ক্ষমতার অপব্যবহার আর কত
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গত ৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে এবং পুনঃনির্বাচন দাবি করেছে। যেভাবে সরকার ৩০ তারিখে নির্বাচন দখল করলো, যে পরিকল্পনার পেছনে অন্তত ১ বছর মেধা ও ব্রেন খাটাতে হয়েছে, সেটা চট করে সরকার হাতছাড়া করবে কেন? আর হাতছাড়া করে ঐক্যফ্রন্ট তথা বিরোধী দলকে আবার ক্ষমতায় আসার সুযোগ দেবে কেন? বলা হয়েছে যে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনঃনির্বাচন করতে হবে। আবার নির্দলীয় সরকার? ইলেকশনের আগে প্রধান মন্ত্রীর সাথে ঐক্যফ্রন্টের যে সংলাপ হলো সেখানেই তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দলীয় সরকারের দাবি মানেন নি। এখন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে ৯০ শতাংশ ভোট লাভের পর তারা আবার নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনঃনির্বাচনে যাবে কেন? তারপরেও প্রশ্ন আছে। কার সাথে এ সংলাপ হবে? নিশ্চয়ই এটি সরকারের সাথে নয়। কারণ সরকার এ ধরনের সংলাপে বসবেই না। তাহলে কার সাথে? একটি পত্রিকা অবশ্য এই মর্মে জল্পনা করেছে যে সুধী বা নাগরিক সমাজের সাথে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। সুধী সমাজ বা নাগরিক সমাজের সাথে এই ধরনের সংলাপ করে লাভ কি? কে শুনবে তাদের কথা? বরং ব্যাপারটি হবে উল্টো। কারণ ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর বাতাস সম্পূর্ণ ঘুরে গেছে।
এখন টেলিভিশনের টক শো হয় শুধু সরকারের গুণ-কীর্তন করে। আসলে সেটিই স্বাভাবিক। আর এবার তো জাতীয় পার্টিসহ সরকার ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯২টি আসন দখল করেছে। এর মধ্যে সংলাপ শুনবে কে, আর সেখানে মনযোগ দেবে কে? একটি ভ্যালিড পয়েন্ট উঠানো হলো আর সকলেই সেটা মেনে নিলো। এত সোজা যদি হতো তাহলে আর বিগত ১০ বছর ধরে বিরোধী দলসমূহের এত কথা খরচ করতে হতো না। এবার তো কোনো ভোট হয়নি। হয়েছে ভোট ডাকাতি বা ভোট চুরি। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন তিনি বলতেন ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং। ইঞ্জিনিয়ারিং করতে গেলে তো সুক্ষ্ম কারুকাজ লাগে। কিন্তু এবার যেরকম ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে সেটা করতে গিয়ে রীতিমতো হাতুড়ি বাটাল প্রয়োগ করতে হয়েছে। প্রশাসনের সাথে মিলে ভোট ডাকাতিতে আওয়ামী লীগ যে কতখানি এ্যাগ্রেসিভ ছিল তার ভুরি ভুরি নজির এখন কোনো কোনো পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা এখানে দুই একটি উদাহরণ দিচ্ছি।
গত ৬ জানুয়ারি রবিবার ইংরেজি ডেইলি স্টারে প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবর বেরিয়েছে। খবরটির শিরোনাম, ‘Voting for Sheaf of Paddy/ A village under siege’. অর্থাৎ ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্য আস্ত একটি গ্রাম অবরুদ্ধ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার কলমা নামক গ্রামের ১৯০৯ জন ভোট দিয়েছেন। তার মধ্যে ১২৪৯ জন ভোট দিয়েছেন ধানের শীষে। এজন্য সেই গ্রামটিকে ঘেরাও করে আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহীরা গ্রামবাসীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, রোববার নির্বাচনের পরদিন সোমবার সকালেই আওয়ামী লীগের লোকরা লাঠিসোঁটা নিয়ে গ্রামের প্রবেশপথে অবস্থান নেয়।
এভাবে অবস্থান নিয়ে তারা বাস থেকে নিয়ে রিকশা, এমনকি সাইকেল পর্যন্ত চলাচল বন্ধ করে। শুধু তাই নয়, তারা গ্রামের গভীর নলকূপটি দখলে নেয়, যা ব্যবহৃত হয় চাষাবাদের জন্য। এর সঙ্গে তারা বন্ধ করে বাড়ি বাড়িতে স্যাটেলাইট টেলিভিশন যোগাযোগ। লোকজনকে তারা বাড়ি থেকে বের হতে না দিয়ে ঘরে ঘরে আটক রাখে। স্থানীয় লোকরা এজন্য মূলত দায়ী করে স্থানীয় কলমা ইউনিয়ন পরিষদের আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যানকে। বিএনপির ভোট দাতাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য চেয়ারম্যান এখন ঢালাও প্রতিশোধের ব্যবস্থা করেন, যার থেকে আওয়ামী লীগের কয়েকজন লোকও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকা সত্ত্বেও পুলিশ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে। এসব কারো মনগড়া কাহিনী নয়। ডেইলি স্টারের মতো পত্রিকা তাদের রিপোর্টার আনোয়ার আলীর নাম দিয়ে রিপোর্টটি ছেপেছে। অর্থাৎ রিপোর্টটির পুরো দায় দায়িত্ব তারা নিয়েছে।
॥দুই॥
এই ধরনের অনেক কাহিনী এখন পত্রপত্রিকায় বেরিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগকে ভোট না দিলে তারা যে কতখানি হিংস্র হতে পারে তার আর একটি নজির হলো নোয়াখালীর সুবর্ণচর গ্রামের ৩৬ বছরের তরুণী গৃহবধূ ৪ সন্তানের মা পারুল বেগম। ৩০ ডিসেম্বর ধানের শীষে ভোট দিয়েছিলেন পারুল। সেই দিনই আওয়ামী লীগের রুহুল আমীন তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। পরদিন ৩১ ডিসেম্বর ভোর রাত ৪টায় তার বাড়ির বেড়া ভেঙে লাঠি হাতে রুহুল আমিনসহ ১০/১২ জন গুন্ডা তাকে বাড়ির বাইরে বের করে আনে এবং পালাক্রমে ধর্ষণ করে। তার সৌভাগ্য যে সে মারা যায়নি। ঘটনাটি চাপাই পড়তে যাচ্ছিলো। কিন্তু ডেইলি স্টার ১লা জানুয়ারি নিম্নলিখিত খবরটি ছাপানোর পর সেটি আর কারো পক্ষে চাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট : Mother of four ‘gang-raped by AL men’/Victim claims she was targeted for voting for ‘sheaf of paddy’. অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সদস্য কর্তৃক চার সন্তানের জননীর গণধর্ষণ/ ধর্ষিতা বলেন যে, ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্যই তাকে টার্গেট করা হয়।
কথায় আছে, মারি, অরি, পারি যে কৌশলে। আওয়ামী লীগ একেক বারে নির্বাচনে কারচুপির একেক রকম কৌশল গ্রহণ করে। ২০১৪ সালে যে কৌশলটি গ্রহণ করেছিল পরবর্তী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেই কৌশল তারা প্রয়োগ করেনি। তখন তারা ভিন্ন কৌশল উদ্ভাবন করে। এইবার যে কৌশলটি প্রয়োগ করা হয়েছে সেই কৌশলটি গভীরভাবে স্টাডি করলে বোঝা যায় যে দীর্ঘ দিন ধরে এই পরিকল্পনা রচনা করা হয়েছে এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপরিকল্পিতভাবে প্রশাসনের কয়েকটি বিভাগ বিশেষ করে সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে জড়িত করা হয়েছে। তার আগে রাজনৈতিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য অকস্মাৎ শুরু হয়ে যায় গায়েবি হামলা ও মামলার হিড়িক।
নির্বাচনের আগে প্রথম আলোয় ‘এক ভয়ংকর সেপ্টেম্বর’ শিরোনামে ঢাকা শহরের নাশকতার মামলা নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। এতে বলা হয়, ওই মাসে ঢাকায় নাশকতার মামলা হয়েছে ৫৭৮টি, যার মধ্যে পুলিশের ওপর হামলার কথা বলা হয়েছে ৯০ বার। আর পেট্রোল বোমা ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনার কথা বলা হয়েছে ১ হাজার ১৮৬টি। অথচ রাজধানীর দেড় কোটি মানুষ কিছুই টের পেল না। শুধু ঢাকা শহরে নয়, প্রতিটি জেলা ও উপজেলাতেই এ ধরনের হাজার হাজার মামলা হয়েছে। বিএনপির বহু নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রায় সারা দেশেই ভোটের আওয়াজ চাপা পড়ে গিয়েছিল মামলা গ্রেফতার আতঙ্কে। পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, সারা দেশেই এ ধরনের গায়েবি মামলা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার অধিকতর সতর্ক ছিল, যাতে বিরোধী পক্ষ ২০১৩ ও ২০১৪-এর মতো নাশকতার ঘটনা না ঘটাতে পারে। এটি দোষের কিছু নয়। কিন্তু যেখানে বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, কেউ বানচাল করার কথা বলেনি, সেখানে ষড়যন্ত্র বা নাশকতার ভূরি ভূরি মামলা হলো কেন? আওয়ামী লীগের নেতারা মুখে যতই বিএনপিকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানিয়ে থাকুন না কেন, হাবভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তারা না এলেই ভালো। নির্বাচনের দিনও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কর্মীদের এই বলে সতর্ক করে দিলেন যে বিএনপি শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে গোলযোগ বাধাতে পারে।
কিন্তু বিএনপি সে রকম কোনো ঘোষণা দেয়নি। দলের ১১ জন প্রার্থীসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে জেলে রেখে এবং ১৭ জন প্রার্থী আক্রান্ত হওয়ার পরও তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী লড়াইয়ে ছিল। কোথাও নাশকতার ঘটনা ঘটলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, অপরাধীর বিচার হবে এ বিষয়ে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। নয়াপল্টনে বিএনপির অফিসের সামনে গাড়ি পোড়ানো ও ভাঙচুরের ঘটনা মনে রেখেই কথাটি বলছি। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে ঘটনাই ঘটেনি, ঘটনার বিন্দুমাত্র আলামতও ছিল না, সেখানে কেন গ্রেফতার ও মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হলো সেই প্রশ্নের উত্তর কেবল নির্বাচন কমিশন ও ‘নির্বাচনকালীন সরকারই’ দিতে পারে।
॥তিন॥
এই ধরনের কয়েক শত ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। গত নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে যারা নির্বাচন করেছেন তাদেরকে ঢাকা ডাকা হয়েছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল যে ঢাকায় আসার আগে যেন তারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় কি কি ধরনের নির্বাচনী অরাজকতা কারচুপি ও সহিংসতা হয়েছে সেগুলো লিখে নিয়ে আসেন। আমরা আশা করি এই ৩০০ জন প্রার্থীর নিকট থেকেই বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট হাইকমান্ড সারা বাংলার নির্বাচনী কারচুপি ও ভোট ডাকাতির বিশদ রিপোর্ট পেয়েছেন। এই সব রিপোর্ট তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণপত্রসহ তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করবেন। সেই প্রোগ্রামটি ঠিকই আছে।
কিন্তু তার চেয়েও যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো তাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার ভৌতিক মামলা ঝুলে আছে এবং প্রায় লক্ষাধিক নেতাকর্মী এখনও জেলে আছেন অথবা হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিএনপি এবং জামায়াতের এখন এক নম্বর প্রায়োরিটি হওয়া উচিত এই সব কর্মীর সুরক্ষা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ঐক্যফ্রন্টের যখন সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় তখন এসব গায়েবি গ্রেফতারের কথা ঐক্যফ্রন্ট নেতারা তুলেছিলেন এবং তাদের মুক্তি দাবি করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তখন এই ধরনের নেতার এবং মামলার একটি তালিকা চেয়েছিলেন। অবশ্য এ তালিকা তো সরকারই দেবে, সরকারের হোম মিনিস্ট্রি দেবে। যাই হোক, তবুও বিএনপি দুই দিনের মধ্যেই অনেক খেটেখুটে সারা দেশ থেকে তথ্য নিয়ে একটি তালিকা প্রধান মন্ত্রীর দফতরে পাঠায়। অবাক ব্যাপার হলো এই যে গ্রেফতার তো বন্ধ হলোই না, বরং সংলাপ চলাকালেও নতুন করে নেতাকর্মীদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ^াস দিয়েছিলেন যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর গ্রেফতার এবং হামলা মামলা বন্ধ হবে। কিন্তু বাস্তবে কি দেখা গেল? ৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হলো। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিন থেকে প্রার্থীরা নির্বাচনী গণসংযোগে মাঠে নামেন। কিন্তু দেখা গেল মামলা গ্রেফতার তো অব্যাহত রয়েছেই, প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী গণসংযোগ সভা ও সমাবেশে আওয়ামী লীগ প্রশাসনের সহায়তায় হামলা করেছে। মওদুদ আহমেদ, আসম আব্দুর রব, গয়েশ^র চন্দ্র রায়, মঈন খান থেকে শুরু করে এমন কোনো বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট নেতা নাই যার সভায় ব্যক্তিগত হামলা হয় নাই। এসব হামলার পরেও যখন পুলিশ স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল তখন মওদুদসহ অনেকে জীবনের নিরাপত্তা শংকায় নির্বাচনী প্রচারণা থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে আনেন।
বস্তুত তখনই নির্বাচনী ফল নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। প্রশাসনের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সমগ্র ইলেকশন মেকানিজম ও ইলেকশন মেশিনারীর কন্ট্রোল নিজেদের হাতে নিয়েছিল। তারই ফল দেখা গেছে একতরফা নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের ৯০ শতাংশ ভোট লাভ।
॥চার॥
আসলে এখন ঐ সব সংলাপ করে কোনো লাভ হবে না। বিগত ৫ বছর নয় বরং বিগত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী। এই দু’টি সংগঠনের জান এবং মাল উভয়েরই ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতি কোনো দিন পূরণ হবার নয়। এসব দলের ঘুরে দাঁড়ানোর একটি মাত্রই পথ। সেটি হলো ঢাকা মহানগর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের তৃণমূল পর্যন্ত যে হাজার হাজার মামলা রয়েছে, ঠা-া মাথায় সেই মামলাগুলো তুলে নেয়া। দ্বিতীয় কাজ হলো যে লক্ষাধিক কর্মী আটক এবং পলাতক রয়েছেন তাদেরকে উদ্ধার করা এবং আর্থিক ও আইনী সহায়তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো। বিএনপি যদি দুর্বার গণআন্দোলনের সামর্থ্য রাখে, তাহলে সেটা এক জিনিস। তা না হলে ভবিষ্যতে গণআন্দোলন তথা গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া। এই বিষয়ে পরবর্তীতে আরও অনেক কিছু লেখার ইচ্ছে রইলো।
এখন টেলিভিশনের টক শো হয় শুধু সরকারের গুণ-কীর্তন করে। আসলে সেটিই স্বাভাবিক। আর এবার তো জাতীয় পার্টিসহ সরকার ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯২টি আসন দখল করেছে। এর মধ্যে সংলাপ শুনবে কে, আর সেখানে মনযোগ দেবে কে? একটি ভ্যালিড পয়েন্ট উঠানো হলো আর সকলেই সেটা মেনে নিলো। এত সোজা যদি হতো তাহলে আর বিগত ১০ বছর ধরে বিরোধী দলসমূহের এত কথা খরচ করতে হতো না। এবার তো কোনো ভোট হয়নি। হয়েছে ভোট ডাকাতি বা ভোট চুরি। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন তিনি বলতেন ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং। ইঞ্জিনিয়ারিং করতে গেলে তো সুক্ষ্ম কারুকাজ লাগে। কিন্তু এবার যেরকম ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে সেটা করতে গিয়ে রীতিমতো হাতুড়ি বাটাল প্রয়োগ করতে হয়েছে। প্রশাসনের সাথে মিলে ভোট ডাকাতিতে আওয়ামী লীগ যে কতখানি এ্যাগ্রেসিভ ছিল তার ভুরি ভুরি নজির এখন কোনো কোনো পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা এখানে দুই একটি উদাহরণ দিচ্ছি।
গত ৬ জানুয়ারি রবিবার ইংরেজি ডেইলি স্টারে প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবর বেরিয়েছে। খবরটির শিরোনাম, ‘Voting for Sheaf of Paddy/ A village under siege’. অর্থাৎ ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্য আস্ত একটি গ্রাম অবরুদ্ধ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার কলমা নামক গ্রামের ১৯০৯ জন ভোট দিয়েছেন। তার মধ্যে ১২৪৯ জন ভোট দিয়েছেন ধানের শীষে। এজন্য সেই গ্রামটিকে ঘেরাও করে আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহীরা গ্রামবাসীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, রোববার নির্বাচনের পরদিন সোমবার সকালেই আওয়ামী লীগের লোকরা লাঠিসোঁটা নিয়ে গ্রামের প্রবেশপথে অবস্থান নেয়।
এভাবে অবস্থান নিয়ে তারা বাস থেকে নিয়ে রিকশা, এমনকি সাইকেল পর্যন্ত চলাচল বন্ধ করে। শুধু তাই নয়, তারা গ্রামের গভীর নলকূপটি দখলে নেয়, যা ব্যবহৃত হয় চাষাবাদের জন্য। এর সঙ্গে তারা বন্ধ করে বাড়ি বাড়িতে স্যাটেলাইট টেলিভিশন যোগাযোগ। লোকজনকে তারা বাড়ি থেকে বের হতে না দিয়ে ঘরে ঘরে আটক রাখে। স্থানীয় লোকরা এজন্য মূলত দায়ী করে স্থানীয় কলমা ইউনিয়ন পরিষদের আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যানকে। বিএনপির ভোট দাতাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য চেয়ারম্যান এখন ঢালাও প্রতিশোধের ব্যবস্থা করেন, যার থেকে আওয়ামী লীগের কয়েকজন লোকও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকা সত্ত্বেও পুলিশ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে। এসব কারো মনগড়া কাহিনী নয়। ডেইলি স্টারের মতো পত্রিকা তাদের রিপোর্টার আনোয়ার আলীর নাম দিয়ে রিপোর্টটি ছেপেছে। অর্থাৎ রিপোর্টটির পুরো দায় দায়িত্ব তারা নিয়েছে।
॥দুই॥
এই ধরনের অনেক কাহিনী এখন পত্রপত্রিকায় বেরিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগকে ভোট না দিলে তারা যে কতখানি হিংস্র হতে পারে তার আর একটি নজির হলো নোয়াখালীর সুবর্ণচর গ্রামের ৩৬ বছরের তরুণী গৃহবধূ ৪ সন্তানের মা পারুল বেগম। ৩০ ডিসেম্বর ধানের শীষে ভোট দিয়েছিলেন পারুল। সেই দিনই আওয়ামী লীগের রুহুল আমীন তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। পরদিন ৩১ ডিসেম্বর ভোর রাত ৪টায় তার বাড়ির বেড়া ভেঙে লাঠি হাতে রুহুল আমিনসহ ১০/১২ জন গুন্ডা তাকে বাড়ির বাইরে বের করে আনে এবং পালাক্রমে ধর্ষণ করে। তার সৌভাগ্য যে সে মারা যায়নি। ঘটনাটি চাপাই পড়তে যাচ্ছিলো। কিন্তু ডেইলি স্টার ১লা জানুয়ারি নিম্নলিখিত খবরটি ছাপানোর পর সেটি আর কারো পক্ষে চাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট : Mother of four ‘gang-raped by AL men’/Victim claims she was targeted for voting for ‘sheaf of paddy’. অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সদস্য কর্তৃক চার সন্তানের জননীর গণধর্ষণ/ ধর্ষিতা বলেন যে, ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্যই তাকে টার্গেট করা হয়।
কথায় আছে, মারি, অরি, পারি যে কৌশলে। আওয়ামী লীগ একেক বারে নির্বাচনে কারচুপির একেক রকম কৌশল গ্রহণ করে। ২০১৪ সালে যে কৌশলটি গ্রহণ করেছিল পরবর্তী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেই কৌশল তারা প্রয়োগ করেনি। তখন তারা ভিন্ন কৌশল উদ্ভাবন করে। এইবার যে কৌশলটি প্রয়োগ করা হয়েছে সেই কৌশলটি গভীরভাবে স্টাডি করলে বোঝা যায় যে দীর্ঘ দিন ধরে এই পরিকল্পনা রচনা করা হয়েছে এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপরিকল্পিতভাবে প্রশাসনের কয়েকটি বিভাগ বিশেষ করে সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে জড়িত করা হয়েছে। তার আগে রাজনৈতিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য অকস্মাৎ শুরু হয়ে যায় গায়েবি হামলা ও মামলার হিড়িক।
নির্বাচনের আগে প্রথম আলোয় ‘এক ভয়ংকর সেপ্টেম্বর’ শিরোনামে ঢাকা শহরের নাশকতার মামলা নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। এতে বলা হয়, ওই মাসে ঢাকায় নাশকতার মামলা হয়েছে ৫৭৮টি, যার মধ্যে পুলিশের ওপর হামলার কথা বলা হয়েছে ৯০ বার। আর পেট্রোল বোমা ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনার কথা বলা হয়েছে ১ হাজার ১৮৬টি। অথচ রাজধানীর দেড় কোটি মানুষ কিছুই টের পেল না। শুধু ঢাকা শহরে নয়, প্রতিটি জেলা ও উপজেলাতেই এ ধরনের হাজার হাজার মামলা হয়েছে। বিএনপির বহু নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রায় সারা দেশেই ভোটের আওয়াজ চাপা পড়ে গিয়েছিল মামলা গ্রেফতার আতঙ্কে। পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, সারা দেশেই এ ধরনের গায়েবি মামলা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার অধিকতর সতর্ক ছিল, যাতে বিরোধী পক্ষ ২০১৩ ও ২০১৪-এর মতো নাশকতার ঘটনা না ঘটাতে পারে। এটি দোষের কিছু নয়। কিন্তু যেখানে বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, কেউ বানচাল করার কথা বলেনি, সেখানে ষড়যন্ত্র বা নাশকতার ভূরি ভূরি মামলা হলো কেন? আওয়ামী লীগের নেতারা মুখে যতই বিএনপিকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানিয়ে থাকুন না কেন, হাবভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তারা না এলেই ভালো। নির্বাচনের দিনও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কর্মীদের এই বলে সতর্ক করে দিলেন যে বিএনপি শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে গোলযোগ বাধাতে পারে।
কিন্তু বিএনপি সে রকম কোনো ঘোষণা দেয়নি। দলের ১১ জন প্রার্থীসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে জেলে রেখে এবং ১৭ জন প্রার্থী আক্রান্ত হওয়ার পরও তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী লড়াইয়ে ছিল। কোথাও নাশকতার ঘটনা ঘটলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, অপরাধীর বিচার হবে এ বিষয়ে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। নয়াপল্টনে বিএনপির অফিসের সামনে গাড়ি পোড়ানো ও ভাঙচুরের ঘটনা মনে রেখেই কথাটি বলছি। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে ঘটনাই ঘটেনি, ঘটনার বিন্দুমাত্র আলামতও ছিল না, সেখানে কেন গ্রেফতার ও মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হলো সেই প্রশ্নের উত্তর কেবল নির্বাচন কমিশন ও ‘নির্বাচনকালীন সরকারই’ দিতে পারে।
॥তিন॥
এই ধরনের কয়েক শত ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। গত নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে যারা নির্বাচন করেছেন তাদেরকে ঢাকা ডাকা হয়েছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল যে ঢাকায় আসার আগে যেন তারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় কি কি ধরনের নির্বাচনী অরাজকতা কারচুপি ও সহিংসতা হয়েছে সেগুলো লিখে নিয়ে আসেন। আমরা আশা করি এই ৩০০ জন প্রার্থীর নিকট থেকেই বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট হাইকমান্ড সারা বাংলার নির্বাচনী কারচুপি ও ভোট ডাকাতির বিশদ রিপোর্ট পেয়েছেন। এই সব রিপোর্ট তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণপত্রসহ তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করবেন। সেই প্রোগ্রামটি ঠিকই আছে।
কিন্তু তার চেয়েও যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো তাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার ভৌতিক মামলা ঝুলে আছে এবং প্রায় লক্ষাধিক নেতাকর্মী এখনও জেলে আছেন অথবা হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিএনপি এবং জামায়াতের এখন এক নম্বর প্রায়োরিটি হওয়া উচিত এই সব কর্মীর সুরক্ষা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ঐক্যফ্রন্টের যখন সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় তখন এসব গায়েবি গ্রেফতারের কথা ঐক্যফ্রন্ট নেতারা তুলেছিলেন এবং তাদের মুক্তি দাবি করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তখন এই ধরনের নেতার এবং মামলার একটি তালিকা চেয়েছিলেন। অবশ্য এ তালিকা তো সরকারই দেবে, সরকারের হোম মিনিস্ট্রি দেবে। যাই হোক, তবুও বিএনপি দুই দিনের মধ্যেই অনেক খেটেখুটে সারা দেশ থেকে তথ্য নিয়ে একটি তালিকা প্রধান মন্ত্রীর দফতরে পাঠায়। অবাক ব্যাপার হলো এই যে গ্রেফতার তো বন্ধ হলোই না, বরং সংলাপ চলাকালেও নতুন করে নেতাকর্মীদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ^াস দিয়েছিলেন যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর গ্রেফতার এবং হামলা মামলা বন্ধ হবে। কিন্তু বাস্তবে কি দেখা গেল? ৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হলো। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিন থেকে প্রার্থীরা নির্বাচনী গণসংযোগে মাঠে নামেন। কিন্তু দেখা গেল মামলা গ্রেফতার তো অব্যাহত রয়েছেই, প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী গণসংযোগ সভা ও সমাবেশে আওয়ামী লীগ প্রশাসনের সহায়তায় হামলা করেছে। মওদুদ আহমেদ, আসম আব্দুর রব, গয়েশ^র চন্দ্র রায়, মঈন খান থেকে শুরু করে এমন কোনো বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট নেতা নাই যার সভায় ব্যক্তিগত হামলা হয় নাই। এসব হামলার পরেও যখন পুলিশ স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল তখন মওদুদসহ অনেকে জীবনের নিরাপত্তা শংকায় নির্বাচনী প্রচারণা থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে আনেন।
বস্তুত তখনই নির্বাচনী ফল নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। প্রশাসনের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সমগ্র ইলেকশন মেকানিজম ও ইলেকশন মেশিনারীর কন্ট্রোল নিজেদের হাতে নিয়েছিল। তারই ফল দেখা গেছে একতরফা নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের ৯০ শতাংশ ভোট লাভ।
॥চার॥
আসলে এখন ঐ সব সংলাপ করে কোনো লাভ হবে না। বিগত ৫ বছর নয় বরং বিগত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী। এই দু’টি সংগঠনের জান এবং মাল উভয়েরই ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতি কোনো দিন পূরণ হবার নয়। এসব দলের ঘুরে দাঁড়ানোর একটি মাত্রই পথ। সেটি হলো ঢাকা মহানগর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের তৃণমূল পর্যন্ত যে হাজার হাজার মামলা রয়েছে, ঠা-া মাথায় সেই মামলাগুলো তুলে নেয়া। দ্বিতীয় কাজ হলো যে লক্ষাধিক কর্মী আটক এবং পলাতক রয়েছেন তাদেরকে উদ্ধার করা এবং আর্থিক ও আইনী সহায়তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো। বিএনপি যদি দুর্বার গণআন্দোলনের সামর্থ্য রাখে, তাহলে সেটা এক জিনিস। তা না হলে ভবিষ্যতে গণআন্দোলন তথা গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া। এই বিষয়ে পরবর্তীতে আরও অনেক কিছু লেখার ইচ্ছে রইলো।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
পি পি আলী আকবর ১৬/০১/২০১৯দারুণ
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ১৫/০১/২০১৯চমৎকার