www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আহত স্বপন

তার মনটাকে যাচাই করার সুযোগ ছিল না সোহেলের। তবুও এক অজানা আত্মবিশ্বাস তার বুকে শিহরণ জাগাতো যে, সে তার। বুকের সেই তিলে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসিত সে, সত্যিই তুই আমারে ভালোবাসছ? তাকে না ভালবাসার কোন কারণই নাই; তবুও তার মনে ভয়। সোহেল নিজেই তাকে সক্ষমতার পরীক্ষায় দাঁড় করিয়ে দিল। প্রচলিত শক্তিমান পুরুষদের মতো তার আছে পেশীবহুল দুটি বাহু, সারা শরীরের ভার ছাড়াও মণ- আধমণ ওজনের অতিরিক্ত ভার সহ্য করার ক্ষমতা রাখে শক্ত দুটি পা, প্রশস্ত কাঁধ আর বুকের লোম তাকে ঈর্ষা জাগায়। বৈশাখ মাসে মাথার উপর আকাশ স্পর্শী ধানের আটি আর মৃদু গতির ছন্দময় হাঁটা সোহেলের হয়ে সাফাই গায় যৌবনের। সোহেল পুরুষ হয়ে ওঠে। কলপাড়ে সাইঝ্যে ভাবীর উর্ধাঙ্গের ঝলক, খোলা পিঠের খাঁজে আটকে যায় দু'চোখ। তার দুটো এখনও উদ্ধ্যত, ছুচালো, ঝুলে পড়ে নি। লুঙ্গির প্যাঁচ খুলে যাওয়ার ভয়ে নয়, গা ঝাড়া দেওয়ার জন্য হলেও কোমরে হাত রাখে সে। তার কানের কাছে মুখ এনে বলে, আমারে তোর ভাল লাগে? সে দুহাতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, যাও সোহেল ভাই! বিলকিসের হাতের রান্না যতটা না ভালো, তার চেয়ে সজনে ডাঁটার কোমল হাতটাই তাকে বেশি লোভাতুর করে। তবুও তাকেই বেশি ভালো লাগে, তার মেহেদি মাখা হাতের কথা মনে পড়ে।

মা মরা মেয়েটা, লাকী। মরে যাওয়া মা তাকে আর কিছু না দিতে পারলেও দিয়ে গেছে সাদা চান্নীর লাহান রূপ। মাথাভর্তি চুল, মায়াভরা চোখ- সোহেলের কাছে হুর। বেহেশতের হুর, গেলমান তার কাছে কিছুই নয়, ঘুমানোর আয়োজন করে সে। ঘুমঘোরে স্বপ্ন দেখে, বেড়ার পাটকাঠি নতুন নাইল্যের, নয়া একটা চৌকি। পাশাপাশি দুজন- লাকী ও সে। মরিচ বাতির সাধ্য নেই, পচিশ টাকার মোমবাতি। ঝিলমিল রঙের ঝলর ঝুলছে। বিছানার নতুন চাদরও কেনা হয়েছে।
সেই তিলটা আরেকবার পরখ করতে গেলেই বাধা দেয় লাকী। "শরম লাগে" বলেই আঁচলে ঢেকে দেয় নিজেকে। মৃদু বাধা তোয়াক্কা করে না সোহেল। আরেকবারের মতন পুরুষ হয়ে ওঠে সে। "চুর" "চুর" চিৎকার করে ওঠে পাশের ঘর থেকে ভাতিজা স্বপন। স্বপনের চিৎকারে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে বাড়ি মাতায়। সোহেলের ঘুম টুটে যায়। তিন ব্যাটারির টর্চটা নিয়ে বের হয়, পেশাবের শব্দে নেশা জাগানো ধ্বনি হয়। ওঠানের কুকুরটা "কিউ" "কিউ" করে থেমে যায়। ভাঙা চৌকিতে জীর্ণশীর্ণ কাঁথাটাকে গামছা দিয়ে আরেকবার ঝাঁট দেয়। বাতাসে ধুলো ওড়ার অস্তিত্ব টের পায় যখন সে দেশলাইট জ্বালায়। ধুলো আর বিড়ির ধোঁয়ায় ছোটখাটো খুপরি ঘরটা অন্ধকারে ছেয়ে যায়। প্রহরের দ্বিতীয় ঘুমটা শুরু হয়।

পৌষ মাসের পনেরো। সোহেলের ব্যস্ততার শেষ নাই। বুরো মওসুমের শুরু। বীজতলা থেকে বীজ ছাড়ানো, আটি বাঁধা, মাথায় করে ক্ষেতে নিয়ে যাওয়া- দম ফেলার ফুসরত নেই তার। একজনের পর আরেকজন সোহেলের শিডিউল নিতে আসে। কামলা শ্রেণীর মান মর্যাদা তখন বেড়ে যায়। গেরস্তেরা এসে ধর্ণা দেয়, সোহেল আমারে কিন্তুক কাইল দিতে অইব। যাও পাঁচশোই দিমু নে। রাতের স্বপ্নগুলোকে দিনের আলোয় আঁকতে চেষ্টা করে। নিজে নিজেই লজ্জা পায় সে, মুচকি হেসে ওঠে। কামালদ্দি ভাই, ধানের চারার আটি বাঁধতে বাঁধতে মশকরা করে, সোহেল্যে তুই খালি খালি হাসস ক্যান? মনে রঙ লাগছে নি! সোহেল থতমত খায়। বিড়ি চেয়ে বলে, কামালদ্দি ভাই আরেকটা বিড়ি দেও, বেশি শীত লাগতাসে। আদতে বুকের ভেতর উষ্ণতা। লাকীর গায়ে লাল শাড়ি, লাল ব্লাউজ- ভাবতেই নেশা ধরে বুকের ভিতর। সেদিন সন্ধ্যা রাত। আরেকটু হলেই ধরা পড়ে যেত জামালের হাতে। চোখে আগুন ধরে যায় সোহেলের, হালার পুত লুইচ্চা কোনহানকার, অই শালার বেটার না দুইড্যা ছেরি আছে! জামালের লোভাতুর চোখ লাকীর দিকে। শরীরের সংবেদনশীল অঙ্গে অঙ্গে তার লোলুপ দৃষ্টি। টর্চ হাতে জামাইল্যা এক্কেবারে বাঘের মতন খেঁকিয়ে ওঠল, কেডা? কেডা এইহানে? অকস্মাৎ লাকীর কম্পিত হৃদ স্পন্দন থেমে যায়। কিছু বুঝবার আগেই সে লাপাত্তা। হাতের কাছে শিকার; পেয়েও বগলদাবা করতে না পারার ক্ষোভ ঝরে জামালের কন্ঠে, সোহেইল্যে এইহানে কী হরস তুই?

এবার আর দেরি করতে চায় না লাকী। লোমশ বুকে নাক ঘষতে ঘষতে সে জিজ্ঞাস করে, কবে ঘরে তুলবা আমারে? জামার জিপার খুলতে খুলতে সোহেল আশ্বস্ত করে, বৈশাইজ্ঞে দাওয়াটা খালি তুলি, তারপর। লাকীর হাত স্থির হয়ে যায়। ভয়ার্ত গলায় সে বলে, না না পারতাম না আমি, ডর লাগে। ভাঙা চৌকি সোহেলকে আরও পরিশীলিত ও মার্জিত করে। মাইঝ্যা ভাবি টের পায়, লাকী- সোহেলের ঘরে। ভাবী বিষয়টা আগে থেকেই জানে। ভাইয়ের কানে বিষয়টা কথায় কথায় পৌছেও যায়। সে দেখা যাবি নে, আগে ট্যাহা পয়সা কিছু অউক। সোহেলও বাজে খরচ কমিয়ে দিয়েছ। লাকীর নির্দেশ, ট্যাহা গাঙদে ভাইস্যে আইয়ে না, ট্যাহা পানিত ফালাইন যাইতো না। সোহেলের বুড়ো আঙুল চলে যায় বাকি চার সহোদরের গিড়ায় গিড়ায়। আট ন'য়ের মত টাকা জমেছে। বৈশাখ মাসের পর আর দেরি করন যাইবো না, বিড়বিড় করতে বিড়িতে সুখ টান দেয় সে।

হৈ চৈ আর আহাজারিতে ঘুম ভাঙে সোহেলের। মহিলাদের মুখে কাপড়ে গোঁজা, ছেলেপুলেরা বিষণ্ণ, মাইঝ্যা ভাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, এমুন কামডা কেডা করলো! মাইঝ্যা ভাবীর চিৎকারে সোহেল ভিমড়ি খায়, আমাগো লাকীরে....
সোহেল সবার আগে জামাল মিয়ার বাড়িতে গেল। সখিনা, জামালের বউ আঁচলে কান্নাভেজা চোখ মুছতে মুছতে বলল, সোহেল্যেরে এমুন কামডা কেডা করলোরে। তোর ভাইও বাইত না, আমার নিজেরই তো ডর লাগতাছে। সোহেল প্রশ্ন করে, ক্যান জামাল কই? রাইতের ট্রেইনে ঢাহা গেছে। সোহেল বাড়ির পেছনের ঝোপের কাছে দাঁড়ায়। তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো লাগল, চিৎ হয়ে পড়ে আছে, পাজামা দূরে পড়ে আছে। উর্ধাঙ্গ আকাশের দিকে মাথা তোলে প্রতিবাদ করছে, কামিজের প্রান্ত দিয়ে তলপেট ঢাকা, নিম্নাঙ্গ খোলা, কালচে রক্ত উরু হতে হাঁটু পর্যন্ত লেগে আছে। মাছিগুলো এদিক ওদিক উড়ছে। মুখমন্ডলের উপর নেকড়ের আঁচড় কাটা, নীচের ঠোঁটটা থেকে রক্ত ঝরে শক্ত হয়ে আছে। ভিড় ঠেলে কেউ একজনকে সোহেলকে সরিয়ে দিয়ে বলল, যান যান সবাই দূরে যান, আমরা আইনের লোক।

২৬অক্টোবর২০১৪।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৯২৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৮/১০/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • বাস্তবিক।
  • খুব ভাল লাগল।
  • অনিরুদ্ধ বুলবুল ২৮/১০/২০১৪
    গল্পের হাত আছে বেশ। সুলিখিত, পড়তে মন কাড়ে। সময়ের অভাব, ভাল করে দেখা হয়নি, কয়েকটা বানান - ততমত>থতমত, কুপড়ি>খুপড়ি...+ + + দেখে নিবেন।

    সবচে' ভাল লেগেছে ধাঁধার মতই টার্ম -
    "বুড়ো আঙ্গুল চলে যায় চার সহোদরের গিড়ায় গিড়ায়...."

    ধন্যবাদ।
  • বেশ ভয়াবহ একটা গল্প। কিছু একটা পশুত্ব। একটু অস্পষ্ট তবে বুঝতে সমস্যা হয় নি।
 
Quantcast