টিকফা কি এবং আমরা কেন এর বিরোধিতা করি
‘টিফা’ বা ‘টিকফা’-এর বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী গত কিছুদিন পূর্বে গার্মেন্টস এক্সেসরিজ এবং প্যাকাজিং উৎপাদকদের একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবার সময় জানিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ ‘টিকফা’ চুক্তি স্বাক্ষর আমেরিকার বাজারে জি এস পি সুবিধা অক্ষুন্ন রাখার জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। চুক্তিটিকে চূড়ান্ত আকার দেয়ার কাজ শেষ হয়েছে এবং তা এখন স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত।
টিকফা কী?
টিকফা শব্দটি নতুন। আগে এর নাম ছিল টিফা।‘টিফা’ চুক্তি হলো Trade and Investment FrAবা সংক্ষেপে TIFA, যেটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে হয় — ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি। ‘টিফা’ চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে দশক কালেরও আগে থেকে। এই চুক্তির খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০০১ সালে। ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা সম্বলিত চুক্তিটির প্রথম খসড়া রচিত হয় ২০০২ সালে। পরে ২০০৪ সালে এবং তারও পরে আবার ২০০৫ সালে খসড়াটিকে সংশোধিত রূপ দেয়া হয়। দেশের বামপন্থি শক্তিসহ অন্যান্য নানা মহলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি স্বাক্ষর করা এখনো সম্ভব হয়নি। চুক্তির খসড়া প্রণয়নের পর সে সম্পর্কে নানা মহল থেকে উত্থাপিত সমালোচনাগুলো সামাল দেয়ার প্রয়াসের অংশ হিসেবে এর নামকরণের সাথে Co-operation বা সহযোগিতা শব্দটি যোগ করে এটিকে এখন ‘টিকফা’ তথা TICFA বা Trade and Investment Co-operamework Agreement (‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি) হিসাবে আখ্যায়িত করার হচ্ছে।
চুক্তিটি কার জন্য?
চুক্তিটি আমেরিকার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের। এই চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র করেছে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গেও। চুক্তিটির ধারা উপধারা ও আমেরিকার তৈরি। আমেরিকা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে নাছোড়বান্দা এবং তারা হাল ছেড়ে না দিয়ে বছরের পর বছর ধরে এজন্য সে বাংলাদেশের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে। এর মাঝে এদেশে ও আমেরিকায় কয়েক দফা সরকার বদল হয়েছে। কিন্তু ‘টিফা’ চুক্তির বিষয়টি সব আমলেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হয়ে থেকেছে। তারা এমনও বলেছে যে, ‘টিফা’ চুক্তি স্বাক্ষর না করলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পরবে। যেহেতু বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য ও আধিপত্য প্রশ্নাতীত এবং এই অসামঞ্জস্য পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগের’ স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে করা চুক্তিটির দ্বারা প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের একতরফা সুবিধা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হবে এই সমালোচনা নিরসনের জন্য ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ’-এর সাথে ‘সহযোগিতা’ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তিতে যে সব প্রস্তাবনা ও ধারা রয়েছে সেগুলোর জন্য চুক্তিটি অসম ও মার্কিন স্বার্থবাহী।
টিকফা চুক্তিতে কী আছে?
‘টিকফা’ চুক্তিতে কি কি ধারা রয়েছে তা দেশবাসী জানে না। এই চুক্তি নিয়ে চরম গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। ২০০৫ সালে টিফার চুক্তি সংক্রান্ত কিছু তথ্য ফাস হয়ে যায়, যেটাতে দেখা যায় অন্যান্য দেশে যে সমস্ত টিফা চুক্তি হয়েছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের ধারা উপধারা গুলো মিলে যায়। এই আলোচনা সেই ফাস হওয়া ড্রাফটের উপর করা হয়েছে। যদিও সেই ড্রাফ্ট পরিবর্তিত হয়ে থাকতে পারে তবে মুল ভাবনা এই আলোচনার বাইরে যাবেনা বলেই মনে হচ্ছে। এই চুক্তির খসড়ায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশের বন্ধন সুদৃঢ় করার উল্লেখ থাকলেও চুক্তির বিভিন্ন প্রস্তাবনায় এবং অনুচ্ছেদে বাজার উন্মুক্তকরণ এবং সেবা খাতের ঢালাও বেসরকারিকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতসমূহে বিশেষ করে সেবা খাতগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। চুক্তির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য উদারনৈতিক নীতি গ্রহণ করবে। বেসরকারি খাতের বিকাশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত “ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন” প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল ও পরামর্শ সরবরাহ করবে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু সার্ভিস সেক্টরের কথা উল্লেখ রয়েছে, ‘পণ্য’ উৎপাদনের বিষয়টি সংযুক্ত রাখা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করবে, তা শুধু সেবা খাতেই। তারা কোনো পণ্য এ দেশে উৎপাদন করবে না। চুক্তির এসব ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য দেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিবে এবং বিদ্যমান শুল্ক এবং অশুল্ক বাধাসমুহ দূর করতে বাধ্য থাকবে। বাংলাদেশকে দেশীয় শিল্পের/কোম্পানির প্রতি সুবিধা প্রদানকারী বাণিজ্য সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ সংরক্ষন নীতি প্রত্যাহার করতে হবে। টিকফা চুক্তিতে বলাই আছে বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালে স্বাক্ষরিত “দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি” অনুযায়ী মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির উপর কোন কর আরোপ করতে পারবে না এবং বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষাসহ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে সেবাখাতে বাণিজ্যের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে দেশের জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি সেক্টরকে মার্কিন পুঁজিপতিদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। চুক্তির প্রস্তাবনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা অনুসারে কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাসকরণ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া টিকফা চুক্তির অন্যতম দিক হচ্ছে মেধাসত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন।
চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সমস্যা কি?
চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে দেশের সেবাখাতসমূহ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির দখলে চলে যাবে। এতে করে দেশীয় কোম্পানিগুলোর স্বার্থও বিঘ্নিত হবে। অবাধ মুনাফা অর্জনের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো সেবা যেমন টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা, বন্দর প্রভৃতি ও পণ্যের দাম বহুগুনে বৃদ্ধি করবে। সেবাখাতে বিদেশি প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করলে বাংলাদেশ তার কল্যাণমূলক রাষ্ট্রনীতির আওতায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষকে কম মূল্যে সেবা দানের যেসব কর্মসূচী নিয়ে থাকে তা সঙ্কুচিত হবে অথবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজে সুকৌশলে বাণিজ্য সংরক্ষন নীতি গ্রহণ করে অনুন্নত দেশকে বাণিজ্য সুবিধা প্রদান থেকে বিরত থাকছে। দোহা এজেন্ডা অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষিতে ৫% এর বেশি ভর্তুকি দিতে পারছে না, অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই কৃষিতে ১৯% এর বেশি ভর্তুকি দিয়ে তাদের কৃষি ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্যের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজে কিন্তু বাণিজ্য সংরক্ষন নীতি গ্রহণ করছে অথচ আমাদের মত অনুন্নত দেশগুলোকে বাণিজ্য উদারনীতি গ্রহণে নানা চুক্তির মাধ্যমে বাধ্য করছে।
মেধাসত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন হলে তা উন্নত দেশগুলোর মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই কাজ করবে যাতে দরিদ্র দেশগুলোর কাছ থেকে অবাধে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুণ্ঠনের আইনি বৈধতা পাওয়া যায়। উন্নত প্রযুক্তি এবং উৎপাদন পদ্ধতির অধিকারী হবার পর তারা এই জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। এর মাধ্যমে তারা চায় যেন অবশিষ্ট বিশ্ব প্রযুক্তি ও উৎপাদনের জন্য তাদের উপর নির্ভরশীল থাকে এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হয়। টিফা চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই মেধাস্বত্ব আইন মানতে বাধ্য করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে ২০১৬ সালের আগেই মেধাস্বত্ব আইন মেনে চলতে হবে। চুক্তির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার (TRIPS) এবং অন্যান্য প্রচলিত মেধাস্বত্ব আইনের যথাযথ এবং কার্যকরী রক্ষণাবেক্ষণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে । দোহা ঘোষণা ২০০০ অনুযায়ী বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় বাণিজ্যবিষয়ক মেধাসম্পদ স্বত্ব চুক্তি অনুসারে স্বল্পোন্নত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় এবং ২০১৬ পর্যন্ত ওষুধের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ববিষয়ক বিধিনিষেধ থেকে ছাড় পেয়েছে এবং এই সুবিধা গ্রহণ করে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পেটেন্ট করা ওষুধ উৎপাদন এবং রফতানি করতে পারছে। কিন্তু টিকফা এ সে ধরনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প, কম্পিউটার সফটওয়্যার সহ গোটা তথ্যপ্রযুক্তি খাত আমেরিকার কোম্পানিগুলোর পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির লাইসেন্স খরচ বহন করতে গিয়ে বিভিন্ন পণ্য এবং প্রযুক্তির দাম অভাবনীয়ভাবে বেড়ে যাবে। মেধাস্বত্ত্ব আইন কার্যকর হলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক ওষুধ তৈরি করতে পারবে না, আমাদেরকে কয়েকগুন বেশি দামে বিদেশি কোম্পানির পেটেন্ট করা ওষুধ খেতে হবে । বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে রপ্তানি সম্ভাবনা হারাবে। দরিদ্ররা ওষুধ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাবে। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেননা দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজ দেশেই তাদের ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে বিদেশি কোম্পানির সাথে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। ফলে অনেক মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প ধংস হয়ে যাবে। আবিষ্কারক কোম্পানি সুদীর্ঘ ২০ বছর ধরে নিজের ইচ্ছামতো দামে ওষুধটির একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা লুট করবে।
‘টিকফা’ চুক্তির খসড়ায় পণ্য ও পুঁজির চলাচলকে অবাধ করার কথা এবং সেই সূত্রে মুনাফার শর্তহীন স্থানাস্তরের গ্যারান্টির কথা বলা হলেও শ্রম শক্তির অবাধ যাতায়াতের সুযোগের কথা কিছুই বলা হয়নি। অথচ শ্রম শক্তিই হলো আমাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান সম্পদ যার রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে বিপুল আপেক্ষিক সুবিধা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ‘খোলাবাজার’ নীতিটি যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োগ করতে রাজি নয়। তারা তা প্রয়োগ করতে প্রস্তুত কেবল পুঁজি এবং পণ্য-সেবা পণ্যের ক্ষেত্রে, যে ক্ষেত্রে তার রয়েছে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি আপেক্ষিক সুবিধা। অন্যদিকে, টিকফাতে ‘শুল্ক বহির্ভূত বাধা’ দূর করার শর্ত চাপানো হলেও ‘শুল্ক বাধা’ দূর করার কথা বেমালুম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত তৈরি পোশাক শিল্পের পণ্যের ক্ষেত্রে, গড় আন্তর্জাতিক শুল্ক যেখানে ১২%, যুক্তরাষ্ট্রের তা ১৯%।
পেটেন্ট আইন মানতে হলে সমস্যা কী?
পেটেন্ট কোন প্রতিষ্ঠানকে মেধাসত্ত্ব দিয়ে দেয়। ফলে সে সেই মেধাসত্ত্বের ভিত্তিতে সেই পেটেন্টের সাথে সম্পর্কিত যে কোন বাণিজ্যে সে রয়্যালটি দাবী করতে পারে। যেমন নিমের পেটেন্ট করা আছে আমেরিকার তাই নিম গাছ থেকে উৎপাদিত যে কোন পণ্যে সে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়্যালটি দাবী করতে পারবে। বাংলাদেশ, ভারত, ব্রাজিল সহ বিভিন্ন দেশের নিজস্ব জীববৈচিত্রের অনেক জীব-অণুজীব এবং উদ্ভিদ প্রজাতি এখন বহুজাতিক কোম্পানির পেটেন্টের দখলে। ভারত উপমহাদেশের শতাধিক গাছগাছড়া যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিসে রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষায় রয়েছে। পেটেন্ট আইন বাস্তবায়ন আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। পেটেন্ট এর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এখন আর শুধু সামরিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় বরং ফল ফসল এবং গাছ গাছড়ার উপরও বিস্তৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট আইনে বলা আছে, “কোন কিছুর পেটেন্টের বেলায় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অলিখিত উৎসের অনুসন্ধানের কোন বাধ্যবাধকতা নেই”। এর মানে হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশের প্রচলিত উৎপাদন প্রনালী, জীববৈচিত্র্য, কৃষকদের নিজস্ব শস্যবীজ ইত্যাদি শুধুমাত্র প্রযুক্তি এবং অর্থের জোরে পেটেন্ট করে নিতে পারবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো তাদের উন্নত জেনেটিক টেকনোলজির মাধ্যমে ডি এন এ ফিংগার প্রিন্ট নির্ণয় করে অন্য দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিজ সম্পদকে নিজের বলে পেটেন্ট করিয়ে নেবে। কৃষিতে পেটেন্ট বাস্তবায়ন হলে কৃষকদের শস্য বীজ উৎপাদন, সংরক্ষন, পুনরুৎপাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে। মেধাস্বত্ব আইন অনুযায়ী রয়্যালটি পাবে আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আর ধ্বংস হবে দেশী প্রজাতি, পরিবেশ এবং কৃষি উৎপাদন কাঠামো। বীজ এবং কৃষি পণ্যের দাম অনেকগুন বেড়ে যাবে বলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তৈরি পোশাক শিল্পকেও ব্র্যান্ড নামে ব্যবহূত এদেশের তৈরি এ্যাকসেসরিজের জন্য সংশ্লিষ্ট মার্কিন কোম্পানিকে রয়্যালটি দিতে হবে। বাসমতি চাল, চিরতার রস, নিমের দাঁতন ইত্যাদি হেন বস্তু নেই যা আগেভাগেই মার্কিনীসহ বিদেশি কোম্পানিরা পেটেন্ট করে রাখেনি। মেধাস্বত্ব অধিকারের ধারা প্রয়োগ করে তারা এসবকিছুর জন্য রয়্যালটি প্রদানে বাংলাদেশকে ‘টিকফা’ চুক্তি মাধ্যমে বাধ্য করতে চায়।
টিকফাতে শ্রমিক বান্ধব ধারাও কী আছে?
মোটেও না। টিকফার প্রস্তাবনায় মানবাধিকার, শ্রমের মান এবং শ্রমজীবীদের অধিকার ও পরিবেশগত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তার লক্ষ্য শ্রমজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নয় বরং এগুলোকে নন- ট্যারিফ (অশুল্ক) বাধা হিসেবে ব্যাবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তার বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। মানবাধিকার, শ্রম পরিবেশের মান ইত্যাদি বিষয়কে অশুল্ক বাধা হিসাবে চিহ্নিত করে মার্কিনীরা ‘টিকফা’ চুক্তি দ্বারা বাংলাদেশকে উত্তরণ অসাধ্য প্রতিকূলতায় আটকে ফেলার ফন্দি করেছে। কয়েক শতাব্দী ধরে তারা আমাদের মতো দেশে ঔপনিবেশিক শাসন চালিয়ে, নিজ নিজ দেশে নির্মম ও অমানবিক শ্রম-শোষণ চালিয়ে, শ্রম পরিবেশের ক্ষেত্রে দাস সুলভ মান বজায় রেখে এখন উন্নত ধনী দেশে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা উন্নয়নের পথ গ্রহণ করা মাত্রই সমানে সমানে প্রতিযোগিতায় নামার কথা বলে আমাদের ওপরে তাদের মতো সমান মাত্রার শর্তাবলী চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এ যেন, হাত-পা খোলা মোটা তাজা মানুষ কর্তৃক পেছনে হাত বাঁধা অনাহারী মানুষকে সমানে সমানে কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো!
চুক্তির জন্য কেন এতো গোপনীয়তা?
বাংলাদেশের সংবিধানে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ‘বিদেশের সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে, এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন; তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোনো চুক্তি কেবলমাত্র সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।’ যেহেতু টিকফা কোন নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তি নয় তাই সে চুক্তির ধারা গুলো প্রকাশ না করাটা সংবিধান বিরোধী। ‘টিকফা’ চুক্তির ধারাসমূহ নিয়ে গোপনীয়তা ও রাখঢাক করার যে চেষ্টা চলছে তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক
টিকফা চুক্তি কী বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়গ বাড়াবে? বাংলাদেশের পণ্য রফতানী বাড়াবে?
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের দেশে বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়বে, সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়বে আমাদের পণ্য রফতানিও। এশিয়ার দুটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি গণচীন এবং ভারত তার রফতানির যথাক্রমে ২১ এবং ১৯% পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করলেও তারা এই চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। অর্থাৎ টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানির সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রফতানিতে প্রধান বাধা হচ্ছে শুল্ক বাধা। বর্তমানে বাংলাদেশি পোশাক রফতানিকারকদের যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৫.৩% শুল্ক দিতে হয় অন্যদিকে চীনকে পরিশোধ করতে হয় মাত্র ৩% তাহলে দেখা যাচ্ছে চীন টিফা চুক্তি স্বাক্ষর না করেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম শুল্কে পণ্য রফতানি করতে পারছে। তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের লোভ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে কিন্তু টিকফা এগ্রিমেন্টে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কোন নিশ্চয়তা রাখা হয়নি কারণ প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় দেশ নিজ নিজ বাজারে পণ্য প্রবেশে নন ট্যারিফ বা অশুল্ক বাধা দূর করবে। কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অশুল্ক বাধা খুব সামান্যই।
যুক্তরাষ্ট্র কেন এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এতটা আগ্রহী?
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাইরে স্বল্পোন্নত দেশের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্যই আমেরিকা সহযোগিতামূলক উদ্যোগের ছদ্মাবরণে টিফা বা টিকফার মত দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলো করার চেষ্টা করছে। যদি স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করা যায় তবে আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক ফোরাম ডব্লিউ,টি,ও এ আমেরিকা তার আধিপত্যবাদী বাণিজ্য নীতি বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে। এই লক্ষ্যেই পাকিস্তান,সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ইরাক, উরুগুয়েসহ বিশ্বের ৩০ টিরও বেশি দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই টিফা চুক্তি সাক্ষর করেছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতা হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছে। বিশ্বব্যাপী পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিপরীতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য এসব ফোরামে বাংলাদেশ যাতে কোন ভূমিকা না রাখতে পারে সেজন্য বাংলাদেশকেও টিকফা চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে যুক্তরাষ্ট্র কেননা টিকফা স্বাক্ষর হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া আর সম্ভব হবে না। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার প্রশ্নে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে চায়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র মনে করে গণচীনের অব্যাহত উন্নয়ন ও পরাশক্তি হিসেবে চীনের অভাবনীয় অগ্রগতি ঠেকাতে এবং দক্ষিন এশিয়ার বিশাল বাজারের উপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে বঙ্গোপসাগরে এবং ভারতমহাসাগরে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি বজায় রাখতে হবে। আর বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা বজায় রাখতে হলে বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আঞ্চলিক পার্টনার বানাতে আগ্রহী। ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা ইস্যুতে ঢাকার কাছ থেকে অধিকতর সহযোগিতার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাচ্ছে কেননা এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ মার্কিন বলয়ে আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য যে, দোহায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে গৃহীত ‘দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডার’ মূল বিষয়গুলো হলো—অ-কৃষিপণ্যের বাজার উন্মুক্তকরণ, কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার, মেধাজাত সম্পত্তি অধিকার (ট্রিপস) এবং সার্ভিস বা পরিবেশ খাতে বিনিয়োগ উদারিকরণ ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের স্বার্থ অভিন্ন নয়। বরং এসব ক্ষেত্রে মার্কিনের স্বার্থের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থের গুরুতর বিরোধ আছে। অথচ ‘সোফা’ চুক্তির সুবাদে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে মার্কিনের পক্ষে এবং স্বল্পোন্নত দেশের বিপক্ষে বাংলাদেশকে দাঁড় করানোর সুযোগ পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিপাক্ষিক ‘সোফা’ চুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে অবস্থান নিতে বাধ্য করতে পারবে। একথা সকলেই জানেন যে, বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলো তাদের অভিন্ন ও সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণে সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক ও বহুপাক্ষিক নানা ফোরামে অবস্থান নিতে পারে। কিন্তু টিফার মতো দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কারণে বাংলাদেশ তা স্বাধীন মতো করতে পারবে না। শুধু তাই নয় বহুপক্ষীয়ভাবে যে কোনো বিরোধ নিরসনের সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। ‘টিকফা’ চুক্তির কারণে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় আন্তর্জাতিক পরিসরে বহুপাক্ষিকভাবে প্রচেষ্টা চালাবার সুযোগ নিরঙ্কুশভাবে পাবে না। উপরন্তু বাণিজ্য সমস্যা বহুপক্ষীয়ভাবে সমাধানের বদলে তা মার্কিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের ফাঁদে পড়বে বাংলাদেশ। একপক্ষ প্রবল শক্তিশালী হলে দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান স্বাভাবিক কারণেই দুর্বলের নয় বরং সবলের পক্ষেই যায়। সে কারণে বাংলাদেশকে সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।
জি এস পি সুবিধার পাবার প্রশ্নের সাথে কি টিকফা চুক্তি যুক্ত?
ঢাকায় নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা গত ২৮ জুলাই আবারো এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, “টিকফা চুক্তি সই না করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে না।“ টিকফা চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে দরকষাকষিকে ‘অস্বস্তিকর’ বিষয় উল্লেখ করে তিনি জানতে চান, “এতে খারাপ কী আছে? আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না।” টিকফার সাথে জি এস পি সুবিধার কোন সম্পর্ক নেই। দোহা নীতি অনুসারে আমেরিকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার কথা যেটাকে সাধারণভাবে জি এস পি সুবিধা বলা হয়। আমেরিকা ঠিকই বাংলাদেশের ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দিয়েছে তবে তাতে ঐসব পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার রপ্তানির পরিমান খুবই কম। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাককে এর বাইরে রাখা হয়েছে। সেই সব পণ্যের জন্য জি এস পি সুবিধা থাকা আর না সমান কথা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের যে গার্মেন্টস পণ্য রফতানি হয় তার ওপর উচ্চহারে শুল্ক বসিয়ে রেখেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের গড় আমদানি শুল্ক হার শতকরা ১ ভাগের মতো। কিন্তু বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ ভাগ। এই শুল্কহার আন্তর্জাতিক বিধিরও পরিপন্থী। এই শুল্ক এমনিতেই বাতিল হওয়া দরকার। এবছরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কবাবদ প্রদান করেছে প্রায় ৫৬০০ কোটি টাকা। এটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ঋণ অনুদান নানাভাবে বাংলাদেশে আসে আসে তার ৬ গুণেরও বেশি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়, বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থের যোগান দিচ্ছে।
জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে রচিত ‘টিকফা’ চুক্তি পুরোটাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তা আরেকটি সর্বনাশের বার্তা। দেশের গলায় আরেকটি ফাঁস পরানোর এই পাঁয়তারা দেশপ্রেমিক জনগণকে রুখতে হবে। এ কর্তব্য সব দেশপ্রেমিকদের।
টিকফা কী?
টিকফা শব্দটি নতুন। আগে এর নাম ছিল টিফা।‘টিফা’ চুক্তি হলো Trade and Investment FrAবা সংক্ষেপে TIFA, যেটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে হয় — ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি। ‘টিফা’ চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে দশক কালেরও আগে থেকে। এই চুক্তির খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০০১ সালে। ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা সম্বলিত চুক্তিটির প্রথম খসড়া রচিত হয় ২০০২ সালে। পরে ২০০৪ সালে এবং তারও পরে আবার ২০০৫ সালে খসড়াটিকে সংশোধিত রূপ দেয়া হয়। দেশের বামপন্থি শক্তিসহ অন্যান্য নানা মহলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি স্বাক্ষর করা এখনো সম্ভব হয়নি। চুক্তির খসড়া প্রণয়নের পর সে সম্পর্কে নানা মহল থেকে উত্থাপিত সমালোচনাগুলো সামাল দেয়ার প্রয়াসের অংশ হিসেবে এর নামকরণের সাথে Co-operation বা সহযোগিতা শব্দটি যোগ করে এটিকে এখন ‘টিকফা’ তথা TICFA বা Trade and Investment Co-operamework Agreement (‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি) হিসাবে আখ্যায়িত করার হচ্ছে।
চুক্তিটি কার জন্য?
চুক্তিটি আমেরিকার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের। এই চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র করেছে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গেও। চুক্তিটির ধারা উপধারা ও আমেরিকার তৈরি। আমেরিকা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে নাছোড়বান্দা এবং তারা হাল ছেড়ে না দিয়ে বছরের পর বছর ধরে এজন্য সে বাংলাদেশের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে। এর মাঝে এদেশে ও আমেরিকায় কয়েক দফা সরকার বদল হয়েছে। কিন্তু ‘টিফা’ চুক্তির বিষয়টি সব আমলেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হয়ে থেকেছে। তারা এমনও বলেছে যে, ‘টিফা’ চুক্তি স্বাক্ষর না করলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পরবে। যেহেতু বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য ও আধিপত্য প্রশ্নাতীত এবং এই অসামঞ্জস্য পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগের’ স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে করা চুক্তিটির দ্বারা প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের একতরফা সুবিধা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হবে এই সমালোচনা নিরসনের জন্য ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ’-এর সাথে ‘সহযোগিতা’ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তিতে যে সব প্রস্তাবনা ও ধারা রয়েছে সেগুলোর জন্য চুক্তিটি অসম ও মার্কিন স্বার্থবাহী।
টিকফা চুক্তিতে কী আছে?
‘টিকফা’ চুক্তিতে কি কি ধারা রয়েছে তা দেশবাসী জানে না। এই চুক্তি নিয়ে চরম গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। ২০০৫ সালে টিফার চুক্তি সংক্রান্ত কিছু তথ্য ফাস হয়ে যায়, যেটাতে দেখা যায় অন্যান্য দেশে যে সমস্ত টিফা চুক্তি হয়েছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের ধারা উপধারা গুলো মিলে যায়। এই আলোচনা সেই ফাস হওয়া ড্রাফটের উপর করা হয়েছে। যদিও সেই ড্রাফ্ট পরিবর্তিত হয়ে থাকতে পারে তবে মুল ভাবনা এই আলোচনার বাইরে যাবেনা বলেই মনে হচ্ছে। এই চুক্তির খসড়ায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশের বন্ধন সুদৃঢ় করার উল্লেখ থাকলেও চুক্তির বিভিন্ন প্রস্তাবনায় এবং অনুচ্ছেদে বাজার উন্মুক্তকরণ এবং সেবা খাতের ঢালাও বেসরকারিকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতসমূহে বিশেষ করে সেবা খাতগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। চুক্তির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য উদারনৈতিক নীতি গ্রহণ করবে। বেসরকারি খাতের বিকাশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত “ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন” প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল ও পরামর্শ সরবরাহ করবে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু সার্ভিস সেক্টরের কথা উল্লেখ রয়েছে, ‘পণ্য’ উৎপাদনের বিষয়টি সংযুক্ত রাখা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করবে, তা শুধু সেবা খাতেই। তারা কোনো পণ্য এ দেশে উৎপাদন করবে না। চুক্তির এসব ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য দেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিবে এবং বিদ্যমান শুল্ক এবং অশুল্ক বাধাসমুহ দূর করতে বাধ্য থাকবে। বাংলাদেশকে দেশীয় শিল্পের/কোম্পানির প্রতি সুবিধা প্রদানকারী বাণিজ্য সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ সংরক্ষন নীতি প্রত্যাহার করতে হবে। টিকফা চুক্তিতে বলাই আছে বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালে স্বাক্ষরিত “দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি” অনুযায়ী মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির উপর কোন কর আরোপ করতে পারবে না এবং বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষাসহ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে সেবাখাতে বাণিজ্যের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে দেশের জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি সেক্টরকে মার্কিন পুঁজিপতিদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। চুক্তির প্রস্তাবনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা অনুসারে কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাসকরণ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া টিকফা চুক্তির অন্যতম দিক হচ্ছে মেধাসত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন।
চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সমস্যা কি?
চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে দেশের সেবাখাতসমূহ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির দখলে চলে যাবে। এতে করে দেশীয় কোম্পানিগুলোর স্বার্থও বিঘ্নিত হবে। অবাধ মুনাফা অর্জনের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো সেবা যেমন টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা, বন্দর প্রভৃতি ও পণ্যের দাম বহুগুনে বৃদ্ধি করবে। সেবাখাতে বিদেশি প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করলে বাংলাদেশ তার কল্যাণমূলক রাষ্ট্রনীতির আওতায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষকে কম মূল্যে সেবা দানের যেসব কর্মসূচী নিয়ে থাকে তা সঙ্কুচিত হবে অথবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজে সুকৌশলে বাণিজ্য সংরক্ষন নীতি গ্রহণ করে অনুন্নত দেশকে বাণিজ্য সুবিধা প্রদান থেকে বিরত থাকছে। দোহা এজেন্ডা অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষিতে ৫% এর বেশি ভর্তুকি দিতে পারছে না, অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই কৃষিতে ১৯% এর বেশি ভর্তুকি দিয়ে তাদের কৃষি ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্যের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজে কিন্তু বাণিজ্য সংরক্ষন নীতি গ্রহণ করছে অথচ আমাদের মত অনুন্নত দেশগুলোকে বাণিজ্য উদারনীতি গ্রহণে নানা চুক্তির মাধ্যমে বাধ্য করছে।
মেধাসত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন হলে তা উন্নত দেশগুলোর মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই কাজ করবে যাতে দরিদ্র দেশগুলোর কাছ থেকে অবাধে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুণ্ঠনের আইনি বৈধতা পাওয়া যায়। উন্নত প্রযুক্তি এবং উৎপাদন পদ্ধতির অধিকারী হবার পর তারা এই জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। এর মাধ্যমে তারা চায় যেন অবশিষ্ট বিশ্ব প্রযুক্তি ও উৎপাদনের জন্য তাদের উপর নির্ভরশীল থাকে এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হয়। টিফা চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই মেধাস্বত্ব আইন মানতে বাধ্য করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে ২০১৬ সালের আগেই মেধাস্বত্ব আইন মেনে চলতে হবে। চুক্তির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার (TRIPS) এবং অন্যান্য প্রচলিত মেধাস্বত্ব আইনের যথাযথ এবং কার্যকরী রক্ষণাবেক্ষণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে । দোহা ঘোষণা ২০০০ অনুযায়ী বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় বাণিজ্যবিষয়ক মেধাসম্পদ স্বত্ব চুক্তি অনুসারে স্বল্পোন্নত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় এবং ২০১৬ পর্যন্ত ওষুধের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ববিষয়ক বিধিনিষেধ থেকে ছাড় পেয়েছে এবং এই সুবিধা গ্রহণ করে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পেটেন্ট করা ওষুধ উৎপাদন এবং রফতানি করতে পারছে। কিন্তু টিকফা এ সে ধরনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প, কম্পিউটার সফটওয়্যার সহ গোটা তথ্যপ্রযুক্তি খাত আমেরিকার কোম্পানিগুলোর পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির লাইসেন্স খরচ বহন করতে গিয়ে বিভিন্ন পণ্য এবং প্রযুক্তির দাম অভাবনীয়ভাবে বেড়ে যাবে। মেধাস্বত্ত্ব আইন কার্যকর হলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক ওষুধ তৈরি করতে পারবে না, আমাদেরকে কয়েকগুন বেশি দামে বিদেশি কোম্পানির পেটেন্ট করা ওষুধ খেতে হবে । বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে রপ্তানি সম্ভাবনা হারাবে। দরিদ্ররা ওষুধ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাবে। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেননা দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজ দেশেই তাদের ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে বিদেশি কোম্পানির সাথে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। ফলে অনেক মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প ধংস হয়ে যাবে। আবিষ্কারক কোম্পানি সুদীর্ঘ ২০ বছর ধরে নিজের ইচ্ছামতো দামে ওষুধটির একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা লুট করবে।
‘টিকফা’ চুক্তির খসড়ায় পণ্য ও পুঁজির চলাচলকে অবাধ করার কথা এবং সেই সূত্রে মুনাফার শর্তহীন স্থানাস্তরের গ্যারান্টির কথা বলা হলেও শ্রম শক্তির অবাধ যাতায়াতের সুযোগের কথা কিছুই বলা হয়নি। অথচ শ্রম শক্তিই হলো আমাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান সম্পদ যার রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে বিপুল আপেক্ষিক সুবিধা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ‘খোলাবাজার’ নীতিটি যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োগ করতে রাজি নয়। তারা তা প্রয়োগ করতে প্রস্তুত কেবল পুঁজি এবং পণ্য-সেবা পণ্যের ক্ষেত্রে, যে ক্ষেত্রে তার রয়েছে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি আপেক্ষিক সুবিধা। অন্যদিকে, টিকফাতে ‘শুল্ক বহির্ভূত বাধা’ দূর করার শর্ত চাপানো হলেও ‘শুল্ক বাধা’ দূর করার কথা বেমালুম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত তৈরি পোশাক শিল্পের পণ্যের ক্ষেত্রে, গড় আন্তর্জাতিক শুল্ক যেখানে ১২%, যুক্তরাষ্ট্রের তা ১৯%।
পেটেন্ট আইন মানতে হলে সমস্যা কী?
পেটেন্ট কোন প্রতিষ্ঠানকে মেধাসত্ত্ব দিয়ে দেয়। ফলে সে সেই মেধাসত্ত্বের ভিত্তিতে সেই পেটেন্টের সাথে সম্পর্কিত যে কোন বাণিজ্যে সে রয়্যালটি দাবী করতে পারে। যেমন নিমের পেটেন্ট করা আছে আমেরিকার তাই নিম গাছ থেকে উৎপাদিত যে কোন পণ্যে সে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়্যালটি দাবী করতে পারবে। বাংলাদেশ, ভারত, ব্রাজিল সহ বিভিন্ন দেশের নিজস্ব জীববৈচিত্রের অনেক জীব-অণুজীব এবং উদ্ভিদ প্রজাতি এখন বহুজাতিক কোম্পানির পেটেন্টের দখলে। ভারত উপমহাদেশের শতাধিক গাছগাছড়া যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিসে রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষায় রয়েছে। পেটেন্ট আইন বাস্তবায়ন আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। পেটেন্ট এর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এখন আর শুধু সামরিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় বরং ফল ফসল এবং গাছ গাছড়ার উপরও বিস্তৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট আইনে বলা আছে, “কোন কিছুর পেটেন্টের বেলায় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অলিখিত উৎসের অনুসন্ধানের কোন বাধ্যবাধকতা নেই”। এর মানে হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশের প্রচলিত উৎপাদন প্রনালী, জীববৈচিত্র্য, কৃষকদের নিজস্ব শস্যবীজ ইত্যাদি শুধুমাত্র প্রযুক্তি এবং অর্থের জোরে পেটেন্ট করে নিতে পারবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো তাদের উন্নত জেনেটিক টেকনোলজির মাধ্যমে ডি এন এ ফিংগার প্রিন্ট নির্ণয় করে অন্য দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিজ সম্পদকে নিজের বলে পেটেন্ট করিয়ে নেবে। কৃষিতে পেটেন্ট বাস্তবায়ন হলে কৃষকদের শস্য বীজ উৎপাদন, সংরক্ষন, পুনরুৎপাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে। মেধাস্বত্ব আইন অনুযায়ী রয়্যালটি পাবে আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আর ধ্বংস হবে দেশী প্রজাতি, পরিবেশ এবং কৃষি উৎপাদন কাঠামো। বীজ এবং কৃষি পণ্যের দাম অনেকগুন বেড়ে যাবে বলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তৈরি পোশাক শিল্পকেও ব্র্যান্ড নামে ব্যবহূত এদেশের তৈরি এ্যাকসেসরিজের জন্য সংশ্লিষ্ট মার্কিন কোম্পানিকে রয়্যালটি দিতে হবে। বাসমতি চাল, চিরতার রস, নিমের দাঁতন ইত্যাদি হেন বস্তু নেই যা আগেভাগেই মার্কিনীসহ বিদেশি কোম্পানিরা পেটেন্ট করে রাখেনি। মেধাস্বত্ব অধিকারের ধারা প্রয়োগ করে তারা এসবকিছুর জন্য রয়্যালটি প্রদানে বাংলাদেশকে ‘টিকফা’ চুক্তি মাধ্যমে বাধ্য করতে চায়।
টিকফাতে শ্রমিক বান্ধব ধারাও কী আছে?
মোটেও না। টিকফার প্রস্তাবনায় মানবাধিকার, শ্রমের মান এবং শ্রমজীবীদের অধিকার ও পরিবেশগত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তার লক্ষ্য শ্রমজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নয় বরং এগুলোকে নন- ট্যারিফ (অশুল্ক) বাধা হিসেবে ব্যাবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তার বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। মানবাধিকার, শ্রম পরিবেশের মান ইত্যাদি বিষয়কে অশুল্ক বাধা হিসাবে চিহ্নিত করে মার্কিনীরা ‘টিকফা’ চুক্তি দ্বারা বাংলাদেশকে উত্তরণ অসাধ্য প্রতিকূলতায় আটকে ফেলার ফন্দি করেছে। কয়েক শতাব্দী ধরে তারা আমাদের মতো দেশে ঔপনিবেশিক শাসন চালিয়ে, নিজ নিজ দেশে নির্মম ও অমানবিক শ্রম-শোষণ চালিয়ে, শ্রম পরিবেশের ক্ষেত্রে দাস সুলভ মান বজায় রেখে এখন উন্নত ধনী দেশে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা উন্নয়নের পথ গ্রহণ করা মাত্রই সমানে সমানে প্রতিযোগিতায় নামার কথা বলে আমাদের ওপরে তাদের মতো সমান মাত্রার শর্তাবলী চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এ যেন, হাত-পা খোলা মোটা তাজা মানুষ কর্তৃক পেছনে হাত বাঁধা অনাহারী মানুষকে সমানে সমানে কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো!
চুক্তির জন্য কেন এতো গোপনীয়তা?
বাংলাদেশের সংবিধানে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ‘বিদেশের সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে, এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন; তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোনো চুক্তি কেবলমাত্র সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।’ যেহেতু টিকফা কোন নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তি নয় তাই সে চুক্তির ধারা গুলো প্রকাশ না করাটা সংবিধান বিরোধী। ‘টিকফা’ চুক্তির ধারাসমূহ নিয়ে গোপনীয়তা ও রাখঢাক করার যে চেষ্টা চলছে তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক
টিকফা চুক্তি কী বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়গ বাড়াবে? বাংলাদেশের পণ্য রফতানী বাড়াবে?
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের দেশে বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়বে, সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়বে আমাদের পণ্য রফতানিও। এশিয়ার দুটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি গণচীন এবং ভারত তার রফতানির যথাক্রমে ২১ এবং ১৯% পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করলেও তারা এই চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। অর্থাৎ টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানির সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রফতানিতে প্রধান বাধা হচ্ছে শুল্ক বাধা। বর্তমানে বাংলাদেশি পোশাক রফতানিকারকদের যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৫.৩% শুল্ক দিতে হয় অন্যদিকে চীনকে পরিশোধ করতে হয় মাত্র ৩% তাহলে দেখা যাচ্ছে চীন টিফা চুক্তি স্বাক্ষর না করেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম শুল্কে পণ্য রফতানি করতে পারছে। তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের লোভ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে কিন্তু টিকফা এগ্রিমেন্টে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কোন নিশ্চয়তা রাখা হয়নি কারণ প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় দেশ নিজ নিজ বাজারে পণ্য প্রবেশে নন ট্যারিফ বা অশুল্ক বাধা দূর করবে। কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অশুল্ক বাধা খুব সামান্যই।
যুক্তরাষ্ট্র কেন এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এতটা আগ্রহী?
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাইরে স্বল্পোন্নত দেশের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্যই আমেরিকা সহযোগিতামূলক উদ্যোগের ছদ্মাবরণে টিফা বা টিকফার মত দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলো করার চেষ্টা করছে। যদি স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করা যায় তবে আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক ফোরাম ডব্লিউ,টি,ও এ আমেরিকা তার আধিপত্যবাদী বাণিজ্য নীতি বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে। এই লক্ষ্যেই পাকিস্তান,সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ইরাক, উরুগুয়েসহ বিশ্বের ৩০ টিরও বেশি দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই টিফা চুক্তি সাক্ষর করেছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতা হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছে। বিশ্বব্যাপী পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিপরীতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য এসব ফোরামে বাংলাদেশ যাতে কোন ভূমিকা না রাখতে পারে সেজন্য বাংলাদেশকেও টিকফা চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে যুক্তরাষ্ট্র কেননা টিকফা স্বাক্ষর হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া আর সম্ভব হবে না। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার প্রশ্নে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে চায়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র মনে করে গণচীনের অব্যাহত উন্নয়ন ও পরাশক্তি হিসেবে চীনের অভাবনীয় অগ্রগতি ঠেকাতে এবং দক্ষিন এশিয়ার বিশাল বাজারের উপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে বঙ্গোপসাগরে এবং ভারতমহাসাগরে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি বজায় রাখতে হবে। আর বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা বজায় রাখতে হলে বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আঞ্চলিক পার্টনার বানাতে আগ্রহী। ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা ইস্যুতে ঢাকার কাছ থেকে অধিকতর সহযোগিতার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাচ্ছে কেননা এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ মার্কিন বলয়ে আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য যে, দোহায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে গৃহীত ‘দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডার’ মূল বিষয়গুলো হলো—অ-কৃষিপণ্যের বাজার উন্মুক্তকরণ, কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার, মেধাজাত সম্পত্তি অধিকার (ট্রিপস) এবং সার্ভিস বা পরিবেশ খাতে বিনিয়োগ উদারিকরণ ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের স্বার্থ অভিন্ন নয়। বরং এসব ক্ষেত্রে মার্কিনের স্বার্থের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থের গুরুতর বিরোধ আছে। অথচ ‘সোফা’ চুক্তির সুবাদে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে মার্কিনের পক্ষে এবং স্বল্পোন্নত দেশের বিপক্ষে বাংলাদেশকে দাঁড় করানোর সুযোগ পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিপাক্ষিক ‘সোফা’ চুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে অবস্থান নিতে বাধ্য করতে পারবে। একথা সকলেই জানেন যে, বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলো তাদের অভিন্ন ও সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণে সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক ও বহুপাক্ষিক নানা ফোরামে অবস্থান নিতে পারে। কিন্তু টিফার মতো দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কারণে বাংলাদেশ তা স্বাধীন মতো করতে পারবে না। শুধু তাই নয় বহুপক্ষীয়ভাবে যে কোনো বিরোধ নিরসনের সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। ‘টিকফা’ চুক্তির কারণে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় আন্তর্জাতিক পরিসরে বহুপাক্ষিকভাবে প্রচেষ্টা চালাবার সুযোগ নিরঙ্কুশভাবে পাবে না। উপরন্তু বাণিজ্য সমস্যা বহুপক্ষীয়ভাবে সমাধানের বদলে তা মার্কিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের ফাঁদে পড়বে বাংলাদেশ। একপক্ষ প্রবল শক্তিশালী হলে দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান স্বাভাবিক কারণেই দুর্বলের নয় বরং সবলের পক্ষেই যায়। সে কারণে বাংলাদেশকে সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।
জি এস পি সুবিধার পাবার প্রশ্নের সাথে কি টিকফা চুক্তি যুক্ত?
ঢাকায় নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা গত ২৮ জুলাই আবারো এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, “টিকফা চুক্তি সই না করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে না।“ টিকফা চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে দরকষাকষিকে ‘অস্বস্তিকর’ বিষয় উল্লেখ করে তিনি জানতে চান, “এতে খারাপ কী আছে? আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না।” টিকফার সাথে জি এস পি সুবিধার কোন সম্পর্ক নেই। দোহা নীতি অনুসারে আমেরিকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার কথা যেটাকে সাধারণভাবে জি এস পি সুবিধা বলা হয়। আমেরিকা ঠিকই বাংলাদেশের ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দিয়েছে তবে তাতে ঐসব পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার রপ্তানির পরিমান খুবই কম। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাককে এর বাইরে রাখা হয়েছে। সেই সব পণ্যের জন্য জি এস পি সুবিধা থাকা আর না সমান কথা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের যে গার্মেন্টস পণ্য রফতানি হয় তার ওপর উচ্চহারে শুল্ক বসিয়ে রেখেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের গড় আমদানি শুল্ক হার শতকরা ১ ভাগের মতো। কিন্তু বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ ভাগ। এই শুল্কহার আন্তর্জাতিক বিধিরও পরিপন্থী। এই শুল্ক এমনিতেই বাতিল হওয়া দরকার। এবছরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কবাবদ প্রদান করেছে প্রায় ৫৬০০ কোটি টাকা। এটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ঋণ অনুদান নানাভাবে বাংলাদেশে আসে আসে তার ৬ গুণেরও বেশি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়, বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থের যোগান দিচ্ছে।
জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে রচিত ‘টিকফা’ চুক্তি পুরোটাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তা আরেকটি সর্বনাশের বার্তা। দেশের গলায় আরেকটি ফাঁস পরানোর এই পাঁয়তারা দেশপ্রেমিক জনগণকে রুখতে হবে। এ কর্তব্য সব দেশপ্রেমিকদের।
(লেখাটি সংগৃহিত)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ১৭/০২/২০১৫দারুন কিছু তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। অনেক কাজে আসবে।
-
রাখাল ২৬/১১/২০১৩এই চুক্তি স্বাক্ষর করা আর স্বাধীনতাকে বিক্রি একই কথা । রাজনীতি ব্যবসায়ীরা আমাদের দাস হিসেবে বিক্রি করলে এমন কী সমস্যা । তারা আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি । দেশসহ নয় আমাদের নির্বাসন দিলো, তাতে ক্ষতি কী!
-
সুমাইয়া বরকতউল্লাহ্ ২৬/১১/২০১৩টিকফা কী আমিও জানি না। এখন জানলাম।
আপনাকে ধন্যবাদ। -
সায়েম খান ২৬/১১/২০১৩অনেক্ কিছু জানলাম ধন্যবাদ।
-
জহির রহমান ২৬/১১/২০১৩২৫ নভেম্বর আমেরিকার সাথে ‘টিকফা’ নামক এক আত্মঘাতী চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। এ চুক্তির শর্তগুলো একটু জটিল হওয়ায় সাধারণ মানুষের কাছে তা সহজে বোধগম্য নয়। অনেকেই জানেন না, তাদের চোখের সামনে কিভাবে বিক্রি করা হচ্ছে তার প্রিয় মাতৃভূমিকে।
আসুন খুব সহজ ভাষায় দেখি ‘টিকফা’ সই হওয়াতে ভবিষ্যতে কি হতে পারে:
(১) গ্যাস: বাংলাদেশে বিনা শুল্কের লোভে শকুনের মতো প্রবেশ করবে শত শত মার্কিন কোম্পানি, দখল করে নেবে পুরো গ্যাস সেক্টর। তাদের সাথে কখনই প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না সরকারি ও দেশীয় কোম্পানিগুলো। একচ্ছত্র অধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর গ্যাসের দাম এত পরিমাণ বৃদ্ধি করবে যে, তখন বাঙালিরা গ্যাসের উপরে থেকেও রান্নার জন্য সামান্য গ্যাস পাবে না, যেমনি হীরার দেশে থেকেও দু’মুঠো খাবার পায় না সাম্রারাজ্যবাদীদের চক্রান্তে বিধ্বস্ত সিয়েরালিয়নবাসী।
(২) বিদ্যুৎ: সরকারি কোম্পানিগুলো পেরে না ওঠায় দেশীয় বিদ্যুৎ বিভাগ চলে যাবে মার্কিনীদের হাতে। তখন আধুনিকায়নের নামে বিদ্যুতের দাম বাড়বে কয়েকগুণ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে দেয়া, কিন্তু এ চুক্তি হলে উল্টো উচ্চ বিলের কারণে সুবিধা হারাবে শহুরে জনগণ। তখন দেশে উৎপন্ন বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া হবে দেশের বাইরে।
(৩) বন্দর: অবাধ বাণিজ্যের নামে বন্দরগুলো অবাধভাবে ব্যবহার করবে মার্কিনীরা। তখন এ বন্দর ব্যবহার করে আমাদের দেশে মার্কিন সেনাবাহিনী ঢুকালো না অস্ত্র ঢুকলো তার কোনো হিসেব নেয়ার ক্ষমতা থাকবে না বাংলাদেশ সরকারের ।
(৪) টেলিযোগযোগ: টেলিযোগাযোগ খাত আগেই বেসরকারিকরণ হওয়ায়, দেশের অনেক গোপন তথ্যই হারিয়েছি আমারা। বিশেষ করে, কোন রাষ্ট্রেই কখন পার্শ্ববর্তী দেশের মোবাইল কোম্পানিকে জায়গা দেয়া হয় না, সেখানে ভারতের এয়ারটেল বাংলাদেশে প্রবেশ করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভারতের নিয়ন্ত্রণে রাখছে। যা আমাদের জন্য খুবই পরিতাপের বিষয়।
তবে এ খাতে মার্কিনীরা প্রবেশ করলে তাদের অধিকতর পোদ্দারিতে অতিষ্ঠ হয়ে ঊঠবে জনগণ, কারণ মার্কিনীদের আড়িপাতার জঘন্য রেকর্ডের জন্য তারা সারা বিশ্বেই কুখ্যাত ।
(৫) শিক্ষা: শিক্ষাখাতে মার্কিনীদের প্রবেশ, আর জাতির মেরুদ-কে ড্রোন দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া একই কথা। আধুনিকায়নের কথা বলে সিলেবাসসহ সর্বত্র বাদ দেয়া হবে ইসলামকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পশ্চিমের মতো ধর্ম চর্চা নিষিদ্ধ করা হবে। বিজাতীয় অপসংস্কৃতি দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
(৬) স্বাস্থ্য: সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্বাস্থ্য খাত। ওষুধের গুণগত মানের কথা বলে মার্কিন নীতি চাপিয়ে দেয়া হবে দেশীয় কোম্পানিগুলোর ঘাড়ে। কথিত নীতি বাস্তবায়ন করতে মারাত্মক বৃদ্ধি পাবে ওষুধের দাম। এখন যদি একপাতা এন্টাসিড কিনতে যদি খরচ হয় ১৫ টাকা, তবে তখন খরচ হবে ১৫০ টাকা। মানুষ সামান্য ওষুধের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। একই সাথে মার্কিন কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পথে বসে যাবে দেশীয় কোম্পানিগুলো।
(৭) পরিবহন সেক্টর: পরিবহণ খাত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সেক্টর। দেশের পরিবহন সেবা না নিয়ে দেশের কোনো নাগরিক থাকতে পারে না। দেশের কোটি কোটি জনগণ এ খাতের সাথে জড়িত, এ খাতের আয়ও প্রচুর। কিন্তু মার্কিনিরা এ ছোট্ট দেশে প্রবেশ করলে তারা বিনিয়োগের মাধ্যমে যে কোনো উপায়ে একচ্ছত্র অধিপত্র প্রতিষ্ঠা করবেই, ফলে বাংলাদেশের সমস্ত পরিবহন মালিকদের পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। আর আমাদের টাকা নিজ দেশে নিয়ে যাবে মার্কিনিরা।
(৮) পথে বসবে দেশীয় ব্যবসায়ীরা: সকল ব্যবসার ক্ষেত্রেই, মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির কাছে পেরে না উঠায় রাস্তায় বসে যাবে দেশীয় ব্যবসায়ীরা। আর এই সুযোগে একচেটিয়া অধিকার পেয়ে সবকিছুর দাম আকাশে উঠাবে মার্কিনীরা। মূলত, এই কারণেই ভারত ও চীন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টিকফা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়নি।
(৯) মার্কিন ঘাঁটি স্থাপন: এ চুক্তির সবচেয়ে ভয়াবহ ফলাফল হচ্ছে, এ চুক্তি বাস্তবায়নের নামে বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনিদের ঘাটি তৈরির পথ সুগম হবে। উল্লেখ্য, চীনের সাথে পেরে উঠতে এ অঞ্চলে সন্ত্রাসী মার্কিনিদের ঘাটি তৈরির বিকল্প নেই, আর ভৌগোলিক দিক থেকে সর্বাধিক উপযুক্ত স্থানে থাকায় বাংলাদেশে তাদের ঘাঁটি স্থাপনের স্বপ্ন বহুদিনের।
সর্বোপরি এ চুক্তি হচ্ছে, একদিক থেকে বাংলাদেশকে আফ্রিকার মতো ভিখারী বানানোর চুক্তি, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিনিদের দস্যুবৃত্তি বিস্তারে গোপন কৌশল। -
জহির রহমান ২৬/১১/২০১৩যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ টিফা চুক্তি(খসড়া)
(৩০ জানুয়ারী ২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্ভাব্য Trade and Investment Framework Agreement
বা TIFA চুক্তির খসড়া)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার-
১) দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বের বন্ধন ও সহযোগিতার চেতনা উন্নত করার আকাঙ্খা পোষণ করে;
২) ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এর মাধ্যমে উভয় দেশের জনগণের বৃহত্তর কল্যানের জন্য কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ;
৩) উভয় দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক আন্ত:সম্পর্ক আরো এগিয়ে নেয়ার আকাঙ্খা পোষণ করে;
৪) আন্তর্জতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির আকাঙ্খা পোষণ করে;
৫) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অবাধ পরিবেশ তৈরীর গুরুত্বকে স্বীকৃতি প্রদান করে;
৬) উভয় পক্ষের জন্যই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কার্যক্রম বৃদ্ধি লাভজনক এবং সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা উভয় পক্ষকেই এইসব সুফল থেকে বঞ্চিত করে- এই বিষয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে;
৭) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায়(WTO) উভয় দেশের সদস্য পদের বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে এবং WTO এর প্রতিষ্ঠাতা চুক্তি Marrakesh Agreement এবং অন্যান্য চুক্তি ও সমোঝাতা এবং এর সাথে সম্পর্কিত ও এর পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় থাকা অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট ইত্যাদির আওতার মাঝে প্রত্যেক পক্ষের নিজস্ব অধিকার ও বাধ্যবাধকতার বিষয়গুলোকে লক্ষ্য রেখে;
৮)প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাণিজ্য বিকাশ, প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করা ইত্যাদির জন্য দেশী এবং বিদেশী ঊভয় ধরণের বেসরকারী বিনিয়োগের আবশ্যিক ভূমিকার বিষয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে;
৯) দুই দেশের মধ্যকার বেসরকারী খাতের কণ্ট্রাক্ট কে উৎসাহিত করা এবং সুবিধাদি দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে;
১০) বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক সমস্যাগুলোর যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের আকাঙ্খাকে স্বীকৃতি প্রদান করে;
১১) বিনিয়োগ বিষয়ে পারস্পরিক অনুপ্রেরণা এবং সংরক্ষণের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাঝে মার্চ ১২, ১৯৮৬ সালে স্বাক্ষরকৃত চুক্তির (Bilateral Investment Treaty) স্বীকৃতি প্রদান করে;
১২) এই চুক্তি প্যারাগ্রাফ ১১ তে উল্লেখিত চুক্তির আওতায় উভয় পক্ষের অধিকার ও বাধ্যবাধকতাগুলোকে অস্বীকার করে না;
১৩) দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক ও উভয়ের অর্থনীতিতে সেবা খাতের বাণিজ্য বৃদ্ধির গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে;
১৪) উভয় দেশের বাজারে প্রবেশের সুবিধাদি বৃদ্ধি করার জন্য অ-শুল্ক বাধা দূর করার প্রয়োজনীয়তা এবং এর ফলে পারস্পরিক সুফল পাওয়ার বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখে;
১৫) বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার বা intellectual property rights (Trade-Related Aspects of Intellectual (Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights (TRIPS) বিষয়ক চুক্তি বা অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি রক্ষার প্রচলিত নীতি ) এর পর্যাপ্ত এবং কার্যকর প্রয়োগ এবং সুরক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করে।
১৬) প্রত্যেক দেশের নিজ নিজ শ্রম আইনের পর্যাপ্ত ও কার্যকর প্রয়োগ এবং সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত শ্রমিক ব্যবস্থাপনা (labor standards) আরও ভাল ভাবে মেনে চলা গুরুত্ব স্বীকার করে;
১৭) টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক এবং পরিবেশবিষয়ক নীতি মালা নিশ্চিত করতে ইচ্ছা পোষণ করে;
১৮) আকাঙ্খাকা পোষণ করে যে এই কাঠামোগত চুক্তি (Framework Agreement ) দোহা উন্নয়ন এজেন্ডা সফলভাবে পরিপূর্ণ করার লক্ষে যৌথ প্রচেষ্টা জোরদার করার মাধ্যমে বহুপাক্ষিক বাণিজ্যকে আরও শক্তিশালী করবে; এবং
১৯) উভয় দেশের বাণিজ্য উদারীকরণ ও নিজেদের মধ্যকার বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দ্বি-পাক্ষিক প্রকৃয়া প্রতিষ্ঠা উভয় দেশের জন্য লাভজনক- এই বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখে।
এ লক্ষ্যে উভয় পক্ষ নিম্নোক্ত বিষয়ে একমত পোষণ করছেঃ
আর্টিকেল একঃ চুক্তিকারী পক্ষদ্বয় এই চুক্তির আওতায় নিজ নিজ দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা খাত সম্প্রসারিত করবে। তারা নিজেদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও চাহিদা মোতাবেক সুদূরপ্রসারী উন্নয়নের লক্ষ্যে পণ্য ও সেবা খাত অধিকতর নিরাপদ ও দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্য সহজতর করার উদ্দেশ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আর্টিকেল দুই: চুক্তিকারী পক্ষদ্বয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত একটি ‘কাউন্সিল’ গঠন করবে। কাউন্সিলে দুই দেশেরই প্রতিনিধিত্ব থাকবে। বাংলাদেশ পক্ষের সভাপতি থাকবেন বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী হবে United States Trade Represntative (USTR)। দুই পক্ষই তাদের যথাযথ পরিস্থিতি ও প্রয়োজনানুযায়ী সরকারের অন্যান্য অঙ্গ-সংগঠনগুলো থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা গ্রহণ করতে পারবে। কাউন্সিল নিজ কাজের সুবিধার্থে ঐকমত্য সহকারে অথবা আলাদাভাবে Joint Working Group প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
আর্টিকেল তিনঃ কাউন্সিলের উদ্দেশ্যাবলী হবে নিম্নরূপঃ
১·বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্র সনাক্তকরণ এবং যথাযথ ফোরামে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
২·চুক্তির আওতার বাইরে বিশেষ বাণিজ্য কিংবা বিনিয়োগ ক্ষেত্রে পক্ষদ্বয়কে চুক্তির নিয়মাবলী অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করা।
৩·দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে বাধাসমূহ চিহ্নিতকরণ ও অপসারণ
৪·কাউন্সিলের সাথে যুক্ত বিষয়ে চুক্তিকারী পক্ষদ্বয়কে যথাযথ ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টর থেকে প্রয়োজনীয় উপদেশ গ্রহণে সাহায্য করা।
আর্টিকেল চারঃ দ্বি-পাক্ষীয় এই চুক্তির আওতার বাইরে কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কাউন্সিল পক্ষদ্বয়ের যে কোন একটির অনুরোধে সুবিধাজনক সময়ে ও স্থানে আলোচনায় বসতে পারে। কোন অবস্থাতেই কোন পক্ষ এককভাবে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না যা দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
আর্টিকেল পাঁচঃ এই চুক্তিটি কোন পক্ষের প্রচলিত অভ্যন্তরীণ আইন এবং কোন পক্ষের স্বাক্ষরিত অন্যকোন চুক্তির ফলে প্রাপ্য অধিকার ও দায়বদ্ধতাকে ব্যাহত করবে না।
আর্টিকেল ছয়ঃ চুক্তি স্বাক্ষরের দিন থেকেই এটা দুই দেশে কার্যকর বলে গণ্য করা হবে।
আর্টিকেল সাতঃ এই চুক্তি দ্বি-পাক্ষীয় সম্মতিতে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কিংবা এক পক্ষ দ্বারা অপর পক্ষকে ছয় মাসের পূর্ব নির্ধারিত নোটিশ ব্যতিরেকে, য়থাশক্তিতে বলবৎ থাকবে।
টিফা কি স্রেফ একটা বাণিজ্য চুক্তি?
টিফা চুক্তির প্রস্তাবনা কিংবা ধারায় ব্যাবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ইত্যাদি কথা থাকলেও চুক্তির ব্যাবহার কিন্তু স্রেফ বাণিজ্যিক নয়। উল্ল্যেখিত উইকিলিকস প্রকাশিত বার্তা থেকে দেখা যায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশের সাথে টিফা স্বাক্ষরের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছেন:
“I would like to stress our compelling political, economic, and potentially commercial reasons for securing a TIFA with Bangladesh….We have important strategic reasons for helping Bangladesh succeed, politically and economically, and approving the Bangladesh TIFA would be a significant step in thatdirection.” (সূত্র: ৫)
কাজেই দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থই নয়, সেই সাথে রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণেও বাংলাদেশের সাথে টিফা স্বাক্ষরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বাস্তবে বহুপাক্ষিক ফোরামগুলোতে স্বল্পন্নোত দেশগুলো জোট বাধতে থাকায় মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বহুপাক্ষিক ফোরামগুলোতে তার স্বার্থ হাসিল করা ক্রমশ কঠিন হয়েপড়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার লক্ষ হলো বহুপাক্ষিক ফোরামে তার স্বার্থ বিরোধী তৎপরতা বন্ধ ওদুর্বল দেশগুলোর সাথে আলাদা আলাদা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে একদিকে অধিকতর বাণিজ্য সুবিধা আদায় অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রে প্রাধান্যবিস্তার। এই প্রেক্ষিতে একটা বিষয় লক্ষণীয়। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যতগুলো দেশের সাথে টিফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তার কোনটির সাথেই কিন্তু তার সম্পর্ক স্রেফ বাণিজ্য কেন্দ্রিক নয়। সবচেয়ে বাণিজ্যিক লেনদেন যেসব দেশের সাথে যেমন: কানাডা, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ইত্যাদির সাথে কিন্তু আমেরিকার কোন টিফা নেই। টিফা আছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের সাথে,দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্তমহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপিনস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের সাথে, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে আলজেরিয়া, বাহরাইন, মিশর, জর্জিয়া, আইসল্যান্ড, ইরাক, কুয়েত, লেবানন, ওমান, কাতার, সৌদিআরব, টিউনিশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেনের সাথে, আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে ক্যারীবিয়ান দেশগুলো ও উরুগুয়ের সাথে এবং আফ্রিকা অঞ্চলের মধ্যে অ্যাঙ্গোলা, ঘানা, লাইবেরিয়া, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি দেশের সাথে।(সূত্র: ৬) দেশগুলোর তালিকা একটু খেয়াল করলেই বোঝা কঠিন নয় টিফা নামের এই বাণিজ্য চুক্তিটি আসলে যতটা না বাণিজ্য বিষয়ক তার চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বের দেশে দেশে আমেরিকার রাজনৈতিক-সামরিক স্ট্রাটেজি বা কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহ্রত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিগুলোকে ব্যবহার করে তার দুর্বল পার্টনাদের কাছ থেকে বিবিধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সুবিধা হাসিল করে নেয়। ইরাক আগ্রাসন কিংবা ”সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” ইত্যাদি ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান কিংবা মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোকে ব্যাবহার করার কাজে দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিগুলোকে কাজে লাগানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্য আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি রবার্ট জোয়েলিক এর বক্তব্যটি স্মরণীয়:
”পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব সন্ত্রাস দমনের বিরুদ্ধে পরস্পের সহযোগী। একটা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে যেন উভয় অর্থনীতির রপ্তানিকারক ও বিনিয়োগকারীরা নতুন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে এবং সন্ত্রাস দমনের জন্য উপযুক্ত অর্থনৈতিক বাস্তবতা তৈরী করতে সহায়তা করতে পারে।” একই ভাবে জোয়েলিক ২০০৪ এর মার্চ মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে টিফা চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ও বলেন এ চুক্তি ”অর্থনৈতিক স্তরে উভয় দেশের সম্পর্ককে শক্তিশালী করবে যা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধকে আরও শক্তিশালী করতে সম্পূরক ভূমিকা পালন করবে”।(সূত্র: ৭)
কাজেই টিফা চুক্তিকে স্রেফ আর দশটা সাধারণ বাণিজ্যচুক্তি হিসেবে দেখলে চলবে না।
ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটসের বাস্তবায়ন:
টিফা চুক্তির প্রস্তাবনা ১৫ তে বুদ্ধিবৃত্তিজাত সম্পত্তির অধিকার বা intellectual property rights (Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights ev TRIPS) বিষয়ক চুক্তি বা অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিজাত সম্পত্তি রক্ষার প্রচলিত নীতির পর্যাপ্ত এবং কার্যকর প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। অথচ ২০০৫ এ ডব্লিও টি ও এর দেয়া ঘোষণা অনুসারে বাংলাদেশ সহ অন্যান্য এলডিসি দেশগুলো ডবি−উ টি ও এর আওতায় ২০১৩ সাল পর্যন্ত ট্রেডমার্ক, কপিরাইট, পেটেন্ট ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সম্পর্ক আইনের আওতার বাইরে থাকার সুযোগ পেয়েছে আর ফার্মাসিউটিক্যালসগুলো পেয়েছে ২০১৬ সাল পর্যন্ত।(সূত্র: ৮) বলা হচ্ছে যেহেতু প্রস্তাবনা ৭ অনুসারে টিফা চুক্তিতে ডবি−উ টি ও এর আইন ও সমঝোতার আওতায় প্রত্যেক দেশের নিজ নিজ দ্বায়িত্ব ও অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে ফলে ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তিজাত সম্পত্তি রক্ষার আইন বিষয়ক টিফার প্রস্তাবনা কার্যকর হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। অথচ বলা হচ্ছে না প্রস্তাবনা ৭ এর আরো পরের প্রস্তাবনা ১৮’র আওতায় ডবি−উ টি ও এরই দোহা এজেন্ডা বাস্তবায়নের অঙ্গিকারের কথা ।
২০০১ সালে দোহায় অনুষ্ঠিত ডবি−উ টি ও এর মন্ত্রীসভা থেকে যে ঘোষণাগুলো আসে সেগুলোই দোহা এজেন্ডা নামে পরিচিত। এ ঘোষণার অন্যতম এজেন্ডা হচ্ছে ট্রিপস বাস্তবায়ন যা ঘোষণাটির ১৭, ১৮ এবং ১৯ নম্বর আর্টিক্যাল তিনটিতে ব্যক্ত করা হয়েছে।(সূত্র: ৯)
অর্থাৎ প্রস্তাবনা ৭ এককথায় পরিবর্তি প্রস্তাবনা ১৮ এর মাধ্যমে বাতিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে সন্দেহ নাই যে টিফা স্বাক্ষরের সাথে সাথে প্রস্তাবনা ১৫ অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বাধ্য করবে ট্রিপস বাস্তবায়ন করতে ফলে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস বা ঔষধ শিল্প, কম্পিউটার-সফওয়ারস সহ গোটা তথ্যপ্রযুক্তি খাত আমেরিকার কম্পানিগুলোর পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির লাইসেন্স খরচ বহন করতে করতে দেউলিয়া হয়ে যাবে। শুধু তথ্য প্রযুক্তি খাতেই দেশকে মেধাসত্ত্ব আইনের অধীনে সফটওয়্যার লাইসেন্স বাবদ ৫০ কোটি ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। ২০০৮ সালে Business Software Alliance (BSA) এর করা এক সমীক্ষা অনুসারে গোটা এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সফ্টওয়ার ”পাইরেসির” হার সবচেয়ে বেশি- ৯২% আর ৯০% পাইরেসি নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে শ্রীলংকা। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত শ্রীলংকা-আমেরিকা ৭ম টিফা বৈঠকে আমেরিকার বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল ডিলানির নেতৃত্বাধীন বাণিজ্য প্রতিনিধি দল এ বিষয়ে শৃলংকার উপর তীব্র চাপ প্রয়োগ করে। বৈঠকে মাইকেল ডিলানি বলেন:
“We’d like to see a strengthened focus on intellectual property protection and strengthened enforcement.” (সূত্র: ১০)
অর্থাৎ ” আমরা দেখতে চাই মেধাসত্ত্ব সংরক্ষণের উপর জোর দেয়া হচ্ছে এবং এ আইন বাস্তবায়ন জোরদার হচ্ছে।”
সফটওয়্যার পাইরেসিতে ২য় স্থান অধিকারকারী শ্রীলংকার উপর যে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে তা থেকে সহজেই অনুমেয় ১ম স্থান অধিকারী বাংলাদেশের অবস্থা কি হবে।
মার্কিন কবলে পড়বে সেবা খাত:
চুক্তির প্রস্তাবনা ৮ এ প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাণিজ্য বিকাশ, প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরানি¡ত করা ইত্যাদির জন্য সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের ধনাত্বক ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। তো কোন খাতে ঘটবে এ বিনিয়োগ সে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায় প্রস্তাবনা ১৩ তে এসে যেখানে সেবা খাতের বাণিজ্য বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ টিফার মাধ্যমে বাংলাদেশের সেবা খাত মার্কিন বেসরকারী পুজির বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের জ্বালানীসহ বিভিন্ন সেবা খাতে বিনিয়োগ করতেই আগ্রহী সে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কথা থেকেই:
” গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক জ্বালানি কোম্পানি শত শত মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশে এখনও বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানী দরকার। যুক্তরাষ্ট্র এসব খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।”(সূত্র: ১১)
আর যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে এসব খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দেয়ার জন্যই জ্বালানী খাতে বাপেক্স বা পেট্রোবাংলাকে যেমন দুর্বল করে রাখা হয়েছে ক্রমশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, বন্দর, ডাক ও যোগাযোগ খাতেরও একই অবস্থা করা হবে। এবং একসময় জ্বালানী খাতের মত অন্যান্য খাতের ক্ষেত্রেও বলা হবে বাংলাদেশের দক্ষতা নাই, প্রযুক্তি নাই, অর্থ নাই, সুতরাং মার্কিন বহুজাতিকের বিনিয়োগ ছাড়া আর উপায় কি! অথচ এই সব সেবা খাতে আমাদের মোট শ্রম শক্তির ২১.৪০ ভাগ নিয়োজিত এবং মোট দেশজ উৎপাদনের ৪১.৩৭ ভাগ আসে এ খাত থেকে। টিফা চুক্তি হলে এসবই চলে যাবে মার্কিন পুজি-বিনিয়োগ কারীদের হাতে, বাণিজ্যিকীকরণের ফলে আরো বেড়ে যাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি সেবার দাম এবং বহুজাতিকের মুনাফার স্বার্থে কাজ হারাবে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক।
বাজার উন্মুক্তকরণ ও কথিত জিএসপি সুবিধা:
একথা এখন সুবিদিত যে টিফা হলে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টের পূর্ব ধাপ। আমেরিকা যত দেশের সাথে টিফা স্বাক্ষর করেছে পরবর্তিতে তাদের তিন ভাগের এক ভাগের সাথে ইতোমধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরও করেছে। বাংলাদেশের বেলায়ও যে তা হবে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন এর আগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সফরে আসা আমেরিকার বাণিজ্য প্রতিনিধি ডিলানি। তিনি বলেছেন:
“Tifa can be a stepping stone to future trade agreements between our nations, but at its heart Tifa is simply an agreement in which both sides agree to meet regularly and explore opportunities to expand economic relations.”(সূত্র: ১২)
অর্থাৎ ”আমাদের দুই জাতির মধ্যে ভবিষ্যত বাণিজ্য চুক্তির প্রাথমিক ধাপ হতে পারে টিফা কিন্তু মূলত টিফা হলো এমন একটি চুক্তি যেখানে উভয় পক্ষ নিয়মিত আলোচনা করা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে একমত হয়।”
আর এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তার যে কোন দিকে যাবে তার ইঙ্গিত পরিস্কার ভাবে টিফা চুক্তির ১৪ নং প্রস্তাবনায় উল্লিখিত অশুল্ক বাধা দূর করণ ও প্রস্তাবণা ১৯ এ উল্লিখিত বাণিজ্য উদারীকরণের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব আরোপ করা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এর আগের বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার চুক্তি অনুসারে আমেরিকার মত উন্নত দেশগুলোতে বাংলাদেশের মতো সল্পোন্নুত দেশ গুলোর মোট ৯৭% পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ দেয়ার কথা। অর্থাৎ কোন স্বল্পোন্নত দেশ ১০০টি পণ্য রপ্তানি করলে ৯৭ টি বিনা শুল্কে রপ্তানি করতে পারবে এবং বাকি ৩ টি পণ্যের ক্ষেত্রে তাকে শুল্ক দিয়ে আমেরিকার বাজারে ঢুকতে হবে। আমেরিকা বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পন্য যেমন: গার্মেন্টস পণ্য, চামড়াজাত পণ্য ও ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্যকে এই ৩% এর মধ্যে ফেলে দেয়ায় বাংলাদেশ কার্যত এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে প্রাপ্য শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার কিছুই পাচ্ছে না। উল্টো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে গড় শুল্কহার ১২% হলেও বাংলাদেশকে আমেরিকার বাজারে ঢুকতে হলে ১৬% শুল্ক দিয়ে ঢুকতে হয়।(সূত্র: ১৩)
প্রশ্ন হলো টিফা হলে কি বাংলাদেশের গার্মেন্টস বা অন্যান্য পণ্য এই ৩% এর বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে? টিফা চুক্তিতে এ বিষয়ে কোন কথাই নেই। চুক্তিতে অ-শুল্ক বাধা বা নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার উভয় দেশেরই তুলে নেয়ার কথা থাকলেও ট্যারিফ বা শুল্ক মুক্ত বাজার সুবিধার কিছুই নেই। টিফার আওতায় বাংলাদেশ যে এ ধরণের কোন কিছুই পাবেনা তা ডিলানির নসিহত থেকেও স্পষ্ট, তিনি মনে করেন:
”শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধার চেয়ে বরং শুল্ক হ্রাস এবং অগ্রাধিকার সুবিধার জন্য বাংলাদেশকে নিরবচ্ছিন্ন সংলাপ চালিয়ে যাওয়া উচিত — আর তৃতীয় বিকল্প হতে পারে দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি(এফটিএ)।”(সূত্র: ১৪)
অর্থাৎ ভয়ংকর ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে আমেরিকার বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশের কোন সুযোগ যে নেই সেটা স্পষ্ট। আর জিএসপি সুবিধা রক্ষার বিনিময়ে টিফা/টিকফা চুক্তি জায়েজ করার জন্য যেসব কথা বলা হচ্ছেতা ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয় কারণ বাংলাদেশ বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জিএসপি সুবিধা পায়ই না! গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এর বক্তব্য থেকেই দেখা যায়:
“যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ক্ষেত্রে সেই অর্থে বাংলাদেশ জিএসপি বা শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না। বরং প্রায় ৭৫ কোটি ডলার শুল্ক আমাদের কাছ থেকে পায় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে বাংলাদেশের মোট রফতানি প্রায় ৪৮০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ পণ্য জিএসপি সুবিধা পায়। কাজেই দেশটি জিএসপি সুবিধা তুলে নিলেও কোনো অসুবিধা হবে না।কারণ আমাদের পোশাক খাত অনেক শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। চাইলেই কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারবে না।” (সূত্র: ১৫)
স্রেফ শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানির সুবিধার বিনিময়ে টিফার মতো জাতীয় স্বার্থ বিরোধী স্বাক্ষর যৌক্তিক হতো কি না, সেই প্রশ্নে না গিয়েও বলা দরকার, যে জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশ পায়ই না, সে জিএসপি সুবিধা কিংবা সেই জিএসপি সুবিধাজাত কথিত ভাবমূর্তির রক্ষার নামে টিফা চুক্তি স্বাক্ষর কোন ভাবেই জায়েজ হতে পারে না।
টিফাতে অ-শুল্ক বাধা তুলে দেয়ার যে কথা আছে তাতে বাংলাদেশের কি কোন উপকার হবে? অশুল্ক বাধা হচ্ছে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য দেশীয় শিল্প কিংবা কৃষিজ পণ্যকে বিদেশী বহুজাতিকের পণ্যের হাত থেকে রক্ষা করার সর্বশেষ হাতিয়ার। বাংলাদেশ যদি মনে করে আমেরিকার রপ্তানিকরা কোন পণ্য বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিংবা দেশের কোন উদীয়মান শিল্পের বা কৃষিজাত পণ্যের জন্য হুমকীস্বরূপ সেক্ষেত্রে এখন চাইলে সেই পণ্য দেশে আমদানী নিষিদ্ধ করতে পারে কিংবা আরো বিভিন্ন ধরণের শর্তের বেড়াজালে ফেলে সে পণ্য আমদানী নিরুৎসাহিত করতে পারে। কিন্তু টিফার মাধ্যমে যদি নাকে খত দিয়ে ফেলে যে আর অ-শুল্ক বাধা আরোপ করবে না তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা টিফা চুক্তি করা শ্রীলংকা কিংবা থাইল্যান্ডের মতোই হবে- থাইল্যান্ডকে চাপ দেয়া হচ্ছে আমেরিকা থেকে জেনিটিক্যালি মডিফাইড বা জিম বীজ আমদানীর উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে আর শ্রীলংকাকে চাপ দেয়া হচ্ছে জিএম খাদ্য আমদানীর উপর থাকা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য।
ভূতের মুখে রাম নাম:
১৬ এবং ১৭ নং প্রস্তাবনায় উল্লিখিত শ্রম আইন এবং পরিবেশ বিষয়ক নীতিমালা মেনে চলার গুরুত্বারোপ আপাত দৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও এগুলোর মাধ্যমে মূলত নীতিগত ভাবে আমেরিকা তার বাজার যেসব ক্ষেত্রে খুলে দেবে, কার্যক্ষেত্রে সে সব খাতে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশে বাধা আরোপে বিভিন্ন ধরনের অজুহাত তৈরী করবে। শুল্ক বহির্ভূত বাধা বা নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার হিসেবে মানবাধিকার, শ্রমমান ও পরিবেশ ইত্যাদি বিষয় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মধ্যে সংযুক্ত করতে বহুদিন ধরে চাপ প্রয়োগ করে চলেছে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র যেন এগুলোকে কাজে লাগিয়ে সে দেশে দেশে অর্থনেতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ হাসিল করে নিতে পারে, বলতে পারে অমুক দেশ মানবাধিকার মানছেনা, অমুক দেশ শিশু শ্রম আইন পালন করছেনা কিংবা পরিবেশ ধ্বংশ করছে সুতরাং এর উপর অবরোধ চাপানো কিংবা হামলা করা জায়েজ। বাস্তবে যে দেশ একবছরের মধ্যে বিনা নোটিশে লাখ লাখ শ্রমিক ছাটাই করাটা ব্যাবসায়ির স্বাধীনতা বলে গণ্য হয়(২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে কেবল সরকারি খাতেই ৬ লক্ষ শ্রমিক ছাটাই হয়েছে) এবং যে দেশ কোন বহুপাক্ষিক পরিবেশ চুক্তি মেনে নেয় না, সেই আমেরিকার মুখে শ্রম আইন ও পরিবেশ বিষয়ক নীতি মালার কথা ভুতের মুখে রাম নাম এর মতই শোনায়।
থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকার অভিজ্ঞাতায় টিফা:
থাইল্যান্ড টিফা চুক্তি করে ২০০২ সালের অক্টোবরে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই থাইল্যান্ডকে বাধ্য করা হতে থাকে আমেরিকার কর্পোরেট মনোপলির স্বার্থে এর বিভিন্ন সেবা খাত বেসরকারী করে দিতে। Electricity Generating Authority of Thailand (EGAT) বেসরকারী করণের উদ্যোগ নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, EGAT বিক্রির পরমর্শক দের মধ্যে অন্যতম কর্পোরেশন Morgan Stanley, Citigroup and JP Morgan Chase and Co. অন্যান্য রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান যেমন: Metropolitan Waterworks Authority, Provincial Waterworks Authority, the Government Pharmaceutical Organization, the Port Authority of Thailand, the Expressway and Rapid Transit Authority of Thailand ইত্যাদি বিক্রি করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। জনগণের তীব্য আন্দোলন সংগ্রাম এর কারণে এগুলো এখন বাস্তবায়ন করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, ১৯৯৯ সাল থেকে থাইল্যান্ড জেনিটিক্যালী ইঞ্জিনিয়ারড বীজ আমদানীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, মুক্ত বাণিজ্যের নামে মনসান্টোর বিটি কটন আর রাউন্ড আপ রেডি কর্ন থাইল্যান্ডের বাজারে ঢুকানোর জন্য আমেরিকা ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করছে। আবার ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস এর আওতায় থাইল্যান্ডের সুগন্ধি চাল জেসমিন এর ও পেটেন্ট করার চেষ্টা চলে। আবার শ্রীলঙ্কার সাথে ২০০২ সালে টিফা চুক্তির সময় আমেরিকা গার্মেন্টস পণ্যের কোটা মুক্ত সুবিধার কথা বললেও বাস্তবে তা না দেয়ার জন্য নানান শর্ত চাপিয়ে দেয়-যেমন রুলস অব অরিজিনের এমন শর্ত যে শ্রীলঙ্কার উৎপাদিত গার্মেন্টস পন্য তেরী হতে হবে আমেরিকান ফ্যাব্রিক্স ব্যবহার করে, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস বাস্তবায়ন ইত্যাদি। ২০০৩ সালে পার্লামেন্ট এ ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস সম্পর্কিত আইন পাশ করতে গেলে তীব্র বাধার সম্মুখীন হয় এবং এক পর্যায়ে আদালতে মামলা পর্যন্ত হয় এবং আদালত মামলাকারীর পক্ষেই রায় দেন।(সূত্র:১৬) সর্বশেষ ২০০৯ সালে ৭ম টিফা বৈঠকে আমেরিকা আবার ট্রিপস বাস্তবায়নের ব্যাপারে শ্রীলংকাকে চাপ দেয় এবং সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জেনিটিক্যালী মডিফাইড ফুড আমদানীর উপর শ্রীলংকার যে নিষেধাজ্ঞা আছে সেটাও তুলে নেয়ার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করে।
এরকম উদাহরণের শেষ নেই, যেখানেই টিফা স্বাক্ষরিত হয়েছে সেখানেই এই ধরণের ঘটনা ঘটছে, অবিলম্বে প্রতিরোধ করা না গেলে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোন কারণ দেখছিনা।
(সংগৃহিত মন্তব্য)