নির্বাচন ব্যবস্থা
সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশিত সব রিপোর্ট সব সময় ভালো লাগে না। ভালো লাগার কথাও নয়। যেমন মাঝখানে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের নেতিবাচক নানাদিক নিয়ে দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটি সংস্থা যেসব রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সেগুলো সম্পর্কেও আবার নেতিবাচক বক্তব্যই বেশি শুনতে ও পড়তে হয়েছে। ওই নির্বাচন নিয়ে এখনও রিপোর্ট এবং পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য প্রকাশের পালা চলছেই। এরপর প্রসঙ্গ হিসেবে এসেছে উপজেলা নির্বাচন। পাঁচ পর্যায়ে অনুষ্ঠেয় সে নির্বাচনের পালা এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে যেসব তথ্য জানা যাচ্ছে সেসবের কোনো একটিও উৎসাহিত হওয়ার মতো নয়। বিষয়টি নিয়ে তাই কথা না বাড়ানোই ভালো।
তা সত্ত্বেও অন্তত একটি বিশেষ কারণে উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গকে একেবারে পাশ কাটিয়ে যাওয়া অনুচিত। সে কারণটির পেছনে রয়েছেন সিইসি বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। নির্বাচনের প্রাক্কালে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে উপজেলা নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন করতে গিয়ে দেয়া বক্তৃতায় তিনি অতীব দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, এই নির্বাচনে ‘বড়’ রাজনৈতিক দলগুলোর অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নাকি ‘হতাশাজনক’! এর ফলে উপজেলা নির্বাচন যে অংশগ্রহণমূলক হতে পারবে না সে কথাটাও অনেকাংশে অনুগ্রহ করার ঢঙে বলেছিলেন সিইসি। তিনি সেই সাথে আবার যোগ করেছিলেন, অংশগ্রহণমূলক না হলেও নির্বাচন যথেষ্ট প্রতিযোগিতামূলক হবে। কারণেরও ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন মিস্টার নূরুল হুদা। বলেছিলেন, বড় দলগুলো অংশ না নিলেও প্রার্থীর কোনো অভাব হবে না। সেজন্যই নির্বাচনও ‘যথেষ্ট প্রতিযোগিতামূলক’ হবে। অন্যদিকে বাস্তবে কতটা ‘প্রতিযোগিতামূলক’ হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রথম দফার নির্বাচনেই। কারণ, ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনের মতোই সেদিনের নির্বাচনেও নৌকার তথা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের জয়জয়কার দেখেছে মানুষ। সিইসির পদে যেহেতু একই নূরুল হুদা রয়েছেন সেহেতু এমন ফলাফলই অবশ্য স্বাভাবিক ছিল। ‘অথর্ব’ ও ‘মেরুদন্ডহীন’ ধরনের ব্যঙ্গাত্মক নানা বিশেষণে ডাকাডাকি করে এতদিন তাকে নিয়ে অনেক উপহাস করা হলেও ৩০ ডিসেম্বর আয়োজিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সিইসি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গেই প্রমাণ করে দিয়েছেন, যে যা-ই বলুক না কেন, তিনি অন্তত ‘অথর্ব’ নন! এজন্যই আওয়ামী লীগ ও তার জোটের সঙ্গী দলগুলো ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতেই জিততে পেরেছে। শুধু তা-ই নয়, দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণও প্রমাণ করেছে, মিস্টার নূরুল হুদা যথেষ্ট করিৎকর্মা বলেই ৯০ থেকে শুরু করে কোথাও কোথাও ৯৯ এমনকি তারও বেশি শতাংশ পর্যন্ত ভোট পেয়েছেন নৌকা মার্কার প্রার্থীরা!
অন্যদিকে ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত হলেও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের খুব কম সংখ্যক প্রার্থীর পক্ষেই কিন্তু চার-পাঁচ শতাংশের ঘর পার করা সম্ভব হয়েছে। ‘পরাজিত’ প্রার্থীরা তথ্য-পরিসংখ্যান হাজির করে দাবি জানিয়েছেন এবং প্রমাণ করেও দেখিয়েছেন যে, তাদের আসলে সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী হারিয়ে দেয়া হয়েছে। এজন্যই ট্রাইব্যুনালে যাওয়া শুরু করেছেন তারা। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে ন্যায় বিচার পাওয়ার আশা ও সম্ভাবনা না থাকলেও বিষয়টিকে ইতিহাসে রেকর্ড করে রাখার তাগিদ থেকেই আদালতে যাচ্ছেন ‘পরাজিত’ প্রার্থীরা। এসব প্রার্থীর সঙ্গে সাধারণ মানুষও অন্তত একটি বিষয়ে একমত যে, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন যেমন, সিইসি নূরুল হুদার নামও তেমনি ‘রেকর্ড’ হয়ে থাকবে! কে জানে, সিইসির নামটি হয়তো ‘স্বর্ণাক্ষরেই’ লিখিত হবে!
এ পর্যন্ত এসে নিবন্ধের বিষয়বস্তুর ব্যাপারে পাঠকরা ধন্দে পড়তে পারেন। উদ্দেশ্য আসলে দু’-একটি রিপোর্ট সম্পর্কে জানানো। আর সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন যেহেতু একটি প্রধান আলোচ্য ও আলোচিত প্রসঙ্গে পরিণত হয়েছে সেহেতু নির্বাচন দিয়েই শুরু করতে হয়েছে। এখানে ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ বা সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের একটি মন্তব্যের উল্লেখ করতে হবে। ৩ মার্চ সংখ্যা দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এই রিপোর্টে জানানো হয়েছে, আগের দিন ময়মনসিংহে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে এবং ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে চরম অনাগ্রহ ও অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সুজন সম্পাদক আরো বলেছেন, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বর্তমানে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে এসে গেছে এবং নির্বাচন কমিশন ও দুদকের মতো রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো দলীয়করণ ও পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে।
বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে সুজন সম্পাদকের এই বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য, এমনকি আপত্তিকর বলেও মনে হতে পারে। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের মাত্র কিছুদিন আগে সংসদ নির্বাচনের নামে যা কিছু ঘটানো হয়েছে সেগুলোকে বিবেচনায় নেয়া হলে স্বীকার করতেই হবে যে, সুজন সম্পাদক মোটেও বাড়িয়ে বলেননি। কারণ, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের বিভিন্ন কর্মকান্ডকে জালিয়াতি ও চুরি থেকে ডাকাতি পর্যন্ত কোনো শব্দ দিয়েই সঠিকভাবে বোঝানো সম্ভব হয়নি। ওই উপলক্ষে সম্পন্ন সামগ্রিক কার্যক্রম বা পারফরমেন্সের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা বরং জনমনে সন্দেহ বাড়িয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। নির্বাচন কমিশনকে বিশ্বাস করার বদলে জনগণ উল্টো ভীত-সন্ত্রস্ত ও স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। কারণ, যেসব কার্যকমের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায় না বরং বিতর্কিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়, তার সবই করা হয়েছিল ওই সংসদ নির্বাচনে। আর সরকারের অঘোষিত প্রত্যক্ষ মদতে এবং পুলিশ ও প্রশাসনের প্রকাশ্য সহযোগিতায় এসবই করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীসহ দলীয় নেতা-কর্মিরা। সহিংসতা, ভোট কেন্দ্র দখল, প্রতিপক্ষ তথা বিরোধী দলের কর্মি-সমর্থকদের ভোটকেন্দ্র থেকে মারপিট করে তাড়িয়ে দেয়া, আওয়ামী লীগ বিরোধী ভোটারদের ভোটকেন্দ্রের ধারে-কাছে যেতে না দেয়া, ব্যালট পেপারে যথেচ্ছভাবে নৌকায় সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা, কোথাও কোথাও ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা, মোট ভোটারের চাইতে অনেক বেশি ব্যালট পেপারে নৌকায় সিল মারা এবং ফলাফল পাল্টে দেয়াসহ ‘বিজয়’ ছিনিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করেছে পুলিশ, প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের লোকজন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা থেকেছেন নির্লিপ্ত। তারা আসলে জেগে ঘুমিয়ে থাকার ‘ভাণ’ করেছেন। কোনোভাবে সময় পার করেছেন। এভাবেই জিতিয়ে এনেছেন আওয়ামী লীগ এবং তার জোটের প্রার্থীদের। এতকিছুর পরও নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলেন সিইসি মিস্টার নূরুল হুদা।
৩০ ডিসেম্বরের অভিজ্ঞতার এই অভিজ্ঞতার কারণে জনগণ যে সত্যিই নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে তার সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেদিন অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। নির্বাচন কেমন হয়েছে সে বিষয়ে ধারণা দেয়ার জন্য একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এক রিপোর্টের শিরোনাম উল্লেখ করাই সম্ভবত যথেষ্ট হবেÑ ‘বিস্ময়কর ফলাফল ঢাকা সিটি ভোটে : কোনো কেন্দ্রে ৩, কোনোটাতে ৫ আবার কোথাও ৮৪.৮১ শতাংশ’। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে এক হাজার ২৯৫টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৩২টিতে ভোট পড়েছে মাত্র এক থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত। পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ ভোট পড়েছে ৪০টি কেন্দ্রে। ২০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে ২০৬টি কেন্দ্রে। ৩২২টি কেন্দ্রে পড়েছে ৩০ শতাংশের কম ভোট। এসব মিলিয়ে ৬২২টি কেন্দ্রে পড়েছে ৩০ শতাংশের কম ভোট। উল্টোরকম ঘটেছে আবার ১১৯টি কেন্দ্রে। এসব কেন্দ্রে ৫০ শতাংশ থেকে ৮৪.৮১ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে। ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে পাঁচটি কেন্দ্রে। মেয়র পদে মিরপুরের একটি কেন্দ্রে ভোটার যেখানে ছিলেন দুই হাজার ৫০৪ জন সেখানে ভোট পড়েছে মাত্র তিনটি। শতকরা হিসাবে মাত্র ০. ১২! এতটাই প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন!
সব মিলিয়েই প্রমাণিত হয়েছে, সুজনের পক্ষ থেকে অকারণে বলা হয়নি যে, বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে দেশে নির্বাচনী ব্যব¯া’ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে এবং ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে চরম অনাগ্রহ ও অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সুজন সম্পাদক আরো বলেছেন, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বর্তমানে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে এসে গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুজন সম্পাদক সৌজন্য দেখানোর উদ্দেশ্যে ‘ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে’ বললেও বাস্তবে নির্বাচনী ব্যবস্থা এরই মধ্যে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। এমন অবস্থার জন্য দায়ী আসলে নির্বাচন কমিশন- সঠিকভাবেই যাকে সরকারের ‘সেবাদাস’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মূলত কমিশনের বিভিন্ন অপকৌশলের কারণেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনমুখী বড় দলগুলো নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবে ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত এসব দলকে সুকৌশলে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের পরিকল্পিত একদলীয় স্বৈরশাসনের স্বার্থে গণতন্ত্রবিরোধী এই কাজটুকু সেরেছেন সিইসি নূরুল হুদা এবং তার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। হঠাৎ শুনতে কঠিন বা দুর্বোধ্য মনে হলেও এমন মন্তব্যের কারণ হলো, গণতন্ত্রের প্রাণ বা মূলকেন্দ্র যে জাতীয় সংসদ, সিইসি এবং তার সঙ্গী-সাথীরা সে সংসদেরই মূলোৎপাটন করে ফেলেছেন। তাদের বদৌলতে ‘নির্বাচিত’ ও গঠিত একাদশ সংসদকে সাধারণ মানুষও ‘ডাকাতের আখড়া’ ছাড়া অন্য কোনো নামে চিহ্নিত করতে সম্মত হচ্ছেন না।
বিষয়টি কিন্তু বাংলাদেশের জন্য শুধু নয়, যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্যই অত্যন্ত আশংকাজনক। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, অনেক বেশি গুরুতর আপত্তির কারণ সৃষ্টি করেছেন সিইসি নূরুল হুদা। তিনি আসলে এমন এক সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভ’মিকা পাল করেছেন, যে সরকার মানুষের সর্বশেষ ভরসার স্থল হিসেবেও কোনো প্রতিষ্ঠানকে থাকতে দিচ্ছে না। সরকার বরং একদলীয় চূড়ান্ত স্বৈরশাসনের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।
এভাবে, বিশেষ করে একদিকে সরকার এবং অন্যদিকে ‘অথর্ব’ না হলেও ‘অতি বিশ্বস্ত’ নির্বাচন কমিশনের কারণে দেশে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচন ও সেগুলোর ফলাফল কখনো গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না। ঢাকা সিটি করপোরেশন দেখে মনে হচ্ছে মানুষ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা থাকলে এমনটি হতে পারতো না। গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি।
তা সত্ত্বেও অন্তত একটি বিশেষ কারণে উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গকে একেবারে পাশ কাটিয়ে যাওয়া অনুচিত। সে কারণটির পেছনে রয়েছেন সিইসি বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। নির্বাচনের প্রাক্কালে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে উপজেলা নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন করতে গিয়ে দেয়া বক্তৃতায় তিনি অতীব দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, এই নির্বাচনে ‘বড়’ রাজনৈতিক দলগুলোর অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নাকি ‘হতাশাজনক’! এর ফলে উপজেলা নির্বাচন যে অংশগ্রহণমূলক হতে পারবে না সে কথাটাও অনেকাংশে অনুগ্রহ করার ঢঙে বলেছিলেন সিইসি। তিনি সেই সাথে আবার যোগ করেছিলেন, অংশগ্রহণমূলক না হলেও নির্বাচন যথেষ্ট প্রতিযোগিতামূলক হবে। কারণেরও ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন মিস্টার নূরুল হুদা। বলেছিলেন, বড় দলগুলো অংশ না নিলেও প্রার্থীর কোনো অভাব হবে না। সেজন্যই নির্বাচনও ‘যথেষ্ট প্রতিযোগিতামূলক’ হবে। অন্যদিকে বাস্তবে কতটা ‘প্রতিযোগিতামূলক’ হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রথম দফার নির্বাচনেই। কারণ, ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনের মতোই সেদিনের নির্বাচনেও নৌকার তথা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের জয়জয়কার দেখেছে মানুষ। সিইসির পদে যেহেতু একই নূরুল হুদা রয়েছেন সেহেতু এমন ফলাফলই অবশ্য স্বাভাবিক ছিল। ‘অথর্ব’ ও ‘মেরুদন্ডহীন’ ধরনের ব্যঙ্গাত্মক নানা বিশেষণে ডাকাডাকি করে এতদিন তাকে নিয়ে অনেক উপহাস করা হলেও ৩০ ডিসেম্বর আয়োজিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সিইসি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গেই প্রমাণ করে দিয়েছেন, যে যা-ই বলুক না কেন, তিনি অন্তত ‘অথর্ব’ নন! এজন্যই আওয়ামী লীগ ও তার জোটের সঙ্গী দলগুলো ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতেই জিততে পেরেছে। শুধু তা-ই নয়, দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণও প্রমাণ করেছে, মিস্টার নূরুল হুদা যথেষ্ট করিৎকর্মা বলেই ৯০ থেকে শুরু করে কোথাও কোথাও ৯৯ এমনকি তারও বেশি শতাংশ পর্যন্ত ভোট পেয়েছেন নৌকা মার্কার প্রার্থীরা!
অন্যদিকে ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত হলেও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের খুব কম সংখ্যক প্রার্থীর পক্ষেই কিন্তু চার-পাঁচ শতাংশের ঘর পার করা সম্ভব হয়েছে। ‘পরাজিত’ প্রার্থীরা তথ্য-পরিসংখ্যান হাজির করে দাবি জানিয়েছেন এবং প্রমাণ করেও দেখিয়েছেন যে, তাদের আসলে সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী হারিয়ে দেয়া হয়েছে। এজন্যই ট্রাইব্যুনালে যাওয়া শুরু করেছেন তারা। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে ন্যায় বিচার পাওয়ার আশা ও সম্ভাবনা না থাকলেও বিষয়টিকে ইতিহাসে রেকর্ড করে রাখার তাগিদ থেকেই আদালতে যাচ্ছেন ‘পরাজিত’ প্রার্থীরা। এসব প্রার্থীর সঙ্গে সাধারণ মানুষও অন্তত একটি বিষয়ে একমত যে, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন যেমন, সিইসি নূরুল হুদার নামও তেমনি ‘রেকর্ড’ হয়ে থাকবে! কে জানে, সিইসির নামটি হয়তো ‘স্বর্ণাক্ষরেই’ লিখিত হবে!
এ পর্যন্ত এসে নিবন্ধের বিষয়বস্তুর ব্যাপারে পাঠকরা ধন্দে পড়তে পারেন। উদ্দেশ্য আসলে দু’-একটি রিপোর্ট সম্পর্কে জানানো। আর সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন যেহেতু একটি প্রধান আলোচ্য ও আলোচিত প্রসঙ্গে পরিণত হয়েছে সেহেতু নির্বাচন দিয়েই শুরু করতে হয়েছে। এখানে ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ বা সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের একটি মন্তব্যের উল্লেখ করতে হবে। ৩ মার্চ সংখ্যা দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এই রিপোর্টে জানানো হয়েছে, আগের দিন ময়মনসিংহে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে এবং ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে চরম অনাগ্রহ ও অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সুজন সম্পাদক আরো বলেছেন, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বর্তমানে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে এসে গেছে এবং নির্বাচন কমিশন ও দুদকের মতো রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো দলীয়করণ ও পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে।
বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে সুজন সম্পাদকের এই বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য, এমনকি আপত্তিকর বলেও মনে হতে পারে। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের মাত্র কিছুদিন আগে সংসদ নির্বাচনের নামে যা কিছু ঘটানো হয়েছে সেগুলোকে বিবেচনায় নেয়া হলে স্বীকার করতেই হবে যে, সুজন সম্পাদক মোটেও বাড়িয়ে বলেননি। কারণ, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের বিভিন্ন কর্মকান্ডকে জালিয়াতি ও চুরি থেকে ডাকাতি পর্যন্ত কোনো শব্দ দিয়েই সঠিকভাবে বোঝানো সম্ভব হয়নি। ওই উপলক্ষে সম্পন্ন সামগ্রিক কার্যক্রম বা পারফরমেন্সের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা বরং জনমনে সন্দেহ বাড়িয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। নির্বাচন কমিশনকে বিশ্বাস করার বদলে জনগণ উল্টো ভীত-সন্ত্রস্ত ও স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। কারণ, যেসব কার্যকমের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায় না বরং বিতর্কিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়, তার সবই করা হয়েছিল ওই সংসদ নির্বাচনে। আর সরকারের অঘোষিত প্রত্যক্ষ মদতে এবং পুলিশ ও প্রশাসনের প্রকাশ্য সহযোগিতায় এসবই করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীসহ দলীয় নেতা-কর্মিরা। সহিংসতা, ভোট কেন্দ্র দখল, প্রতিপক্ষ তথা বিরোধী দলের কর্মি-সমর্থকদের ভোটকেন্দ্র থেকে মারপিট করে তাড়িয়ে দেয়া, আওয়ামী লীগ বিরোধী ভোটারদের ভোটকেন্দ্রের ধারে-কাছে যেতে না দেয়া, ব্যালট পেপারে যথেচ্ছভাবে নৌকায় সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা, কোথাও কোথাও ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা, মোট ভোটারের চাইতে অনেক বেশি ব্যালট পেপারে নৌকায় সিল মারা এবং ফলাফল পাল্টে দেয়াসহ ‘বিজয়’ ছিনিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করেছে পুলিশ, প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের লোকজন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা থেকেছেন নির্লিপ্ত। তারা আসলে জেগে ঘুমিয়ে থাকার ‘ভাণ’ করেছেন। কোনোভাবে সময় পার করেছেন। এভাবেই জিতিয়ে এনেছেন আওয়ামী লীগ এবং তার জোটের প্রার্থীদের। এতকিছুর পরও নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলেন সিইসি মিস্টার নূরুল হুদা।
৩০ ডিসেম্বরের অভিজ্ঞতার এই অভিজ্ঞতার কারণে জনগণ যে সত্যিই নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে তার সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেদিন অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। নির্বাচন কেমন হয়েছে সে বিষয়ে ধারণা দেয়ার জন্য একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এক রিপোর্টের শিরোনাম উল্লেখ করাই সম্ভবত যথেষ্ট হবেÑ ‘বিস্ময়কর ফলাফল ঢাকা সিটি ভোটে : কোনো কেন্দ্রে ৩, কোনোটাতে ৫ আবার কোথাও ৮৪.৮১ শতাংশ’। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে এক হাজার ২৯৫টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৩২টিতে ভোট পড়েছে মাত্র এক থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত। পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ ভোট পড়েছে ৪০টি কেন্দ্রে। ২০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে ২০৬টি কেন্দ্রে। ৩২২টি কেন্দ্রে পড়েছে ৩০ শতাংশের কম ভোট। এসব মিলিয়ে ৬২২টি কেন্দ্রে পড়েছে ৩০ শতাংশের কম ভোট। উল্টোরকম ঘটেছে আবার ১১৯টি কেন্দ্রে। এসব কেন্দ্রে ৫০ শতাংশ থেকে ৮৪.৮১ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে। ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে পাঁচটি কেন্দ্রে। মেয়র পদে মিরপুরের একটি কেন্দ্রে ভোটার যেখানে ছিলেন দুই হাজার ৫০৪ জন সেখানে ভোট পড়েছে মাত্র তিনটি। শতকরা হিসাবে মাত্র ০. ১২! এতটাই প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন!
সব মিলিয়েই প্রমাণিত হয়েছে, সুজনের পক্ষ থেকে অকারণে বলা হয়নি যে, বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে দেশে নির্বাচনী ব্যব¯া’ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে এবং ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে চরম অনাগ্রহ ও অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সুজন সম্পাদক আরো বলেছেন, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বর্তমানে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে এসে গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুজন সম্পাদক সৌজন্য দেখানোর উদ্দেশ্যে ‘ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে’ বললেও বাস্তবে নির্বাচনী ব্যবস্থা এরই মধ্যে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। এমন অবস্থার জন্য দায়ী আসলে নির্বাচন কমিশন- সঠিকভাবেই যাকে সরকারের ‘সেবাদাস’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মূলত কমিশনের বিভিন্ন অপকৌশলের কারণেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনমুখী বড় দলগুলো নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবে ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত এসব দলকে সুকৌশলে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের পরিকল্পিত একদলীয় স্বৈরশাসনের স্বার্থে গণতন্ত্রবিরোধী এই কাজটুকু সেরেছেন সিইসি নূরুল হুদা এবং তার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। হঠাৎ শুনতে কঠিন বা দুর্বোধ্য মনে হলেও এমন মন্তব্যের কারণ হলো, গণতন্ত্রের প্রাণ বা মূলকেন্দ্র যে জাতীয় সংসদ, সিইসি এবং তার সঙ্গী-সাথীরা সে সংসদেরই মূলোৎপাটন করে ফেলেছেন। তাদের বদৌলতে ‘নির্বাচিত’ ও গঠিত একাদশ সংসদকে সাধারণ মানুষও ‘ডাকাতের আখড়া’ ছাড়া অন্য কোনো নামে চিহ্নিত করতে সম্মত হচ্ছেন না।
বিষয়টি কিন্তু বাংলাদেশের জন্য শুধু নয়, যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্যই অত্যন্ত আশংকাজনক। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, অনেক বেশি গুরুতর আপত্তির কারণ সৃষ্টি করেছেন সিইসি নূরুল হুদা। তিনি আসলে এমন এক সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভ’মিকা পাল করেছেন, যে সরকার মানুষের সর্বশেষ ভরসার স্থল হিসেবেও কোনো প্রতিষ্ঠানকে থাকতে দিচ্ছে না। সরকার বরং একদলীয় চূড়ান্ত স্বৈরশাসনের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।
এভাবে, বিশেষ করে একদিকে সরকার এবং অন্যদিকে ‘অথর্ব’ না হলেও ‘অতি বিশ্বস্ত’ নির্বাচন কমিশনের কারণে দেশে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচন ও সেগুলোর ফলাফল কখনো গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না। ঢাকা সিটি করপোরেশন দেখে মনে হচ্ছে মানুষ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা থাকলে এমনটি হতে পারতো না। গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সেলিম রেজা সাগর ০৬/০৩/২০১৯ভালো
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ০৬/০৩/২০১৯ভালো লাগলো