www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

হিজরি সালের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা



সূচনা কথাঃ
হিজরি সনের সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর আদর্শ ও ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। যার সঙ্গে জড়িত আছে বিশ্বমানবতার মুক্তির অমর কালজয়ী আদর্শ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় ও পুণ্যময় জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গমনের ঐতিহাসিক ঘটনা। মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই বর্ষ গণনার উদ্ভব ঘটেছে। এ সময় গণনায় মানুষ চাঁদের গতি ও প্রকৃতির প্রতি নজর রেখেছে। যা আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমের সুরা ইউনুসের ৫নং আয়াতে উল্লেখ করে বলেন, “তিনিই সেই সত্তা যিনি সূর্যকে করেছেন দ্বীপ্তিমান তেজস্বী এবং চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় আলোকোজ্জ্বল করেছেন। আর চন্দ্রের জন্য ক বা মনজিলসমূহ নির্ধারিত করেছেন। যাতে তোমরা বছর সমূহের সংখ্যা গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার।”

হিজরি সালঃ

মুসলিম হিসেবে হিজরি নববর্ষ উদযাপন কিংবা মুসলিমদের গৌরবের দিনটি পালনের ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপকতা লাভ করেনি। আমরা অনেকেই জানি না যে, মুসলিমদের নববর্ষ কোন মাসে হয়? আবার কেউ হয়ত বা হিজরিবর্ষ গণনার সঠিক ইতিহাস জানেন না। হিজরি সনের তারিখের খবরও রাখেন না। এর প্রতি মানুষ আকর্ষণও অনুভব করেন না। তা খুব দুঃখজনক।

বর্ষপঞ্জিঃ

পৃথিবীর প্রতিটি এলাকার লোকজন আপন কাজ সম্পাদনের জন্য দিন-তারিখ ঠিক রাখতে কোনো না কোনো বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করে থাকে। আমরা যে বাংলা সাল ব্যবহার করি তা সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রচলিত। এভাবে খ্রিস্টানরা হজরত ঈসার আলাহিস সালামের জন্মদিন থেকে এর গণনা আরম্ভ করে। যেহেতু এ গণনাকে ইংরেজরা প্রচলন করেছে, তাই এটাকে ইংরেজি সাল বলা হয়। হিজরি সাল বর্তমান বিশ্বের প্রায় দেড়শ’ কোটি তৌহিদি জনতার কাছে অতি পবিত্র, মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ সাল।

বাংলাদেশে প্রচলিত বর্ষপঞ্জিঃ

পৃথিবীতে বর্ষ গণনার দুটো ধারা প্রচলিত। একটির সম্পর্ক সূর্যের গতির সঙ্গে, আর অন্যটির সম্পর্ক চাঁদের গতির সঙ্গে। প্রথমটির নাম সৌর সাল আর দ্বিতীয়টির নাম চন্দ্র সাল। এই দুটো সালের প্রতি বছর ব্যবধান হয় ১০ কিংবা ১১ দিনের। বাংলাদেশে বর্তমানে হিজরি সাল, ইংরেজি সাল ও বাংলা সালের প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে প্রচলিত ওই তিনটি সালের মধ্যে সর্বপ্রাচীন সাল হচ্ছে হিজরি সাল।

হিজরি সনের ইতিহাসঃ

হিজরি সন ১৭ হিজরি সাল (৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) হতে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের শাসক হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা এর শাসন আমলে হিজরি সন গণনা শুর হয়। হযর ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা এর কাছে ইরাক ও কুফার প্রশাসক আবু মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা এক চিঠিতে শাসন কার্যের সাথে সংশ্লিষ্ট উপদেশ, পরামর্শ এবং নির্দেশ সম্বলিত বিভিন্ন চিঠিপত্র ও দলিলে কোন সন-তারিখ না থাকায় তার কার্যের সময় ও কাল নির্ধারণে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার কথা জানান। এ গুরুত্বপূর্ণ পত্র পাওয়ার পর হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে এক পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। পরামর্শ সভায় সর্বসম্মতি ক্রমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মদীনায় হিজরত করার ঐতিহাসিক দিন থেকে নতুন একটি সন তৈরী করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ১৪ বা ১৫ জুলাইয়ের সূর্যাস্তের সময়কে হিজরি সন শুরুর সময় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।

হিজরি সন নামকরণের কারণঃ

হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে হিজরি সন শুরু করার কারণ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর মদীনায় হিজরত করার মাধ্যমে ইসলাম প্রসার লাভ করে, মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, মুসলিমদের শক্তিমত্তা বাড়তে থাকে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, ইসলাম বিজয়ী শক্তিতে পরিণত হয় এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিজরতের কথা গুরুত্বের সাথে কুরআনে উল্লেখ করেছেন। হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে বানানো হয়েছে বলে এ সনকে হিজরি সন বলা হয়।

হিজরি সালের মাস সমূহঃ

মুসলিম বিশ্বে চাঁদের হিসাবে অনেক ইবাদত-বন্দেগি, আমল-অনুশাসন পালিত হওয়ায় হিজরি সালের পবিত্র মাহাত্ম্য ও প্রাচুর্য প্রত্যেক মুসলিমের অন্তর জুড়ে সমান ভাবে বিশেষ মর্যাদায় সমাসীন হয়েছে। মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আওয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ। এই ১২ মাস নিয়ে হিজরি সাল।

বিশেষ দিবস সমূহঃ
হিজরি নববর্ষের শুরুর মাস হচ্ছে মহররম, যার অর্থ হচ্ছে অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। এই মহররমের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা। এই আশুরা সৃষ্টির আদিকাল থেকেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নীরব সাী।
রবিউল আউয়াল মাসের কোন সোমবারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেন।
রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজে গমন করেন, যা লাইলাতুল মেরাজ হিসেবে পরিচিত।
নবম মাস রমজানুল মোবারক সবচেয়ে প্রাচুর্যমণ্ডিত ও মর্যাদাপূর্ণ। এটা সিয়ামের মাস। সহমর্মিতার মাস। তাকওয়া অর্জনের মাস।
শাওয়ালের ১ম তারিখ পালিত হয় পবিত্র ঈদুল ফিতর।
জিলহজ মাসে মুসলমানরা হজ পালন করে থাকে, যা সামর্থ্যবানদের জন্য জীবনে একবার পালন করা ফরজ।
১০ জিলহজ বিশ্ব মুসলিম পালন করে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ।
আরব দেশে প্রাচীনকালে ১২টি মাসের মধ্যে সফর, আউয়াল, রজব, জিলকদ, জিলহজ এই চারটি মাসকে বলা হতো অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। এ চারটি মাসে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মারামারি-খুনাখুনি থেকে তারা বিরত থাকত। পরবর্তীকালে আরবি মাসগুলোর প্রথম মাস সফরে আউয়ালকে মহররম নামকরণ করা হয়।

বাংলাদেশে হিজরি সালঃ
৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিজরি সাল প্রবর্তিত হলে তার এক বছরের মধ্যে তা আমাদের এই বাংলাদেশে চলে আসে আরব বণিকদের হাত ধরে। হিজরি সাল প্রবর্তনের বছর বা তার পরের বছর এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় এবং হিজরি সালও স্বাভাবিক ভাবে আমাদের দেশে প্রচলিত হয়। এই হিজরি সাল আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় সাল হিসেবেও প্রচলিত হয়েছিল, যা প্রায় ৫ শতাধিক বছর স্থায়ী হয়েছিল। এখনও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে হিজরি সালের প্রভাবই বেশি। অন্যান্য সালে নববর্ষ ধুমধামে পালিত হলেও হিজরি নববর্ষ আমরা পালন করি না সেই ধুমধামে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার কারণে।

পরিশেষেঃ
রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিজরতের এই প্রোপট ও পটভূমি যদি হিজরি নববর্ষে স্মরণ করা হয় তাহলে মুসলিম ভাই-বোনরা ইসলামী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারবে। তখনই কেবল ইসলামি সংস্কৃতি বিমুখ হৃদয় পরিবর্তিত হয়ে ইসলামী হৃদয়ে পরিণত হবে। তাই আমাদের উচিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হিজরতের তাৎপর্য স্পষ্টভাবে জনসম্মুখে তুলে ধরা। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৮৪৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১২/০৯/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast