দ্যা ব্লক ম্যাজিক (স্টোরি অফ সিরিয়াল কিলিং)
**এক (বাকী অংশ)**
উৎকন্ঠিত হয় শরীফ। এই পর্যন্ত করার জন্য মনোবল জোগাড় করে এসেছে ওরা। আরও কিছু?
‘আগে বলেননি কেন?’ শরিফ জানতে চায় ঠান্ডা গলায়।
‘আগে তো নিশ্চিত ছিলাম না এই কাজটাই করার জন্য কতটা সিরিয়াস তোমরা। এতদূর যখন এগিয়ে গেছ তখন আশা করি বাকিটা করতে পারবে। কাজটা কঠিন কি না।’
‘কাজটা কি?’
‘যকৃত আর চা পানের পর তোমাদের বারো ঘন্টার মাঝে একটা বলি দিতে হবে। মানুষ বলি। শয়তানের নামে।’
‘হোয়াট দ্যা ফা-’ বাক্যটার শেষ অংশ নিজের মাঝেই গিলে নেয় শরিফ।
‘সিদ্ধি লাভ করতে চাও তো? তাহলে আর দ্বিধা নয়। একটা ব্যাপার সহজ। কোন বাধাধরা নিয়ম নেই। যাকে ইচ্ছে বলি দিতে পারবে। তবে বলিটা দিতে হবে বারো ঘন্টার মাঝে। আগে অথবা পরে।’
কট করে কেটে যায় লাইন।
‘ওটা করা যাবে।’ ঠান্ডা গলায় তুষাড় বলে। ওর হাবভাবে বেশ আত্মবিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়।
‘সেটাই।’ কাঁধ ঝাঁকায় শরিফ। কাজটা বেশ কঠিন বৈকি। কয়েক স্তর ওপরে উঠতে পারবে নিশ্চিত। টেলিপোর্টেশনের ব্যাপারটা ম্যাগমা পর্যায়ে পাওয়া যায়। ওরা অতটুকু পৌঁছতে পারলেই আপাতত খুশি।
**দুই**
কবরস্থানের ভেতরটা শুনশান নীরবতার চাদরে ঢাকা।
‘কোন দিকে রে?’ আস্তে করে শরিফের কনুইয়ে খোঁচা দেয় তুষাড়।
‘সাতাশ সারির পনের নম্বর কবরটা। নতুন খোঁড়া।’
মোবাইলের ফ্ল্যাশের আলোয় ওরা কবর গুণে।
নির্দিষ্ট কবরটার সামনে এসে থমকে যায় কিছুটা।
কবরটা মাটি দিয়ে ঢাকা নয়। বরং একটা বিশাল গর্ত।
মাটিগুলো যেভাবে বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে – মনে হচ্ছে কেউ যেন প্রবল আক্রোশে ভেতর থেকে ধাক্কা দিয়ে মাটি ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছে বাইরে।
একটুকরো সাদা কাপড় পড়ে থাকতে দেখে ওরা। ছেঁড়া কাফন ?
ভয়ের একটা অনুভূতি ওদের তলপেটে অস্বস্তিকর শিরশিরানি তুলে দেয়!
‘কবর ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল নাকি?’ বিড় বিড় করে কাকে বলে শরিফ কে জানে!
চারপাশে মোবাইলের ফ্ল্যাশ মেরে দেখার চেষ্টা করে ওরা – কিন্তু সুবিশাল কবরস্থানে সেই আলো যেন মহাশূন্যের নিঃসঙ্গ জোনাকির কাজও করে না।
‘আমার কিন্তু এগুলো ভালো লাগছে না। এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত।’ আস্তে করে বলে তুষাড়।
মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থমকে যায় – ঠিক বারোটা বাজে!
‘ঠিক বলেছিস।’ চেষ্টা করেও গলার কাঁপুনী ঠেকাতে পারে না শরিফ, ‘যাওয়া যাক।’
ঘুরে দাঁড়ায় দুইজন একই সাথে এবং চমকে ওঠে প্রবল ভাবে।
ওদের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা। কালো চুলে আর কালো চোখ যেন মিশে গেছে কবরস্থানের অন্ধকারের সাথে। সেই সাথে ফর্সা মুখটা আরও ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। সারা শরীরে সাদা কাপড় জড়ানো।
পাথরের মত মুখ করে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল এতক্ষণ। এবার আস্তে করে হেসে ফেলল।
রহস্যময় ওই হাসি সহ্য করার মত না। তারপর যখন অসম্ভব সুন্দর গলায় মেয়েটা জানতে চায়, ‘যকৃত খুঁজছ? আমার আছে তো একটা।’
একমুহূর্ত একজন আরেকজনের দিকে তাকায় শরিফ আর তুষাড়।
তারপরেই প্রাণপনে ছুট লাগায় বিপরীত দিকে।
***
চারপাশে কবর আর কবর।
তার মাঝেই ছুটে যাচ্ছে ওরা। অন্ধের মত।
ভস করে একটা গর্তে হাঁটু পর্যন্ত দেবে যায় তুষাড়ের। কোনমতে সেটা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবারও সামনের দিকে দৌড়ায় ও। শরিফটা স্বার্থপর আছে এরই মাঝে পঞ্চাশ মিটার আগিয়ে গেছে ও।
ছুটছেও হরিণের মত।
পেছনে কি কোন পদশব্দ শোনা যাচ্ছে? মেয়েটাও কি এগিয়ে আসছে?
ওরা জানে না।
ফিরে তাকানোর সাহস ওদের নেই।
কোনমতে কবরস্থানের অন্যপাশ থেকে বেরিয়েও ওরা থামে না।
বিশাল লাইটপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁফায় দুইজনে।
‘দোস্ত – এইটা কি হল?’ বিহ্বলের মত জানতে চায় তুষাড়।
‘চুপ কর ব্যাটা। মুখে ওই ঘটনার নাম নিবি না ব্যাটা!’ ক্ষেপে যায় শরিফ । আসলে ওর চিরচেনা পৃথিবীর বাইরের দৃশ্য দেখে অতিমাত্রায় শকড বেচারা।
‘চল তোর রুমে যাই। চিন্তা ভাবনা করা দরকার।’
শরিফের বাসার নিচ থেকে একপ্যাকেট সিগারেট কেনে ওরা।
ঘটনার প্যাচ লেগে গেছে। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না মোটেও।
এরপরও ভাবতে হবে। তরুণীর লাশ লাগবে। থেমে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
সিঁড়িঘরটা অন্ধকার।
অন্ধকারকে এই প্রথম একটু ভয় করে শরিফের।
বাশারের রুমে এসে খাটের ওপর ধপ করে বসে পড়ে দুইজনেই।
‘দাঁড়া আলম ভাইকে একটা ফোন লাগাই।’
আলম ভাই ফোন ধরেন না।
সম্ভবত চর্চায় আছেন। রাত একটা বাজে। এখন তাঁর সাধনার জগতেই থাকার কথা।
‘ওই মেয়ের কথা মাথা থেকে সরিয়ে কাজ করা লাগবে আমাদেরশ তুষার ঠান্ডা হয়েছে কিছুটা।
‘হুঁ।’ একমত হয় শরিফও । ‘নতুন মেয়ে লাগবে। আরেকটা লাশ। সবগুলো তো আর সারি দিয়ে বের হয়ে আসবে না কবর থেকে। এই কেসটা কেমন জানি কাবজাব লেগে গেল!’
‘একদম ঠিক বলেছিস। আর কিছু খোঁজ খবর নিয়ে -’
এই সময় দড়াম করে খুলে গেল ওয়াল-ওয়ারড্রোবের দরজা।
ঘরের ভেতরটা ভরে যায় সুন্দর একটা গন্ধে। গন্ধটা একই সাথে মন খারাপ করা।
মৃতদেহের গোসলের পর এমন গন্ধই পাওয়া যায় তাদের শরীর থেকে।
শরিফের কোটটা ঝুলছিল – ওটা ঠেলে বেড়িয়ে আসে একটু আগে দেখে আসা কবরস্থানের মৃত মেয়েটির।
**তিন**
শরিফের কাঁপাকাঁপি লেগে গেছে।
তুষাড়ের অবস্থাও সুবিধের না।
তবে সেই সব দিকে লক্ষ্যই করে না যেন মেয়েটা!
‘চন্দ্রিকা আমার নাম।’ ভীষণ শীতল কন্ঠে বলে মেয়েটা।
চুপ হয়েই থাকে দুইজনই।
‘তোমরা শরিফ আর তুষাড়। আমার হৃৎপিন্ড আর যকৃত দরকার। প্রেতচর্চা আর শয়তানের পূজারীর একটা রিমিক্সড ভার্সনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছ।’
খুক করে কাশে তুষাড়, ‘ব্যাপারটা ব্যক্তিগত ভাবে নেবেন না আশা করি। আমাদের সামনের স্তরে ওঠার জন্য -’
হাত তুলে ওকে থামায় চন্দ্রিকা, ‘জানি আমি। আমার মত যারা – তাদের অনেক কিছুই জানতে হয়। নিজের শরীরের প্রতি একটা মায়া আমার ছিলই। তবে তোমাদের আমার কাহিনী শুনতে হবে। তারপর হৃৎপিন্ড আর যকৃত আমি স্যাক্রিফাইস করে দিতে রাজি আছি। আমার আত্মার মুক্তির পর অবশ্য দেহ নিয়ে কি করলে সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই। আমি শুধু এই বিভীষিকা থেকে মুক্তি চাই।’
‘আপনার প্রস্তাবটা কি?’ প্রথমবারের মত মুখ খোলে শরীফ।
‘আমার মৃত্যুর ব্যাপারটা সবাই আত্মহত্যা হিসেবেই জানে।’ শরিফের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলে মেয়েটা। ‘কিন্তু আসল ঘটনা সেটা না। তোমরা কি জানো কখন একটা মৃতদেহ থেকে আত্মা চলে যেতে পারে না? ’
আগ্রহের সাথে তাকিয়ে থাকে ওরা।
‘যখন সেই মানুষটার অতৃপ্ত বাসনা থেকে যায়।’ নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দেয় চন্দ্রিকা , ‘হ্যাঁ – প্রশ্ন থেকে যায় – প্রতিটা মানুষই কিছু অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে মারা যায় – সেক্ষেত্রে কেন কিছু আত্মার মুক্তি হয় না? কারণ, আত্মার বাসনাটা হতে হয় খুবই তীব্র। আমাকে দেখছ হেঁটে বেড়াতে – কিন্তু সারা শরীরে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে আমার। তোমাদের কি বলে বোঝাবো -’ কিছুক্ষণ চুপচাপ উদাহরণ খোঁজে মেয়েটা, ‘অনেকটা একই সাথে গায়ে আগুন আর বরফ ধরিয়ে দেয়ার মত। পার্থিব কোন যন্ত্রণা না এটা। অতৃপ্ত আত্মাদের দীর্ঘশ্বাস কিংবা শীতল গলায় ভড়কে যায় সবাই – সেটার উৎপত্তিস্থল কিন্তু এই যন্ত্রণা।’
বিষাদের ছায়া পড়ে মেয়েটার মুখে। ওর দিকে ব্যাথাভরা চোখে তাকিয়ে থাকে শরিফ আর তুষাড়।
‘এই যন্ত্রণাকে সহ্য করে নিয়েও যখন কোন আত্মা তীব্রভাবে চায় পৃথিবীর বুকে থেকে যেতে অসমাপ্ত কাজ সমাধার জন্য – তখন আমরা আর দেহ ছেড়ে যেতে পারি না। যতক্ষণ না আমাদের বাসনা পূর্ণ হবে – দেহ ছাড়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এখানেই আসছ তোমরা - এই যন্ত্রণা থেকে তোমরা আমাকে মুক্তি দেবে – দেহটা পেয়ে যাবে। তোমাদেরও সাফল্য আমারও শান্তি। ’
একজন আরেকজনের দিকে তাকায় শরিফ আর তুষাড়।
‘এলাকায় আত্মহত্যার ঘটনাই প্রকাশ হয়েছে। আপনি মারা গেলেন কিভাবে, যদি আত্মহত্যা না হয় সেটা?’ তুষাড় জানতে চায় মোমের মত সাদা মুখটার দিকে তাকিয়ে। ওর দিকে প্রাণশূন্য চোখ ঘুরিয়ে তাকায় এবার মেয়েটা ।
‘আহাদ আমার বয়ফ্রেন্ড। আমাদের সম্পর্কটা ছিল অনেক দীর্ঘ। সাত বছর।’ দীর্ঘশ্বাসের মত শব্দ হয় একটা ঘরের মাঝে। ‘গত একবছর আমরা একসাথে ছিলাম। উই ওয়্যার লিভিং টুগেদার। বাট হি লেফট মি। লেফট মি উইদ আ গুডবাই গিফট।’
‘বুঝলাম না।’ মাথা নাড়ায় শারিফ।
‘আমাকে তাড়িয়ে দেয় ওর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। আমি অন্তঃসত্ত্বা জানার পর পরই। আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে ওর কোনদিনও ছিল না। নিজের ওপর তীব্র ঘৃণা হত তখন। আরও বেশি ঘৃণা হত আহাদের ওপর। কিন্তু আমি আত্মহত্যা করি নি। আমার একটা তুলতুলে বাবু হত! একটা পিশাচের কাছে নিজের জীবনযুদ্ধে হেরে যাবার মত বোকা আমি ছিলাম না। কিন্তু সাতদিনের মাথায় টুপ করে মরে গেলাম!’
‘কিন্তু কিভাবে?’ একসাথে জানতে চায় শরিফ আর তুষাড়।
‘মেডিকেশন।’ চোখ মুছে জবাব দেয় চন্দ্রিকা। ‘আমার রোজ দুইটা ওষুধ নিতে হত। সেটার সাথে একই রকম দেখতে সায়নায়িড পিল রেখে দিয়েছিল আহাদ। পনেরটা ট্যাবলেটের মাঝে একটা বিষ সেটা আমি কি করে জানব? ওর বাসা থেকে চলে যাওয়ার সময় তো নিজের সবকিছুই সাথে করে নিয়ে এসেছি। মেডিসিন নেয়া থামানোর কোন কারণ ছিল না। প্রেশার লো হয়ে যায় ভয়ানক ভাবে সেটা থামালে। শেষের দিকে এসে এক পর্যায়ে না জেনেই নিয়ে ফেললাম বিষটা। আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন ভাবে দেখবে না কেউ-ই।’
জ্বলন্ত চোখে দেখে ওদের মেয়েটা। চোখ কিভাবে ধ্বক ধ্বক করে জ্বলে!
শরিফ আর তুষাড়ের হার্টবীট বেড়ে যায়। ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে কিছুই করার থাকবে না।
মৃত মানুষের সাথে লড়াই করা যায় না।
তবে আবার শান্ত হয়ে বলতে শুরু করে মেয়েটা।
‘মারা যাওয়ার সময় আর পরের বেশ কয়েক ঘন্টা খুব কষ্টের, জানো? কিন্তু তারপরই সব বিষয়ে তুমি জেনে যাবে। এত এত জ্ঞান – উফফ!’ মাথা আঁকড়ে ধরে চন্দ্রিকা। ‘তখন জেনে গেলাম – কিভাবে মারা গেছি আমি। কিভাবে আমাকে ঠকিয়ে ভবিষ্যতের ঝামেলাও দূর করেছে আহাদ। তোমাদের কাছ থেকে আশা করি আহাদকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে। যেখানে আমাকে থাকতে দেয়নি ও নিজের সুখের জন্য – সেখানে আমিও তাকে থাকতে দেব না। আমার ইচ্ছে এতটুকুই – এর জন্যই মুক্তি পাচ্ছি না আমি।’
মৃত প্রত্যাশা নিয়ে ওদের দিকে তাকায় ও ।
‘কাজটা আপনি করছেন না কেন?’ জানতে চায় তুষাড়।
‘কারণ –’ বিষন্ন গলায় বলে চন্দ্রিকা, ‘একবার মরে গেলে আমরা আর কিছু স্পর্শ করতে পারি না যে!’
‘আহাদটা থাকে কোথায়?’ মেঘ গলায় জানতে চায় শরিফ।
‘আপনার হয়ে আমরা প্রতিশোধ নেব আপু।’ তুষাড়ও সায় দেয়, ‘তাছাড়া আমাদের একজন মানুষ বলি দিতে হবে বারো ঘন্টা আগে অথবা পরে। আপনার কথা যদি আপনি রাখেন – কাল রাতে আপনার শরীর থেকে আমরা ইয়ে – ওই দুটো পার্টস বের করে নিতে পারব। বারো ঘন্টা আগে আহাদকে শেষ করে দেব।’
ওদের মাথায় তখন চলছে এক ঢিলে দুই পাখি মারার ইচ্ছে।
‘আমি রাজি আছি।’ মাথা ঝাঁকায় বিষন্ন আত্মা।
আহাদের ঠিকানা তুলে নিতে থাকে শরিফ।
তুষাড় ডিটেইলস শুনতে চায় লোকটার ব্যাপারে। খুনোখুনির কাজ – ভুল করা চলবে না।
বাইরে তখন রাত সাড়ে তিনটার অন্ধকার!
(চলব)
উৎকন্ঠিত হয় শরীফ। এই পর্যন্ত করার জন্য মনোবল জোগাড় করে এসেছে ওরা। আরও কিছু?
‘আগে বলেননি কেন?’ শরিফ জানতে চায় ঠান্ডা গলায়।
‘আগে তো নিশ্চিত ছিলাম না এই কাজটাই করার জন্য কতটা সিরিয়াস তোমরা। এতদূর যখন এগিয়ে গেছ তখন আশা করি বাকিটা করতে পারবে। কাজটা কঠিন কি না।’
‘কাজটা কি?’
‘যকৃত আর চা পানের পর তোমাদের বারো ঘন্টার মাঝে একটা বলি দিতে হবে। মানুষ বলি। শয়তানের নামে।’
‘হোয়াট দ্যা ফা-’ বাক্যটার শেষ অংশ নিজের মাঝেই গিলে নেয় শরিফ।
‘সিদ্ধি লাভ করতে চাও তো? তাহলে আর দ্বিধা নয়। একটা ব্যাপার সহজ। কোন বাধাধরা নিয়ম নেই। যাকে ইচ্ছে বলি দিতে পারবে। তবে বলিটা দিতে হবে বারো ঘন্টার মাঝে। আগে অথবা পরে।’
কট করে কেটে যায় লাইন।
‘ওটা করা যাবে।’ ঠান্ডা গলায় তুষাড় বলে। ওর হাবভাবে বেশ আত্মবিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়।
‘সেটাই।’ কাঁধ ঝাঁকায় শরিফ। কাজটা বেশ কঠিন বৈকি। কয়েক স্তর ওপরে উঠতে পারবে নিশ্চিত। টেলিপোর্টেশনের ব্যাপারটা ম্যাগমা পর্যায়ে পাওয়া যায়। ওরা অতটুকু পৌঁছতে পারলেই আপাতত খুশি।
**দুই**
কবরস্থানের ভেতরটা শুনশান নীরবতার চাদরে ঢাকা।
‘কোন দিকে রে?’ আস্তে করে শরিফের কনুইয়ে খোঁচা দেয় তুষাড়।
‘সাতাশ সারির পনের নম্বর কবরটা। নতুন খোঁড়া।’
মোবাইলের ফ্ল্যাশের আলোয় ওরা কবর গুণে।
নির্দিষ্ট কবরটার সামনে এসে থমকে যায় কিছুটা।
কবরটা মাটি দিয়ে ঢাকা নয়। বরং একটা বিশাল গর্ত।
মাটিগুলো যেভাবে বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে – মনে হচ্ছে কেউ যেন প্রবল আক্রোশে ভেতর থেকে ধাক্কা দিয়ে মাটি ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছে বাইরে।
একটুকরো সাদা কাপড় পড়ে থাকতে দেখে ওরা। ছেঁড়া কাফন ?
ভয়ের একটা অনুভূতি ওদের তলপেটে অস্বস্তিকর শিরশিরানি তুলে দেয়!
‘কবর ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল নাকি?’ বিড় বিড় করে কাকে বলে শরিফ কে জানে!
চারপাশে মোবাইলের ফ্ল্যাশ মেরে দেখার চেষ্টা করে ওরা – কিন্তু সুবিশাল কবরস্থানে সেই আলো যেন মহাশূন্যের নিঃসঙ্গ জোনাকির কাজও করে না।
‘আমার কিন্তু এগুলো ভালো লাগছে না। এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত।’ আস্তে করে বলে তুষাড়।
মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থমকে যায় – ঠিক বারোটা বাজে!
‘ঠিক বলেছিস।’ চেষ্টা করেও গলার কাঁপুনী ঠেকাতে পারে না শরিফ, ‘যাওয়া যাক।’
ঘুরে দাঁড়ায় দুইজন একই সাথে এবং চমকে ওঠে প্রবল ভাবে।
ওদের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা। কালো চুলে আর কালো চোখ যেন মিশে গেছে কবরস্থানের অন্ধকারের সাথে। সেই সাথে ফর্সা মুখটা আরও ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। সারা শরীরে সাদা কাপড় জড়ানো।
পাথরের মত মুখ করে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল এতক্ষণ। এবার আস্তে করে হেসে ফেলল।
রহস্যময় ওই হাসি সহ্য করার মত না। তারপর যখন অসম্ভব সুন্দর গলায় মেয়েটা জানতে চায়, ‘যকৃত খুঁজছ? আমার আছে তো একটা।’
একমুহূর্ত একজন আরেকজনের দিকে তাকায় শরিফ আর তুষাড়।
তারপরেই প্রাণপনে ছুট লাগায় বিপরীত দিকে।
***
চারপাশে কবর আর কবর।
তার মাঝেই ছুটে যাচ্ছে ওরা। অন্ধের মত।
ভস করে একটা গর্তে হাঁটু পর্যন্ত দেবে যায় তুষাড়ের। কোনমতে সেটা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবারও সামনের দিকে দৌড়ায় ও। শরিফটা স্বার্থপর আছে এরই মাঝে পঞ্চাশ মিটার আগিয়ে গেছে ও।
ছুটছেও হরিণের মত।
পেছনে কি কোন পদশব্দ শোনা যাচ্ছে? মেয়েটাও কি এগিয়ে আসছে?
ওরা জানে না।
ফিরে তাকানোর সাহস ওদের নেই।
কোনমতে কবরস্থানের অন্যপাশ থেকে বেরিয়েও ওরা থামে না।
বিশাল লাইটপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁফায় দুইজনে।
‘দোস্ত – এইটা কি হল?’ বিহ্বলের মত জানতে চায় তুষাড়।
‘চুপ কর ব্যাটা। মুখে ওই ঘটনার নাম নিবি না ব্যাটা!’ ক্ষেপে যায় শরিফ । আসলে ওর চিরচেনা পৃথিবীর বাইরের দৃশ্য দেখে অতিমাত্রায় শকড বেচারা।
‘চল তোর রুমে যাই। চিন্তা ভাবনা করা দরকার।’
শরিফের বাসার নিচ থেকে একপ্যাকেট সিগারেট কেনে ওরা।
ঘটনার প্যাচ লেগে গেছে। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না মোটেও।
এরপরও ভাবতে হবে। তরুণীর লাশ লাগবে। থেমে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
সিঁড়িঘরটা অন্ধকার।
অন্ধকারকে এই প্রথম একটু ভয় করে শরিফের।
বাশারের রুমে এসে খাটের ওপর ধপ করে বসে পড়ে দুইজনেই।
‘দাঁড়া আলম ভাইকে একটা ফোন লাগাই।’
আলম ভাই ফোন ধরেন না।
সম্ভবত চর্চায় আছেন। রাত একটা বাজে। এখন তাঁর সাধনার জগতেই থাকার কথা।
‘ওই মেয়ের কথা মাথা থেকে সরিয়ে কাজ করা লাগবে আমাদেরশ তুষার ঠান্ডা হয়েছে কিছুটা।
‘হুঁ।’ একমত হয় শরিফও । ‘নতুন মেয়ে লাগবে। আরেকটা লাশ। সবগুলো তো আর সারি দিয়ে বের হয়ে আসবে না কবর থেকে। এই কেসটা কেমন জানি কাবজাব লেগে গেল!’
‘একদম ঠিক বলেছিস। আর কিছু খোঁজ খবর নিয়ে -’
এই সময় দড়াম করে খুলে গেল ওয়াল-ওয়ারড্রোবের দরজা।
ঘরের ভেতরটা ভরে যায় সুন্দর একটা গন্ধে। গন্ধটা একই সাথে মন খারাপ করা।
মৃতদেহের গোসলের পর এমন গন্ধই পাওয়া যায় তাদের শরীর থেকে।
শরিফের কোটটা ঝুলছিল – ওটা ঠেলে বেড়িয়ে আসে একটু আগে দেখে আসা কবরস্থানের মৃত মেয়েটির।
**তিন**
শরিফের কাঁপাকাঁপি লেগে গেছে।
তুষাড়ের অবস্থাও সুবিধের না।
তবে সেই সব দিকে লক্ষ্যই করে না যেন মেয়েটা!
‘চন্দ্রিকা আমার নাম।’ ভীষণ শীতল কন্ঠে বলে মেয়েটা।
চুপ হয়েই থাকে দুইজনই।
‘তোমরা শরিফ আর তুষাড়। আমার হৃৎপিন্ড আর যকৃত দরকার। প্রেতচর্চা আর শয়তানের পূজারীর একটা রিমিক্সড ভার্সনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছ।’
খুক করে কাশে তুষাড়, ‘ব্যাপারটা ব্যক্তিগত ভাবে নেবেন না আশা করি। আমাদের সামনের স্তরে ওঠার জন্য -’
হাত তুলে ওকে থামায় চন্দ্রিকা, ‘জানি আমি। আমার মত যারা – তাদের অনেক কিছুই জানতে হয়। নিজের শরীরের প্রতি একটা মায়া আমার ছিলই। তবে তোমাদের আমার কাহিনী শুনতে হবে। তারপর হৃৎপিন্ড আর যকৃত আমি স্যাক্রিফাইস করে দিতে রাজি আছি। আমার আত্মার মুক্তির পর অবশ্য দেহ নিয়ে কি করলে সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই। আমি শুধু এই বিভীষিকা থেকে মুক্তি চাই।’
‘আপনার প্রস্তাবটা কি?’ প্রথমবারের মত মুখ খোলে শরীফ।
‘আমার মৃত্যুর ব্যাপারটা সবাই আত্মহত্যা হিসেবেই জানে।’ শরিফের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলে মেয়েটা। ‘কিন্তু আসল ঘটনা সেটা না। তোমরা কি জানো কখন একটা মৃতদেহ থেকে আত্মা চলে যেতে পারে না? ’
আগ্রহের সাথে তাকিয়ে থাকে ওরা।
‘যখন সেই মানুষটার অতৃপ্ত বাসনা থেকে যায়।’ নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দেয় চন্দ্রিকা , ‘হ্যাঁ – প্রশ্ন থেকে যায় – প্রতিটা মানুষই কিছু অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে মারা যায় – সেক্ষেত্রে কেন কিছু আত্মার মুক্তি হয় না? কারণ, আত্মার বাসনাটা হতে হয় খুবই তীব্র। আমাকে দেখছ হেঁটে বেড়াতে – কিন্তু সারা শরীরে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে আমার। তোমাদের কি বলে বোঝাবো -’ কিছুক্ষণ চুপচাপ উদাহরণ খোঁজে মেয়েটা, ‘অনেকটা একই সাথে গায়ে আগুন আর বরফ ধরিয়ে দেয়ার মত। পার্থিব কোন যন্ত্রণা না এটা। অতৃপ্ত আত্মাদের দীর্ঘশ্বাস কিংবা শীতল গলায় ভড়কে যায় সবাই – সেটার উৎপত্তিস্থল কিন্তু এই যন্ত্রণা।’
বিষাদের ছায়া পড়ে মেয়েটার মুখে। ওর দিকে ব্যাথাভরা চোখে তাকিয়ে থাকে শরিফ আর তুষাড়।
‘এই যন্ত্রণাকে সহ্য করে নিয়েও যখন কোন আত্মা তীব্রভাবে চায় পৃথিবীর বুকে থেকে যেতে অসমাপ্ত কাজ সমাধার জন্য – তখন আমরা আর দেহ ছেড়ে যেতে পারি না। যতক্ষণ না আমাদের বাসনা পূর্ণ হবে – দেহ ছাড়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এখানেই আসছ তোমরা - এই যন্ত্রণা থেকে তোমরা আমাকে মুক্তি দেবে – দেহটা পেয়ে যাবে। তোমাদেরও সাফল্য আমারও শান্তি। ’
একজন আরেকজনের দিকে তাকায় শরিফ আর তুষাড়।
‘এলাকায় আত্মহত্যার ঘটনাই প্রকাশ হয়েছে। আপনি মারা গেলেন কিভাবে, যদি আত্মহত্যা না হয় সেটা?’ তুষাড় জানতে চায় মোমের মত সাদা মুখটার দিকে তাকিয়ে। ওর দিকে প্রাণশূন্য চোখ ঘুরিয়ে তাকায় এবার মেয়েটা ।
‘আহাদ আমার বয়ফ্রেন্ড। আমাদের সম্পর্কটা ছিল অনেক দীর্ঘ। সাত বছর।’ দীর্ঘশ্বাসের মত শব্দ হয় একটা ঘরের মাঝে। ‘গত একবছর আমরা একসাথে ছিলাম। উই ওয়্যার লিভিং টুগেদার। বাট হি লেফট মি। লেফট মি উইদ আ গুডবাই গিফট।’
‘বুঝলাম না।’ মাথা নাড়ায় শারিফ।
‘আমাকে তাড়িয়ে দেয় ওর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। আমি অন্তঃসত্ত্বা জানার পর পরই। আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে ওর কোনদিনও ছিল না। নিজের ওপর তীব্র ঘৃণা হত তখন। আরও বেশি ঘৃণা হত আহাদের ওপর। কিন্তু আমি আত্মহত্যা করি নি। আমার একটা তুলতুলে বাবু হত! একটা পিশাচের কাছে নিজের জীবনযুদ্ধে হেরে যাবার মত বোকা আমি ছিলাম না। কিন্তু সাতদিনের মাথায় টুপ করে মরে গেলাম!’
‘কিন্তু কিভাবে?’ একসাথে জানতে চায় শরিফ আর তুষাড়।
‘মেডিকেশন।’ চোখ মুছে জবাব দেয় চন্দ্রিকা। ‘আমার রোজ দুইটা ওষুধ নিতে হত। সেটার সাথে একই রকম দেখতে সায়নায়িড পিল রেখে দিয়েছিল আহাদ। পনেরটা ট্যাবলেটের মাঝে একটা বিষ সেটা আমি কি করে জানব? ওর বাসা থেকে চলে যাওয়ার সময় তো নিজের সবকিছুই সাথে করে নিয়ে এসেছি। মেডিসিন নেয়া থামানোর কোন কারণ ছিল না। প্রেশার লো হয়ে যায় ভয়ানক ভাবে সেটা থামালে। শেষের দিকে এসে এক পর্যায়ে না জেনেই নিয়ে ফেললাম বিষটা। আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন ভাবে দেখবে না কেউ-ই।’
জ্বলন্ত চোখে দেখে ওদের মেয়েটা। চোখ কিভাবে ধ্বক ধ্বক করে জ্বলে!
শরিফ আর তুষাড়ের হার্টবীট বেড়ে যায়। ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে কিছুই করার থাকবে না।
মৃত মানুষের সাথে লড়াই করা যায় না।
তবে আবার শান্ত হয়ে বলতে শুরু করে মেয়েটা।
‘মারা যাওয়ার সময় আর পরের বেশ কয়েক ঘন্টা খুব কষ্টের, জানো? কিন্তু তারপরই সব বিষয়ে তুমি জেনে যাবে। এত এত জ্ঞান – উফফ!’ মাথা আঁকড়ে ধরে চন্দ্রিকা। ‘তখন জেনে গেলাম – কিভাবে মারা গেছি আমি। কিভাবে আমাকে ঠকিয়ে ভবিষ্যতের ঝামেলাও দূর করেছে আহাদ। তোমাদের কাছ থেকে আশা করি আহাদকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে। যেখানে আমাকে থাকতে দেয়নি ও নিজের সুখের জন্য – সেখানে আমিও তাকে থাকতে দেব না। আমার ইচ্ছে এতটুকুই – এর জন্যই মুক্তি পাচ্ছি না আমি।’
মৃত প্রত্যাশা নিয়ে ওদের দিকে তাকায় ও ।
‘কাজটা আপনি করছেন না কেন?’ জানতে চায় তুষাড়।
‘কারণ –’ বিষন্ন গলায় বলে চন্দ্রিকা, ‘একবার মরে গেলে আমরা আর কিছু স্পর্শ করতে পারি না যে!’
‘আহাদটা থাকে কোথায়?’ মেঘ গলায় জানতে চায় শরিফ।
‘আপনার হয়ে আমরা প্রতিশোধ নেব আপু।’ তুষাড়ও সায় দেয়, ‘তাছাড়া আমাদের একজন মানুষ বলি দিতে হবে বারো ঘন্টা আগে অথবা পরে। আপনার কথা যদি আপনি রাখেন – কাল রাতে আপনার শরীর থেকে আমরা ইয়ে – ওই দুটো পার্টস বের করে নিতে পারব। বারো ঘন্টা আগে আহাদকে শেষ করে দেব।’
ওদের মাথায় তখন চলছে এক ঢিলে দুই পাখি মারার ইচ্ছে।
‘আমি রাজি আছি।’ মাথা ঝাঁকায় বিষন্ন আত্মা।
আহাদের ঠিকানা তুলে নিতে থাকে শরিফ।
তুষাড় ডিটেইলস শুনতে চায় লোকটার ব্যাপারে। খুনোখুনির কাজ – ভুল করা চলবে না।
বাইরে তখন রাত সাড়ে তিনটার অন্ধকার!
(চলব)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
পবিত্র চক্রবর্তী ১৫/০৪/২০১৮সুন্দর