স্নেহের বাঁধনঃ
আপু আস না, দেখ কি সুন্দর করে তোমার গায়ে হলুদের স্টেজ বানিয়েছে।
কি করছ তুমি আপু, আসনা, চল ছাদে যাবে, দেখবে সব কিছু।
বীথি বলল তোরা আনন্দ কর টুনু আমার একটু একা থাকতে দে! লক্ষী বোনটি আমার।
আপু তুমি যে কি? তোমার বিয়ে আর তুমি মন খারাপ করে ঘরে শুয়ে আছ?
টুনু আমার ছোট বোন, এবার এস এস সি পরিক্ষা দেবে, ও খুব আনন্দ করছে কারন ওর বড় আপুর বিয়ে।
কদিন আগেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে পারিবারিকভাবেই। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। পরিবার ও ছোট, সব দিক দিয়েই ভাল তাই বাবা মা আর দেরী করেনি।
আজ কয়েকদিন ধরেই গায়ে হলুদ হচ্ছে। প্রথমে বড় কাকুর বাসায়।
পরের দিন মেজ কাকুর বাসায়, তার পরের দিন ছোট কাকুর বাসায়।বাড়ী ভর্তি লোকজন। ফুফু, মামা, মামী, খালা, খালু, কাজিনরা সবাই এসেছে, সবাই খুব আনন্দ করছে। প্রথম দিকে আমার ও খুব ভাল লেগেছে, কিন্তু যতই বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে কেন জানি খুব মন খারাপ হচ্ছে।নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে শুধু পানি বের হচ্ছে।
বীথি বিছানা ছেড়ে উঠল, ঘরের সবকিছু ও ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে পরম মমতায়। দ্রেসিং টেবিল, পড়ার টেবিল, টেবিল ল্যাম্প, আলমারি, ওর রুমের দেয়ালে অনেক ছবি টানানো রয়েছে, কোনটা বাবা মায়ের সাথে, ভাই বোনের সাথে,ওর বিভিন্ন বয়সের ছবি, ও প্রতিটা ছবি ছুয়ে ছুয়ে দেখছে, আমি আর তোদের সাথে দুই দিন আছিরে, তারপর এই ঘর, এই বাড়ি, সবকিছু ছেড়ে চলে যাব।আমার খুব মন খারাপ তোদের জন্য, তোদের ও কি মন খারাপ আমার মত।
আস্তে আস্তে বিথী প্রিয় বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। কোন কারনে মন খারাপ হলে ও এই বারান্দায় দাড়ায় , আকাশের দিকে থাকিয়ে থাকে। বারান্দার সাথেই শিউলি ফুলের গাছ, কিছু গোলাপের গাছ ও আছে। ও হাত দিয়ে ছুয়ে দিল একটা গোলাপের ফুলকে , জিজ্ঞাসা করল, তোদের কি খুব খারাপ লাগবে আমাকে ছাড়া, আমি ছাড়া তোদের কে যত্ন নেবে, আমি কেমন করে থাকব তোদের ছাড়া।তোরা এরকম মন খারাপ করে আছিস কেন?কথা বলছিস না কেন? আগে তো তোদের কাছে আসলেই দেখি পাপড়ি মেলে ধরতি, আজ কি হয়েছে, তাহলে কি আমার জন্য তোদের ও মন খারাপ।
আস্তে আস্তে ও উঠানে এসে দাঁড়াল যেখানে পেয়ারা গাছ টা দাড়িয়ে আছে, ও নিজ হাতে এই পেয়ারা গাছ টা লাগিয়েছিল, গাছটি ওর কত আপন।
আস্তে করে পেয়ারা গাছটাকে জিজ্ঞাসা করল, তোর কি আমার জন্য খারাপ লাগবে, আমি যখন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব, কেমন লাগবে তোর? আমি তোদের ছাড়া কি ভাবে থাকব, ও বাড়িতে কি তোর মত এরকম গাছ আছে, যে আমাকে তোর মত আপন করে নেবে? গাছের পাতায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চিন্তা করতে লাগল, বাবা যখন এই বাড়ি বানায় তখন আমার বয়স মাত্র পনের বছর। শুরু থেকেই বাড়িটাকে কিভাবে সাজাবে সব আমার পরিকল্পনা মত হত। সবকিছু সবকিছু, ডাইনিং টেবিল কেমন হবে, সোফার কভার কোন রঙ এর হবে, কুশন কভার কেমন হবে, বিছানার চাদর সব আমার পছন্দের কেনা হত।এই বাড়িতে প্রতিটা রুমে যা কিছু আছে সব আমার পছন্দের। আমার সেই পছন্দের সবকিছু ছেড়ে অপরিচিত এক বাড়িতে গিয়ে কিভাবে থাকব আমি?
আমি কি করে থাকব তোদের ছাড়া, এই বাড়ি ছাড়া, মা বাবা, টুনু, আরিফ কে ছাড়া। সকালে ঘুম থেকে ঊঠে আমি এই প্রিয় মানুষ গুলোর মুখ দেখতে পাবনা, বাবাকে আর চা বানিয়ে দিতে পারব না?
বাবা তো আমার বানানো ছাড়া আর কারো হাতের চা খায়না, এই পেয়ারা গাছ বল না বাবা কিভাবে থাকবে, বাবা কি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে, বাবার খুব কস্ট হবে তাই না? টুনু, টুনু কি করবে, ওর তো আমার জন্য খুব মন খারাপ করবে, আর টুনু যখন আরীফকে মারবে তখন ওকে কে বাঁচাবে বল। আমি না থাকলে আরীফ টা তো টুনুর কাছে শুধু মার খাবে। মার কেমন লাগবে রে? মা তো সব কথা আমাকে বলে, আমি চলে গেলে মা কাকে বলবে।
আজকাল যে কি হয়েছে চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ে। আমার চোখে পানি দেখলে বাবার খুব মন খারাপ হবে। কত করে যে চোখ কে বলছি পানি আনিস না ,ও তা শুনছে না, মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে যেন অঝোরে ধারায় বৃষ্টি নামছে। আমি এখন কাঁদছি, আর ভাবছি সবার কথা, মা, বাবা, টুনু, আরীফের কথা, পেয়ারা গাছের কথা, শিউলী ফুলের কথা, এদের ছাড়া আমি থাকব কি করে?এতদিন ধরে একটু একটু করে এই বাড়িতে বাবা মায়ের আদরে, তোদের ছায়ায় আমি বড় হয়েছি, আর মাত্র দুই দিন পর এই স্নেহের বাঁধন ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে।
ইচ্ছা করলেই আমি বাবাকে চা বানিয়ে দিতে পারব না, ছোট ভাই বোনটাকে আদর করতে পারব না। ভাল কিছু খেলে ওদেরকে দিতে পারবনা। কেমন করে থাকব আমি?
বিথী, মা তুই কোথায়?
মা তুই এখানে দাড়িয়ে আছিস আর আমি তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, কাঁদছিস কেন মা?
বাবা আমি তোমাদের ছাড়া কেমন করে থাকব? বলেই হু হু করে কাঁদতে লাগল।
ওর বাবা ও ওকে জড়িয়ে ধরে চোখ মুছতে লাগল আর মাথায় হাত বুলাতে লাগল।
আজ যে শুধু কান্নার দিন। স্নেহের বাঁধন খোলার দিন।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ১১/১১/২০১৪খুব আবেগপ্রবন হয়ে গেলাম। বিচ্ছেদ আমার কখনই পছন্দ না। লেখাটি ভালো লাগলো। আর সবচেয়ে ভালো লেগেছে ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ার, কজ আমিয়ো একজন ইঞ্জিনিয়ার। হাহাহাহ..................
-
দাদা মুহাইমিন চৌধূরী ০৪/০১/২০১৪লেখাটা খুব সুন্দর হয়েছে। মেয়েদের জীবনে এরকম সময় আসে খুব কষ্টের। তবে আপনার লেখায় বক্তার পরিচয়টা ঠিক ভাবে ফুটে ওঠেনি। আপনি কোথাও এমন ভাবে লিখেছেন মনে হচ্ছে বীথির কথা বর্ননা করছেন আবার কোথাও মনে হচ্ছে আপনি 1st person হিসাবে অর্থাৎ নিজেই বীথি হয়ে বর্ননা করছেন। তাই 1st person অথবা 3rd person যেকোনো একভাবে বর্ননা করলে লেখাটি আর ভাল লাগবে আশা করি।
-
সায়েম খান ২৪/১১/২০১৩চমৎকার, চমৎকার লেখা। আমার বাড়িতে দাওয়াত রইল।
-
আফিয়া খাতুন মলি ২৩/১১/২০১৩ভালো লাগলো বেশ।
-
প্রবাসী পাঠক ২২/১১/২০১৩হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া একটি লেখা। মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া প্রতিটি মানুষকেই একদিন এই সময়টা পার করতে হয়। দু চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে প্রতিটি মেয়েই একদিন বাবার বাড়ির চিরচেনা গণ্ডি ছেড়ে স্বামীর বাড়ির উদ্দেশ্যে পারি জমায়।
অল্প কিছুদিনের ভিতর সেই অচেনা অজানা একটি পরিবারকেই তারা স্নেহ মমতা আর ভালবাসা দিয়ে আপন করে নেয়। মহান সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি নারীকেই সেই ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
http://www.youtube.com/watch?v=fFYoL4RncNk -
suman ২২/১১/২০১৩ভীষন touchy... চোখে পানি এসে যায় ...