www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

পাহাড়ি কলেজ লাইফ (অবতাড়না)

নাকের নিচে গোঁফের রেখা। মলিন হাফ র্শাট ও দুবছরের পুরোনো প্যন্ট পরে যে ছেলেটি কলেজের ১ম বর্ষের ক্লাশ রুমের ১ম বেঞ্চ সবার আগে বসে রইল তাকে কেউ চিনতেই পারলো না। সে ভাবছিল নোটিশ বোর্ড ঠিকমত দেখলাম তো! নাকি আর একবার দেখে আসবো? আবার পরক্ষণে ভাবল, না, তেমন তো হবার কথা নয়। আজ জুলাই মাসের পহেলা দিন। আজকেই তো ১ম বর্ষের ১ম ক্লাশ শুরু হবার কথা। নিজের স্কুলে সে ছিল সবচেয়ে ভালো ছাত্র। নাম কিশোর দেওয়ান। তাদের এলাকায় দেওয়ান পারিবার আর একটিও নেই। সব কিছু মিলে নিজের গ্রামে ও স্কুলে তার যথেষ্ঠ পরিচিতি আছে। কিন্তু দূরের এই কলেজে তাকে কে চিনবে! সে চুপচাপ বসে তাই ভাবছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে দুটি অচেনা মেয়ে এসে ক্লাশে ধুকল। তারা সারি বদ্ধ বেঞ্চের অপর পারে গিয়ে নিজেদের আসন দখল করল। কিশোর ভাবছে- এরা কারা, নিশ্চই আমার ক্লাশেরই বান্ধবী। কিন্তু সে কোন কথা না বলে নিজের আনা একটি পুরোনো খাতার দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করল
-ইয়ে…ত’ নাঙান কি? তার কন্ঠ ইতস্তত শোনাল। জবাব এল-
- এমম… কিশোর! কিশোর বেশ লাজুক। সে মুখ তুলে বলল।
-কন্ স্কুলোত্তুন ইচোচ্ছে?
- বড়আদাম হাই স্কুল।
- অ… মুই অনন্যা, অন্য বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে বলল- তেএ বর্ষা। তাদের মুখে মুচকি হাসি। ঠিক মুচকি নয় চাপা হাসি। শুধু মুখের, চোখের অভিব্যক্তিতে বোঝা যায়। কিশোর দেওয়ান মেয়ে দুটি কোন স্কুলের জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সংকোচে করতে পারলো না। অনন্যা বিষয়টি বুঝে জবাব দিল-
-আমি গর্ভানমেন্ট হাই স্কুলত্তুন। আর কিছু অনন্যা বা বর্ষা বলতে যাবে এমন সময় একজন শাড়ি পড়া ম্যাডামই হবে, প্রবেশ করল ক্লাশ রুমে। তিনি ক্লাশে প্রবেশ করলেন হতাশা নিয়ে। বললেন- আর কেউ নেই…! টেবিলে হোয়াইট বোর্ড মার্কার আর ডাষ্টার রেখে আবার বেরিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষনের মধ্যে শুরু হয়ে গেল চাপা হুল্লোড়, অনেকজন ছাত্র-ছাত্রী এগিয়ে আসার শব্দ। ম্যাডাম পেছনে। প্রায় জনা পঞ্চাশেক ছাত্র-ছাত্রী ক্লাশে প্রবেশ করলো। পাহাড়ি-বাঙালী প্রায় সমান সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী। ম্যডাম বললেন-
-শান্ত হও!... আস্তে! আস্তে!... ক্রমে সবাই যার যার আসনে বসে পরল। তিনি বললেন-
-আমি তোমাদের বাংলা শিক্ষক। তারপর দেয়ালে লাগানো সাদা বোর্ডে লিখলেন ‘পরানী চাকমা’। বললেন –পরানী চাকমা আমার নাম। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মার্স্টাস করেছি অমুক সনে। আমি…ইত্যাদি।
ম্যাডামের নাম শুনে কিশোরের হাসি পেল। মনে মেনে ভাবল-চাকমা মেয়ে হিসাবে ভারী সুন্দর নাম। কিন্তু কেমন যেন সেকেলে! ম্যাডামের শাড়িটি বেশ সুন্দুর পরিপাটি করে পড়া। আর বাঙালী ললনার পোশাক হিসাবে শাড়িতে ম্যাডামটিকে কেমন যেন বেমানান মনে হলো তার কাছে। বাঙলী ছাত্রীদের অনেকে বোরকা পড়া বা র্স্কাফ জড়ানো, যা কিশোরের কাছে ব্যতিক্রম দৃশ্য, যা সে স্কুলে দেখেনি। যা হোক এক এক করে দু-তিনটি ক্লাশ হয়ে গেল। আর ক্লাশ হবে না ভেবে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে যাবে এমন সময় চশমাপরা আধ বয়স্ক একজন স্যার ক্লাশে প্রবেশ করলেন। তিনি সবার নাম, স্কুল,ঠিকানা পরিচয় নিলেন। নিজের পরিচয় দিলেন কলেজের প্রিন্সিপাল হিসাবে। ইতোমধ্যে দু-চারজন বন্ধু-বান্ধবীর নাম জানাজানি হয়ে গেছে। অনেকে আগে একই স্কুলের ছাত্র বা ছাত্রী ছিল, তাই তাদের মধ্যে খাতির বেড়ে গেল।
প্রিন্সিপাল স্যার অত্র কলেজের ইতিহাস একটু আলোকপাত করলেন। পাবর্ত্য জেলা শহরের কিছু দূরে এই কলেজ স্থাপিত হয়েছিল তৎকালিন বিশিষ্ট সমাজ সেবক অমুক বাবুর আকুন্ঠ সমর্থনে আর অর্থানুকূল্যে । তখন আমাদের জেলা শহরে যাওয়া লাগতো কলেজে পড়ার জন্য। যা সবার জন্য হয়ে উঠত না। খরচ বেড়ে যেত। কৃষক বাবার পক্ষে তা সম্ভব না হলে লেখাপড়ার সেখানেই সমাপ্তি। কিছু শিক্ষিত বেকার ছিল যাদের তৎপরতায় এলাকাবাসী সব কিছু জোগার করে দিয়েছিল। সকলের স্বেচ্ছাশ্রমে দুটি শ্রেণী কক্ষ ও অফিস স্থাপন করা হল। আর তাদের ছেলেমেয়েরা বাড়িতে থেকে পড়াশুনার সুযোগ পেল। বেশ কিছু নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু এলাকার বেশীর ভাগ লোক চাকমা হওয়ায় চাকমাদের ঐতিহাসিক বিজয়ী রাজা বিজয়গীরি কলেজ নাম করা হয়। ২০১০ সালে শিক্ষাবোর্ডে এই কলেজ শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। তিনি সবাইকে বললেন-তোমাদের মন দিয়ে পড়াশুনা করে যেতে হবে। কলেজের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন থেকে লক্ষ স্থির কর, জিপিএ ৫।
কিশোর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল জিপিএ ৫ হোক বা না হোক ক্লাশে তাকে প্রথম হতে হবে। কারন স্কুলে তার বরাবর প্রথম থাকাই অভ্যাষ। অনেক স্কুলের ১ম/২য় ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে উপস্থিত। কাজেই কাজটি চরম কঠিন হবে, কোন সন্দেহ নেই। ক্লাশ শেষ হতে সে কলেজ প্রাঙ্গন থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটতে লাগল কাছাকাছি টাইগার স্কয়ারের দিকে। সেখানে সমর জ্যোতি মামার দোকানে একটি সবজির থলে সকালে ফেলে গিয়েছিল তা নিতে হবে। নিজেদের ক্ষেতের কিছু সবজি রয়েছে থলেতে, যেটা পৌছেঁ দিতে হবে কাকার বাসায় কাছের একটি ছোট পাড়ায়। মামার দোকান থেকে সবজির থলে নিয়ে সে টমটম গাড়িতে উঠল। আর ভাবতে লাগল, যতক্ষন পাসেঞ্জার পূর্ণ হচ্ছে না টমটম গাড়িটি। বাবা বলেছেন, ধারকরা টাকাগুলো ফেরৎ দিতে আর কিছু দেরী হবে। কিশোর জানে বাবার হাতে টাকা নেই। একমাস আগে কলেজে ভর্তির সময় কাকার কাছ থেকে টাকাগুলো ধার নেয়া হয়েছিল। কলেজে ভর্তি ফিস আর দাদুর ঔষধ কিনতে বাবা ধার চাইতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাত্র হাজার দশেক টাকা একজন কৃষকের কাছে খুব সহজ বা মাত্র নয় কয়েকদিনের মধ্যে জোগার করা। বিশেষ করে যখন বর্ষাকাল কাজের সময়, টাকা খরচের সময়।
টাকাগুলো চাইতে যে রকম লজ্জা বোধ হচ্ছিল, এখন ফেরৎ দিতে দেরী হবে এই কথাটা বলতে তার দ্বিগুণ ল্জ্জা বোধ হতে লাগল। যা হোক টমটম ইতোমধ্যে চলা শুরু করেছে। বাসায় পৌঁছে দেখে কাকা বাড়িতে নেই। সে কাকীর হাতে সবজিগুলো গুছিয়ে দিয়ে বলল-
-কাক্কী, বাবা কইয়েদে কাক্কা টেঙাগুন ফিরাদে ভেলে আর ১/২ মাচ লাগিবো!
- অইয়েআয়, ত’ বাবারে কোচ, যেক্কে সেক্কে দিলে অহল্! কাকীর বলল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন-
-তর ক্লাশ ফগদাঙ ন’অহয়?
-অইয়ে কাক্কী, ইক্কু ক্লাশ গুরি তোমা সিদু এলুঙগে।
- অহ্, দোলে পরিচ, বুজন। গমেদালে পরি পেবে…
হঠাৎ কিশোরের মনে একটি বুদ্ধি এল বলল-
-কাক্কী, ইদু চিগোন স্কুলো পো পেবনি, পোরেদুঙ?
-পারিবে বুঝ পোরে! ন’লে ধ’ ত’ হুত্তোপুত ভেইবোরে এক্কা চে’ পারিলিন!
- কন্ ক্লাজত উত্তেদে চিজি?
-এ বজর সিক্সোত উত্তে, পাইভোত রেজাল গম ন’অয়।
- কাক্কী, মুই পারিম! কিশোর আপন মনে হাসল বুঝি। বলল-
-মর কলেজ থুম অহ্ লে ইন্দি একবার গুরি যেম আ’য়। কাকী বললেন-
- আচ্ছা, চাং, মুই ত’ কাক্কারে কোম!

সমর কাকার বাড়ি থেকে কিশোর দেওয়ান যখন বেরিয়ে এল তখন সে বেশ আত্নবিশ্বাসী। আজ সকালে সে ভাবছিল বাবাক কিভাবে সাহায্যে করা যায়। কেননা শুধু কৃষিকাজ করে আজকাল আর আগের মতো আয়-রোজগার নেই। কেবল কয়েক বছর পর পর জমি বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। বড় দুই দাদার পেছনে অনেক খরচ করেও কোন লাভ হয়নি। দুজনেই পড়াশুনা ভালোভাবে শেষ করতে পারেননি। এখন কেবল বাবার বোঝা হয়ে আছেন। কিশোর মনে মনে ভাবল-আমার পড়াশুনার খরচ এবার আমিই রোজগার করব। কেননা তাকে অনেক বড় হতে হবে। অন্তত পক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রিতো করা চায়ই। পরেরটা পরে দেখা যাবে।
সে গভমেন্ট স্কুলের সামনে দাড়িয়ে ছিল টমটমের অপেক্ষায়। দেখল অনন্যা আর বর্ষা দুই বান্ধবী হেঁটে এগিয়ে আসছে। ওরা কাছে আসতেই রাস্তার ওপার থেকে শুভেচ্ছা স্বরূপ হাত নাড়িয়ে ওদের বিদায় বা হাই জানাল। কিশোর তাকিয়ে দেখল দুই বান্ধবী হেটে চলেছে। সে ভাবল-বর্ষা বোধয় একটু বেশী সুন্দর! কিন্তু কথা বলে না! টমটম এসে গেল, সে টমটমে চড়ে বসল। কিশোরের যাবার পথ অনেক বাকী। উন্মুক্ত জীবন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সে এগিয়ে যেতে লাগল সম্মুখপানে।

(২)
বর্ষা চাকমা বরাবরই ভালো ছাত্রী। এসএসসি পরিক্ষায় আরো একটু ভালো করলে জিপিএ-৫ পেতে পারতো। কিন্তু বেরসিক ভাবে শরীরটা অসুষ্ঠ না হলে সে ঠিকই জিপিএ-৫ পেতো। একটুর জন্য ওটা মিস্ হয়ে গেল। মনে মনে কিছু দিন দুঃখ ছিল। তবে কাউকে বঝেতে দেয়নি। তার কাছের বান্ধবী অনন্যাও খুবই ভালো পড়াশুনায়। সেও এবারের মতো জিপিএ-৫ পেল না। বর্ষার আশা ছিল রেজাল্ট ভালো হলে বাবাকে বলবে চট্টগ্রাম বা ঢাকায় কোন কলেজে ভর্তি হতে দিতে। রেজাল্ট পাবার পর বাবা বললেন-বাড়ির কাছেই কলেজ, বাড়ীর ভাত খেয়ে কলেজটাও এখানেই পড়। ইউনিভারসিটিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাছ। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে জোড় করে আর কিছু বলতে পারেনি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এখানেই পড়বে, তবে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ তুলে ছাড়বে। মেয়েটি ভেতর থেকে দারুন জেদী, চেহারা দেখলে বোঝার উপাই নেই। মনে হয় সাধারন মিষ্টি একটি মেয়ে, হয়তো খানিকটা ভোলা টাইপের। কলেজ শুরু হবার আগের দিন অনন্যা ফোন করে বলল- কেল্ল কি উরিবে?
- কিয়া !? কলেজ’ ড্রেস আগে ধ”!
- তা ধ’ আগে, পইল্লে দিনত সিবে ন’ পিনিলেউ চলিব।
- সালোয়ার-কামিজ পিনিবোং নাহি?
- আচ্ছা, বরং পিনোন পিনি যেই! বর্ষার কন্ঠে কৌতুক।
- পাগল অহ্উচ নাহি তুই?! অনন্যার বিরক্তীর ছল।
- ত’ কলেজ’ সুলুম্মো ডেলিভারী দিওন?
- নাদে, এজেত্তে কল্লে/পরশু তেএ পেম্বে।
- বুঝোছোং!... তুই সালোয়র কামিজ পিনি এইচ। মুই কলেজ’ ড্রেস।
কলেজের রূটিন অনুযায়ী ক্লাশ শুরু হওয়া কথা সকাল ৯টায়। কিন্ত ৮টার কিছু পর অনন্যা বর্ষার বাসায় হাজির। তখন বর্ষা সালোযার কামিজ পরেছে মাত্র, ওরনাটা বুকে জড়ায়নি। অনন্যা বলল-
-বাহ! বাহ! চমৎকার! তার মুখে বিষ্ফোরিত হাসি। তাহলে একট সেল্ফী হয়ে যাক বান্ধবী। তারা মাঝে মাঝে বাংলায়ও কথা বলে। বিশেষত কিছু শব্দ যখন চাকমা ভায়ায় খুঁজে পাওয়া না। আর যখন কেউ আদিখ্যেতা করে কিছু বলে।
বর্ষা টানা চোখে কাজল পড়তে পড়তে বলে- না না, এখন না! কলেজের সামনে গিয়ে ছবিটা তুলতে হবে। অনন্যা কথাটা সায় দিয়ে বলে- এখন চলো ক্লাশ শুরু হতে সময় বাকি নেই। তার যেন তর সইছে না। সে পড়েছে লাল রঙের রাজস্থানী ডিজাইন ঘাগড়া সাথে চুড়িদার কামিজ। লম্বা চুল বেনী করে গোছানো।
বর্ষা পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে ২/৩ টি ক্লীপ জুড়ে দিলে চুলের গোড়ায়। তাতেই দারুন সুন্দর মানিয়েছে তাকে। এই গরমে খোলা চুলই পছন্দ তার। মেরুন কালারের সালোয়ার আর কামিজ মেচিং করা। একটু উচু হিল জুতো। আলমিরা থেকে মাংকি ব্যাগ ও নতুন মোবাইল ফোন । ঢাকা-চট্টগ্রামের দুঃখ ভোলার জন্য বাবা তাকে এটি কিনে দিয়েছে Symphony র শো রুম থেকে। বর্ষাদের বাড়ি থেকে কলেজ ১০ মিনিটের হাঁটা পথ। টমটমে চড়লে ৫ মিনিট। ঠমটমে উঠে বর্ষা ভাবল একটু বেশি সাজগোজ হয়ে গেল কি? টমটমের আধ বয়স্ক ড্রাইভার বারবার পেছন ফিরে তাকাতে চাইছে। চাঁটগাইয়া ভাষায় জিজ্ঞেস করল – আজ তোঙারর কলেজ শুরু অহয়েনাহ?! ফর্সা রাঙা দুই বান্ধবী চোখাচোখি করে হাসল একটু। যা হোক তারা দুই বান্ধবী টমটমেই পৌঁছুল কলেজের নব নির্মিত গেইতে। বর্ষার কথা মতো ছবি তোলা হল। যা কলেজ শুরু হবার আগে অনন্যার Facebook ওয়ালে শোভা বৃদ্ধি করতে লাগল। সে স্মার্ট মোবাইল ফোন কিনেছে ৯ম শ্রেণীতে থাকতে। বর্ষা মোবাইল পেয়েছিল ১ বছর পর । বর্ষা ছবি আপলোড করবে রাতের বেলা, ইন্টারনেটে এখনো তার এডিকশান হয়নি। ওরা ক্লাশে গিয়ে দেখল কেবল একটি মাত্র স্টুডেন্ট উপস্থিত। চুলে তেল নেই, শুকনো মুখে ছেলেটি কেমন যেন আনমনা। তাদের দেখে নত শির আরো বেশী নত হয়ে গেল। অনন্যার মাধ্যমেই জানা গেল ‘কিশোর’ ছেলেটির নাম। বর্ষা কথা বলার সময় পেল না। বাংলা ম্যাডাম ক্লাশ চালু করে দিলেন। ম্যাডামের নির্দেশে অনেকেই তাদের নাম, পরিচয়, স্কুল ইত্যাদি বলে চল্ ল। আর থেমে থেমে উঠল হাসির রোল। কেননা, এতগুলো নতুন মুখের সামনে নিজের কথা বলতে গিয়ে তাদের কথা জড়িয়ে গেল।অধিকাংশ পাহাড়ি ছেলে মেয়েদের বাংলা বলায় আড়ষ্ট। তাতেই মজা পেল সবাই। ম্যাডাম কলেজের নিয়ম কানুন ইত্যাদি বলতে লাগলেন। যেমন কলেজের ড্রেস পরিষ্কারভাবে পড়ে আসতে হবে। ক্লাশ চলাকালিন গাছ তলায় আড্ডা মারা চলবে না। মিনিমাম ৭০% ক্লাশ উপস্থিত থাকতে হবে, না হলে পরীক্ষা দিতে দেয়া হবে না। বর্ষার পরানী ম্যাডামকে ভালো লেগে গেল। তার বাংলা উচ্চারনে শ,স, ত, ট তে পার্থক্য খেয়াল করা যাচ্ছে। চাকমাদের কথায় উচ্চারনে যা একদম বোঝা যায় না।
কলেজ শেষে বর্ষা, অনন্যাসহ আরো ৫/৭ জন বান্ধবী গেল কলেজের কাছে ছোট্ট একটি বৌদ্ধ মন্দিরে। কলেজের অদূরে এই বৌদ্ধ বিহার পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের । আশপাশের ৪/৫টি পাড়ার চাকমা, মারমা ও বড়ুয়ারা এখানে পূজা করতে আসেন। কয়েকজন শ্রমন বা জুনিয়র ভিক্ষু দেখা গেল বিহার প্রাঙ্গন সাফ করছে। আসলে গতকাল রাতে একটু বৃষ্টির ভাব ছিল কিন্তু বাতাস বইলেও বৃষ্টি আর তেমন হয়নি। চারদিক গাছের ছড়ানো পাতাগুলোই তারা কুড়িয়ে পরিষ্কার করছে। ওরা সবাই বুদ্ধ বন্ধনা করতে বসল সোনালী বুদ্ধ মুর্তির সামনে কিছুক্ষনের জন্য। বিহারে আসলে বর্ষার মনটা পবিত্র হয়ে উঠে । বুদ্ধ র্মুতির মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, কী সুন্দর! রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম বাস্তবে না জানি আরো কত সুন্দর ছিল। কিন্তু মানব জাতীর কল্যানে প্রকৃত সুখের সন্ধান দিতে জাগতিক সকল সুখ রাজবিলাসীতা ত্যাগ করেছিলেন।
বাইরে বোধীবৃক্ষ তলে মোমবাতি জ্বালানো ছোট্ট ব্যবস্থা। যদিও দিনে বেলা মোম জ্বালিয়ে সন্ধা বেলার ভালো লাগাটা আসে না। তবুও ওখানে ওরা মোমবাতি প্রজ্জলন করল আগামী দিনের উজ্জল ভবিষ্যৎ কামনায়। বর্ষার বুদ্ধের কাছে একটাই চাওয়া - যেন জিপিএ-৫ পেয়ে এই কলেজ থেকে বেরুতে পারি।
ফেরার পথে তারা ভাবল হেঁটেই বাড়ি ফেরা যাক। অন্যদের বিদায় দিয়ে কথা বলতে বলতে তারা বাড়িতে ফিরছে, তখন গর্ভনমেন্ট স্কুলের সামনে চেনা একজনকে দেখলেও বর্ষা মনে করতে পারল না। পরে অনন্যা কথায় বোঝা গেল ছেলেটি সকালেই পরিচয় হওয়া কলেজেরই বন্ধু কিশোর। বর্ষার মনে হলো, এ তো যেন সে নয়! যেন অন্য কেউ। সকালে মনে হয়েছিল লাজুক বর্ণচোরা। এখন মনে হচ্ছে বেশ আত্ন বিশ্বাসী আর বেশ উচু-লম্বাও। ছেলেটি ওদের দেখে সকালে যেমন মুখ লুকিয়ে ছিল, এখন আর তেমন করছে না। বরং ওদের হাত নাড়িয়ে মনোযোগ আর্কষন করার চেষ্টা করছে। বর্ষাও হাত নেড়ে প্রতি উত্তর করল। ওর টমটম এসে যাওয়ায় সে টমটমমে উঠতে গেল এবং এই বান্ধবীদের দিকে আর না তাকিয়েই চলে গেল বোধয়। বর্ষারা কিশোরকে ফেলে এসেও আবার কি ফিরে তাকাবে! হ্যাঁ বর্ষাই একটু পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, তখন টমটমের আর দিশা নেই। কিন্তু কেন যেন হঠাৎ বর্ষাও নিজের দিশা খুজেঁ পেল না। নিজের অজান্তেই প্রথম পরিচয়ে কিশোরকে ভালো লেগে গেল কিনা বুঝতে পারলো না।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৪৯৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১২/০৭/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast