি যাব”।
স্বামীজী কাঁধের ঝুলি থেকে এক নরকঙ্কালের মাথার খুলি আর দুটো হাড় বার করে ফুলমতির সামনে রাখলেন । এবার ফুলমতির বাকশক্তি রহিত হয়ে গেল । চক্ষুগোলক একজায়গায় স্থির হল । স্বামীজী তাঁর ঝুলি থেকে একটা ছোট্ট মোড়ক বার করলেন । মোড়ক খুলে লাল রঙের গুড়ো পদার্থ বার করে ফুলমতির গায়ে নিক্ষেপ করলেন । স্বামীজীর কি সাংঘাতিক রূপ তখন ! রাগে তাঁর শরীর থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে । গুরুকে স্মরণ করে মন্ত্রচ্চারন করতে লাগলেন । সেই মন্ত্রচ্চারনের আওয়াজে বাড়িটা কাঁপতে লাগল । প্রায় অর্ধমৃত যুবকটিও ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল । ধীরে ধীরে ফুলমতির শরীর ছোট হতে হতে একটা মাংসপিণ্ডে পরিনত হল । স্বামীজী সেই মাংসপিণ্ডকে নরকঙ্কালের খুলিতে ধারন করিয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে এলেন । বাইরে এসে দেখলেন তাঁর ভক্তরা তাঁর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে । তাদের উদ্দেশ্যে বললেন – “আমার ভক্তরা সবাই এদিকে এস । ধুনি জ্বালাও”। স্বামীজীর নির্দেশ পাওয়া মাত্র কালবিলম্ব না করে এক ভক্ত ধুনি প্রজ্জলন করল । আগুনের লেলিহান শিখায় সারা বন শিহরিত হয়ে উঠল । স্বামীজী গুরুগম্ভীর মন্ত্রচ্চারনের সাথে ফুলমতির শেষ মাংসপিণ্ড ধুনির আগুনে নিক্ষেপ করলেন । আগুনের লেলিহান শিখায় চিরদিনের মত হারিয়ে গেল ফুলমতির শেষ চিহ্ন । স্বামীজী রুদ্রাক্ষের মালা জপ করতে লাগলেন । ভক্তবৃন্দ স্তব্ধ । কারও মুখে কোন কথা নেই । ধীরে ধীরে ধুনির আগুন নিভে গেল । হঠাৎই সকলের মাথার উপর দিয়ে একটা বাদুড় ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে অন্ধকারে মিশে গেল । স্বামীজী এক ভক্তের কাছ থেকে গঙ্গা জল নিয়ে ধুনির ভস্মে নিক্ষেপ করলেন । বিড় বিড় করে বললেন – “তোর জ্বালা আমি জানি ফুলমতি । কিন্তু কি করব বল ? এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না”। বাইরের কাজ শেষ করে তিনি তাড়াতাড়ি আবার বাগান-বাড়িতে ঢুকলেন । পালঙ্কে শায়িত যুবকটির কাছে এসে তার মাথায় হাত রাখলেন – “বাবা, আর কোন ভয় নেই । বিপদ কেটে গিয়েছে । এই বাড়িতে আর কখনও এমনটি হবেনা”। সৌম্য অপলক দৃষ্টিতে স্বামীজীর দিকে তাকিয়ে রইল ।
স্বামীজী বাড়ির সদর দরজার বাইরে এসে অপেক্ষারত ভক্তদের বললেন – “ভোরের আলো ফুটতে আর বেশি দেরী নেই । কাল বিলম্ব কোরনা । স্বত্বর যাত্রা কর । প্রভাত ফেরির সমস্ত দায়িত্ব জিতেনের উপর রইল । বাড়ির ভিতরে এক অসুস্থ যুবক রয়েছে । তাকে এ-ভাবে ফেলে রেখে যাওয়াটা ঠিক নয় । আমি তাকে একটু সুস্থ করে এবং বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে সোজা আশ্রমেই ফিরব । আমার সাথে শুধু অপরেশ থাকবে । ছেলেটি সুস্থ হলে ও ওকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে”। স্বামীজীর আদেশে শুধুমাত্র অপরেশ থেকে গেল । বাকী ভক্তরা স্বামীজীর জয়ধ্বনি দিতে দিতে তাদের গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হল ।
স্বামীজী অপরেশকে সাথে নিয়ে আবার বাড়ির ভিতর ঢুকলেন । সামনের ঘরে ঢুকে দেখলেন যুবকটি একই ভাবে পালঙ্কে শুয়ে আছে । স্বামীজী তার পাশে বসলেন । অপরেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইল । মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন – “তোমাকে দেখে তো বাঙালী বলে মনে হচ্ছে । তা বাবা কোথা থেকে আসছো”? ধীর কণ্ঠে সে বলল – “আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি বাঙালী । আমার নাম সৌম্য দত্ত । বাড়ি বর্ধমানের মেমারিতে”। স্বামীজী আবার জিজ্ঞাসা করলেন – “তা বাবা এখানে এলে কিভাবে”? সৌম্য আস্তে আস্তে বলতে লাগল –“আমি মেডিসিন-ইন্সট্রুমেনট সাপ্লাইয়ের কাজ করি । কলকাতার হেড অফিস থেকে নির্দেশ পেয়ে মুঙ্গেরে কয়েকটা কাস্টোমারের কাছ থেকে সাপ্লাই-অর্ডার নেবার উদ্দেশ্যে এসেছিলাম । কাজ সম্পূর্ণ করতে রাত হয়ে গেল । যানবাহন না পাওয়াতে স্টেশনে যেতে পারলাম না । বৃষ্টি ভেজা রাতে অজানা অচেনা জায়গায় ক্লান্ত শরীরে একটু আশ্রয় আর একটু খাবার খুঁজছিলাম । দিশেহারা হয়ে কোন দিকে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি । জনশূন্য রাস্তা থেকে এক মৃদু আলোকে অনুসরন করে এই বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলাম শুধুমাত্র রাতের আশ্রয়ের জন্য । তারপর......”। স্বামীজী সৌম্যকে বাধা দিয়ে বললেন – “আর তোমাকে বলতে হবে না । সব বুঝতে পেরেছি । তবে করুণাময়ের অশেষ দয়ায় প্রাণটা ফিরে পেলে । তুমি তো এই বাড়ির আসল ঘটনাটা জানো না । আসল ঘটনা হোল – অনেক বছর আগে এই বাগান-বাড়িটা ছিল রঘুবীর সিংহ নামে এক জমিদারের । তার এক সুদর্শন লম্পট পুত্র ছিল, সন্দীপ । এই তোমার বয়সীই হবে । কিন্তু তার গুণের অন্ত ছিলনা । অসাধারণ সুন্দরী ফুলমতিকে মুঙ্গেরের এক গ্রাম থেকে তুলে সে এই বাড়িতে নিয়ে আসে । বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেয় । তোমাকে আর কি বলব বাবা ! প্রতি রাতে জমিদার-পুত্রের কাছে ফুলমতি হয়ে ওঠে এক ভোগ্য বস্তু । ইতিমধ্যে ওর গর্ভে জমিদার-পুত্রের সন্তান আসে । কিন্তু লম্পট জমিদার-পুত্র সন্দীপ তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এক গভীর রাতে গলা টিপে খুন করে ফুলমতিকে । কিন্তু ফুলমতি অভিমানে ক্রোধে এই বাড়ি ছেড়ে যায়নি । তার অ-শরীরী আত্মা এই বাড়িতে এতদিন ঘোরা-ফেরা করেছে । কিছুদিনের মধ্যেই সে অপমানের বদলা নিয়েছিল । জমিদার-পুত্রের মৃতদেহ এই জঙ্গলেই পাওয়া গিয়েছিল । শুধু জমিদার-পুত্রের উপর প্রতিশোধ নিয়েই ও ক্ষান্ত থাকেনি । ওর মনে পুরুষ মানুষের প্রতি ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। যার ফলে তোমাদের মত বয়সের কোন সুদর্শন যুবককে বাগে পেলে ওর লিপ্সা চরিতার্থ করতো । এর আগে কত যুবক যে ওর শিকার হয়েছে তার ঠিক ঠিকানা নেই । প্রায় বিশ বছর আগে এই অঞ্চলে ধর্মসভার কাজে যখন প্রথম এসেছিলাম সে সময় তোমার মত অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছিল। গুরুজির শেখানো মন্ত্রের বলে সে যাত্রায় আমি ওর মোহজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম । সে-সময় আজকের এই মন্ত্র আমার জানা ছিল না । যখন দেখলাম ফুলমতি নিজেকে পরিবর্তিত করতে পারেনি তখন এই মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ না করে পারলাম না। যদি এবারেও ওকে ছেড়ে দিতাম সমাজের সর্বনাশ ঘটেই চলতো । আর কোনদিন ফুলমতি কারও সর্বনাশ করতে পারবে না । তবে বেচারির জন্য খুব দুঃখ হয় । আমি ওর আত্মার শান্তি কামনা করি”।
সৌম্য একটু সুস্থ হতেই ধীরে ধীরে উঠে বসল । পালঙ্ক থেকে নেমে স্বামীজীর পায়ে গড় হয়ে প্রণাম করল । স্বামীজী তার মাথায় হাত রাখলেন । এরপর শিস্য অপরেশকে সাথে দিয়ে সৌম্যকে তার বাড়ির পথে রওনা করিয়ে দিলেন এবং তিনি আশ্রমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
***************
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
হাসান কাবীর ২০/১১/২০১৫এত ডিটেলে না গেলেও হোতো মনে হয়।তবে লেখনির গাথুনি ভালো।
-
তরীকুল ইসলাম সৈকত ১৪/১১/২০১৫ভালো লাগল!!
-
দেবব্রত সান্যাল ১৪/১১/২০১৫আপনার গল্পে ডিটেলের কাজ বেশ ভালো। গল্পে বিশেষ অভিনবত্ব নেই। ঘটনা চক্র পূর্বানুমান করা যায়। একটু ব্যতিক্রমী প্লট নিয়ে ভাবুন। আপনি চমত্কার গল্প লিখবেন। ১ , ২ ভাগ গুলো পৃষ্টা ভাগ ? সম্পাদনা করে নেবেন ?