কবি নিজামের গল্প
পাঠকদের সাথে অল্পস্বল্প গল্প করার সুযোগ ঐ কবির ভাগ্যে জোটে না! কারণ, সে কবিতা ছাড়া অন্য বিষয়ে কখনোই কাউকে কিছু বলে না! যেকেউ তার কাছে আসুক না কেন জোর করে হলেও অন্ততঃ একটা কবিতা শুনিয়ে ছাড়বে! তার উপর, তিনি এই লিখেছেন-সেই লিখেছেন, অমুক পত্রিকার তমুক পাতায় তার লেখা ছেপেছে, আবার ওই ম্যাগাজিন সেই ম্যাগাজিন, একক-যৌথ মিলিয়ে ১২৪ খানা কাব্যগ্রন্থ...... আরও কত্ত কী! কবি নিজামের মহান কীর্তির গল্পকথা অত্র এলাকার বাচ্চা থেকে বুড়ো সবারই মুখস্থ! আজকাল, লোকটাকে বড্ড একঘেয়েমি মনে করায় তেমনকেউ তার আশেপাশেও ঘেঁষে না! অথচ, এইরকম একটা পাগল টাইপ লোকের সাক্ষাত করার জন্য আমার যেতে হচ্ছে। স্বেচ্ছায় নয়, অনেকটা বাধ্য হয়েই! আজ সকালে ঘুমঘুম চোখে কলপাড়ে ব্রাশ করছি, এমন সময় হাসিনা বুবু এসে বললেনঃ
- ভাইজান, আব্বায় অক্ষনি ডাকে!
মুখহাত ধুয়ে আব্বার ঘরে গেলাম। তিনি আমার হাতে একটা সবুজরঙ্গা চিঠির খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেনঃ
- এই খামটা ঐ কবির হাতে পৌঁছে দিবি, কোনোভাবেই যেন অন্যকারো হাতে না পড়ে।
আব্বার মুখে ঐ কবির নামটা শুনেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। কিছু বলার সাহস পেলাম না। অগত্যা, মাথা নেড়ে সায় দিতে হলো। ঘর থেকে বেরুনোর সময় আব্বা পেছন থেকে বললেনঃ
- খামের মুখে আঠা লাগিয়ে নিস।
'ঠিক আছে' বলেই নিজের ঘরে এসে বেরুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় টেবিলে রাখা খামের ওপর বারবার চোখ পড়ছে। খামটার দিকে আড়চোখে দেখছি আর মনেমনে ভাবছি- "আব্বার সাথে ঐ কবির কী এমন কথা থাকতে পারে! যেজন্য আমাকে দিয়ে এতো সকাল সকাল চিঠি পাঠাতে হচ্ছে? আবার সেটা সরাসরি তার হাতেই দিতে হবে! কারণ কী? আর কীইবা লেখা আছে এই চিঠিতে?"
যাইহোক, অজস্র জিজ্ঞাসার গলা টিপে ধরতে খামের মুখটা ভাতের আঠা দিয়ে বন্ধ করে দিলাম। অতঃপর, দ্বিচক্রযান নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। আষাঢ় মাসে খরা দিন, রৌদ্রেরঝাঁজ যেন তালু বরাবর। সাত কিলো রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে ঘর্মাক্ত শরীর, একদম খ্যাঁত ক্যাঁত অবস্থা। চারিদিকে মাঠঘাট শুকিয়ে চৌচির, কোথাও পানি নেই। উপর থেকে সূর্যতাপ নীচের থেকে মাটির উত্তাপ সবমিলিয়ে একাকার অবস্থা, পিপাসায় বুক শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে যাবার উপক্রম। চলতে চলতে টিংটিং মোড়ের ত্রি রাস্তায় বটগাছের নীচের চায়ের দোকানে ঢুকেই ঢকঢক করে তিন গ্লাস পানি পান করলাম। পানির স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে, মূলত প্রচন্ড গরমে পানির স্বাদ এভাবেই থেঁতলে যায়!!
দোকানী জিজ্ঞেস করলেনঃ
- ভাইজান, কী খাইবেন?
আমি শুধু বললাম - কী আছে? সে গড়গড় করে বলতে শুরু করলো -
-"চিড়া, মুড়ি, সবরিকলা, বিস্কুট, চানা, চিবড়ি, বান্দামোলা..."
তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম -
'আচ্ছা ঠিক আছে, একটা চিবড়ি আর রং চা দাও!'
চিড়াভাজা আর গুড়ের রসায়নে প্রস্তুতকৃত এই খাবারটি আমার বেশ প্রিয়। গ্রামের প্রায় সকল দোকানেই এটি পাওয়া যায়, দাম মাত্র পাঁচ টাকা। বেশ আয়েশ করে চা, চিবড়ি খাচ্ছি এমন সময় আমার পূর্ব পরিচিত সাহেব আলী দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে চা, চিবড়ির অর্ডার করলাম। চল্লিশোর্ধ্ব সাহেব আলী আমার বন্ধুর মতন, যাকে দেখে পথের ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়ে গেলো, খুব মজার মানুষ। কথায় কথায় সে জানতে চাইলে বললাম যে, "কবি নিজামের বাড়ি যাচ্ছি।" কথাটা শুনেই সে আৎকে উঠে বললোঃ
- বলিস কী রে! ঐ পাগলের বাড়িতে তোর কী কাজ?
এই প্রখর রোদে পুড়ে তার ওখানে যাওয়া কি খুব জরুরী?
তার কথা শেষ না হতেই পাশে থেকে একজন অতিউৎসাহী লোক সাহেব ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ
- "ভাইজান, এইরকম আষাঢ়-শান মাসে বন্যার পানিত চাইরচলা দোলা ডাংগা সউগ ডুবি যাবার কতা, তা না হয়া এইরকম রইদ-খরা হওয়াটা য্যামন অভাক কান্ড! ত্যামন ঐ কবি নিজামের বাড়িত যাওয়াটাও অভাক কান্ড!! পাগলা না হইলে কাহো উয়ার বাড়িত যায়!?"
দোকানের ভেতরে বাইরে জনা দশেক লোকের ভীড়। লোকটির কথা চলমান অবস্থায় সবাই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল! যেনো, চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে আসা কোন প্রাণীকে এই বটতলায় বিনামূল্যে দেখতে পাচ্ছে! কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছি, তাই আর দেরি না করে বিল চুকিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
কিছুদূর এগিয়ে গেছি, পেছন থেকে সাহেব ভাই ডাকছেন, তার ডাক শুনে অশ্বত্থের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি পা চালিয়ে এসে বললেনঃ
- চল, আমিও যাবো।
(চলবে.....)
- ভাইজান, আব্বায় অক্ষনি ডাকে!
মুখহাত ধুয়ে আব্বার ঘরে গেলাম। তিনি আমার হাতে একটা সবুজরঙ্গা চিঠির খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেনঃ
- এই খামটা ঐ কবির হাতে পৌঁছে দিবি, কোনোভাবেই যেন অন্যকারো হাতে না পড়ে।
আব্বার মুখে ঐ কবির নামটা শুনেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। কিছু বলার সাহস পেলাম না। অগত্যা, মাথা নেড়ে সায় দিতে হলো। ঘর থেকে বেরুনোর সময় আব্বা পেছন থেকে বললেনঃ
- খামের মুখে আঠা লাগিয়ে নিস।
'ঠিক আছে' বলেই নিজের ঘরে এসে বেরুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় টেবিলে রাখা খামের ওপর বারবার চোখ পড়ছে। খামটার দিকে আড়চোখে দেখছি আর মনেমনে ভাবছি- "আব্বার সাথে ঐ কবির কী এমন কথা থাকতে পারে! যেজন্য আমাকে দিয়ে এতো সকাল সকাল চিঠি পাঠাতে হচ্ছে? আবার সেটা সরাসরি তার হাতেই দিতে হবে! কারণ কী? আর কীইবা লেখা আছে এই চিঠিতে?"
যাইহোক, অজস্র জিজ্ঞাসার গলা টিপে ধরতে খামের মুখটা ভাতের আঠা দিয়ে বন্ধ করে দিলাম। অতঃপর, দ্বিচক্রযান নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। আষাঢ় মাসে খরা দিন, রৌদ্রেরঝাঁজ যেন তালু বরাবর। সাত কিলো রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে ঘর্মাক্ত শরীর, একদম খ্যাঁত ক্যাঁত অবস্থা। চারিদিকে মাঠঘাট শুকিয়ে চৌচির, কোথাও পানি নেই। উপর থেকে সূর্যতাপ নীচের থেকে মাটির উত্তাপ সবমিলিয়ে একাকার অবস্থা, পিপাসায় বুক শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে যাবার উপক্রম। চলতে চলতে টিংটিং মোড়ের ত্রি রাস্তায় বটগাছের নীচের চায়ের দোকানে ঢুকেই ঢকঢক করে তিন গ্লাস পানি পান করলাম। পানির স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে, মূলত প্রচন্ড গরমে পানির স্বাদ এভাবেই থেঁতলে যায়!!
দোকানী জিজ্ঞেস করলেনঃ
- ভাইজান, কী খাইবেন?
আমি শুধু বললাম - কী আছে? সে গড়গড় করে বলতে শুরু করলো -
-"চিড়া, মুড়ি, সবরিকলা, বিস্কুট, চানা, চিবড়ি, বান্দামোলা..."
তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম -
'আচ্ছা ঠিক আছে, একটা চিবড়ি আর রং চা দাও!'
চিড়াভাজা আর গুড়ের রসায়নে প্রস্তুতকৃত এই খাবারটি আমার বেশ প্রিয়। গ্রামের প্রায় সকল দোকানেই এটি পাওয়া যায়, দাম মাত্র পাঁচ টাকা। বেশ আয়েশ করে চা, চিবড়ি খাচ্ছি এমন সময় আমার পূর্ব পরিচিত সাহেব আলী দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে চা, চিবড়ির অর্ডার করলাম। চল্লিশোর্ধ্ব সাহেব আলী আমার বন্ধুর মতন, যাকে দেখে পথের ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়ে গেলো, খুব মজার মানুষ। কথায় কথায় সে জানতে চাইলে বললাম যে, "কবি নিজামের বাড়ি যাচ্ছি।" কথাটা শুনেই সে আৎকে উঠে বললোঃ
- বলিস কী রে! ঐ পাগলের বাড়িতে তোর কী কাজ?
এই প্রখর রোদে পুড়ে তার ওখানে যাওয়া কি খুব জরুরী?
তার কথা শেষ না হতেই পাশে থেকে একজন অতিউৎসাহী লোক সাহেব ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ
- "ভাইজান, এইরকম আষাঢ়-শান মাসে বন্যার পানিত চাইরচলা দোলা ডাংগা সউগ ডুবি যাবার কতা, তা না হয়া এইরকম রইদ-খরা হওয়াটা য্যামন অভাক কান্ড! ত্যামন ঐ কবি নিজামের বাড়িত যাওয়াটাও অভাক কান্ড!! পাগলা না হইলে কাহো উয়ার বাড়িত যায়!?"
দোকানের ভেতরে বাইরে জনা দশেক লোকের ভীড়। লোকটির কথা চলমান অবস্থায় সবাই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল! যেনো, চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে আসা কোন প্রাণীকে এই বটতলায় বিনামূল্যে দেখতে পাচ্ছে! কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছি, তাই আর দেরি না করে বিল চুকিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
কিছুদূর এগিয়ে গেছি, পেছন থেকে সাহেব ভাই ডাকছেন, তার ডাক শুনে অশ্বত্থের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি পা চালিয়ে এসে বললেনঃ
- চল, আমিও যাবো।
(চলবে.....)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সুপ্রিয় কুমার চক্রবর্তী ২৯/০৮/২০১৯আশা করছি একজন কবির কষ্টের কথা উঠে আসবে ....যা আমরা পাঠকরা কখনই সেভাবে ভাবি না ! আমাদের দরকার শুধু কবিতা , কবি নয় !!
-
শাহানাজ সুলতানা (শাহানাজ) ১২/০৭/২০১৯ভালো লাগলো
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৭/০৭/২০১৯পড়তে থাকি।