বাল্যস্মৃতি যেন জাতিস্মরের অন্য এক জনমের গল্প
[অস্থির সময়, চঞ্চল মন। কারো সময় নেই, সবাই ব্যস্ত। তবুও করোনা ভাইরাস কিছু সময় দিয়েছে। তাই অনুরোধ একটু পড়ে দেখুন।]
দীঘিনালায় আমার জন্মের দু-বছর পর জন্ম হলো আমার ছোট ভাইটির। এইটিই আমার জীবনের প্রথম স্মৃতি। খাগড়াছড়িতে আমাদের পুরোনো বাড়িতে, যেটি ভেঙে এখন নতুন বাড়ী করা হয়েছে, সেখানে মাকে শুয়ে রাখা হয়েছে বিছানায়। আমি কান্না করছি কেননা আমাকে মায়ের কাছে যেতে দেয়া হচ্ছে না। আমার দিদিকে দেখতে পাই কৌতুহলী দৃষ্টি, বোধকরি ছটফট করছে। এগিয়ে দিচ্ছে দরকারী কোন জিনিস পত্র। বুড়ি দাইমা অপেক্ষা করছেন সেই মাহেন্দ্র ক্ষনটির জন্য। ভাইটি হওয়ার আগে মাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকতে খুবই আরাম লাগতো। বিশেষ করে বুকের দিক থেকে। মায়ের পেটের নরম চর্বিতে হাত না বুলিয়ে না ঘুমালে যেন ঘুমই হতো না। মনে পড়ে মাকে সামনের দিক থেকে আলিঙ্গন করতে চাইতাম যা ভাইটি হওয়ার পর আর সে সুযোগ থাকল না। তাই মনের মধ্যে একটু ব্যথা রয়ে গেছে বোধয়। বাবাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে কোন আরাম নেই। তার শক্ত শরীর আলিঙ্গন করেও সুখ নেই, ঘুমও পায় না।
ভাইটি যখন একটু বড় হলো, সে হলো আমার প্রধান খেলার সাথী। মনে পড়ে সারাটা সকাল মাঠে, বিশেষ করে খাগড়াছড়ি ছড়ায় খেলাধুলা করে কখন বেলা গড়িয়ে যায় তার খেয়াল থাকতো না। সারাদিন খেলাধুলা শেষ করে বাড়ি ফিরতে ছিল দারুন ভয়। কিভাবে মায়ের সামনে যাবো, কে আগে যাবে। কেননা যে আগে যাবে তার পিঠে পড়তে পারে প্রথম বেতের চাবুক! বাড়ির বেড়ার আড়ালে মাকে লক্ষ্য করতাম উঁকিঝুকিঁ দিয়ে, আগে মায়ের রাগ খেয়াল করতে হতো। বুদ্ধি করে ছোট ভাইটিকে আগে বাড়িয়ে দিতাম, যেন সহজে মার না পড়ে। সে মায়ের সাথে মিলে যাবার পর, আবস্থা স্বাভাবিক হলে আমিও নিজেকে মিলিয়ে নিতাম। মাঝে মাঝে এমন হয়েছে খেলতে খেলতে বেলা গড়িয়ে হয়তো দুপুরের খাবার সময় পেরিয়ে গেছে। মা হয়তো বাশেঁর কঞ্চি নিয়ে মারতে মারতে আমাদের নিয়ে গেলেন। মা যখন এগিয়ে আসতেন তার হাত থাকতো পেছনে লুকিয়ে রাখা। আগে থেকে বোঝার উপাই নেই হাতে বেত আছে কি নেই। তাই মা আমাদের নিতে এলেও আমরা পালিয়ে থাকতাম। যখন বুঝতে পারতাম হাতে বেত নেই তবেই ধরা দিতাম। খাগড়াছড়ি ছড়ার পাড়ে জমতো বালির ছোট টিলা, যা ছিল আমাদের প্রথম পছন্দের খেলার জায়গা। বর্ষাকালে এ ছড়াই প্রচুর পানি থাকতো। মা তখন পানিতে যেতে দিতেন না।
শীতকালে জলের ধারা ছোট, লাফিয়েও পার হওয়া যায়। আর পাড়ে পড়ে খাকতো বালির টিলা। বিশেষ করে ছড়ার বাকেঁ বাকেঁ বালি জমতো। ভেজা আর শুকনো বালি দিয়ে বানাতাম একধরনের গোলা। কার গোলা কত বেশী শক্ত সেটাই হতো পরীক্ষা! মজার খেলা । ঢালু জায়গা দেখে গোলা গড়িয়ে যাওয়ার দুটো রাস্তা তৈরী করা হতো। নিচে যেখানে দুটি গোলা পরস্পর আঘাত লাগবে সেটি থাকতো ঢালুর শেষ প্রান্তে। এইটিই ছিল যুদ্ধক্ষেত্র বা কুরুক্ষেত্র, যেখানে জয়-পরাজয় নির্ধারন হতো। বালির মধ্যে কতগুলো গুনের ভাগ আছে। যে বালিগুলো সবচেয়ে মিহি ও পরিষ্কার তা দিয়েই সবচেয়ে শক্ত গোলা তৈরী করা যায়। তবে হাতেরও দক্ষতা প্রয়োজন, নিপূণ হাতের মসৃন ছোয়াঁয় ধীরে ধীরে তৈরী করতে হয় গোলা-যুদ্ধের মোক্ষম অস্ত্র। রণক্ষেত্রের ঢালুত্ব বুঝেও গোলাটা বানাতে হয়। পথ বেশী লম্বা হলে গোলা করতে হয় ছোট। দীর্ঘ পথে বড় গোলা নিজে নিজে গড়িয়েই ভেঙে যায়, শত্রু পক্ষকে আঘাত করার আর শক্তি থাকে না। তবে রাস্তা ছোট হলে বড় গোলার সাথে চোট গোলা পেরে উঠে না। এই বুঝেই আমার চেষ্টা থাকতো সব সময় শক্তিশালী গোলা বানানোর। মাঝে মাঝে ছোট ভাইটিকে দু-একটি গোলা দিয়ে দিতাম হয়তো।
ছড়াটির বাকেঁ আর একটি মজার খেলা ছিল আমাদের তা হলো-হ্যন্ডসাফ খেলা। মূলত ওটা ছিল হ্যন্ডস-আপ খেলা! শত্রুকে যে আগে দেখে নাম বলতে পারবে সেই বিজয়ী। দুই পক্ষ ভাগ হয়ে বাকেঁর র্শীষ বিন্দুতে শেষ দেখা হতো দুই গ্রুপের। সবাই সবাইকে দেখা-দেখীর পর সবাই লকিুয়ে পরতো নদীর বাকেঁর বাঁশঝাড়ে। লুকিয়ে অপেক্ষা করতো কখন শত্রু সামনে আসে। এক পক্ষের সবাইকে দেখে ফেললে সেই পক্ষ পরাজিত ধরে নেয়া হতো। আমাদের গ্রাম মিলনপুরে তখন খেলার সাথীর অভাব নেই। বাচ্চুগুলো (রনেল দেওয়ান), মুনি/মনি (রাজীব চাকমা), নোবেল ও রুবেল, বুলটন ও নিটন, অক্কনা (রাকেশ চাকমা), চিজি, তকেল, সুকুমারদার ছোট দুই ভাই, বারাবো (প্রিয়তম চাকমা), সুজন, গোড়াইয়ে আরো অনেক কত বন্ধুর পাল! একটি দিন বন্ধুহীন থাকতে পারতাম না। মনিরা পাঁচ ভাই আর তাদের বাবা-মা ছিলেন তুলনামূলক আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাই তাদের বাসার চারপাশে আমরা সবাই ঘুরঘুর করতাম। পাঁচ ভাই ১/২ বছরের ফারাক মাত্র। তাই পাড়ার কেউ না কেউ পাচঁ ভাইয়ের এক ভাই বন্ধু হিসাবে মিলতো। একদিন তাদের এক ভাইয়ের দেখা না পেলে আমাদের দিন চলে না!
শীতের শেষে যখন বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু করে তখন সবার মনে বয়ে যায় আনন্দ হিল্লোল। মিলনপুরের মাঝখানে ছোট ধানী জমির মাঠ,ধান কাটা হয়ে গেলে তা খেলার মাঠে রূপ নিতো। এই বিশাল মাঠে তখন আমাদের দৌড়ঝাপঁ- লাফালাফি-দাপাদাপি ইত্যাদি ঠেকায় কে?! বিকালের প্রথম কাজ ছিল শুকনো খড়ি বা খড় যা মাঠে পরে থাকতো তা একত্র করে আগুন দিয়ে ধোঁয়া সৃষ্টি করা। সেই ধোয়াঁয় বেলুন ওড়ানো ছিল আমাদের খেলা। কত বেশী দূর আকাশে বেলুন ওড়ানো যায়, তাই ছিল আনন্দ। ভাগ্য খারাপ হলে আগুনের ফুলকী লেগে বেলুন ফেটে গেল বা সুঙসুঙি লেগেও বেলুন ফাটতে পারে। কিন্তু যতক্ষন না ফাটছে ততক্ষন গোল হয়ে আগুনের চারপাশে আমাদের উল্লাস, চিৎকার, হৈ-হত্তগোল আর থামে না। চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলে তবে ঘরে ফেরার পালা। সারাদিন খড়খড়ির সাথে খেলে সন্ধায় হাত-পা ধোয়ার সময় শুরু হয় কঠিন চুলকানী। কেননা সুঙসুঙিতে পানি লাগলে তা দারুন চুলচুলি সৃষ্টি করে। তার উপর শীতের প্রচন্ড কামড়। গরম কাপড় গায়ে জড়িয়ে পড়তে বসা। হারিকেন বা চেরাগের আলোয় পড়তে হয়েছে বেশ কয়েক বছর।
মিলনপুরে বিদ্যুত এল আশির দশকের শেষ অংশে ১৯৮৬ তে। বিদ্যুতের পর এল বৈদুতিক সামগ্রী, স্ত্রী বা আয়রন, টেবিল ফ্যান, টিভি এল সেকেন্ড হ্যন্ড কয়েক বছর পর মামার বাড়ি থেকে। কিন্তু কপাল খারাপ আমাদের, দু-তিন বছর পর টিভি নষ্ট হয়ে গেল। মেকানিক বললেন পিকচার টিউব খারাপ, যা ছিল ঠিভির প্রাণ তাই হলো অকেজো। থান্ডার কেটস ছিল আমাদের সবার প্রিয় কার্টুন। আর এদের তলোয়ারের মতো বাশেঁর তলোয়ার বানিয়ে খেলেছি এক-দু বছর। দীঘিনালা থেকে আজু আসলে কোন কোন দিন বাংলাদেশের পতাকা দেখা পর্যন্ত চলতো টিভি দেখা। ’৮৬ র বিশ্বকাপ ফুটবল দেখে বাংলাদেশের সবাই ম্যারাডোনা তথা আর্জেনটিনার সাপোর্টার বনে যায়। ’৯০ এর বিশ্বকাপে তারা সবাই হতাশ যখন পশ্চিম জার্মানী কাপ নিয়ে গেল। মনে আছে ইতালীর বেইজিও কি মর্মান্তিক ভাবেই না টাইব্রেকার স্যুটে গোল পোস্টের মাথার উপর দিয়ে বল পাঠিয়ে দেন। ’৯৪ এর বিশ্বকাপ দেখার পর আমরা অনেকেই হলাম ব্রাজিল ফ্যান। বেবেতো, রবার্টো কার্লোস, দুঙ্গা মনের মাঝে গাথা হয়ে যায়। বইয়ে পড়া ফুটবলের জাদুকর কালো মানিক পেলে। পর পর তিন বারের বিশ্বকাপ বিজেতা একমাত্র অরিজিনাল গোল্ডকাপ যারা ঘরে নিয়ে গেল। ’৯০ এ এরশাদ সরকারের পতনের আগে প্রতি শুক্রবার বিকালে প্রচার হতে লাগল রাজ্জাক, সাবানা, ববিতার বাংলা ছায়াছবি। পরে জেনেছি এ নাকি সরকারেরই চাল, মুভি দেখতে গিয়ে যেন সরকার বিরোধী মিছিলে না যায়! রবিবার সকালে ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা যেতো ভারতের টিভি চ্যানেল, মহাভারত বা রামায়ন, তবে এ্যন্টনার বাঁশ ঘুড়াতে হতো বেশ কয়েক বার। রামায়ন শুনতে গিয়ে বহুবার পাকাচুল তুলতে হয়েছে নতুবা মালিশ দিতে হয়েছে যার মধ্যে ডাঃ চিমুনী কাকা অন্যতম। আর একদিন মহাভারত দেখার এমনি একটি সকালে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মাঝে আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হলো হঠাৎ এক কাপড়ে। মায়ের হাতে তার দু-এক রতি সোনাদানা বা বাবার দেয়া কাগজপত্রের ফাইল, দুমুঠো ভাত খাবার সময়ই নেই। আমাদের পুরো গ্রামবাসীকে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হলো গ্রামের মাঠের ওপারে চেয়ারম্যান জতিন্দ্রলাল ত্রিপুরার বাড়িতে। বাবা আর জমিতে কাজ করার একজন ননীলাল কাকা বা নাগজ্জ্যে কাকা বাড়িতে রয়ে গেলেন। ত্রিশিখাদিরা বোনদের মধ্যে ঝগড়া লেগে গিয়ে কেউ খাবার খাচ্ছিল না আমাদের ভাগে জুটে গেল সেই খাবার। কিছুক্ষনের মধ্যে পানখাইয়াপাড়া আর মহাজন পাড়ার আকাশে কালো ধোঁয়া আর আগুনের লাল লেলিহান শিখা জ্বলতে লাগল। মিলনপুরের যে বাড়িটি বাজারের সবচেয়ে কাছে তা হলো বন্ধু বাচ্চুগুলোদের বাড়ি। সেই বাড়িটি একদল দুর্বৃত্ত এসে আগুন লাগিয়ে দিল। চেয়ারম্যানের বাড়িতে কয়েকজন পুলিশ ছিল, তারা আর কিছু গ্রামের যুবক গিয়ে বাড়িটির আগুন নেভায়। আর বাধা পেয়ে দুর্বৃত্তের দল গ্রামে ধুকে অন্য গ্রামের মতো আগুন লাগানো সুযোগ পেল না। চলে গেল অন্যদিকে।
সন্ধ্যার সময় এক দুই ঘন্টা পড়া হলো কি হলো না, খিদে লাগত ব্যাপক। তারপর ঘনঘন পাকঘরে যাতায়ত! মায়ের একটি রান্না হয়ে গেলে চেখে দেখা মায়ের অগোচরে। পড়তে বসলে আমার ভাইটির বারবার প্রসাব পেয়ে বসে, পানির তৃঞ্চা পায়। পড়া পড়তে হয় জোড়ে আওয়াজ করে যেন বাবা/মা পাকঘর থেকে শুনতে পায়। পড়ালেখা-লেখাপড়া হলো আমাদের বাবার প্রথম এবঙ একমাত্র চাওয়া। যত অন্যায় করি না কেন, পড়াশুনা করতে দেখলে বাবা খুশি। তাই সারাদিন যত খেলাধুলা বা ঘুরাফেরা করি না কেন সন্ধা ও সকাল কয়েক ঘন্টা লেখাপড়া ছিল আমাদের তিন ভাই-বোনের নিয়মিত কাজ। বাবার সাথে আমার ভয়ানক স্মৃতি হচ্ছে তার হাতে গরুমারার বেত দিয়ে প্রথম মার খাওয়া! তিনি স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি জমিতে ধান বা বিবিধ শস্য চাষ করতেন। ধান মাড়াই করতেন বাড়ির উঠানে গরুর পা দিয়ে! মধ্য উঠানে একটি খুটির সাথে ২ বা ততোধিক গরু বেঁধে চক্রকারে ঘুড়ানো হতো বিছিয়ে দেয়া ধানের শিষের উপর। গরুর পায়ের আঘাতে ধানগুলো শীষ থেকে ঝড়ে পড়ে তলায়। কিন্তু তারা ক্লান্ত হলে হাটতে চায় না, তখন বেত্রাঘাত করার প্রয়োজন হয়। তাই উঠানের এক কোন রাখা থাকে কিছু বেত। সম্ভবত এমনই এক দিনে তিনি স্কুলের বাচ্চাদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করছিলেন। আমি কি কারনে জানি না উনাকে খুব বিরক্ত করছিলাম হয়তো। তিনি রেগে গিয়ে আমাকে খুব মার দিলেন সেই গরুমারার বেত দিয়ে। এই মারের পর জীবনে দ্বিতীয় বার বাবার হাতে আর মার খাইনি। হয়তো তিনিও মনে মনে কষ্ট পেয়েছিলেন খুব। পরে কখনো হাতের মুষ্ঠি পাকিয়ে মাথায় একটু ঘষে দিয়েছেন। কিন্তু মার আর মারেননি। ছোট ভাই বা দিদি কাউকে কোনদিন মারধোর করতে দেখিনি। তবে মার হাতের মার ছিল একদম ডালভাত! কোনদিন সকালে একবার ও বিকালে হয়তো আরেকবার মার খেয়েছি মার হাতে। তবুও একটু বড় হতেই মা’ই ছিলেন আমাদের ভাইবোনদের বন্ধুর মতো।
মেয়ে বন্ধুদের বা দিদিদের একটি খেলা খুব প্রিয় ছিল- বৌচি খেলা। তারা মাঝে মাঝে আমাদেরকেও সাথে নিতো।বর্গাকার সদৃশ একটি জমির দুই কোনায় দুটি বাড়ি মানে পায়ের সেন্ডল দিয়ে বেরিকেড বানিয়ে ঘর বানাতে হতো। দুটি টিম গড়া হতো ৪/৫ জন নিয়ে। মূল কাজ ছিল এর একটি ঘর থেকে অন্য একটি ঘরে বৌ (মানে যে কোন একজন যাকে বৌ বলে ধরে নেয়া হলো) নিয়ে যাওয়া অপর পক্ষের স্পর্শ ছাড়া। বৌ পক্ষের একজন কাবাডির মতো নিশ্বাস বন্ধ করে চিঁইই শব্দ করতে করতে বৌকে স্পর্শ করার জন্য অপেক্ষমান অপর পক্ষের সদস্যদের তাড়া করতো। বৌ পক্ষের জন যদি অন্য দলের কাউকে ছুতে পারে তাহলে সে খেলা থেকে আউট। নিশ্বাস শেষ হলে সে ফিরতো বাড়িতে। তারপর অন্যজনের পালা । আর বৌ এর চেষ্টা থাকত কখন অন্য বাড়িতে যাবার রাস্তা ফ্রি হচ্ছে যেন অপর দলের কেউ তাকে ছুতে না পারে। বৌ অপর বাড়িতে পৌছে গেলে বৌ পক্ষ জয়ী বা অপর পক্ষ বৌকে ছুয়ে দিলে অপর পক্ষ জয়ী।
ছেলেদের আর একটি মজার ও একই সাথে ব্যথ্যা পাওয়ার খেলা ছিল টেনিস বল দিয়ে অপর খেলোয়ারের গায়ে ছুড়ে মারা। শর্ত হলো বলটা যেখানে পাওয়া গেল, সেখান থেকেই আপর খেলোয়ারদের দিকে ছুঁড়ে মারতে হবে। যার পিঠে বল লাগতো সেই ব্যথ্যা পেতো আর সাথে মজাও। এমনি করে সারাটা বিকেল মিলনপুরের মাঠটি আমরা ছেলে-মেয়েরা হুল্লোরে মাতিয়ে রাখতাম। কোন বছর শীতের শেষে বসন্তের আহবা ফিরিলে জাপানী শিশুদের মতো আমরাও ঘুড়ি ওড়াতাম সেই মাঠেই। আমাদের ২/৩ বছরের বড় দাদারা ছিল ঘুড়ি ওড়ানোয় ওস্তাদ। যাদের মধ্যে কালাইয়েদা, সুকুমারদা বা ঝন্টুদা উল্লেখযোগ্য। তাদের কাছ থেকেই শিখে নেয়া কিভাবে ঘুড়ি বানাতে হয়। বাশেঁর কাঁচা কঞ্চি কেটে, রঙিন কাগজ, ভাতের আঠা দিয়ে, লম্বা রংবেরঙা লেজ লাগিয়ে কিভাবে ঘুড়ি ওড়াোত হয় তা আমি ভালোই শিখেছিলাম। কলকাতার মতো আমাদের কাটাকুটি কম্পিটিশান কমই ছিল। তাই সুতায় কাঁচ ভাঙার ধারালো মার দেয়া খুব কমই হয়েছে। মজা হতো যখন মাঠের এমাথা ওমাথা দৌড়ে গলদঘাম হয়ে ড়ুড়িটা যখন আকাশে ওড়া শুরু করতো। কেননা নিচে বাতাস কম থাকে, ওপরে বাতাস বেশি। তাই একবার আকাশে ঘুড়ি উঠলে আর চিন্তা নেই, সারাটা দিন উড়তেই থাকে। একবার ভাবলাম সারাদিন যদি ঘুড়ি উড়ে তবে রাতেও নিশ্চই উড়ার কথা। এই ভেবে সন্ধ্যায় একটি গাছের আগায় ঘুড়ির সুতা বেধে বাড়ি চলে আসলাম। ভোর না হতেই মাঠে দৌড়! কোথাই আমার ঘুড়ি? দেখা গেল ঘুড়ি আকাশে নেই। সুতার নাল খুজেঁ ঘুড়িটা পাওয়া গেল কল্যানপুরের এক বাড়ি ছাদে। কুয়াশায় ভিজে গেছে। এই ঘুড়ি আর আকাশে উড়বেনা।
একদিন এক ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেল মিলনপুরে। সুকুমারদার মা, আমার বাবার দূর সম্পর্কের বোন। তার ছোট দুই ছেলে আমাদেরই সমবয়সী অনেকটা আমাদের দু-ভাইয়ের মতোই পিঠাপিঠি। কি হয়েছিল জানি না। কোন একটা সংক্রামক ও ভয়ানক এক রোগে দুই ভাই আক্রান্ত হলো এবং কিছু দিনের মধ্যেই তারা মারা গেল। হাতপাতাল থেকে তাদের লাশ আনা হল বুরগি ( চাকমাদের হাতে বোনা চাঁদর) আর বেতের মাদুরে মুড়ে। তাদের মা হয়ে গেল পাগল প্রায়। এলোচুলে তিনি বাড়ির উঠানে বসে মাতম করতে লাগলেন। গ্রামের সবাই দেখতে এল। আমরাও ভয়ে ভয়ে বড়দের পায়ের ফাঁকে আমাদের বন্ধুদের দেখে এলাম। জীবিত মানুষ কত আপন। মারা গেলে, মুহূর্তেই কত পর!...বিকালে মাঠে খেলছি স্বভাব মতো। হঠাৎ দেখি এক পাগলিনী আমাদের দিকে আলুঠালু বেশে তেড়ে আসছে। আমি আর আমার ভাই দুজনেই বাড়ির দিকে দৌড় লাগালাম প্রাণের ভয়ে। দৌড়ানোর সময় আমি বুঝে গিয়েছিলাম বাড়িতে গেলেও রেহাই পাওয়া যাবে না। আমি বাড়ি থেকে মুখ ঘুড়িয়ে দৌড়তে লাগলাম দ্বিকবিদিক। সুমন ছোট , সে গেল মায়ের কাছে। সেই পাগলিনী মা দুই সন্তান হারানোর বেদনায় সুমনকে মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে চুমো খেতে লাগল। তারপর থেকে সেই পিসিকে কোনদিন প্রকৃত সুষ্ঠ দেখিনি। সেই ব্যথা তিনি জীবনে আর ভুলতে পারেনি। এমনকি অনেক পরে দেরিতে আর এক সন্তান জন্ম দিয়েও না। আমিও ভুলতে পারিনি আমাদের প্রথম বন্ধু হারানোর দুঃখ-শোক।
দীঘিনালায় আমার জন্মের দু-বছর পর জন্ম হলো আমার ছোট ভাইটির। এইটিই আমার জীবনের প্রথম স্মৃতি। খাগড়াছড়িতে আমাদের পুরোনো বাড়িতে, যেটি ভেঙে এখন নতুন বাড়ী করা হয়েছে, সেখানে মাকে শুয়ে রাখা হয়েছে বিছানায়। আমি কান্না করছি কেননা আমাকে মায়ের কাছে যেতে দেয়া হচ্ছে না। আমার দিদিকে দেখতে পাই কৌতুহলী দৃষ্টি, বোধকরি ছটফট করছে। এগিয়ে দিচ্ছে দরকারী কোন জিনিস পত্র। বুড়ি দাইমা অপেক্ষা করছেন সেই মাহেন্দ্র ক্ষনটির জন্য। ভাইটি হওয়ার আগে মাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকতে খুবই আরাম লাগতো। বিশেষ করে বুকের দিক থেকে। মায়ের পেটের নরম চর্বিতে হাত না বুলিয়ে না ঘুমালে যেন ঘুমই হতো না। মনে পড়ে মাকে সামনের দিক থেকে আলিঙ্গন করতে চাইতাম যা ভাইটি হওয়ার পর আর সে সুযোগ থাকল না। তাই মনের মধ্যে একটু ব্যথা রয়ে গেছে বোধয়। বাবাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে কোন আরাম নেই। তার শক্ত শরীর আলিঙ্গন করেও সুখ নেই, ঘুমও পায় না।
ভাইটি যখন একটু বড় হলো, সে হলো আমার প্রধান খেলার সাথী। মনে পড়ে সারাটা সকাল মাঠে, বিশেষ করে খাগড়াছড়ি ছড়ায় খেলাধুলা করে কখন বেলা গড়িয়ে যায় তার খেয়াল থাকতো না। সারাদিন খেলাধুলা শেষ করে বাড়ি ফিরতে ছিল দারুন ভয়। কিভাবে মায়ের সামনে যাবো, কে আগে যাবে। কেননা যে আগে যাবে তার পিঠে পড়তে পারে প্রথম বেতের চাবুক! বাড়ির বেড়ার আড়ালে মাকে লক্ষ্য করতাম উঁকিঝুকিঁ দিয়ে, আগে মায়ের রাগ খেয়াল করতে হতো। বুদ্ধি করে ছোট ভাইটিকে আগে বাড়িয়ে দিতাম, যেন সহজে মার না পড়ে। সে মায়ের সাথে মিলে যাবার পর, আবস্থা স্বাভাবিক হলে আমিও নিজেকে মিলিয়ে নিতাম। মাঝে মাঝে এমন হয়েছে খেলতে খেলতে বেলা গড়িয়ে হয়তো দুপুরের খাবার সময় পেরিয়ে গেছে। মা হয়তো বাশেঁর কঞ্চি নিয়ে মারতে মারতে আমাদের নিয়ে গেলেন। মা যখন এগিয়ে আসতেন তার হাত থাকতো পেছনে লুকিয়ে রাখা। আগে থেকে বোঝার উপাই নেই হাতে বেত আছে কি নেই। তাই মা আমাদের নিতে এলেও আমরা পালিয়ে থাকতাম। যখন বুঝতে পারতাম হাতে বেত নেই তবেই ধরা দিতাম। খাগড়াছড়ি ছড়ার পাড়ে জমতো বালির ছোট টিলা, যা ছিল আমাদের প্রথম পছন্দের খেলার জায়গা। বর্ষাকালে এ ছড়াই প্রচুর পানি থাকতো। মা তখন পানিতে যেতে দিতেন না।
শীতকালে জলের ধারা ছোট, লাফিয়েও পার হওয়া যায়। আর পাড়ে পড়ে খাকতো বালির টিলা। বিশেষ করে ছড়ার বাকেঁ বাকেঁ বালি জমতো। ভেজা আর শুকনো বালি দিয়ে বানাতাম একধরনের গোলা। কার গোলা কত বেশী শক্ত সেটাই হতো পরীক্ষা! মজার খেলা । ঢালু জায়গা দেখে গোলা গড়িয়ে যাওয়ার দুটো রাস্তা তৈরী করা হতো। নিচে যেখানে দুটি গোলা পরস্পর আঘাত লাগবে সেটি থাকতো ঢালুর শেষ প্রান্তে। এইটিই ছিল যুদ্ধক্ষেত্র বা কুরুক্ষেত্র, যেখানে জয়-পরাজয় নির্ধারন হতো। বালির মধ্যে কতগুলো গুনের ভাগ আছে। যে বালিগুলো সবচেয়ে মিহি ও পরিষ্কার তা দিয়েই সবচেয়ে শক্ত গোলা তৈরী করা যায়। তবে হাতেরও দক্ষতা প্রয়োজন, নিপূণ হাতের মসৃন ছোয়াঁয় ধীরে ধীরে তৈরী করতে হয় গোলা-যুদ্ধের মোক্ষম অস্ত্র। রণক্ষেত্রের ঢালুত্ব বুঝেও গোলাটা বানাতে হয়। পথ বেশী লম্বা হলে গোলা করতে হয় ছোট। দীর্ঘ পথে বড় গোলা নিজে নিজে গড়িয়েই ভেঙে যায়, শত্রু পক্ষকে আঘাত করার আর শক্তি থাকে না। তবে রাস্তা ছোট হলে বড় গোলার সাথে চোট গোলা পেরে উঠে না। এই বুঝেই আমার চেষ্টা থাকতো সব সময় শক্তিশালী গোলা বানানোর। মাঝে মাঝে ছোট ভাইটিকে দু-একটি গোলা দিয়ে দিতাম হয়তো।
ছড়াটির বাকেঁ আর একটি মজার খেলা ছিল আমাদের তা হলো-হ্যন্ডসাফ খেলা। মূলত ওটা ছিল হ্যন্ডস-আপ খেলা! শত্রুকে যে আগে দেখে নাম বলতে পারবে সেই বিজয়ী। দুই পক্ষ ভাগ হয়ে বাকেঁর র্শীষ বিন্দুতে শেষ দেখা হতো দুই গ্রুপের। সবাই সবাইকে দেখা-দেখীর পর সবাই লকিুয়ে পরতো নদীর বাকেঁর বাঁশঝাড়ে। লুকিয়ে অপেক্ষা করতো কখন শত্রু সামনে আসে। এক পক্ষের সবাইকে দেখে ফেললে সেই পক্ষ পরাজিত ধরে নেয়া হতো। আমাদের গ্রাম মিলনপুরে তখন খেলার সাথীর অভাব নেই। বাচ্চুগুলো (রনেল দেওয়ান), মুনি/মনি (রাজীব চাকমা), নোবেল ও রুবেল, বুলটন ও নিটন, অক্কনা (রাকেশ চাকমা), চিজি, তকেল, সুকুমারদার ছোট দুই ভাই, বারাবো (প্রিয়তম চাকমা), সুজন, গোড়াইয়ে আরো অনেক কত বন্ধুর পাল! একটি দিন বন্ধুহীন থাকতে পারতাম না। মনিরা পাঁচ ভাই আর তাদের বাবা-মা ছিলেন তুলনামূলক আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাই তাদের বাসার চারপাশে আমরা সবাই ঘুরঘুর করতাম। পাঁচ ভাই ১/২ বছরের ফারাক মাত্র। তাই পাড়ার কেউ না কেউ পাচঁ ভাইয়ের এক ভাই বন্ধু হিসাবে মিলতো। একদিন তাদের এক ভাইয়ের দেখা না পেলে আমাদের দিন চলে না!
শীতের শেষে যখন বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু করে তখন সবার মনে বয়ে যায় আনন্দ হিল্লোল। মিলনপুরের মাঝখানে ছোট ধানী জমির মাঠ,ধান কাটা হয়ে গেলে তা খেলার মাঠে রূপ নিতো। এই বিশাল মাঠে তখন আমাদের দৌড়ঝাপঁ- লাফালাফি-দাপাদাপি ইত্যাদি ঠেকায় কে?! বিকালের প্রথম কাজ ছিল শুকনো খড়ি বা খড় যা মাঠে পরে থাকতো তা একত্র করে আগুন দিয়ে ধোঁয়া সৃষ্টি করা। সেই ধোয়াঁয় বেলুন ওড়ানো ছিল আমাদের খেলা। কত বেশী দূর আকাশে বেলুন ওড়ানো যায়, তাই ছিল আনন্দ। ভাগ্য খারাপ হলে আগুনের ফুলকী লেগে বেলুন ফেটে গেল বা সুঙসুঙি লেগেও বেলুন ফাটতে পারে। কিন্তু যতক্ষন না ফাটছে ততক্ষন গোল হয়ে আগুনের চারপাশে আমাদের উল্লাস, চিৎকার, হৈ-হত্তগোল আর থামে না। চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলে তবে ঘরে ফেরার পালা। সারাদিন খড়খড়ির সাথে খেলে সন্ধায় হাত-পা ধোয়ার সময় শুরু হয় কঠিন চুলকানী। কেননা সুঙসুঙিতে পানি লাগলে তা দারুন চুলচুলি সৃষ্টি করে। তার উপর শীতের প্রচন্ড কামড়। গরম কাপড় গায়ে জড়িয়ে পড়তে বসা। হারিকেন বা চেরাগের আলোয় পড়তে হয়েছে বেশ কয়েক বছর।
মিলনপুরে বিদ্যুত এল আশির দশকের শেষ অংশে ১৯৮৬ তে। বিদ্যুতের পর এল বৈদুতিক সামগ্রী, স্ত্রী বা আয়রন, টেবিল ফ্যান, টিভি এল সেকেন্ড হ্যন্ড কয়েক বছর পর মামার বাড়ি থেকে। কিন্তু কপাল খারাপ আমাদের, দু-তিন বছর পর টিভি নষ্ট হয়ে গেল। মেকানিক বললেন পিকচার টিউব খারাপ, যা ছিল ঠিভির প্রাণ তাই হলো অকেজো। থান্ডার কেটস ছিল আমাদের সবার প্রিয় কার্টুন। আর এদের তলোয়ারের মতো বাশেঁর তলোয়ার বানিয়ে খেলেছি এক-দু বছর। দীঘিনালা থেকে আজু আসলে কোন কোন দিন বাংলাদেশের পতাকা দেখা পর্যন্ত চলতো টিভি দেখা। ’৮৬ র বিশ্বকাপ ফুটবল দেখে বাংলাদেশের সবাই ম্যারাডোনা তথা আর্জেনটিনার সাপোর্টার বনে যায়। ’৯০ এর বিশ্বকাপে তারা সবাই হতাশ যখন পশ্চিম জার্মানী কাপ নিয়ে গেল। মনে আছে ইতালীর বেইজিও কি মর্মান্তিক ভাবেই না টাইব্রেকার স্যুটে গোল পোস্টের মাথার উপর দিয়ে বল পাঠিয়ে দেন। ’৯৪ এর বিশ্বকাপ দেখার পর আমরা অনেকেই হলাম ব্রাজিল ফ্যান। বেবেতো, রবার্টো কার্লোস, দুঙ্গা মনের মাঝে গাথা হয়ে যায়। বইয়ে পড়া ফুটবলের জাদুকর কালো মানিক পেলে। পর পর তিন বারের বিশ্বকাপ বিজেতা একমাত্র অরিজিনাল গোল্ডকাপ যারা ঘরে নিয়ে গেল। ’৯০ এ এরশাদ সরকারের পতনের আগে প্রতি শুক্রবার বিকালে প্রচার হতে লাগল রাজ্জাক, সাবানা, ববিতার বাংলা ছায়াছবি। পরে জেনেছি এ নাকি সরকারেরই চাল, মুভি দেখতে গিয়ে যেন সরকার বিরোধী মিছিলে না যায়! রবিবার সকালে ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা যেতো ভারতের টিভি চ্যানেল, মহাভারত বা রামায়ন, তবে এ্যন্টনার বাঁশ ঘুড়াতে হতো বেশ কয়েক বার। রামায়ন শুনতে গিয়ে বহুবার পাকাচুল তুলতে হয়েছে নতুবা মালিশ দিতে হয়েছে যার মধ্যে ডাঃ চিমুনী কাকা অন্যতম। আর একদিন মহাভারত দেখার এমনি একটি সকালে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মাঝে আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হলো হঠাৎ এক কাপড়ে। মায়ের হাতে তার দু-এক রতি সোনাদানা বা বাবার দেয়া কাগজপত্রের ফাইল, দুমুঠো ভাত খাবার সময়ই নেই। আমাদের পুরো গ্রামবাসীকে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হলো গ্রামের মাঠের ওপারে চেয়ারম্যান জতিন্দ্রলাল ত্রিপুরার বাড়িতে। বাবা আর জমিতে কাজ করার একজন ননীলাল কাকা বা নাগজ্জ্যে কাকা বাড়িতে রয়ে গেলেন। ত্রিশিখাদিরা বোনদের মধ্যে ঝগড়া লেগে গিয়ে কেউ খাবার খাচ্ছিল না আমাদের ভাগে জুটে গেল সেই খাবার। কিছুক্ষনের মধ্যে পানখাইয়াপাড়া আর মহাজন পাড়ার আকাশে কালো ধোঁয়া আর আগুনের লাল লেলিহান শিখা জ্বলতে লাগল। মিলনপুরের যে বাড়িটি বাজারের সবচেয়ে কাছে তা হলো বন্ধু বাচ্চুগুলোদের বাড়ি। সেই বাড়িটি একদল দুর্বৃত্ত এসে আগুন লাগিয়ে দিল। চেয়ারম্যানের বাড়িতে কয়েকজন পুলিশ ছিল, তারা আর কিছু গ্রামের যুবক গিয়ে বাড়িটির আগুন নেভায়। আর বাধা পেয়ে দুর্বৃত্তের দল গ্রামে ধুকে অন্য গ্রামের মতো আগুন লাগানো সুযোগ পেল না। চলে গেল অন্যদিকে।
সন্ধ্যার সময় এক দুই ঘন্টা পড়া হলো কি হলো না, খিদে লাগত ব্যাপক। তারপর ঘনঘন পাকঘরে যাতায়ত! মায়ের একটি রান্না হয়ে গেলে চেখে দেখা মায়ের অগোচরে। পড়তে বসলে আমার ভাইটির বারবার প্রসাব পেয়ে বসে, পানির তৃঞ্চা পায়। পড়া পড়তে হয় জোড়ে আওয়াজ করে যেন বাবা/মা পাকঘর থেকে শুনতে পায়। পড়ালেখা-লেখাপড়া হলো আমাদের বাবার প্রথম এবঙ একমাত্র চাওয়া। যত অন্যায় করি না কেন, পড়াশুনা করতে দেখলে বাবা খুশি। তাই সারাদিন যত খেলাধুলা বা ঘুরাফেরা করি না কেন সন্ধা ও সকাল কয়েক ঘন্টা লেখাপড়া ছিল আমাদের তিন ভাই-বোনের নিয়মিত কাজ। বাবার সাথে আমার ভয়ানক স্মৃতি হচ্ছে তার হাতে গরুমারার বেত দিয়ে প্রথম মার খাওয়া! তিনি স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি জমিতে ধান বা বিবিধ শস্য চাষ করতেন। ধান মাড়াই করতেন বাড়ির উঠানে গরুর পা দিয়ে! মধ্য উঠানে একটি খুটির সাথে ২ বা ততোধিক গরু বেঁধে চক্রকারে ঘুড়ানো হতো বিছিয়ে দেয়া ধানের শিষের উপর। গরুর পায়ের আঘাতে ধানগুলো শীষ থেকে ঝড়ে পড়ে তলায়। কিন্তু তারা ক্লান্ত হলে হাটতে চায় না, তখন বেত্রাঘাত করার প্রয়োজন হয়। তাই উঠানের এক কোন রাখা থাকে কিছু বেত। সম্ভবত এমনই এক দিনে তিনি স্কুলের বাচ্চাদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করছিলেন। আমি কি কারনে জানি না উনাকে খুব বিরক্ত করছিলাম হয়তো। তিনি রেগে গিয়ে আমাকে খুব মার দিলেন সেই গরুমারার বেত দিয়ে। এই মারের পর জীবনে দ্বিতীয় বার বাবার হাতে আর মার খাইনি। হয়তো তিনিও মনে মনে কষ্ট পেয়েছিলেন খুব। পরে কখনো হাতের মুষ্ঠি পাকিয়ে মাথায় একটু ঘষে দিয়েছেন। কিন্তু মার আর মারেননি। ছোট ভাই বা দিদি কাউকে কোনদিন মারধোর করতে দেখিনি। তবে মার হাতের মার ছিল একদম ডালভাত! কোনদিন সকালে একবার ও বিকালে হয়তো আরেকবার মার খেয়েছি মার হাতে। তবুও একটু বড় হতেই মা’ই ছিলেন আমাদের ভাইবোনদের বন্ধুর মতো।
মেয়ে বন্ধুদের বা দিদিদের একটি খেলা খুব প্রিয় ছিল- বৌচি খেলা। তারা মাঝে মাঝে আমাদেরকেও সাথে নিতো।বর্গাকার সদৃশ একটি জমির দুই কোনায় দুটি বাড়ি মানে পায়ের সেন্ডল দিয়ে বেরিকেড বানিয়ে ঘর বানাতে হতো। দুটি টিম গড়া হতো ৪/৫ জন নিয়ে। মূল কাজ ছিল এর একটি ঘর থেকে অন্য একটি ঘরে বৌ (মানে যে কোন একজন যাকে বৌ বলে ধরে নেয়া হলো) নিয়ে যাওয়া অপর পক্ষের স্পর্শ ছাড়া। বৌ পক্ষের একজন কাবাডির মতো নিশ্বাস বন্ধ করে চিঁইই শব্দ করতে করতে বৌকে স্পর্শ করার জন্য অপেক্ষমান অপর পক্ষের সদস্যদের তাড়া করতো। বৌ পক্ষের জন যদি অন্য দলের কাউকে ছুতে পারে তাহলে সে খেলা থেকে আউট। নিশ্বাস শেষ হলে সে ফিরতো বাড়িতে। তারপর অন্যজনের পালা । আর বৌ এর চেষ্টা থাকত কখন অন্য বাড়িতে যাবার রাস্তা ফ্রি হচ্ছে যেন অপর দলের কেউ তাকে ছুতে না পারে। বৌ অপর বাড়িতে পৌছে গেলে বৌ পক্ষ জয়ী বা অপর পক্ষ বৌকে ছুয়ে দিলে অপর পক্ষ জয়ী।
ছেলেদের আর একটি মজার ও একই সাথে ব্যথ্যা পাওয়ার খেলা ছিল টেনিস বল দিয়ে অপর খেলোয়ারের গায়ে ছুড়ে মারা। শর্ত হলো বলটা যেখানে পাওয়া গেল, সেখান থেকেই আপর খেলোয়ারদের দিকে ছুঁড়ে মারতে হবে। যার পিঠে বল লাগতো সেই ব্যথ্যা পেতো আর সাথে মজাও। এমনি করে সারাটা বিকেল মিলনপুরের মাঠটি আমরা ছেলে-মেয়েরা হুল্লোরে মাতিয়ে রাখতাম। কোন বছর শীতের শেষে বসন্তের আহবা ফিরিলে জাপানী শিশুদের মতো আমরাও ঘুড়ি ওড়াতাম সেই মাঠেই। আমাদের ২/৩ বছরের বড় দাদারা ছিল ঘুড়ি ওড়ানোয় ওস্তাদ। যাদের মধ্যে কালাইয়েদা, সুকুমারদা বা ঝন্টুদা উল্লেখযোগ্য। তাদের কাছ থেকেই শিখে নেয়া কিভাবে ঘুড়ি বানাতে হয়। বাশেঁর কাঁচা কঞ্চি কেটে, রঙিন কাগজ, ভাতের আঠা দিয়ে, লম্বা রংবেরঙা লেজ লাগিয়ে কিভাবে ঘুড়ি ওড়াোত হয় তা আমি ভালোই শিখেছিলাম। কলকাতার মতো আমাদের কাটাকুটি কম্পিটিশান কমই ছিল। তাই সুতায় কাঁচ ভাঙার ধারালো মার দেয়া খুব কমই হয়েছে। মজা হতো যখন মাঠের এমাথা ওমাথা দৌড়ে গলদঘাম হয়ে ড়ুড়িটা যখন আকাশে ওড়া শুরু করতো। কেননা নিচে বাতাস কম থাকে, ওপরে বাতাস বেশি। তাই একবার আকাশে ঘুড়ি উঠলে আর চিন্তা নেই, সারাটা দিন উড়তেই থাকে। একবার ভাবলাম সারাদিন যদি ঘুড়ি উড়ে তবে রাতেও নিশ্চই উড়ার কথা। এই ভেবে সন্ধ্যায় একটি গাছের আগায় ঘুড়ির সুতা বেধে বাড়ি চলে আসলাম। ভোর না হতেই মাঠে দৌড়! কোথাই আমার ঘুড়ি? দেখা গেল ঘুড়ি আকাশে নেই। সুতার নাল খুজেঁ ঘুড়িটা পাওয়া গেল কল্যানপুরের এক বাড়ি ছাদে। কুয়াশায় ভিজে গেছে। এই ঘুড়ি আর আকাশে উড়বেনা।
একদিন এক ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেল মিলনপুরে। সুকুমারদার মা, আমার বাবার দূর সম্পর্কের বোন। তার ছোট দুই ছেলে আমাদেরই সমবয়সী অনেকটা আমাদের দু-ভাইয়ের মতোই পিঠাপিঠি। কি হয়েছিল জানি না। কোন একটা সংক্রামক ও ভয়ানক এক রোগে দুই ভাই আক্রান্ত হলো এবং কিছু দিনের মধ্যেই তারা মারা গেল। হাতপাতাল থেকে তাদের লাশ আনা হল বুরগি ( চাকমাদের হাতে বোনা চাঁদর) আর বেতের মাদুরে মুড়ে। তাদের মা হয়ে গেল পাগল প্রায়। এলোচুলে তিনি বাড়ির উঠানে বসে মাতম করতে লাগলেন। গ্রামের সবাই দেখতে এল। আমরাও ভয়ে ভয়ে বড়দের পায়ের ফাঁকে আমাদের বন্ধুদের দেখে এলাম। জীবিত মানুষ কত আপন। মারা গেলে, মুহূর্তেই কত পর!...বিকালে মাঠে খেলছি স্বভাব মতো। হঠাৎ দেখি এক পাগলিনী আমাদের দিকে আলুঠালু বেশে তেড়ে আসছে। আমি আর আমার ভাই দুজনেই বাড়ির দিকে দৌড় লাগালাম প্রাণের ভয়ে। দৌড়ানোর সময় আমি বুঝে গিয়েছিলাম বাড়িতে গেলেও রেহাই পাওয়া যাবে না। আমি বাড়ি থেকে মুখ ঘুড়িয়ে দৌড়তে লাগলাম দ্বিকবিদিক। সুমন ছোট , সে গেল মায়ের কাছে। সেই পাগলিনী মা দুই সন্তান হারানোর বেদনায় সুমনকে মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে চুমো খেতে লাগল। তারপর থেকে সেই পিসিকে কোনদিন প্রকৃত সুষ্ঠ দেখিনি। সেই ব্যথা তিনি জীবনে আর ভুলতে পারেনি। এমনকি অনেক পরে দেরিতে আর এক সন্তান জন্ম দিয়েও না। আমিও ভুলতে পারিনি আমাদের প্রথম বন্ধু হারানোর দুঃখ-শোক।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জানবক্স খান ১৫/০৭/২০২০Thanks to All.
-
ফয়জুল মহী ১৩/০৭/২০২০Excellent
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ১৩/০৭/২০২০চমৎকার।