শিক্ষার এপিঠ ওপিঠ
সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আমরা তো কম মাতামাতি করি না, তবুও কিছু দিকে আমরা অবহেলা করে তা অন্ধকারেই রাখি সবসময়। একাট জাতি বা দেশ তখনই উন্নত হয় যখন সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হয় বৈষম্যহীন। আজ কাল আমরা আধুনিক শিক্ষার নামে বা সময়োপযোগী শিক্ষার দোহাই দিয়ে শিক্ষা মাধ্যমের একটা অংশকে শেষ করে দিচ্ছি। অথচ ইসলামের অভ্যুদয় মানবসভ্যতার বিকাশে বৈপ্লবিক যুগান্তর ঘটিয়েছিল। আরবে মুসলিম জ্ঞানসাধনা একাধারে ইসলামি জীবনব্যবস্থা তথা ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার সমন্বিত রূপ হিসেবে বিকশিত হয়। উমাইয়া শাসকেরা খ্রিষ্টীয় নবম শতকে স্পেন ও পর্তুগাল জয় করেন এবং মধ্য ষোড়শ শতক পর্যন্ত মুসলমানেরা সেখানে শাসন করে। এই দীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত গ্র্যানাডা ও কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে ইউরোপে মধ্যযুগের অবসান ও নবযুগের সূচনা হয়।
ধর্মান্ধদের শত বাধা উপেক্ষা করে, আব্বাসীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান চর্চায় নতুন বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল। আব্বাসীয় খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা আল মনসুর ৭৬২ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানী বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠা করেন পরে যা গণিত, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন, চিত্রকলা তথা বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। চীনাদের কাগজ প্রস্তুত প্রণালি ও ভারতীয় সংখ্যা গণনা পদ্ধতি আরব পণ্ডিতদের বিজ্ঞানচর্চায় বিশেষ অবদান রাখে। খলিফা হারুন-আল-রশিদকে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকদের অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি গ্রিক, রোমান, মিসরীয়, বাইজেন্টাইন, পারস্য, ভারতীয় ও চীনা জ্ঞান-বিজ্ঞান মাতৃভাষা আরবিতে অনুবাদ করার ব্যবস্থা গড়ে তোলেন এবং আরবে ভারতীয় গণিতচর্চা, বিশেষ করে সংখ্যা গণনা পদ্ধতি গ্রহণ করে আরবীয় গণিত ও জ্যামিতি চর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। মহামতি আল কিন্দি ভারতীয় গণিতশাস্ত্রের বৈপ্লবিক বিকাশ সাধন করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি গ্রিক ও ইসলামি দর্শনের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। মহাপণ্ডিত আল বেরুনি, আবু নসর মনসুর গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আল খারিজমি ও আল জাবের গ্রিক ও ভারতীয় গণিতের বিকাশ ঘটিয়ে বীজগণিত আবিষ্কার করেন। আলোকবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন আল-হাইছাম। কৃষি ও সেচব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি হয় তখন। আরবরা ওই সময়ে ভারত থেকে ধান, তুলা ও ইক্ষু চাষ, চীন থেকে লেবু এবং আফ্রিকা থেকে সারগম চাষ শেখে এবং আরবে তা উৎপাদন করতে সেচব্যবস্থার উদ্ভাবন করে, যা আধুনিক সেচনির্ভর কৃষির ভিত্তিস্বরূপ।
হারুন আল-রশিদের পুত্র মামুন আল-রশিদ মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার জ্ঞানচর্চার অনন্য কেন্দ্র হিসেবে বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়, বায়তুল-হিকমাহ বা বিজ্ঞানভবন এবং জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় এক হাজার বছরের সাধনায় এশিয়া, আফ্রিকা পেরিয়ে মুসলিম জ্ঞানসাধনা খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতকে প্রথমে ইতালি ও পরে পুরো ইউরোপে রেনেসাঁ অনিবার্য করে তোলে।
এই উপমহাদেশে মাদরাসা শিক্ষার সূচনা ভারতে মুসলিম শাসনের প্রথম যুগ থেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও মুসলিম শাসনের প্রথম যুগ থেকেই মাদরাসা শিক্ষা প্রচলিত। সব ধর্মাবলম্বী মাদরাসায় শিক্ষালাভ করত। তখন শুধু ইসলামি শিক্ষা মাদরাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল না। তাহলে সে শিক্ষালয়ে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরও শিক্ষা লাভ বিবেচিত হতে পারত না। মুসলিম শাসনকালে মাদরাসা শিক্ষা কেমন ছিল, তা অনুসন্ধান করা জরুরি।
মাদরাসা সংক্রান্ত শিক্ষাকোষ-এ বেশ চমকপ্রদ তথ্য আছে। সেখানে সৈয়দ আমীরুল ইসলাম মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রসঙ্গে বলেছেন, আরবি দারস-এর শাব্দিক অর্থ ‘পাঠদান’, এবং যেখানে পাঠদান কাজ চলে তাই মাদরাসা। ইসলামের প্রথম যুগে মদিনায় এ ধরনের শিক্ষাদান কার্যক্রমে সাহাবারাসহ নবী করিম সা: নিয়মিত অংশ নিতেন। মসজিদের একটি পৃথক অংশে পাঠদান কাজ চলতো। তবে আব্বাসীয় বাদশাহ আল-মামুন তার প্রতিষ্ঠিত বায়তুল-হিকমাহ বা বিজ্ঞানভবন স্বতন্ত্র শিক্ষাকেন্দ্র বা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলেন। সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় জ্ঞানচর্চা শুরু হয়। তুর্র্কিদের বিজয়ের পর বাংলাদেশসহ ভারতে মাদরাসা গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে সুলতানি ও মুঘল আমলে (১২০৫-১৭৫৭ খ্রি:) যেসব মাদরাসার খবর পাওয়া যায়, সেগুলোতে কুরআন, হাদিস, তফসির, ফিকাহ,্ আরবি, ফারসি ভাষা ছাড়াও দর্শন, ইতিহাস, হিসাব (অঙ্ক), চিকিৎসাশাস্ত্র, ভূগোল, সমরবিদ্যা ও মাতৃভাষা পাঠ্য ছিল (শিক্ষাকোষ, পৃ. ৬২৬-৬২৭)। Wikipaedia বলছে, Madrasa (Arabic, madâris, Turkish: Medrese,) is the Arabic word for any type of educational institution, whether secular or religious (of any religion. আর বাংলাপিডিয়া মতে, ‘মুঘল আমলে মাদরাসা শিক্ষার পাঠক্রম বর্ধিত করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা চালু করা হয়। সে আমলে পর্যায়ক্রমে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ভূগোল, হিসাববিজ্ঞান, কৃষি, লোকপ্রশাসন, জীববিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, চারুকলা প্রভৃতি বিষয় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল।’ অর্থাৎ, মাদরাসা হলো পরিপূর্ণ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র। অ্যাডামের রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্রিটিশ যুগেও বাংলার মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমান এবং দক্ষিণ বিহার, তিরহুতের মাদরাসাগুলোয় মুসলমান শিক্ষার্থীর চেয়ে অমুসলিম শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল। এমনকি, বিখ্যাত হুগলি মাদরাসায় মুসলমান শিক্ষার্থীর প্রায় দ্বিগুণসংখ্যক হিন্দু শিক্ষার্থী লেখাপড়া করত এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই হাজী মুহম্মদ মুহসীন প্রবর্তিত ‘মুহসীন তহবিল’ থেকে বৃত্তি পেত (অ্যাডাম’স রিপোর্ট)। ইংরেজ শাসকদের চক্রান্তে, বিশেষ করে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে মাদরাসা শিক্ষা রাজানুকূল্য হারায়। কেননা, এই আইন লাখেরাজ সম্পত্তি বাতিল করে মুঘল শিক্ষাব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় (জওয়াহের লাল নেহরু, ভারত সন্ধানে)। করমুক্ত এই সম্পত্তি ছিল মাদরাসা শিক্ষার অর্থনৈতিক ভিত্তি। একটি মাদরাসা পরিচালনার জন্য কয়েকটি কিংবা প্রয়োজন অনুযায়ী বহু গ্রাম করমুক্ত সম্পত্তি হিসেবে দেয়া হতো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কর্নওয়ালিস তা বাতিল করে দেন। ফলে উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে মাদরাসা তার মর্যাদা হারায় এবং সীমিত পরিসরে ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা রাখে। মাদরাসাগুলো এর পর থেকে পরিচালিত হতে থাকে সমাজের সাধারণ মানুষের মুষ্টিভিক্ষায় এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বদান্যতায়। এভাবে মাদরাসাগুলো ক্রমেই গরিব হতে থাকা মুসলমানদের শিক্ষা লাভের শেষ ভরসাস্থল রূপে কোনো রকমে টিকে থাকে। আজো ‘সে ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে’।
বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা সবচেয়ে অবহেলিত। একই সাথে, তা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ পেতে পেতে প্রান্তিক সীমায় নির্বাসিত। হাল আমলে মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। কিন্তু এসব অভিযোগ কতখানি বস্তুনিষ্ঠ কিংবা সে সব অভিযোগ থেকে মাদরাসা শিক্ষাকে উদ্ধারে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়; সে সম্পর্কে কোনো একাডেমিক আলোচনা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। অথচ বাংলাদেশে দরিদ্র শিক্ষার্থীর বিপুলসংখ্যকই মাদরাসার ছাত্র। দেখা যায়, ২০১৭ সালে মাধ্যমিক স্তরে মোট ১৪.৩২ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে দাখিল পরীক্ষার্থী ছিল ২.৩৯ লাখ এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মোট প্রায় ১২ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে আলিম পরীক্ষার্থী প্রায় ৯৯ হাজার। লক্ষণীয়, দাখিল পরীক্ষার্থীর তুলনায় আলিমপর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক কমে যায়। এর কারণ কী? তারা কি ঝরে পড়ে? সাধারণ বা কারিগরি শিক্ষায় চলে যায়? কর্মজীবনে প্রবেশ করে? এসব বিষয়ে কোনো গবেষণা নেই কেন?
সাধারণ অভিযোগ, মাদরাসা শিক্ষা সেকেলে এবং কর্ম-অনুপযোগী শিক্ষাদানে মানবসম্পদের অপচয়ে ক্লিষ্ট। তবে মাদরাসা সম্পর্কে সমাজ ও রাষ্ট্রের ধারণা বেদনাদায়কভাবে অস্পষ্ট। অনেকেই আরবি ‘মাদ্রাসা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থও জানেন না; কিন্তু এর সমালোচনায় মুখর। বাংলা একাডেমির English-Bangla Dictionary-তে madrasa শব্দের ভুক্তি পর্যন্ত নেই। এটা সম্ভবত এ কারণে যে, বাংলা একাডেমির এই অভিধান সঙ্কলিত হয়েছে Oxford Advanced Learner’s Dictionary of Englishঅনুকরণে। সেখানে শব্দটির ঠাঁই নেই! বাংলা একাডেমি প্রকাশিত প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা ভাষার অভিধানও ‘মাদরাসা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেনি। বাংলা একাডেমির Bengali-English Dictionary ‘মাদরাসা’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ‘traditional Muslim religious school, college; seminary.’ বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান ‘মাদরাসা’ শব্দের অর্থ করেছে, ‘ইসলাম-ধর্মসংক্রান্ত বিষয় অনুশীলনে গুরুত্ব দেয়া হয় এমন শিক্ষাকেন্দ্র; বিদ্যাপীঠ।’ আর পশ্চিম বঙ্গ আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান ‘মাদরাসা’ শব্দের অর্থ লিখেছে, ‘ধর্ম-সংস্কৃতি অনুযায়ী মুসলমান উচ্চবিদ্যালয় বা কলেজ।’ Oxford English Dictionary-তে মাদরাসাকে ‘ইসলামি ধর্মীয় শিক্ষালয়’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ধারণা করা যেতে পারে, বাংলা অভিধান সঙ্কলকগণ Oxford English Dictionary অনুসরণ করে এই অর্থ নির্ধারণ করেছেন। বলা হয়েছে, মাদরাসায় শুধু ইসলাম ধর্মবিষয়ক পাঠদান করা হয় এবং তা স্কুল বা কলেজ স্তরের। এর মধ্যে একটি বিশেষ ধর্ম সম্পর্কিত শিক্ষাদানের বিষয়টি যতখানি ব্যক্ত হয়, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি উচ্চকিত এর ‘সাম্প্রদায়িক’ দ্যোতনা। একই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এই প্রচার-পণ্ডিতকূল টোল বা চতুষ্পাঠীর ধর্মীয় অনুষঙ্গটি সর্বপ্রযত্নে পরিহার করে থাকেন; সেখানে কী পড়ানো হয়, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেন না। তারা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ধর্মীয় শিক্ষাদান বা সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের বিষয়টি চেপে যান। এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মীয় শিক্ষা সম্পর্কে এমন বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ রহস্যময়।
উল্লেখ্য, মুঘল মাদরাসা শিক্ষা ছিল একাধারে ধর্মীয় এবং ধর্ম নির্বিশেষ বা সেকুলার। ১৭৮০ সালে কলকাতায় আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হলেও ইংরেজ গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সুকৌশলে মুঘল অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে শুরু করেন। বাংলায় মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমানদের শিক্ষার সুযোগের নামে এক দিকে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা, অন্য দিকে ১৮১৭ সালে রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক হিন্দুদের জন্য হিন্দু কলেজ স্থাপন তাদের পরিকল্পনার অভিন্ন রূপ। লর্ড মেকলে কলকাতা, আগ্রা ও দিল্লি মাদরাসা বন্ধ করে দেয়ার খায়েশ ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু প্রবল গণ-অসন্তোষের মুখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসকরা সে অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। অন্য দিকে, শ্রীরামপুরে খ্রিষ্টান পাদরিরা স্থানীয় ভাষায় বাইবেল মুদ্রণ ও প্রচার এবং খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা দিতে শুরু করে, যদিও খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে কোম্পানি তাদের রাজত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ছিল।
বিশ শতকে ‘নিউ স্কিম মাদরাসা’ শিক্ষা পদ্ধতিতে বেশ কিছু গুণগত পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এরপর পাকিস্তানে ১৯৬৯ সালে গঠিত শিক্ষা কমিশনের প্রধান এয়ার মার্শাল নূর খান মাদরাসা শিক্ষাকে প্রচলিত স্কুল শিক্ষা পদ্ধতির সাথে একীভূত করার সুপারিশ করেন। এই কমিশনের কোনো সুপারিশই অবশ্য আলোর মুখ দেখেনি। কারণ ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরশাদ আমলে, ১৯৮০-এর দশকে, অনেকটা নূর খান কমিশনের আদলে মাদারাসা শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে মাদরাসায় ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো পাঠ বাধ্যতামূলক করা হয়। এই সংস্কার মাদরাসা শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। এর পার্শ্বফল হিসেবে মাদরাসায় অমুসলিম শিক্ষকরা চাকরির সুযোগ পান। পরে এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে যায়।
প্রায় এক হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে মাদরাসা শিক্ষা ছিল পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও ব্যবহারিক। হেস্টিংস ও কর্নওয়ালিস ভারতে ব্রিটিশ শাসন পাকাপোক্ত করতে মাদরাসা শিক্ষাধারায় সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দিতে চাইলেন। পরে মধ্যউনবিংশ শতাব্দীতে বেন্টিঙ্কের প্রশ্রয়ে মেকলে’র পরিকল্পনায় মাদরাসা শিক্ষাকে অতীতের গহ্বরে ঠেলে দেয়া হয়। বাংলায় ‘নবযুগের পুরোধা’ পুরুষেরা তাতে ঘৃতাহুতি দেন। চার্লস উডের ডেসপাচ হয়ে ওঠে মাদরাসা শিক্ষাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত অস্ত্র।
মনে রাখতে হবে, ধর্মান্ধ ইসরাইল, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত, এমনকি গণতান্ত্রিক ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় শিক্ষা বহাল রয়েছে। বহু ক্ষেত্রে অবশ্য তা ধর্মীয় কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদকে লালন করে। তুলনামূলক বাংলাদেশের মাদরাসাশিক্ষা অনেক বেশি অসাম্প্রদায়িক হওয়া সত্ত্বেও ওইসব দেশের ধর্মীয় শিক্ষা সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য করা হয় না।
এ দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও একটি গোষ্ঠী মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়ায় এবং মিথ্যার বেসাতি করে। মাদরাসাগুলোকে আধুনিক শিক্ষাকেন্দ্রে রূপান্তর ও উন্নয়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু সে দায়িত্ব পালন না করে রাষ্ট্র বরং উল্টো এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অপপ্রচারে লিপ্ত। আর বিশেষ একটি গোষ্ঠী সরকারকে দায়ী না করে মাদরাসাকেই দায়ী করে থাকে।
যৌক্তিক রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত মাদরাসাগুলো প্রচারমহিমায় একই সঙ্গে ‘জঙ্গিদের প্রসবাগার’ বলে পরিচিত হয়ে উঠছে। কিন্তু জঙ্গি উৎপাদনক্ষেত্র হিসেবে এত দিন ধরে শুধু মাদরাসার বিরুদ্ধে ঢাক পেটানো হলেও, ২০১৬ সালে গুলশান হোলে আর্টিজান হত্যাযজ্ঞে জানা গেল, তার চেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হয়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যমের দামি স্কুল আর নামীদামি সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু তরুণ। তারা ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ এবং খুবই স্মার্ট। তাদের সাথে বিদেশী কোন কোন শক্তির কেমন যোগাযোগ, তা কতটা নিবিড়, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ইহুদি নজরদারি প্রতিষ্ঠান SITE-এর আগাম এবং সন্ত্রাস-পরবর্তী সংবাদ প্রচারের ধরণ থেকে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মুসলিমবিরোধী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর সংশ্লিষ্টতা অনুমান করা অসঙ্গত নয়। অর্থাৎ কথিত ইসলামি জঙ্গিবাদের পেছনে বহিঃরাষ্ট্রীয়, সাম্রাজ্যবাদী, বিশ্বপরাশক্তি, আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর ফাঁদ ও ইন্ধন থাকতে পারে। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় পাওয়া বিপুল বিস্ফোরক প্রতিবেশী ভারত থেকে চোরাই পথে আসা বলে গোয়েন্দা বরাতে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে (মানবজমিন,মার্চ ২৮, ২০১৭)।
বাংলাদেশে সাধারণ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নৈমিত্তিক দলীয় কোন্দল, হানাহানি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস প্রভৃৃতি কবলিত। শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারীরা নানা দল-উপদলে বিভক্ত এবং হানাহানিতে লিপ্ত। সে তুলনায় মাদরাসাগুলো এখনো এ ধরনের হানাহানি ও সন্ত্রাসমুক্ত। সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নৈতিক মানও সাধারণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ভালো। অপর দিকে, কিছু মাদরাসা গণ-নকল, ভুয়া শিক্ষক-কর্মচারীর নামে এমপিও গ্রহণের মতো অনৈতিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো মাদরাসার জঙ্গিবাদের সাথে সংশ্লিষ্টতাও প্রমাণিত।
প্রায় দুই শ’ বছর ধরে মাদরাসাশিক্ষা ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকার এক ধরনের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এখনো তা চলছে। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার না করে তা বন্ধ করা সম্ভব নয়।
সরকারই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অভিমুখ নির্ধারক। কাজেই মাদরাসার সিলেবাস-কারিকুলাম আধুনিক, কর্মোপযোগী, প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতাভিত্তিক করার দায়িত্ব সরকারের। সে দায়িত্ব অবশ্যই পালন করতে হবে। মাদরাসা শিক্ষাকে দোষারোপ করে কোনো লাভ হবে না। বরং এই শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে যুগোপযোগী নতুন কারিকুলাম-সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। এভাবেই মাদরাসা শিক্ষা হয়ে উঠতে পারে আধুনিক, কর্মক্ষম, দেশপ্রেমিক এবং দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তরের এক শক্তিশালী কৌশল ও মাধ্যম। এ জন্য দরকার সর্বসাধারণের একান্ত সদিচ্ছা। সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হতে পারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দোষ না দিয়ে সমস্যাবলীর সমাধান করা, এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
ধর্মান্ধদের শত বাধা উপেক্ষা করে, আব্বাসীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান চর্চায় নতুন বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল। আব্বাসীয় খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা আল মনসুর ৭৬২ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানী বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠা করেন পরে যা গণিত, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন, চিত্রকলা তথা বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। চীনাদের কাগজ প্রস্তুত প্রণালি ও ভারতীয় সংখ্যা গণনা পদ্ধতি আরব পণ্ডিতদের বিজ্ঞানচর্চায় বিশেষ অবদান রাখে। খলিফা হারুন-আল-রশিদকে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকদের অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি গ্রিক, রোমান, মিসরীয়, বাইজেন্টাইন, পারস্য, ভারতীয় ও চীনা জ্ঞান-বিজ্ঞান মাতৃভাষা আরবিতে অনুবাদ করার ব্যবস্থা গড়ে তোলেন এবং আরবে ভারতীয় গণিতচর্চা, বিশেষ করে সংখ্যা গণনা পদ্ধতি গ্রহণ করে আরবীয় গণিত ও জ্যামিতি চর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। মহামতি আল কিন্দি ভারতীয় গণিতশাস্ত্রের বৈপ্লবিক বিকাশ সাধন করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি গ্রিক ও ইসলামি দর্শনের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। মহাপণ্ডিত আল বেরুনি, আবু নসর মনসুর গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আল খারিজমি ও আল জাবের গ্রিক ও ভারতীয় গণিতের বিকাশ ঘটিয়ে বীজগণিত আবিষ্কার করেন। আলোকবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন আল-হাইছাম। কৃষি ও সেচব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি হয় তখন। আরবরা ওই সময়ে ভারত থেকে ধান, তুলা ও ইক্ষু চাষ, চীন থেকে লেবু এবং আফ্রিকা থেকে সারগম চাষ শেখে এবং আরবে তা উৎপাদন করতে সেচব্যবস্থার উদ্ভাবন করে, যা আধুনিক সেচনির্ভর কৃষির ভিত্তিস্বরূপ।
হারুন আল-রশিদের পুত্র মামুন আল-রশিদ মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার জ্ঞানচর্চার অনন্য কেন্দ্র হিসেবে বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়, বায়তুল-হিকমাহ বা বিজ্ঞানভবন এবং জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় এক হাজার বছরের সাধনায় এশিয়া, আফ্রিকা পেরিয়ে মুসলিম জ্ঞানসাধনা খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতকে প্রথমে ইতালি ও পরে পুরো ইউরোপে রেনেসাঁ অনিবার্য করে তোলে।
এই উপমহাদেশে মাদরাসা শিক্ষার সূচনা ভারতে মুসলিম শাসনের প্রথম যুগ থেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও মুসলিম শাসনের প্রথম যুগ থেকেই মাদরাসা শিক্ষা প্রচলিত। সব ধর্মাবলম্বী মাদরাসায় শিক্ষালাভ করত। তখন শুধু ইসলামি শিক্ষা মাদরাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল না। তাহলে সে শিক্ষালয়ে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরও শিক্ষা লাভ বিবেচিত হতে পারত না। মুসলিম শাসনকালে মাদরাসা শিক্ষা কেমন ছিল, তা অনুসন্ধান করা জরুরি।
মাদরাসা সংক্রান্ত শিক্ষাকোষ-এ বেশ চমকপ্রদ তথ্য আছে। সেখানে সৈয়দ আমীরুল ইসলাম মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রসঙ্গে বলেছেন, আরবি দারস-এর শাব্দিক অর্থ ‘পাঠদান’, এবং যেখানে পাঠদান কাজ চলে তাই মাদরাসা। ইসলামের প্রথম যুগে মদিনায় এ ধরনের শিক্ষাদান কার্যক্রমে সাহাবারাসহ নবী করিম সা: নিয়মিত অংশ নিতেন। মসজিদের একটি পৃথক অংশে পাঠদান কাজ চলতো। তবে আব্বাসীয় বাদশাহ আল-মামুন তার প্রতিষ্ঠিত বায়তুল-হিকমাহ বা বিজ্ঞানভবন স্বতন্ত্র শিক্ষাকেন্দ্র বা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলেন। সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় জ্ঞানচর্চা শুরু হয়। তুর্র্কিদের বিজয়ের পর বাংলাদেশসহ ভারতে মাদরাসা গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে সুলতানি ও মুঘল আমলে (১২০৫-১৭৫৭ খ্রি:) যেসব মাদরাসার খবর পাওয়া যায়, সেগুলোতে কুরআন, হাদিস, তফসির, ফিকাহ,্ আরবি, ফারসি ভাষা ছাড়াও দর্শন, ইতিহাস, হিসাব (অঙ্ক), চিকিৎসাশাস্ত্র, ভূগোল, সমরবিদ্যা ও মাতৃভাষা পাঠ্য ছিল (শিক্ষাকোষ, পৃ. ৬২৬-৬২৭)। Wikipaedia বলছে, Madrasa (Arabic, madâris, Turkish: Medrese,) is the Arabic word for any type of educational institution, whether secular or religious (of any religion. আর বাংলাপিডিয়া মতে, ‘মুঘল আমলে মাদরাসা শিক্ষার পাঠক্রম বর্ধিত করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা চালু করা হয়। সে আমলে পর্যায়ক্রমে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ভূগোল, হিসাববিজ্ঞান, কৃষি, লোকপ্রশাসন, জীববিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, চারুকলা প্রভৃতি বিষয় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল।’ অর্থাৎ, মাদরাসা হলো পরিপূর্ণ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র। অ্যাডামের রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্রিটিশ যুগেও বাংলার মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমান এবং দক্ষিণ বিহার, তিরহুতের মাদরাসাগুলোয় মুসলমান শিক্ষার্থীর চেয়ে অমুসলিম শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল। এমনকি, বিখ্যাত হুগলি মাদরাসায় মুসলমান শিক্ষার্থীর প্রায় দ্বিগুণসংখ্যক হিন্দু শিক্ষার্থী লেখাপড়া করত এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই হাজী মুহম্মদ মুহসীন প্রবর্তিত ‘মুহসীন তহবিল’ থেকে বৃত্তি পেত (অ্যাডাম’স রিপোর্ট)। ইংরেজ শাসকদের চক্রান্তে, বিশেষ করে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে মাদরাসা শিক্ষা রাজানুকূল্য হারায়। কেননা, এই আইন লাখেরাজ সম্পত্তি বাতিল করে মুঘল শিক্ষাব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় (জওয়াহের লাল নেহরু, ভারত সন্ধানে)। করমুক্ত এই সম্পত্তি ছিল মাদরাসা শিক্ষার অর্থনৈতিক ভিত্তি। একটি মাদরাসা পরিচালনার জন্য কয়েকটি কিংবা প্রয়োজন অনুযায়ী বহু গ্রাম করমুক্ত সম্পত্তি হিসেবে দেয়া হতো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কর্নওয়ালিস তা বাতিল করে দেন। ফলে উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে মাদরাসা তার মর্যাদা হারায় এবং সীমিত পরিসরে ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা রাখে। মাদরাসাগুলো এর পর থেকে পরিচালিত হতে থাকে সমাজের সাধারণ মানুষের মুষ্টিভিক্ষায় এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বদান্যতায়। এভাবে মাদরাসাগুলো ক্রমেই গরিব হতে থাকা মুসলমানদের শিক্ষা লাভের শেষ ভরসাস্থল রূপে কোনো রকমে টিকে থাকে। আজো ‘সে ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে’।
বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা সবচেয়ে অবহেলিত। একই সাথে, তা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ পেতে পেতে প্রান্তিক সীমায় নির্বাসিত। হাল আমলে মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। কিন্তু এসব অভিযোগ কতখানি বস্তুনিষ্ঠ কিংবা সে সব অভিযোগ থেকে মাদরাসা শিক্ষাকে উদ্ধারে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়; সে সম্পর্কে কোনো একাডেমিক আলোচনা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। অথচ বাংলাদেশে দরিদ্র শিক্ষার্থীর বিপুলসংখ্যকই মাদরাসার ছাত্র। দেখা যায়, ২০১৭ সালে মাধ্যমিক স্তরে মোট ১৪.৩২ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে দাখিল পরীক্ষার্থী ছিল ২.৩৯ লাখ এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মোট প্রায় ১২ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে আলিম পরীক্ষার্থী প্রায় ৯৯ হাজার। লক্ষণীয়, দাখিল পরীক্ষার্থীর তুলনায় আলিমপর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক কমে যায়। এর কারণ কী? তারা কি ঝরে পড়ে? সাধারণ বা কারিগরি শিক্ষায় চলে যায়? কর্মজীবনে প্রবেশ করে? এসব বিষয়ে কোনো গবেষণা নেই কেন?
সাধারণ অভিযোগ, মাদরাসা শিক্ষা সেকেলে এবং কর্ম-অনুপযোগী শিক্ষাদানে মানবসম্পদের অপচয়ে ক্লিষ্ট। তবে মাদরাসা সম্পর্কে সমাজ ও রাষ্ট্রের ধারণা বেদনাদায়কভাবে অস্পষ্ট। অনেকেই আরবি ‘মাদ্রাসা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থও জানেন না; কিন্তু এর সমালোচনায় মুখর। বাংলা একাডেমির English-Bangla Dictionary-তে madrasa শব্দের ভুক্তি পর্যন্ত নেই। এটা সম্ভবত এ কারণে যে, বাংলা একাডেমির এই অভিধান সঙ্কলিত হয়েছে Oxford Advanced Learner’s Dictionary of Englishঅনুকরণে। সেখানে শব্দটির ঠাঁই নেই! বাংলা একাডেমি প্রকাশিত প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা ভাষার অভিধানও ‘মাদরাসা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেনি। বাংলা একাডেমির Bengali-English Dictionary ‘মাদরাসা’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ‘traditional Muslim religious school, college; seminary.’ বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান ‘মাদরাসা’ শব্দের অর্থ করেছে, ‘ইসলাম-ধর্মসংক্রান্ত বিষয় অনুশীলনে গুরুত্ব দেয়া হয় এমন শিক্ষাকেন্দ্র; বিদ্যাপীঠ।’ আর পশ্চিম বঙ্গ আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান ‘মাদরাসা’ শব্দের অর্থ লিখেছে, ‘ধর্ম-সংস্কৃতি অনুযায়ী মুসলমান উচ্চবিদ্যালয় বা কলেজ।’ Oxford English Dictionary-তে মাদরাসাকে ‘ইসলামি ধর্মীয় শিক্ষালয়’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ধারণা করা যেতে পারে, বাংলা অভিধান সঙ্কলকগণ Oxford English Dictionary অনুসরণ করে এই অর্থ নির্ধারণ করেছেন। বলা হয়েছে, মাদরাসায় শুধু ইসলাম ধর্মবিষয়ক পাঠদান করা হয় এবং তা স্কুল বা কলেজ স্তরের। এর মধ্যে একটি বিশেষ ধর্ম সম্পর্কিত শিক্ষাদানের বিষয়টি যতখানি ব্যক্ত হয়, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি উচ্চকিত এর ‘সাম্প্রদায়িক’ দ্যোতনা। একই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এই প্রচার-পণ্ডিতকূল টোল বা চতুষ্পাঠীর ধর্মীয় অনুষঙ্গটি সর্বপ্রযত্নে পরিহার করে থাকেন; সেখানে কী পড়ানো হয়, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেন না। তারা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ধর্মীয় শিক্ষাদান বা সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের বিষয়টি চেপে যান। এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মীয় শিক্ষা সম্পর্কে এমন বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ রহস্যময়।
উল্লেখ্য, মুঘল মাদরাসা শিক্ষা ছিল একাধারে ধর্মীয় এবং ধর্ম নির্বিশেষ বা সেকুলার। ১৭৮০ সালে কলকাতায় আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হলেও ইংরেজ গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সুকৌশলে মুঘল অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে শুরু করেন। বাংলায় মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমানদের শিক্ষার সুযোগের নামে এক দিকে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা, অন্য দিকে ১৮১৭ সালে রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক হিন্দুদের জন্য হিন্দু কলেজ স্থাপন তাদের পরিকল্পনার অভিন্ন রূপ। লর্ড মেকলে কলকাতা, আগ্রা ও দিল্লি মাদরাসা বন্ধ করে দেয়ার খায়েশ ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু প্রবল গণ-অসন্তোষের মুখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসকরা সে অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। অন্য দিকে, শ্রীরামপুরে খ্রিষ্টান পাদরিরা স্থানীয় ভাষায় বাইবেল মুদ্রণ ও প্রচার এবং খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা দিতে শুরু করে, যদিও খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে কোম্পানি তাদের রাজত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ছিল।
বিশ শতকে ‘নিউ স্কিম মাদরাসা’ শিক্ষা পদ্ধতিতে বেশ কিছু গুণগত পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এরপর পাকিস্তানে ১৯৬৯ সালে গঠিত শিক্ষা কমিশনের প্রধান এয়ার মার্শাল নূর খান মাদরাসা শিক্ষাকে প্রচলিত স্কুল শিক্ষা পদ্ধতির সাথে একীভূত করার সুপারিশ করেন। এই কমিশনের কোনো সুপারিশই অবশ্য আলোর মুখ দেখেনি। কারণ ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরশাদ আমলে, ১৯৮০-এর দশকে, অনেকটা নূর খান কমিশনের আদলে মাদারাসা শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে মাদরাসায় ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো পাঠ বাধ্যতামূলক করা হয়। এই সংস্কার মাদরাসা শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। এর পার্শ্বফল হিসেবে মাদরাসায় অমুসলিম শিক্ষকরা চাকরির সুযোগ পান। পরে এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে যায়।
প্রায় এক হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে মাদরাসা শিক্ষা ছিল পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও ব্যবহারিক। হেস্টিংস ও কর্নওয়ালিস ভারতে ব্রিটিশ শাসন পাকাপোক্ত করতে মাদরাসা শিক্ষাধারায় সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দিতে চাইলেন। পরে মধ্যউনবিংশ শতাব্দীতে বেন্টিঙ্কের প্রশ্রয়ে মেকলে’র পরিকল্পনায় মাদরাসা শিক্ষাকে অতীতের গহ্বরে ঠেলে দেয়া হয়। বাংলায় ‘নবযুগের পুরোধা’ পুরুষেরা তাতে ঘৃতাহুতি দেন। চার্লস উডের ডেসপাচ হয়ে ওঠে মাদরাসা শিক্ষাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত অস্ত্র।
মনে রাখতে হবে, ধর্মান্ধ ইসরাইল, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত, এমনকি গণতান্ত্রিক ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় শিক্ষা বহাল রয়েছে। বহু ক্ষেত্রে অবশ্য তা ধর্মীয় কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদকে লালন করে। তুলনামূলক বাংলাদেশের মাদরাসাশিক্ষা অনেক বেশি অসাম্প্রদায়িক হওয়া সত্ত্বেও ওইসব দেশের ধর্মীয় শিক্ষা সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য করা হয় না।
এ দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও একটি গোষ্ঠী মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়ায় এবং মিথ্যার বেসাতি করে। মাদরাসাগুলোকে আধুনিক শিক্ষাকেন্দ্রে রূপান্তর ও উন্নয়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু সে দায়িত্ব পালন না করে রাষ্ট্র বরং উল্টো এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অপপ্রচারে লিপ্ত। আর বিশেষ একটি গোষ্ঠী সরকারকে দায়ী না করে মাদরাসাকেই দায়ী করে থাকে।
যৌক্তিক রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত মাদরাসাগুলো প্রচারমহিমায় একই সঙ্গে ‘জঙ্গিদের প্রসবাগার’ বলে পরিচিত হয়ে উঠছে। কিন্তু জঙ্গি উৎপাদনক্ষেত্র হিসেবে এত দিন ধরে শুধু মাদরাসার বিরুদ্ধে ঢাক পেটানো হলেও, ২০১৬ সালে গুলশান হোলে আর্টিজান হত্যাযজ্ঞে জানা গেল, তার চেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হয়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যমের দামি স্কুল আর নামীদামি সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু তরুণ। তারা ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ এবং খুবই স্মার্ট। তাদের সাথে বিদেশী কোন কোন শক্তির কেমন যোগাযোগ, তা কতটা নিবিড়, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ইহুদি নজরদারি প্রতিষ্ঠান SITE-এর আগাম এবং সন্ত্রাস-পরবর্তী সংবাদ প্রচারের ধরণ থেকে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মুসলিমবিরোধী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর সংশ্লিষ্টতা অনুমান করা অসঙ্গত নয়। অর্থাৎ কথিত ইসলামি জঙ্গিবাদের পেছনে বহিঃরাষ্ট্রীয়, সাম্রাজ্যবাদী, বিশ্বপরাশক্তি, আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর ফাঁদ ও ইন্ধন থাকতে পারে। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় পাওয়া বিপুল বিস্ফোরক প্রতিবেশী ভারত থেকে চোরাই পথে আসা বলে গোয়েন্দা বরাতে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে (মানবজমিন,মার্চ ২৮, ২০১৭)।
বাংলাদেশে সাধারণ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নৈমিত্তিক দলীয় কোন্দল, হানাহানি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস প্রভৃৃতি কবলিত। শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারীরা নানা দল-উপদলে বিভক্ত এবং হানাহানিতে লিপ্ত। সে তুলনায় মাদরাসাগুলো এখনো এ ধরনের হানাহানি ও সন্ত্রাসমুক্ত। সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নৈতিক মানও সাধারণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ভালো। অপর দিকে, কিছু মাদরাসা গণ-নকল, ভুয়া শিক্ষক-কর্মচারীর নামে এমপিও গ্রহণের মতো অনৈতিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো মাদরাসার জঙ্গিবাদের সাথে সংশ্লিষ্টতাও প্রমাণিত।
প্রায় দুই শ’ বছর ধরে মাদরাসাশিক্ষা ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকার এক ধরনের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এখনো তা চলছে। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার না করে তা বন্ধ করা সম্ভব নয়।
সরকারই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অভিমুখ নির্ধারক। কাজেই মাদরাসার সিলেবাস-কারিকুলাম আধুনিক, কর্মোপযোগী, প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতাভিত্তিক করার দায়িত্ব সরকারের। সে দায়িত্ব অবশ্যই পালন করতে হবে। মাদরাসা শিক্ষাকে দোষারোপ করে কোনো লাভ হবে না। বরং এই শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে যুগোপযোগী নতুন কারিকুলাম-সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। এভাবেই মাদরাসা শিক্ষা হয়ে উঠতে পারে আধুনিক, কর্মক্ষম, দেশপ্রেমিক এবং দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তরের এক শক্তিশালী কৌশল ও মাধ্যম। এ জন্য দরকার সর্বসাধারণের একান্ত সদিচ্ছা। সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হতে পারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দোষ না দিয়ে সমস্যাবলীর সমাধান করা, এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শেলি ২৬/০৫/২০১৭দারুন
-
আলম সারওয়ার ২২/০৫/২০১৭দারুন ।শুভেচ্ছা জানবেন।
-
মুহম্মদ কবীর সরকার(Mahdi Kaabir) ২২/০৫/২০১৭অনেক কিছু জানতে পারলাম
-
রুবেল চন্দ্র দাস ১৮/০৫/২০১৭Porlam
-
সাঁঝের তারা ১৮/০৫/২০১৭ভাল তথ্য