হেরেছে বাংলাদেশ
ভোট হয়ে গেছে প্রায় একমাস। কেমন ভোট হয়েছে তা দেশবাসি জানে। কাউকে নতুন করে কিছু বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই। যে দেশবাসি ভোট ডাকাতির প্রত্যক্ষ সাক্ষী তাদের সামনে যতই ভাষণ দিয়ে সাফাই গাওয়া হোক যে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ভোট হয়েছে তারা তা কখনো বিশাস করবেনা। এরই মধ্যে নয়া এমপিদের শপথ হয়েছে। ৪৬ সদস্যের নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়েছে। গত ৭ জানুয়ারি বঙ্গভবনের দরবার হলে শপথ নেয়ার পর তারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। ৩০ জানুয়ারি নবগঠিত একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে।আগামী ৫ বছর ক্ষমতা পরিচালনার পুনরায় মালিকানা লাভ করেছেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। যদিও সরকারপ্রধান শাসক নয় সেবক হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী আছেন। ১০ বছর পূর্ণ করার পর তিনি আরো ৫ বছরের জন্য ক্ষমতা পেলেন।
ভোটের এতদিন পরে এসে ভোটের বিশ্লেষণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়।আজকের এই লেখায় আমি দেশের ভবিষ্যৎ তথা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কিছু ধারণা পাঠকের সাথে শেয়ার করতে চাই।আর তার জন্যই তথ্যগুলো যতটুকু তুলে ধরা প্রয়োজন তাই উল্লেখ করছি। পাশাপাশি আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা ও মতামত উল্লেখ করব।
৩০ ডিসেম্বর সম্পন্ন নির্বাচনে প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা। নির্বাচন-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণ যেভাবে ভোট দিয়েছে, সেভাবেই ফল এসেছে। নতুন করে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই।সিইসি বলেন, মূলত পুরো জাতি ৩০ ডিসেম্বর ভোট উৎসবের মাধ্যমে নতুন একটি সরকার গঠনের সুযোগ করে দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের ২৯৯ আসনে ৪০ হাজারের বেশি কেন্দ্রে ভোট চলাকালে সহিংসতা ও অনিয়মের কারণে ১৬টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে। তিনটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের ফল চূড়ান্ত করা যায়নি। বাকি ২৯৮টি আসনের ফলাফলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ২৫৯টি আসনে। এছাড়া জাতীয় পার্টি ২০টি, বিএনপি পাঁচ ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি তিনটি আসনে জয়ী হয়েছে। এর বাইরে গণফোরাম, বিকল্পধারা ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) দুটি করে আসনে জয় পেয়েছে। একটি করে আসন পেয়েছে তরীকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টি (জেপি)। তিনটি আসনে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন আমি নিজের ভোট নিজে দিয়েছি। ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতিও দেখেছি। তাতে নৌকায় ভোট দিয়েছেন এমন লোক খুব কম পেয়েছি। তবে প্রতিপক্ষের তথা ধানের শীষের কোন এজেন্ট দেখিনাই। ইভিএম এ প্রথম ভোট। আমার কাছে মনে হয়েছিল যে, যেহেতু ভোট কারচুপির এই ডিজিটাল বড়িটা জাতিকে নির্বাচন কমিশন গেলাতে চায় সেহেতু এই পরীক্ষামূলক ৬টি আসনে হয়তো কোন অনিয়ম হবে না। কিন্তু পরে জানলাম আগের রাতে যেভাবে সারাদেশে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতাসীনরা অর্ধেক ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রেখেছে ইভিএমএও তার ব্যতিক্রম হয়নি।এটা কি করে সম্ভব হলো? এ যুগে কোন খবরই গোপন থাকেনা। তাই যেটা জানা গেল তা হলো-পূর্বরাতে একটি করে বিশেষ কোড ব্যবহার করে ইভিএম কেন্দ্রগুলোতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোট নৌকা প্রতিকে দিয়ে রাখা হয়েছে। আর দিনের বেলায় জাতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সুন্দর ভোটের মহড়া দেখানো হয়েছে।
আগের রাতেই ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখার ব্যাপারটা যে সারাদেশে সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে তা আর গোপন নেই। তারপরেও ভরসা পায়নি। তাই ভোটের দিনও সারাদেশে কেন্দ্র দখল করে সিল মেরে কার্যত রাষ্ট্রক্ষমতা ডাকাতি করে দখল করে নেয়া হয়েছে।আর ভোটের আগে যেভাবে পাইকাড়ি হারে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের গ্রেফতার ও হয়রানি করা হয়েছে তাও দেশবাসি জানে।ভোটের মাঠেই যাতে প্রতিপক্ষের কেউ থাকতে না পারে তার পূর্বপরিকল্পনা নিয়েই কাজ করেছে মাঠপ্রশাসন। তাতে অংশীদার হয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা মূলত সরকারের পরিকল্পিত এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে মাত্র।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের ভোটারদের মধ্যে আড়াই শতাংশেরও কমসংখ্যক ভোটারের সমর্থন নিয়ে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া একটি পরিহাসের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসন দখল করে একটি নতুন সরকার গঠন করেছিল। ঐ সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে কোনও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শাসকদল ও তার জোটের প্রার্থীরা এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। অবশিষ্ট ১৪৭টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে জনগণের প্রতিরোধের মুখে এবং তাদের অংশগ্রহণ ছাড়াই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরীক দলগুলো এতে অংশগ্রহণ করেছিল। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক কোন সংস্থাই বলতে গেলে এতে পর্যবেক্ষক পাঠাননি, একমাত্র ফেমা এবং আওয়ামী লীগের বশংবদ দু’একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া। ঐ নির্বাচনে সরকার ও তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে ভয়ভীতি এবং প্রলোভন দেখিয়েও ভোটারদের কাছে টানতে পারেনি। অনির্বাচিত এই সংসদ নিয়েই প্রধানমন্ত্রী তার তৃতীয় মাত্রার অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন। বিনা বাধায় তিনি এই সংসদ ও তার থেকে সৃষ্ট সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেন।
এর আগে ২০০৮, ২০০১, ১৯৯৬ (৭ম) এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচন হয়েছিল নিন্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের অধিণে। সেসব নির্বাচনেও কিছু অভিযোগ উঠেছিল। তবে তা ছিল মাইনর। দেশে বিদেশে এই নির্বাচনগুলো প্রশংসা অর্জন করেছিল। যেসব দেশে গণতন্ত্র এবং ভোটব্যবস্থা উন্নত নয় তারা আমাদের নির্বাচনকালিন নিন্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে মডেল হিসেবে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।কিন্তু ২০১০ সালে আওয়ামীলীগ সংসদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সে ব্যবস্থা বাতিল করে দেয় সংবিধান সংশোধন করে। তার পরই হলো এই ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের প্রহসনের নির্বাচন।অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধিণে যে এদেশে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ হয়না তা আবারো প্রমান হলো।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে কার্যত আওয়ামী লীগ ছাড়া কোন প্রতিদ্বন্দি দলই ছিলনা। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সময়ে জনগণ ভোট দিয়ে বিএনপিকে নির্বাচিত করেছিল।১৯৮২ সালে নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা ডাকাতি করে নিয়েছিল এরশাদ। তারপর ১৯৮৬ সালে ভোট ডাকাতি আর ১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তীব্র গণআন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত তিনি ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। তারপর থেকে দেশে সর্বসম্মতভাবেই এসেছিল তত্তাবধায়ক সরকার। এটা ছিল গনতন্ত্রের নবযাত্রা। কিন্তু তা বাতিল করার কারণে কার্যত আমাদের জনগণের আর ভোটাধিকার নেই। ভোট দিয়ে জনগণ এখন আর তাদের পছন্দের দলকে ক্ষমতায় আনতে পারছেনা।
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, ডাকাতির ভোটে আওয়ামী লীগ ও তার শরিকরা যতই আত্মতৃপ্তি পাক তাতে দলটির লাভ হয়নি। এই দলটি স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে-এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। কিন্তু জনগনের উপর তারা কেন আস্থা হারিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল? সুষ্ঠু ভোট হলে এক টার্ম যদি তারা ক্ষমতায় আসতে না পারতো তাহলে তাদের এমন কি ক্ষতি হতো। এতে তাদের সাময়িক লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়েছে বলেই মনে করছে বোদ্ধা মহল। তাছাড়াও স্বাভাভাবিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তানরের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে অস্বাভাবিক ব্যবস্থাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে সেই আশঙ্কাও মাথায় রাখতে হবে।
ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল যে হবেনা সেটা আর এখন কারো বুঝতে অসুবিধা নেই। মূলত ভোট ব্যবস্থার প্রতিই মানুষের আর কোন আস্থা নেই। আশঙ্কা হচ্ছে যে, এই টার্ম অর্থাৎ আগামী ৫ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারলে ক্ষমতাসীনরা বিএনপি তথা প্রধান বিরোধী দলকেই শেষ করে দেবে।যেমন বিগত দশ বছরে তারা জামায়াতকে শেষ করে দিয়েছে।এই ৫ বছর পরে হয়তো কোন প্রতিদ্বন্দি দলই থাকবেনা। আবার ফাঁকামাঠে গোল হবে।অর্থাৎ দীর্ঘ মেয়াদী একদলীয় শাসন কায়েম হতে বোধহয় আর বাকি নেই।সেক্ষেত্রে কি হতে পারে?
আমার মনে আছে,জন্মের পর থেকে যখন একটু একটু বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশের শাসকদের নাম শুনে আসছি। আর শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করার পরও ঐসব দেশের শাসনক্ষমতায় তাদেরকেই দেখেছি। যেমন মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মোয়ামের গাদ্দাফী, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনসহ আরো অনেকে। তারা জনগণকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। আরববসন্তসহ নানা প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে ঐসব শাসকের পতন যেমন ঘটেছে তেমনি তাদের কোন কোন দেশে বিদেশি আধিপত্য কায়েম হয়েছে। ঐসব শাসক দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার দাপট দেখাতে পারলেও হেরে গেছে তাদের দেশ। আল্লাহ না করুন-আমাদেরও আশঙ্কা হচ্ছে এমনটি ভাবতে যে, জিতেছে আওয়ামী লীগ, হেরে গেছে বাংলাদেশ।
উন্নয়ন কাকে বলে? রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট এগুলোই কি উন্নয়ন? যেসব দেশ উন্নত তাদের ভোটব্যবস্থাও উন্নত। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সেখানে স্বাভাবিক। রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন সম্ভব নয় তেমনি অর্থহীনও বটে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দিকে নির্মূল করার কর্মসূচি যেমন ষোলআনা সফল হয়না তেমনি তা সুখকরও নয়।
ভোটের এতদিন পরে এসে ভোটের বিশ্লেষণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়।আজকের এই লেখায় আমি দেশের ভবিষ্যৎ তথা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কিছু ধারণা পাঠকের সাথে শেয়ার করতে চাই।আর তার জন্যই তথ্যগুলো যতটুকু তুলে ধরা প্রয়োজন তাই উল্লেখ করছি। পাশাপাশি আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা ও মতামত উল্লেখ করব।
৩০ ডিসেম্বর সম্পন্ন নির্বাচনে প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা। নির্বাচন-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণ যেভাবে ভোট দিয়েছে, সেভাবেই ফল এসেছে। নতুন করে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই।সিইসি বলেন, মূলত পুরো জাতি ৩০ ডিসেম্বর ভোট উৎসবের মাধ্যমে নতুন একটি সরকার গঠনের সুযোগ করে দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের ২৯৯ আসনে ৪০ হাজারের বেশি কেন্দ্রে ভোট চলাকালে সহিংসতা ও অনিয়মের কারণে ১৬টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে। তিনটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের ফল চূড়ান্ত করা যায়নি। বাকি ২৯৮টি আসনের ফলাফলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ২৫৯টি আসনে। এছাড়া জাতীয় পার্টি ২০টি, বিএনপি পাঁচ ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি তিনটি আসনে জয়ী হয়েছে। এর বাইরে গণফোরাম, বিকল্পধারা ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) দুটি করে আসনে জয় পেয়েছে। একটি করে আসন পেয়েছে তরীকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টি (জেপি)। তিনটি আসনে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন আমি নিজের ভোট নিজে দিয়েছি। ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতিও দেখেছি। তাতে নৌকায় ভোট দিয়েছেন এমন লোক খুব কম পেয়েছি। তবে প্রতিপক্ষের তথা ধানের শীষের কোন এজেন্ট দেখিনাই। ইভিএম এ প্রথম ভোট। আমার কাছে মনে হয়েছিল যে, যেহেতু ভোট কারচুপির এই ডিজিটাল বড়িটা জাতিকে নির্বাচন কমিশন গেলাতে চায় সেহেতু এই পরীক্ষামূলক ৬টি আসনে হয়তো কোন অনিয়ম হবে না। কিন্তু পরে জানলাম আগের রাতে যেভাবে সারাদেশে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতাসীনরা অর্ধেক ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রেখেছে ইভিএমএও তার ব্যতিক্রম হয়নি।এটা কি করে সম্ভব হলো? এ যুগে কোন খবরই গোপন থাকেনা। তাই যেটা জানা গেল তা হলো-পূর্বরাতে একটি করে বিশেষ কোড ব্যবহার করে ইভিএম কেন্দ্রগুলোতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোট নৌকা প্রতিকে দিয়ে রাখা হয়েছে। আর দিনের বেলায় জাতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সুন্দর ভোটের মহড়া দেখানো হয়েছে।
আগের রাতেই ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখার ব্যাপারটা যে সারাদেশে সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে তা আর গোপন নেই। তারপরেও ভরসা পায়নি। তাই ভোটের দিনও সারাদেশে কেন্দ্র দখল করে সিল মেরে কার্যত রাষ্ট্রক্ষমতা ডাকাতি করে দখল করে নেয়া হয়েছে।আর ভোটের আগে যেভাবে পাইকাড়ি হারে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের গ্রেফতার ও হয়রানি করা হয়েছে তাও দেশবাসি জানে।ভোটের মাঠেই যাতে প্রতিপক্ষের কেউ থাকতে না পারে তার পূর্বপরিকল্পনা নিয়েই কাজ করেছে মাঠপ্রশাসন। তাতে অংশীদার হয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা মূলত সরকারের পরিকল্পিত এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে মাত্র।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের ভোটারদের মধ্যে আড়াই শতাংশেরও কমসংখ্যক ভোটারের সমর্থন নিয়ে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া একটি পরিহাসের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসন দখল করে একটি নতুন সরকার গঠন করেছিল। ঐ সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে কোনও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শাসকদল ও তার জোটের প্রার্থীরা এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। অবশিষ্ট ১৪৭টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে জনগণের প্রতিরোধের মুখে এবং তাদের অংশগ্রহণ ছাড়াই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরীক দলগুলো এতে অংশগ্রহণ করেছিল। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক কোন সংস্থাই বলতে গেলে এতে পর্যবেক্ষক পাঠাননি, একমাত্র ফেমা এবং আওয়ামী লীগের বশংবদ দু’একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া। ঐ নির্বাচনে সরকার ও তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে ভয়ভীতি এবং প্রলোভন দেখিয়েও ভোটারদের কাছে টানতে পারেনি। অনির্বাচিত এই সংসদ নিয়েই প্রধানমন্ত্রী তার তৃতীয় মাত্রার অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন। বিনা বাধায় তিনি এই সংসদ ও তার থেকে সৃষ্ট সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেন।
এর আগে ২০০৮, ২০০১, ১৯৯৬ (৭ম) এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচন হয়েছিল নিন্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের অধিণে। সেসব নির্বাচনেও কিছু অভিযোগ উঠেছিল। তবে তা ছিল মাইনর। দেশে বিদেশে এই নির্বাচনগুলো প্রশংসা অর্জন করেছিল। যেসব দেশে গণতন্ত্র এবং ভোটব্যবস্থা উন্নত নয় তারা আমাদের নির্বাচনকালিন নিন্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে মডেল হিসেবে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।কিন্তু ২০১০ সালে আওয়ামীলীগ সংসদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সে ব্যবস্থা বাতিল করে দেয় সংবিধান সংশোধন করে। তার পরই হলো এই ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের প্রহসনের নির্বাচন।অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধিণে যে এদেশে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ হয়না তা আবারো প্রমান হলো।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে কার্যত আওয়ামী লীগ ছাড়া কোন প্রতিদ্বন্দি দলই ছিলনা। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সময়ে জনগণ ভোট দিয়ে বিএনপিকে নির্বাচিত করেছিল।১৯৮২ সালে নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা ডাকাতি করে নিয়েছিল এরশাদ। তারপর ১৯৮৬ সালে ভোট ডাকাতি আর ১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তীব্র গণআন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত তিনি ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। তারপর থেকে দেশে সর্বসম্মতভাবেই এসেছিল তত্তাবধায়ক সরকার। এটা ছিল গনতন্ত্রের নবযাত্রা। কিন্তু তা বাতিল করার কারণে কার্যত আমাদের জনগণের আর ভোটাধিকার নেই। ভোট দিয়ে জনগণ এখন আর তাদের পছন্দের দলকে ক্ষমতায় আনতে পারছেনা।
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, ডাকাতির ভোটে আওয়ামী লীগ ও তার শরিকরা যতই আত্মতৃপ্তি পাক তাতে দলটির লাভ হয়নি। এই দলটি স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে-এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। কিন্তু জনগনের উপর তারা কেন আস্থা হারিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল? সুষ্ঠু ভোট হলে এক টার্ম যদি তারা ক্ষমতায় আসতে না পারতো তাহলে তাদের এমন কি ক্ষতি হতো। এতে তাদের সাময়িক লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়েছে বলেই মনে করছে বোদ্ধা মহল। তাছাড়াও স্বাভাভাবিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তানরের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে অস্বাভাবিক ব্যবস্থাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে সেই আশঙ্কাও মাথায় রাখতে হবে।
ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল যে হবেনা সেটা আর এখন কারো বুঝতে অসুবিধা নেই। মূলত ভোট ব্যবস্থার প্রতিই মানুষের আর কোন আস্থা নেই। আশঙ্কা হচ্ছে যে, এই টার্ম অর্থাৎ আগামী ৫ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারলে ক্ষমতাসীনরা বিএনপি তথা প্রধান বিরোধী দলকেই শেষ করে দেবে।যেমন বিগত দশ বছরে তারা জামায়াতকে শেষ করে দিয়েছে।এই ৫ বছর পরে হয়তো কোন প্রতিদ্বন্দি দলই থাকবেনা। আবার ফাঁকামাঠে গোল হবে।অর্থাৎ দীর্ঘ মেয়াদী একদলীয় শাসন কায়েম হতে বোধহয় আর বাকি নেই।সেক্ষেত্রে কি হতে পারে?
আমার মনে আছে,জন্মের পর থেকে যখন একটু একটু বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশের শাসকদের নাম শুনে আসছি। আর শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করার পরও ঐসব দেশের শাসনক্ষমতায় তাদেরকেই দেখেছি। যেমন মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মোয়ামের গাদ্দাফী, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনসহ আরো অনেকে। তারা জনগণকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। আরববসন্তসহ নানা প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে ঐসব শাসকের পতন যেমন ঘটেছে তেমনি তাদের কোন কোন দেশে বিদেশি আধিপত্য কায়েম হয়েছে। ঐসব শাসক দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার দাপট দেখাতে পারলেও হেরে গেছে তাদের দেশ। আল্লাহ না করুন-আমাদেরও আশঙ্কা হচ্ছে এমনটি ভাবতে যে, জিতেছে আওয়ামী লীগ, হেরে গেছে বাংলাদেশ।
উন্নয়ন কাকে বলে? রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট এগুলোই কি উন্নয়ন? যেসব দেশ উন্নত তাদের ভোটব্যবস্থাও উন্নত। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সেখানে স্বাভাবিক। রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন সম্ভব নয় তেমনি অর্থহীনও বটে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দিকে নির্মূল করার কর্মসূচি যেমন ষোলআনা সফল হয়না তেমনি তা সুখকরও নয়।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৮/০২/২০১৯বাংলাদেশ বেঁচে গেছে। বাংলাদেশ জিতেছে।
-
সেলিম রেজা সাগর ০৮/০২/২০১৯হা হাহা
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ০৬/০২/২০১৯Nice.