www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মিষ্টিভরা সিকিম গ্যংটক (২)



চাংগুবাবা মন্দিরের সামনে আমরা তিন


এমজি মার্গ হলো একটি বড় রাস্তা যেখানে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ। ওটা শুধুমাএ পায়ে হাঁটার জন্য ব্যবহৃত হয়। রাস্তার দুপাশে ঝলমলে শপিংমলের সারি, স্যুভেনিরের দোকান, কফি হাউজ, হোটেল, রেস্তোঁরা, কি নেই সেখানে। গ্যংটকে ট্যুরিস্টদের প্রধান কেন্দ্র এটি। থাকার ও খাবার হোটেল, ঘুড়ে বেড়ানোর গাড়ির সার্ভিস সব এখানে। আমরা চারপাশ দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম। একটি সুদৃশ্য কফিশপ দেখে ঝিমলী বলে, দাদা, চলুন কফি খাই। মন ফুরফুরে হলেও হেঁটে হেঁটে পা ক্লান্ত। সেএকটু বসতে চায়। কফি কিনতে হলো অগ্রিম পে করে। খুব ভালো ব্যবস্থা কিন্তু বসার চেয়ার নেই মানে ওরা বসতে দেবে না। ওয়ান টাইম কপি মগ হাতে বেরিয়ে বসলাম বাইরে। বসার চেয়ার রয়েছে বাইরে সাজানো। রাস্তাটি ক্রিস্টমাস ট্রি দিয়ে ঝলমল আলোয় ডেকোরেট করা। কিছুক্ষনের মধ্যে পুরো জায়গাটি ভরে গেল ট্যুরিস্টদের সমাগমে, তাদের পদচারনায় মুখোর হয়ে উঠল সবকিছু। আসলে সারাদিন বিভিন্ন ট্যুর ভ্যনুতে বেরিয়ে এসে সন্ধ্যাটা সবাই এখানিই কাটায়। শপিং করে ইচ্ছে মতো। আমার যখন গেছি তখন শীত প্রায়ই চলে এসেছে ওখানে। দোকানগুলোতে বাহারী শীতের কাপড়, কিছু আছে তিব্বত থেকে আনা। স্থানীয় লোকগুলো সিকিমিয়ান ছাড়াও নেপালী, গোর্খা বা আমাদের আপাত আলাদা করার উপায় নেই। কিন্তু খেয়াল করলে বোঝা যায় তারা নানান ভাষায় কথা বলছে। ড্রেসগুলোর মধ্যেও কিছুটা পার্থক্য আছে। বেশ কিছু দোকান ঘুরে তিব্বতি বুদ্ধের মুর্তি সহ ঘর সাজানো জিনিস নিলাম। সানজিৎ নিল গরম কাপড়। ঝিমলী নিল কিছু কসমেটিকস। সানজিৎ বলে সিকিম এলাম একটু সিকিমের টেস্ট না নিলেতো হয় না। আমি বুঝি না সে কি মিন করে। সে নিয়ে গেল একটি মদের বারে। বাংলাতে মদ বলতেই আমার কেমন জানি খারাপ লাগে, মনে হয় স্ল্যং। ওরা সব চেনে, অফিসার’স চয়েস, রাম, ভোদকা, হুয়িস্কিসহ বিভিন্ন জাতের মদ! বাংলাদেশের মতো ইন্ডিয়াতে হট ড্রিংস তেমন দুস্প্রাপ্য নয়। আমি বললাম আমিতো পারিনা। তাই সে নিল ছোট একটি বোতল শুধু নিজের জন্য। রাতের খাবার রুমেই অর্ডার করা হলো। সারাদিনের ধকলে আর টিভি দেখারও শক্তি নেই। তাছাড়া টিভির চ্যানেল খুঁজে পেতেও দারুন সমস্যা হয় এখানে। নানা ভাষার শতশত চ্যানেল নিজের পছন্দের চ্যানেলটি পেতে অনেক সময় ম্যানেজারের হেল্প নিতে হয়। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে তাই রাত ১১টার মধ্যেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়লাম।
প্লান ছিল সান রাইজয়ে কাঞ্চনজংঘা দেখা। তবে তা দেখতে হলে ভাগ্য লাগে। আকাশ পরিষ্কার থাকলেই পশ্মিম দৃষ্টি সিমানায় হয়তো তার দেখা মেলে। গ্যংটক শহরটি মোটামুটি পাহাড়ের গায়ের পশ্মিম পারে । তাই এখান থেকে সানসেট দেখা যায় না। আমরা ৭টার দিকে বেরিয়ে পরলাম। পাশে একটি বিল্ডিং ছিল ৫তলা সেখানেই উঠে গেলাম। অক্টোবর মাস তাই আকাশে হালকা মেঘ আর রোদ্দুরের খেলা চলছে তখন। একটু খানি দেখা পেলাম কি পেলাম না জানি না। যা মনে হলো সোনালী রংঙে ভরে গেছে চুড়াটি। ক্যামেরা দিয়ে ধরার চেষ্টা করেও পেলাম না। আসলে দৃশ্যটি ক্যামেরাতে আসে না যতটা চোখে দেখে ফিল করা যায়। হিমালয়ের চুড়া একবার আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল যখন আমি ঢাকা থেকে দিল্লী যাচ্ছিলাম জেট এয়ারের প্লেনে। মেঘের উপরে পরিষ্কার ভেসে আছে কোন শিল্পীর আঁকা স্বর্গীয় কোন ল্যন্ডস্কেপ বুঝি। প্রথমে বুঝতে পারিনি। অনেকক্ষন যাবৎ ভেসে রয়েছে হলুদ সোনালী লাল মিশ্রিত বিভিন্ন শেইধ । পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করে কনফার্ম হলাম যে আসলে ওটাই এভারেস্ট চূড়া। সূর্যের আলোর সাতটি বেসিক রং হলেও দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রঙে এভারেস্ট ফুটে ওঠে। আসলে চূড়াটি বরফ বা পানি ধাকা থাকে। বরফে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয় নানান রূপে।
কাঞ্চনজংঘা দেখে পেট ভরল না। ঝুপড়ি একটি ছোট হোটেলে ব্রেকফাস্ট সারলাম গতকালকের ম্যনুতে। কিন্তু বিল আসল প্রায় ডবল, ২০০ রুপি। এখানে খাবারের দামও বেশ বেশী।
যা হোক একটি ছোট কার রিজার্ভ করা হল। যাবো ১৪০০০ ফুট উচুতে চাংগুবাবা মন্দির আর সাংগু (Tsongmo) লেক দেখতে। যাওয়া আসা মোট ৩৫০০ রুপি। পাসপোর্ট সাইজ ছবি, আইডি কার্ড ও হোটেলের ঠিকানা দিতে হয় ড্রাইভারকে। তাকে আবার পুলিশ পাস নিতে হবে। যে কেউ যখন তখন যাবার অনুমতি পায় না । সামরিক প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার আবহাওয়া বুঝে অনুমতি দেয় কতজন যেতে পারবে। সকাল ৮টার মধ্যে পুরো কাজটি শেষ করতে হয়। তারপর আর দরখাস্ত গ্রহন করা হয় না। তাড়াতাড়ি সব সেড়ে রওনা হলাম উপরের দিকে। এখানে কেবল দুই দিকেই গাড়ি চলে, নিচের দিক নামা না হয় উপরের দিকে উঠা। সমান কোন রাস্তায় নেই!
আগের দিন উঠেছি প্রায় পৌনে এক ঘন্টা। আজ আরো এঁকে বঁকে আধা ঘন্টা উঠার পর চেক পোস্ট পাওয়া গেল যেখানে অনুমতি পত্র চেক করা হচ্ছে। ছোট একটি জ্যামের মতো লেগে গেল। পাশেই পাওয়া গেল একটি ঝর্না। আমরা ফটাফট কিছু ছবি তুলে ফেললাম। যতই উঠছি চারপাশের দৃশ্যপট বদল হতে লাগল। আস্তে আস্তে সবুজ গাছপালা কমে গেল। আর যা গাছপালা দেখা যেতে লাগল ছোট সাইজের। আসলে উপরে মাটি খুব রুক্ষ, মাটির নিচে জল নেই। বছরের বেশীর ভাগ সময় বরফের নিচেই থাকে জায়গাটি। দেখলাম হলুদ-লাল- খয়েরী বর্নের পাতাবাহার, ফুল, সবই প্রায়ই মাটির কাছাকাছি।
ঝিমলী সামনের সিটে। সে ড্রাইভারের সাথে নানান গল্প জুড়ে দিয়েছে। আসলে সে নেপালী ভাষায় কথা বলতে পারে। আর ড্রাইভারটিও ছিল নেপালী। সানজিৎ পুরো রাস্তার ভিউগুলো ভিডিও করতে লাগল। আমি হিন্দি গান শুনতে শুনতে মগ্ন হয়ে দেখছি চারপাশ। রাস্তা কেবল উপরের দিকে উঠছে তো উঠছেই। কয়েকটা পয়েন্ট ছিল রাস্তা ভাঙা আর গাড়ি চালানো খুবই রিস্কি। লোকাল ড্রাইভার ছাড়া এ এলাকায় যাওয়া মোটেও নিরাপদ নয়। কিছু পয়েন্টে পাহাড়ের খাঁজে যেন কংক্রিটের রাস্তা লেপ্টে দেয়া হয়েছে।


চারদিক মেঘ আর পাহাড় চূড়ার লুকোচুড়ি খেলা। বিশেষ একটি জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ছবি নিলাম যেথান থেকে উঠতি রাস্তার দৃশ্য দেখা যায়।
মোটামুটি আড়াই ঘন্টা যাবার পর পৌঁছুলাম সাংগু লেক যেখান থেকে উৎপত্তি হয়েছে তিস্তা বা অন্য কোন নদী। ভাবলাম আহা, এমনই বুঝি নদীর জন্ম স্থান! স্বচ্ছ বরফ গলা জল নীল। শীত কালে পুরোটাই বরফের আস্তরনে আবৃত হয়ে যায় তাই বড় করে নোটিশ দেয়া আছে—এখান থেকেই লেক শুরু আর সামনে যাওয়া বারন! পাথুরে মাটি বৃষ্টি পরার সংগে সংগেই নিচের দিকে গড়িয়ে যায়। অনেক পর্বত চূড়ার মাঝখানে কিছু নিচু খোলা জায়গা তাই জল জমে লেকের সৃষ্টি হয়েছে। আসলে এইসব উচু স্থানের কাল দুটি শীত কাল আর বর্ষা কাল। শীতকালে কম বা বরফ শীত। বর্ষাকালের মধ্যেই বসন্তকাল। ঘাসের সমান উচ্চতায় যে গুল্ম বা লতাপাতার চারা (গাছ নয়) রয়েছে সেখানে বরফ না জমায় পাতা ফুল ফোটে। আর মেঘ বৃষ্টি লেগেই রয়েছে হরদম। কেননা আকাশের যত মেঘ জমে সকল মেঘ এখানে চূড়ার সংর্স্পশে আসবেই।
দেখলাম সিকিমের ড্রেস পরে ছবি তুলছে অনেকে। মহিলা দুই দোকানী ভাড়া দিচ্ছে কিছুক্ষনের জন্য। একটির দাম ১০০রুপি। পাশেই বসে বা দাড়িয়ে রয়েছে বিশাল সাইজের ইয়াক। গরুরই ভিন্ন জাত, দেখতে সুন্দর। ইয়াকে পিঠেও চড়া যায় অন্য সময়। তখন সার্ভিস বন্ধ ছিল। আমরা তিনজন তিন রংঙের তিনটি বেছে টুপিও লাগালাম মাথায়। ছবি তুলে দেখলাম, ভালোই, বোঝা যায় না আমরা সিকিমিয়ন নই!


ঝিমলী বলে, দেখ, দেখ, আমি সিকিমের কনে হয়ে গেছি! বিয়ের পাত্র চাই! আর খুশিতে আপন মনে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। আমি কিছু সুন্দর ছবি তুলে দিলাম। কিছু যুগল ছবিও নিলাম সানজিতের সাথে। জানি আমার আর জীবনে ২য় বার আসার সম্ভাবনা নেই। তাই পুরো আনন্দ নিতে চেষ্টা করলাম। ড্রাইভার তাড়া দিলেন যেতে হবে। আরো অনেক টুরিস্ট এসেছে, তারা যাচ্ছে আরো সামনে। আমরাও চললাম তাদের পেছন পেছন।
শীত তেমন নেই। ১০-১২ ডিগ্রীর মতো তাপমাত্রা। রোদও উঠেছে, মিষ্টি রোদ। শৈল সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা চললাম আরো সামনে। ড্রাইভার দেখিয়ে দিলেন একটি রাস্তা যে রাস্তা চলে গেছে নাথুলা পাস, তিব্বত। আমরা চললাম অন্য দিক। পরে পৌছে গেলাম সাংগু বাবা মন্দির। খুব সুন্দর জায়গাটি। খোলামেলা, বেশ বড়, এক পাশে মিউজিয়াম। অন্যপাশে ছোট্ট মন্দির। বাবা হরভজন ছিলেন ইন্ডিয়ান আর্মির এক সৈনিক, যে চীনাদের সাথে যুদ্ধে শহীদ হয়। মূলত তার স্মৃতি সংরক্ষনের উদ্দেশ্যই এ সব কিছু। কয়েকটি দোকানের মধ্যে আর্মিদের একটি দোকান ছিল। আমরা দুই বন্ধু কিনলাম দুটি আর্মি ছুড়ি বা চাকু বা ছোড়া। কেবলই স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে। ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। উচু একটি স্টিলের থামে পতপত করে উড়ছে তিনরঙা পতাকা, আমরা বীরের পোজে ছবি তুললাম সেখানে। যেন বিজয় করেছি ১৪০০০ ফুট উচ্চতা। এখানে ছোট বাচ্চা বা বুড়ো লোকদের যাওয়া বারন কেননা অক্সিজেন কম থাকায় অনেকের শ্বাস কষ্ট হতে পারে।
একটু দূরে দেখলাম ঝর্না, তার পাশেই শিবের বড় সুদৃশ্য মুর্তি স্থাপন করা হয়েছে। কয়েকজন নেমে পরেছে জমা ছোট জলে। জল ছিটিয়ে দিচ্ছে একে অন্যের গায়ে। এত ঠান্ডায় আমরা কেবল ঝর্না জলে ছবি তুললাম। এটাই লাস্ট পয়েন্ট, খাবারের ব্যবস্থা নেই। আমরা কেবল পূজারীদের দেয়া প্রসাদ ভাগ পেলাম। খাবার পাওয়া যায় রাস্তার ধারে ছোট ছোট ধাবা বা রেস্তোঁরায়।

শিবমন্দিরের সামনে ঝর্না জলের ধারা

হালকা মেঘে ধাকা নীল আকাশ। আদিগন্ত প্রসারিত পর্বতের শিখর। এ যেন অপার্থিব অদেখা কোন সৌন্দর্য। কিন্তু সময় বয়ে চলে তার মতো। আমাদের ফিরতে হবে। তবুও এ খনিকের সুখ লাভ যেন জীবনে এক অনন্য পাওয়া। যে পাওয়া না পেলে কোন ক্ষতি নেই। তবে পেলে নশ্বর জীবনটা ধণ্য হয়ে যায়! ইচ্ছে হয় নতুন করে, সুন্দর করে বেঁচে থাকবার। তাই কবি গুরুর কবিতাটিই মনে পড়ে—
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।
এই সূর্যকরে এই পুস্পিত কাননে,
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।
বিষয়শ্রেণী: ফটোব্লগ
ব্লগটি ১২৫৩৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/০৭/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast