আই লাভ ইউ (ছোট গল্প)
ইয়াসমিনঃ মা, আজকে আমার ফিরতে দেরী হবে। ক্যাম্পাসে আজ ফাংশান আছে।
মাঃ দেরী মানে? কয়টা বাজবে?
ইয়াসমিনঃ বেশী না, রাত দশটা মতো বাজতে পারে। না’রে পরমা?
পরমা দেবীঃ হ্যাঁ, কাকী, দশটার বেশী কোনভাবে হবে না। গলায় আস্বস্ত করার সুর।
মাঃ না, না, ইয়সামিন। একলা একটা মেয়ে রাতে দশটায় বাড়ি ফিরবে তা চলবে না! মায়ের কথা খুব কড়া।
ইয়াসমিনঃ একলা কেন! আমাদের বন্ধুরা আছে না। শিলচরে ইয়ুনির্ভারসিটির বাস যাবে না! তাছাড়া বন্ধুরা
কেউ ওদিকে না গেলে, পরমা আছে না। সে না হয় আমাদের বাড়িতে এসে থাকবে এক রাত্র।
মাঃ বাছা দিনকাল ভালো না। রাত বিরাতে কি যে তোমাদের ফাংশান আমি তো বুঝি না। মা ভাবে, আমার বড় মেয়েটা বরাবরই পর্দানশীল, আর লক্ষী ছিল। আসাম ইয়ুনির্ভারসিটিতে ভর্তি হবার পর থেকেই কেমন জানি বেশী চঞ্চল মনে হয়। সে বলে, আমি জানি না, তোর বাবাকে বলেছিস?
ইয়াসমিনঃ হ্যাঁ, বললাম না, বাবা বলেছে ঠিক আছে। আর বলেছে দশটার আগে ফিরতে।
মাঃ দশটার বেশী বাজলে আমি তোর বাবাকে পাঠাবো। তিনি আকাশের দিকে দেখলেন রোদ উঠার সময় হয়েছে। লেপ-কম্বল রোদে দিতে হবে। হাতে অনেক কাজ।
পরমা দেবীঃ কাকী, টেনশন কইরেন না। কিছু সমস্যা হবে না। তার বাংলা কথাগুলো একটু যেন কেমন! গুরুচরন কলেজে দুই বান্ধবী পড়েছে এক সাথে। বহু বছর শিলচর শহরেই থাকে তবু বাংলাটায় কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে। হিন্দি বললে আবার কোন সমস্যা বোঝা যায় না।
মা কাজে গেলে ইয়াসমিন ঝটপট তৈরী হয়ে বলে, পরমা, চল বেরুই! একটু দূরে রাস্তার পাশেই একটি দরগা শরীফ। ইয়াসমিন কিছু টাকা দান করে । তারপর হাত তুলে কি যেন দোয়া পড়ে।
মার্চ মাসের ২য় ভাগ চলছে। শীত যায় যায় করছে। তবু উত্তরপূর্ব ভারতের এই কোনে একটু যেন দীর্ঘ শীত থাকে। আজ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজে পার্টি । বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস কাউন্সিল প্রতি বছর অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে থাকে। এখানকার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্টসরা বছরের একদিন একটু মজা করে এই দিনে।
ইয়াসমিনদের বাড়ি ইয়ুনির্ভারসিটি ক্যাম্পাসের বেশী দূরে নয়। শিলচর যাবার রাস্তার ধারে মুসলিম পাড়ায়। তার দাদাবাড়ি হাইলাদান্দি হলেও বাবা আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা হওয়ায় কাছাকাছি জায়গা কিনে ছোট বাড়ি করেছেন। সে গুরুচরন কলেজেই গ্রাজুয়েট শেষ করে বাবার ইয়ুনির্ভারসিটিতেই ভর্তী হয়েছে এক বছর হয়ে গেছে। মুনিপুরী মেয়ে পরমা দেবী ওর সাথেই কলেজে ছিল, এখনো এক সাথেই পড়ছে। এখন সে আইরংমারায় মেয়েদের একটি পিজিতে ( হোস্টেলের মত) থাকে।
বসন্তের বাতাস বইছে। আজ ইয়াসমিনের মন খুব ফুরফুরে। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ। এমন সুন্দর দিন আর কখনই আসবে না। আজই মোক্ষম দিন । আজই ডিজের সন্ধ্যার সময় তাকে বলতে হবে। অনেক হয়েছে অপেক্ষার পালা, রমজানকে তার আজকেই বলতে হবে মনের গোপন কথা। গাড়ির অপেক্ষায় দাড়িয়ে ছিল ওরা রাস্তার ধারে।
সে বলে, পরমা, আচ্ছা, তোর ওখানে আজ খাবার বানালে কেমন হয়?
মন্দ হবে না, জবাব আসে। পরমা আরো বলে, আমার তো খাবার প্রতিদিন বানিয়েই খাওয়া লাগে।
আর শোন, একজনকে দাওয়াত দেব! ইয়াসমিনের কন্ঠে একটু দ্বিধা।
পরমার মুখে হাসি ফুঠে উঠল, বলে, কে??? বুঝেছি… রমজান!
আরে না ওসব কিছু না! লজ্জা পায় ইয়াসমিন।
আসলে পরমা লক্ষ্য করেছে ব্যপারটা। বলেনি কখনো । তার মনে হয়েছে ইয়াসমিন ও রমজান দুজন দুজনের প্রেমে পরে গেছে। লোয়ার আসাম ধুবরী জেলার ছেলে রমজান হোসেন, উচু লম্বা ছেলেটা। স্মার্ট তবে একটু লাজুক, মেয়েদের সাথে কথা কম বলতে চায়।
কিছুক্ষন পর লোকার বাস এলো একটি। বাসে ভিড় বেশী, জায়গা হলো না। ওরা একটি অটো পেয়ে গেল। ক্যম্পাসের গেট পৌছল ২০ টাকা ভাড়ায়। ভিতরে যাবার অটোর জন্য অপেক্ষা করছে এমন সময় ইয়াসমিনের ফোনে বেজে উঠে। রমজানের ফোন। বলে, কোথায়?
ইয়াসমিন বলে গেইটে অটো অপেক্ষা করছি। রমজান বলে, আমি আসছি কিছক্ষন ওয়েট কর। ও কিছু মাস হলো একটি বাইক কিনেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সে হাজির। বলল, চল, দুজনেই ওঠ্, পেছনে। পরমা বলে, কেইসে? সে আবার রমজানের সাথে হিন্দিই বলে। উত্তর আসে,হো যায়েগা! সে একটু সামনে বসে ওদের বেশী জায়গা ছেড়ে দেয়। ইয়সমিন মাঝখানে বসে বলে, ওঠ, ওঠ, হয়ে যাবে।
ডিপার্টমেন্টের সামনে ওদের বন্ধুরা মিলে ক্রিকেট খেলছে। ক্লাশ হবে কিনা ঠিক নেই ম্যাম এখনো আসেনি। বাইকটা পার্ক করে রমজান বলে, তোরা ক্যন্টিনে বসবি, নাকি খেলা দেখবি? আমি এক ওভার বল করে আসছি।
ইয়াসমিন পরমা দাঁড়িয়েই খেলা দেখতে লাগল। চমৎকার রোদ উঠেছে। পাহাড়ের চূড়ায় ডিপার্টমেন্ট, ইয়াসমিনের খুব সুন্দর লাগে। ওদের কলেজটাও এমনি পাহাড়ের উপরে ছিল। ওর মনে আছে একটা পুরোনো কাঠাল গাছ ছিল যার শিকরে ছায়ায় বসে ওরা আডডা দিত। এখানে বড় গাছ নেই তবু কিছু ফুলের বাগান ক্যম্পাসটা সুন্দর করে তুলেছে। কিছুক্ষন পর ইয়াসমিন রমজানকে বলে, কথা আছে, আমরা ক্যন্টিনে গেলাম।
চায়ের অর্ডার করে বসে আছে ওরা। রমজান এলো খানিক পরে। বলে, কি কথা রে? ইয়াসমিন বলে, এখন না। তার মুখে রহস্য। রমজান বলে, আমারও কথা আছে! উত্তর আসে কি, কি, কি কথা? রমজান হাসে পরে বলব! পরমা হাসি হাসি মুখ করে আছে, বলে, লে লো, চা আ গিয়া।
ইয়াসমিন জানতে চায়, সন্ধ্যায় কখন প্রোগ্রাম স্টার্ট হবে রে?
রমজানঃ টাইম তো লেখা আছে ৮ টা, কখন হবে আল্লাহ্ জানে। গত বছর তো রাত ১০টা বেজে গিয়েছিল।
ইয়াসমিনঃ শোন আমি আজকে পরমার রুমে আছি। রাতের খাবার বানাবো ওখানে । তুই ওখানে আসিস্!
পরমার দিকে মিুখ ফিরিয়ে বলে, সমস্যা হবে না তো, না?
পরমাঃ সমস্যা আবার কি, তুই একটু বাজার করলেই মিটে যাবে!
ইয়াসমিনঃ সে আমি করলাম, বাড়িওয়ালা কিছু বলে নাকি?
পরমাঃ না না, সব ফ্রী, কে কি বলবে?
রমজান হাসে, বলে, কি খাওয়াবি আগে বল?
ইয়াসমিনঃ যা হয়, করবো একটা কিছু। আগেই আসবি, আমার খেয়েদেয়ে, প্রোগ্রাম দেখে ১০টার আগে ফিরতে হবে।
দূরে ম্যামকে দেখা গেল গাড়ি চালিয়ে আসছেন। পরমা বলে, চল, চল, ক্লাশে চল। আজকেও রেহাই নেই। ক্লাশ হবেই।
দুপুরে হালকা পরটা-সবজি দিয়ে ওদের চলে যায়। ক্লাশ শেষ হতে তিনটে বেজে গেল। দুই বান্ধবী আইরংমারা পিজিতে ফিরতে পৌনে চার বেজে গেল। মাঝে মাঝে অটোতে ৪/৫ জন ভরতে অনেকক্ষন লেগে যায়। রুমে কিছুক্ষন জিরিয়ে নিয়ে ওরা বাজারে যায় আবার। পরমার রুমে মোটামুটি সবই আছে শুধু একটু চিকেন নিল ওরা। এক রুমেই পরমার ছোট্ট সংসার। ছোট্ট বিছানায় ওরা গড়াগড়ি খেল কিছুক্ষন। পরমা বলে আমি স্নানটা সেরে নিই আগে। তারপর তুই যাস।
সাড়ে সাতটার মধে্যই খাবার রেডি, চিকেন, ডাল, ভাজি আর ইরম্বা (মুনিপুরী খাবার)। কিছুক্ষনের মধ্যে রমজানও উপস্তিত। বলে, খাবার হলে, চলো খেয়ে নিই।
ইয়াসমিন বলল, হ্যা, আমারও আগেই ফিরতে হবে।
পরমা বলে, তোরা খেয়ে বেরো, আমি আসবো একটু পর। একটা বড়দাদা আসবে খানিক পর।
ইয়াসমিন বুঝতে পারে, আসলে পরমা ওদের দুজেনকে একান্ত সময় দিতে চায়। খাবার খাওযা হয়ে গেলে। রমজান বাইরে অপেক্ষা করে। ইয়াসমিন রেডি হয়। সে তার ব্যাগ থেকে বের করে, সুন্দর একটি ঝলমলে স্কার্ট। মাঝারি হিল। মাথায় সে স্কার্ফটিও জড়িয়ে নেয়। ওকে দেখতে অনেক ছোট্ট কিশোরীর মত লাগে। ওর একটু অস্বস্তি হয়। তবু কি করা আজকের জন্য সব মেয়েদের একটিই ড্রেস, স্কার্ট।
রমজানের গায়ে মোটা জ্যাকেট, রাতে ঠান্ডা বাড়বে হয়তো। ইয়াসমিনকে আসতে দেখে বলে, এই, দারুন লাগছে কিন্তু।
জবাব আসে, চুপ! চুপ! বাড়ির কেউ যেন না দেখে। রমজান হাসে, এত সুন্দর সাজগোছ, কেউ না দেখলে তো সব বৃথা! তার কাঁধে মেকি ক্রোধে নরম বারি দেয় ইয়াসমিন। বাইকের পেছনে বসে বল, চল!
অর্ধ চাঁদ আকাশে, প্রিয় মানুষ দুজন বাইকের পিঠে খুব কাছে। চাদেঁর আলোয় যেন পঙ্খিরাজের পিঠে রাজকন্যা আর রাজকুমার। প্লে-গ্রাউন্ডের মাঠে তখনো বিশাল মঞ্চ সাজানোর প্রস্তুতি শেষ হয়নি। বড় সাউন্ড বক্সগুলোর টেস্টিং চলছে। ওরা বসল একটু পেছনে উঁচু গ্যালারীতে। ইতোমধ্যেই মাঠের অনেক ছেলে মেয়ে জড়ো হয়েছে। উচ্চস্বরে আডডা চলছে গ্রুপগুলোর ছেলেমেয়ের মধ্যে। বেশীর ভাগ দাঁড়ানো, কিছু বসে পড়েছে গ্যালারিতে। ওরা অনেকক্ষন চুপচাপ পাশাপাশি বসা। ইয়াসমিন ভাবছে কিভাবে বলি কথাটা? রমজান ভুল বুঝবে নাতো? তিনটি মাত্র শব্দ, তাও বলা যেন দারুন কঠিন হয়ে উঠল। সে বলে, দেখতো, আকাশটা আজ কি সুন্দর সেজেছে চাঁদের আলোয়। সে রমজানের মুখের দিকে তাকায়। কি চলছে তার মনের মধ্যে? সেও কি আমাকে ভালোবাসে? হঠাৎ সে বলে, কৈ, তোমার কথাটা বললে না তো?
রমজানও চেয়ে দেখে তার মুখের দিকে, বলে, আই লাভ ইউ ! ইয়াসমিন… জানি না তুমি কি ভাবছো? সাউন্ড টেস্টিংএর শব্দে কথাটা পরিস্কার শুনতে পায় না ইয়াসমিন। বলে, কি, কি, তুমি কি বললে? সে আবার নিশ্চিত করে শুনতে চায়। ইতস্তত রমজান আরো কাছে ঘেঁষে এসে বলে, আসলে… আই লাভ ইউ। ইয়াসমিনও রমজানের হাত চেপে ধরে বলে, আই লাভ ইউ,টু…ইন ফ্যক্ট আমিই আগে বলতে চেয়ে ছিলাম। অনেকদিন বলতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। আবেগে তার গলা কেঁপে উঠে। সে ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে কি চুমু খাওয়া যায়? না, অনেক ছেলে মেয়ে আশেপাশে। রামজানের হাত চেপে ধরে সে নিজেকে সম্বরন করে। দিল্লি থেকে এসেছে ‘লোকাল ট্রেন’ নামে যে ব্যন্ড দলটি, তারা গেয়ে চলে—
ছো লো জো মুঝে কাভি, খো না যাও মে রাত দিন…
রেহ যাওংগা ইয়েহি, ব্যাস ইয়েহি, ব্যাস ইয়েহি…
একবার ছুঁয়ে দাও না আমায়, আমি প্রতিক্ষায় রাতদিন…
আমি এখানেই, ব্যাস এখানেই আছি…
মাঃ দেরী মানে? কয়টা বাজবে?
ইয়াসমিনঃ বেশী না, রাত দশটা মতো বাজতে পারে। না’রে পরমা?
পরমা দেবীঃ হ্যাঁ, কাকী, দশটার বেশী কোনভাবে হবে না। গলায় আস্বস্ত করার সুর।
মাঃ না, না, ইয়সামিন। একলা একটা মেয়ে রাতে দশটায় বাড়ি ফিরবে তা চলবে না! মায়ের কথা খুব কড়া।
ইয়াসমিনঃ একলা কেন! আমাদের বন্ধুরা আছে না। শিলচরে ইয়ুনির্ভারসিটির বাস যাবে না! তাছাড়া বন্ধুরা
কেউ ওদিকে না গেলে, পরমা আছে না। সে না হয় আমাদের বাড়িতে এসে থাকবে এক রাত্র।
মাঃ বাছা দিনকাল ভালো না। রাত বিরাতে কি যে তোমাদের ফাংশান আমি তো বুঝি না। মা ভাবে, আমার বড় মেয়েটা বরাবরই পর্দানশীল, আর লক্ষী ছিল। আসাম ইয়ুনির্ভারসিটিতে ভর্তি হবার পর থেকেই কেমন জানি বেশী চঞ্চল মনে হয়। সে বলে, আমি জানি না, তোর বাবাকে বলেছিস?
ইয়াসমিনঃ হ্যাঁ, বললাম না, বাবা বলেছে ঠিক আছে। আর বলেছে দশটার আগে ফিরতে।
মাঃ দশটার বেশী বাজলে আমি তোর বাবাকে পাঠাবো। তিনি আকাশের দিকে দেখলেন রোদ উঠার সময় হয়েছে। লেপ-কম্বল রোদে দিতে হবে। হাতে অনেক কাজ।
পরমা দেবীঃ কাকী, টেনশন কইরেন না। কিছু সমস্যা হবে না। তার বাংলা কথাগুলো একটু যেন কেমন! গুরুচরন কলেজে দুই বান্ধবী পড়েছে এক সাথে। বহু বছর শিলচর শহরেই থাকে তবু বাংলাটায় কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে। হিন্দি বললে আবার কোন সমস্যা বোঝা যায় না।
মা কাজে গেলে ইয়াসমিন ঝটপট তৈরী হয়ে বলে, পরমা, চল বেরুই! একটু দূরে রাস্তার পাশেই একটি দরগা শরীফ। ইয়াসমিন কিছু টাকা দান করে । তারপর হাত তুলে কি যেন দোয়া পড়ে।
মার্চ মাসের ২য় ভাগ চলছে। শীত যায় যায় করছে। তবু উত্তরপূর্ব ভারতের এই কোনে একটু যেন দীর্ঘ শীত থাকে। আজ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজে পার্টি । বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস কাউন্সিল প্রতি বছর অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে থাকে। এখানকার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্টসরা বছরের একদিন একটু মজা করে এই দিনে।
ইয়াসমিনদের বাড়ি ইয়ুনির্ভারসিটি ক্যাম্পাসের বেশী দূরে নয়। শিলচর যাবার রাস্তার ধারে মুসলিম পাড়ায়। তার দাদাবাড়ি হাইলাদান্দি হলেও বাবা আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা হওয়ায় কাছাকাছি জায়গা কিনে ছোট বাড়ি করেছেন। সে গুরুচরন কলেজেই গ্রাজুয়েট শেষ করে বাবার ইয়ুনির্ভারসিটিতেই ভর্তী হয়েছে এক বছর হয়ে গেছে। মুনিপুরী মেয়ে পরমা দেবী ওর সাথেই কলেজে ছিল, এখনো এক সাথেই পড়ছে। এখন সে আইরংমারায় মেয়েদের একটি পিজিতে ( হোস্টেলের মত) থাকে।
বসন্তের বাতাস বইছে। আজ ইয়াসমিনের মন খুব ফুরফুরে। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ। এমন সুন্দর দিন আর কখনই আসবে না। আজই মোক্ষম দিন । আজই ডিজের সন্ধ্যার সময় তাকে বলতে হবে। অনেক হয়েছে অপেক্ষার পালা, রমজানকে তার আজকেই বলতে হবে মনের গোপন কথা। গাড়ির অপেক্ষায় দাড়িয়ে ছিল ওরা রাস্তার ধারে।
সে বলে, পরমা, আচ্ছা, তোর ওখানে আজ খাবার বানালে কেমন হয়?
মন্দ হবে না, জবাব আসে। পরমা আরো বলে, আমার তো খাবার প্রতিদিন বানিয়েই খাওয়া লাগে।
আর শোন, একজনকে দাওয়াত দেব! ইয়াসমিনের কন্ঠে একটু দ্বিধা।
পরমার মুখে হাসি ফুঠে উঠল, বলে, কে??? বুঝেছি… রমজান!
আরে না ওসব কিছু না! লজ্জা পায় ইয়াসমিন।
আসলে পরমা লক্ষ্য করেছে ব্যপারটা। বলেনি কখনো । তার মনে হয়েছে ইয়াসমিন ও রমজান দুজন দুজনের প্রেমে পরে গেছে। লোয়ার আসাম ধুবরী জেলার ছেলে রমজান হোসেন, উচু লম্বা ছেলেটা। স্মার্ট তবে একটু লাজুক, মেয়েদের সাথে কথা কম বলতে চায়।
কিছুক্ষন পর লোকার বাস এলো একটি। বাসে ভিড় বেশী, জায়গা হলো না। ওরা একটি অটো পেয়ে গেল। ক্যম্পাসের গেট পৌছল ২০ টাকা ভাড়ায়। ভিতরে যাবার অটোর জন্য অপেক্ষা করছে এমন সময় ইয়াসমিনের ফোনে বেজে উঠে। রমজানের ফোন। বলে, কোথায়?
ইয়াসমিন বলে গেইটে অটো অপেক্ষা করছি। রমজান বলে, আমি আসছি কিছক্ষন ওয়েট কর। ও কিছু মাস হলো একটি বাইক কিনেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সে হাজির। বলল, চল, দুজনেই ওঠ্, পেছনে। পরমা বলে, কেইসে? সে আবার রমজানের সাথে হিন্দিই বলে। উত্তর আসে,হো যায়েগা! সে একটু সামনে বসে ওদের বেশী জায়গা ছেড়ে দেয়। ইয়সমিন মাঝখানে বসে বলে, ওঠ, ওঠ, হয়ে যাবে।
ডিপার্টমেন্টের সামনে ওদের বন্ধুরা মিলে ক্রিকেট খেলছে। ক্লাশ হবে কিনা ঠিক নেই ম্যাম এখনো আসেনি। বাইকটা পার্ক করে রমজান বলে, তোরা ক্যন্টিনে বসবি, নাকি খেলা দেখবি? আমি এক ওভার বল করে আসছি।
ইয়াসমিন পরমা দাঁড়িয়েই খেলা দেখতে লাগল। চমৎকার রোদ উঠেছে। পাহাড়ের চূড়ায় ডিপার্টমেন্ট, ইয়াসমিনের খুব সুন্দর লাগে। ওদের কলেজটাও এমনি পাহাড়ের উপরে ছিল। ওর মনে আছে একটা পুরোনো কাঠাল গাছ ছিল যার শিকরে ছায়ায় বসে ওরা আডডা দিত। এখানে বড় গাছ নেই তবু কিছু ফুলের বাগান ক্যম্পাসটা সুন্দর করে তুলেছে। কিছুক্ষন পর ইয়াসমিন রমজানকে বলে, কথা আছে, আমরা ক্যন্টিনে গেলাম।
চায়ের অর্ডার করে বসে আছে ওরা। রমজান এলো খানিক পরে। বলে, কি কথা রে? ইয়াসমিন বলে, এখন না। তার মুখে রহস্য। রমজান বলে, আমারও কথা আছে! উত্তর আসে কি, কি, কি কথা? রমজান হাসে পরে বলব! পরমা হাসি হাসি মুখ করে আছে, বলে, লে লো, চা আ গিয়া।
ইয়াসমিন জানতে চায়, সন্ধ্যায় কখন প্রোগ্রাম স্টার্ট হবে রে?
রমজানঃ টাইম তো লেখা আছে ৮ টা, কখন হবে আল্লাহ্ জানে। গত বছর তো রাত ১০টা বেজে গিয়েছিল।
ইয়াসমিনঃ শোন আমি আজকে পরমার রুমে আছি। রাতের খাবার বানাবো ওখানে । তুই ওখানে আসিস্!
পরমার দিকে মিুখ ফিরিয়ে বলে, সমস্যা হবে না তো, না?
পরমাঃ সমস্যা আবার কি, তুই একটু বাজার করলেই মিটে যাবে!
ইয়াসমিনঃ সে আমি করলাম, বাড়িওয়ালা কিছু বলে নাকি?
পরমাঃ না না, সব ফ্রী, কে কি বলবে?
রমজান হাসে, বলে, কি খাওয়াবি আগে বল?
ইয়াসমিনঃ যা হয়, করবো একটা কিছু। আগেই আসবি, আমার খেয়েদেয়ে, প্রোগ্রাম দেখে ১০টার আগে ফিরতে হবে।
দূরে ম্যামকে দেখা গেল গাড়ি চালিয়ে আসছেন। পরমা বলে, চল, চল, ক্লাশে চল। আজকেও রেহাই নেই। ক্লাশ হবেই।
দুপুরে হালকা পরটা-সবজি দিয়ে ওদের চলে যায়। ক্লাশ শেষ হতে তিনটে বেজে গেল। দুই বান্ধবী আইরংমারা পিজিতে ফিরতে পৌনে চার বেজে গেল। মাঝে মাঝে অটোতে ৪/৫ জন ভরতে অনেকক্ষন লেগে যায়। রুমে কিছুক্ষন জিরিয়ে নিয়ে ওরা বাজারে যায় আবার। পরমার রুমে মোটামুটি সবই আছে শুধু একটু চিকেন নিল ওরা। এক রুমেই পরমার ছোট্ট সংসার। ছোট্ট বিছানায় ওরা গড়াগড়ি খেল কিছুক্ষন। পরমা বলে আমি স্নানটা সেরে নিই আগে। তারপর তুই যাস।
সাড়ে সাতটার মধে্যই খাবার রেডি, চিকেন, ডাল, ভাজি আর ইরম্বা (মুনিপুরী খাবার)। কিছুক্ষনের মধ্যে রমজানও উপস্তিত। বলে, খাবার হলে, চলো খেয়ে নিই।
ইয়াসমিন বলল, হ্যা, আমারও আগেই ফিরতে হবে।
পরমা বলে, তোরা খেয়ে বেরো, আমি আসবো একটু পর। একটা বড়দাদা আসবে খানিক পর।
ইয়াসমিন বুঝতে পারে, আসলে পরমা ওদের দুজেনকে একান্ত সময় দিতে চায়। খাবার খাওযা হয়ে গেলে। রমজান বাইরে অপেক্ষা করে। ইয়াসমিন রেডি হয়। সে তার ব্যাগ থেকে বের করে, সুন্দর একটি ঝলমলে স্কার্ট। মাঝারি হিল। মাথায় সে স্কার্ফটিও জড়িয়ে নেয়। ওকে দেখতে অনেক ছোট্ট কিশোরীর মত লাগে। ওর একটু অস্বস্তি হয়। তবু কি করা আজকের জন্য সব মেয়েদের একটিই ড্রেস, স্কার্ট।
রমজানের গায়ে মোটা জ্যাকেট, রাতে ঠান্ডা বাড়বে হয়তো। ইয়াসমিনকে আসতে দেখে বলে, এই, দারুন লাগছে কিন্তু।
জবাব আসে, চুপ! চুপ! বাড়ির কেউ যেন না দেখে। রমজান হাসে, এত সুন্দর সাজগোছ, কেউ না দেখলে তো সব বৃথা! তার কাঁধে মেকি ক্রোধে নরম বারি দেয় ইয়াসমিন। বাইকের পেছনে বসে বল, চল!
অর্ধ চাঁদ আকাশে, প্রিয় মানুষ দুজন বাইকের পিঠে খুব কাছে। চাদেঁর আলোয় যেন পঙ্খিরাজের পিঠে রাজকন্যা আর রাজকুমার। প্লে-গ্রাউন্ডের মাঠে তখনো বিশাল মঞ্চ সাজানোর প্রস্তুতি শেষ হয়নি। বড় সাউন্ড বক্সগুলোর টেস্টিং চলছে। ওরা বসল একটু পেছনে উঁচু গ্যালারীতে। ইতোমধ্যেই মাঠের অনেক ছেলে মেয়ে জড়ো হয়েছে। উচ্চস্বরে আডডা চলছে গ্রুপগুলোর ছেলেমেয়ের মধ্যে। বেশীর ভাগ দাঁড়ানো, কিছু বসে পড়েছে গ্যালারিতে। ওরা অনেকক্ষন চুপচাপ পাশাপাশি বসা। ইয়াসমিন ভাবছে কিভাবে বলি কথাটা? রমজান ভুল বুঝবে নাতো? তিনটি মাত্র শব্দ, তাও বলা যেন দারুন কঠিন হয়ে উঠল। সে বলে, দেখতো, আকাশটা আজ কি সুন্দর সেজেছে চাঁদের আলোয়। সে রমজানের মুখের দিকে তাকায়। কি চলছে তার মনের মধ্যে? সেও কি আমাকে ভালোবাসে? হঠাৎ সে বলে, কৈ, তোমার কথাটা বললে না তো?
রমজানও চেয়ে দেখে তার মুখের দিকে, বলে, আই লাভ ইউ ! ইয়াসমিন… জানি না তুমি কি ভাবছো? সাউন্ড টেস্টিংএর শব্দে কথাটা পরিস্কার শুনতে পায় না ইয়াসমিন। বলে, কি, কি, তুমি কি বললে? সে আবার নিশ্চিত করে শুনতে চায়। ইতস্তত রমজান আরো কাছে ঘেঁষে এসে বলে, আসলে… আই লাভ ইউ। ইয়াসমিনও রমজানের হাত চেপে ধরে বলে, আই লাভ ইউ,টু…ইন ফ্যক্ট আমিই আগে বলতে চেয়ে ছিলাম। অনেকদিন বলতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। আবেগে তার গলা কেঁপে উঠে। সে ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে কি চুমু খাওয়া যায়? না, অনেক ছেলে মেয়ে আশেপাশে। রামজানের হাত চেপে ধরে সে নিজেকে সম্বরন করে। দিল্লি থেকে এসেছে ‘লোকাল ট্রেন’ নামে যে ব্যন্ড দলটি, তারা গেয়ে চলে—
ছো লো জো মুঝে কাভি, খো না যাও মে রাত দিন…
রেহ যাওংগা ইয়েহি, ব্যাস ইয়েহি, ব্যাস ইয়েহি…
একবার ছুঁয়ে দাও না আমায়, আমি প্রতিক্ষায় রাতদিন…
আমি এখানেই, ব্যাস এখানেই আছি…
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শ.ম. শহীদ ১৫/১১/২০২৪চমৎকার উপস্থাপন।
-
মোঃ আমিনুল ইসলাম মিঠু ২৬/০২/২০২২ভালো লাগলো। সুন্দর লিখা
-
আব্দুর রহমান আনসারী ২৬/০২/২০২২মুগ্ধতা এর মুগ্ধতা
-
শুভজিৎ বিশ্বাস ২৪/০২/২০২২ভালো লাগলো
-
ফয়জুল মহী ২৩/০২/২০২২অসাধারণ লিখেছেন
একরাশ মুগ্ধতা রেখে গেলাম।l