www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আমার কিশোরবেলা

আমার কিশোরবেলা
ইসমাইল জসীম
ব্যস্ত  সকাল, উদাস দুপুর, চঞ্চল বিকেল এসবের মাঝেই কেটেছে  আমার কিশোরবেলা। অজানাকে জানা নতুনের প্রতি আকর্ষণ,প্রতি মুহুর্তে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লব্ধ করা, জেনে না জেনে ভুল করে সময় পার করা, নিজেকে অনুভব করা সহপাঠিদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠা স্কুল ফাঁকি দেয়া, গুরুজনদের চোখ এড়িয়ে দুরন্তপনা এসব নিয়েই আমার কিশোর বেলা। শৈশব কাটে স্বাভাবিকভাবেই নিজগ্রামে। কিশোরবেলাও কাটার কথা তাই। কিন্তু নানা ভাই পুঁথিসাধক আবদুস সাত্তার চৌধুরি মায়ের কাছে চেয়ে বসলেন আমাকে। সেই থেকে আমার ঠাঁই হলো নানার বাড়ি, রাখলেন তার কাছে; আদরে শাসনে। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর। ইতিমধ্যে হারিয়েছি সেই প্রিয় মানুষটিকে।  নানি, খালা, মামা এবং নতুন যুক্ত হলো মামি পূর্ব সম্পর্কে যিনি আমার ফুফু। তাদের আদর আর শাসন বন্দি ছিলো আমার কৈশোর জীবন। এ সময়টুকু আমার জীবনের একটি সর্ণ্বালী অধ্যায়। মিস করতাম মা্যের আদর, বাবার স্নেহ।
রাজ্যের ঘুম যেনো ভর করে চোখের উপর, কিছুতেই মন চায়না বিছানা ছেড়ে উঠতে। এই জেগেছি তো পাশ ফিরে আবার ঘুম। স্বপ্নের রাজ্যে আমি জেনো এক রাজকুমার। মজার মজার সব চিত্রকল্প ভিড় করে স্বপ্নের আঙিনায়। তারপেরও নানির ডাক হাঁকে না উঠে কি আর পারা যায়? এভাবেই শুরু হতো আমার সকাল। চা বিস্কুট খেয়ে কোরান হাতে মক্তব। প্রসিদ্ধ বেলা বিস্কুট কিম্বা কড়ই(সিদ্ধ চাউল ভাজা)মুড়ি কখনোবা কড়ইয়ের নাড়ু মুড়ির মোয়া। মক্তবের কথা বললেই মনে পড়ে কিছু স্মৃতি। মাওলানা আবদুর রহমান ছিলেন আমাদের লড়িহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, আমাদের মক্তবের হুজুর আর মসজিদের ঈমাম। আমাদের মক্তবে ছিলো তখন কিছু প্রথা। প্রথম যেদিন আরবি শিক্ষার হাতেখড়ি সেদিন খই মুড়ি দিতে হয়, আমপারা কিম্বা কা্যদা পড়া শেষ করে কোরান শরীফ নিলে বড় ধরনের খাবারের আয়োজন করতে হয়। নানি তাই করতেন। আমার মনে পড়ে আমি যেদিন কোরান শরীফ নিয়েছিলাম সেদলন মক্তবের সবাইকে গরুর মাংস আর রুটি পিঠা খাওয়ানো হয়েছিলো। এছাড়া মাঝামাঝি সময়ে আরো কতো কী। এসব বিষয় আরবি শিক্ষা তথা মক্তবের প্রতি আমাদের আকর্ষণ করাতো। শান্তির ব্যবন্থাও ছিলো অন্যরকম। আমার কোরান শিক্ষাটা হ্য় মূলত হাফেজ হারুণ অর রশীদ (মামা)র হাতে। একদিন আয়তুল কুরসি শিখতে দেয়া হয়েছিলো আমাদের। সবাই যথাসময়ে শিখে নিলেও আমি শিখতে পারিনি। যতক্ষণ না শিখতে পেরেছি আমাকে বসে থাকতে হয়েছিলো মক্তবে। তখন খুব খারাপ লেগেছিলো বটেই। বলে রাখি মুখস্ত করাটা আমাকে দিয়ে তেমন একটা হতো না। অর্থ না বুঝে আরবি মুখস্থ করতে গিয়ে আমারও যা হওয়ার হয়েছে। যাক শেষ পর্যন্ত আয়াতগুলো আমার এখনো মনে আছে। যেমনি করে মুখস্থ করেছিলাম ইংরেজি রচনা আর দরখাস্তগুলো। জনৈক শিক্ষক আমাকে মুখস্থ করার একটি পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। একটি শব্দকে দ্রুতার সাথে পাঁচবার পড়ে তারপর পূর্ণবাক্য। যদিওবা পদ্ধতিটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। কী আর করা বেতের ভয়ে ভুতের নাম। না বুঝেই গলদকরণ করেছিলাম আর কী। হুজুর নানার আদেশে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হতো রীতিমত। স্কুলে ফাঁকি দিতে পারলেও মক্তব ফাঁকি দেয়া যেতো না। মাথায় টুপি আর পায়ের গোড়ালির উপর প্যান্ট পরে স্কুলে যেতে হতো।
স্কুল ছিলো অনেক দূরে। দীর্ঘ পখ পাড়ি দিয়ে যেতে হতো স্কুলে। মাঝেমধ্যে পেটে ব্যথার অযুহাত দেখিয়ে, কিম্বা দেরি হয়ে গেছে এই বাহানায় স্কুল কামাই করেছি সে কতোবার! তাছাড়া মনে পড়ে দুয়েকদিন দুষ্টু বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে স্কুল পলায়ন। আমাদের স্কুলটা ছিলো দুতলা বিশিষ্ট। উপর তলা থেকে বইগুলো নিচে ফেলে দিয়ে টিচারদের নাকের ডগার উপর দিয়ে সোজা চলে আসতাম নিচে। এ অপকর্মটা হতো অবশ্যই টিফিনের ফাঁকে। এটা অবশ্যই আমাদের এক ফাঁকিবাজ বন্ধুর নেতৃত্বেই করা হতো। জানতাম পরেরদিন শাস্তি পেতে হবে তারপেরও স্কুল পালিয়ে পখে বাংগি তরমুজ ক্ষেত থেকে এসব চুরি করে খাওয়ার মজাই ছিলো আলাদা। সখ ছিলো না কোন রাজনীতি ফাজনীতিতে, তবে জড়িত ছিলাম সামাজিক সংগঠনের সাথে। সাহিত্য সংগঠনের সাথে। থাকতাম খেলাধূলা নিয়ে। ফুটবলই ছিলো আমার প্রিয় খেলা। গোলরক্ষক হিশেবে খেলতে পছন্দ করতাম।  নিজেকে মোহামেডানের কানন ভাবতে ভালোই লাগতো মনে মনে। আমার কিশোর বেলা ছিলো দুরন্ত আর দুষ্টুমিতে ভরা। মাঝমেধ্যে নানি আমার মাকে বলতেন আমি আর পারছি না তোর ছেলেটা তুই নিয়ে যা। তাবে এটা তার মনের কথা ছিলো না। নানার বাড়ির সবাই আমাকে ভীষণ আদর করতেন আর আমার প্রতি স্নেহমিশ্রিত শ্রদ্ধবোধও ছিলো অনেকের।  আর আমার এই কিশোরবেলায় যাদের আদর্শ আমার জীবন প্রতিষ্ঠা্য় খুব বেশি প্রভাবিত করেছে তারা হলেন আমার নান প্রাচীন পুঁথি সংগ্রাহক গবেষক আব্দুস সাত্তার চৌধুরী এবং মামা গবেষক ও লেখক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী।
যে অধ্যায়টির অবতারণা না করলে  কিশোরবেলার পূর্ণতা ক্ষুণ্ন হয় তা হচ্ছে আমার দুরন্তপনা। দুপুরের খাঁ খাঁ করা রোদ উপেক্ষা করে মামি এর নানিকে ফাঁকি দিয়ে বল হাতে ছুটে যেতাম মাঠে। বৈশাখের খরতাপ রোদেও আমার পদচারণা ছিলো আমগাছের মগডালে। কোন গাছের কোন ডালে আম পেকেছে আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়ানো ছিলো অসম্ভব। সামনের পকুর ছিলো অনেকটা পানিশূন্য। সেখানে আমাদের মতো করে ছোট্ট এক টুকরা জমি বানিয়ে ধান চারা রোপন করতাম সকলে। ছোট ছোট পুকুর বানিয়ে মাছের চাষ। প্রতিদিন কয়েকবার করে দেখতাম পুকুরের মাছগুলো জীবিত আছে কিনা। এসব নিয়ে ঘরে নালিশও এসেছে অনেকবার। সবচেয়ে আনন্দ উপভোগ করতাম যখন বন্যা হতো। চারদিকে পানি আর পানি থৈ থৈ করছে খাল বিল। তখন কলা গাছের ভেলায় চড়ে কোমড় পানির বিল পাড়ি দেয়া, জাল বসিয়ে কই সিং ধরা ছিল আমার সখ। পুকুর পাড়ের গাছের মগডালে উঠে পুকুরের অথৈ পানিতে লাফ দেয়া কিংবা সেতুর উপর থেকে খালের পানিতে ঝাপিয়ে পড়া কতই না আনন্দ হতো তখন আমাদের কিশোর বেলায়! তা ছাড়া ডংগুলি, কানামাছি, ফুটবল, ব্যাটমিন্টন এসব তো ছিলোই।
এই কিশোরবেলায় যে বিষয়টি আমাকে খুব বেশি রোমঞ্চিত করেছে সেটা হচ্ছে প্রেম। যে প্রেম ছিলো প্রকৃতির সাথে, পাখির সাথে, ফড়িঙের সাথে। গাছে উঠে ময়না পাখির ছানা ধরা, ঘাস ফড়িং ধরে জার এর মধ্যে আটকিয়ে রাখা, ফাঁদ পেতে ডাহুক ধরা, প্রজাপতির ডানায় ভর করে রঙিন স্বপ্ন বোনা, কখনো বা নাটায় হাতে রঙ বেরঙের ঘুড়ি উড়ানো। কার ঘুড়ি কতো ছুটতে পারে। কে কাকে কাটতে পারে এসবের প্রতিযোগিতায় হতো আমাদের তখন। সেই কিশোরবেলা আজ কেবলই স্মৃতি। কেবলই স্বপ্ন।
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ৮৩৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৫/১১/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

 
Quantcast