উন্নয়ণ বটে
উন্নয়নের মহাজোয়ারে ভেসে চলা দেশের নাগরিক হিসেবে ভিন্নমত পোষণ করার ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য আসলে ছিল না। কিন্তু এমন কিছু জরুরি বিষয়ও রয়েছে, যেগুলোকে পাশ কাটানো যায় না। সেসব প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে অতি সংক্ষেপে দু’-একটি কথা জানিয়ে রাখা দরকার। এগুলো শোনা যায় সাধারণ মানুষের মুখে। যেমন কথিত ‘উন্নয়ন’ বলতে সাধারণ মানুষ শুধু বড় বড় ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল প্রকল্প এবং চার-ছয় লেনের মহাসড়ক ধরনের কর্মযজ্ঞই দেখতে পাচ্ছে। এসবের প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যই যে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে সে কথাটা সবচেয়ে মুর্খ এবং বোকা মানুষেরও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। মানুষ সেই সাথে ঘুষ ও কমিশন বাণিজ্যের কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। সেখানেও হাজার হাজার কোটি টাকার হিসাবই রয়েছে। এত বিপুল অর্থ ঠিক কোন গোষ্ঠীর পকেটে যাচ্ছে এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষেই কাজ বা কন্ট্রাক্ট পাওয়াসহ কোনো প্রকল্পের ধারেকাছে যাওয়া সম্ভব কি না- এমন জিজ্ঞাসার জবাব নিয়েও মানুষের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা যথেষ্টই চলছে।
সাধারণ মানুষ অবশ্য মনে করে, আসল কাজের কাজ কতটুকু করা হচ্ছে সে সম্পর্কে জানতে হলে আরো বহুবছর অপেক্ষা করতে হবে- যখন কৈফিয়ৎ বা জবাব দেয়ার জন্য মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরদের পাওয়া যাবে না। তবে একটি বিষয়ে সবচেয়ে বোকা মানুষেরও বিশ্বাস, এই যে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে, সেসবের বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কথাটা এমনকি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকেও মাঝেমধ্যে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত এসেই থেমে পড়েন অর্থমন্ত্রী। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই তাকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। সে ক্ষমতাও আসলে তার নেই। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদসহ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা আগেও বলেছেন এবং এখনো বলে চলেছেন, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সত্যি উদ্দেশ্য হলে সরকারের উচিত ছিল শিল্প-কারখানা স্থাপনের মতো প্রকল্পে বিনিয়োগ করা, যাতে মানুষের জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। যাতে রফতানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো সম্ভব হয়। কৃষিখাতের ব্যাপারেও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। চাষাবাদের মওসুমে ঋণ এবং সার-বীজ দেয়া থেকে শুরু করে ফলনের পর লাভজনক দামে পণ্য কিনে নেয়ার মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এসব কথার কোনো একটিও কিন্তু মুহিত সাহেবদের কানে ঢোকেনি। কৃষিমন্ত্রী এবং এককালের ‘কমরেড’ মতিয়া চৌধুরীকেও কৃষি বা কৃষকের স্বার্থে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ফলাফলও যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। সরকার যখন হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল এবং চার-ছয় লেনের মহাসড়ক বানানোর নামে জাতির ঘাড়ে বিপুল ঋণের বোঝা চাপাতে এবং বিদেশে অর্থ পাচাকারীদের সাহায্য করতে ঘেমে নেয়ে উঠছে, কৃষকরা তখন তাদের কষ্টের ফসল রাস্তায় ফেলে দিয়ে চোখের পানি ঝরাচ্ছে। এটা কিন্তু নিতান্তই কথার কথা নয়। মাত্র মাস চার-পাঁচেক আগে জামালপুর থেকে বগুড়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার রাস্তায় শত-হাজার মণ পাকা টমেটো ফেলে রেখেছিল কৃষকরা। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় এসবের ছবি ছাপানো হয়েছিল- যা দেখে মনে হচ্ছিল যেন সেই ‘লালে লাল দুনিয়ার’ মতো অবস্থা! টমেটোগুলোকে রাগে-দুঃখে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল টমেটো চাষিরা।
এর কারণ সম্পর্কে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, সাধারণ মানুষ যখন প্রতিকেজি টমেটো ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত দরে কিনে খাচ্ছিল, চাষিরা তখন তিন-চার টাকায়ও বিক্রি করতে পারছিল না। ফলে লোকসানই কেবল গুনতে হয়নি, হতাশাও গ্রাস করেছিল তাদের। এরই প্রতিক্রিয়ায় শত শত নয়, হাজার হাজার মণ টমেটো চাষিরা আশপাশের ডোবায় এবং রাস্তার ধারে ফেলে দিয়েছে। অনেকে আবার ক্ষেতেই পচিয়ে ফেলার পদক্ষেপ নিয়েছিল। তারা বলেছে, পচা টমেটো তাদের ক্ষেতের জন্য সার-এর কাজ করবে!
অন্যদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও’র এক জরিপ রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রায় ৭৫ হাজার একর জমিতে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে চার লাখ টন টমেটোর উৎপাদন হয়। ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি কেজির দর ২০ টাকা ধরে এর গড় দাম হয় প্রায় আটশ’ কোটি টাকা। কিন্তু বিক্রি না হওয়া থেকে পচে যাওয়া পর্যন্ত সংগ্রহ-পরবর্তী লোকসান বা পোস্ট-হারভেস্ট লস হয় প্রায় ৪৬ শতাংশের। সে হিসাবে প্রতিবছর প্রায় চারশ কোটি টাকার টমেটো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে এফএও তার জরিপ রিপোর্টে জানিয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ খবর চাষিদের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে তো বটেই, জাতীয় অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত ভীতিকর। এমন অবস্থাকে নিশ্চয়ই ‘উন্নয়ন’ বলার উপায় নেই!
শুধু টমেটোর বেলায় নয়, কমবেশি একই অবস্থা চলছে অন্য সব সবজির ক্ষেত্রেও। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে সমাধানের লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে এবছরও আলু চাষিরা ভয়ংকর বিপদে পড়েছে। তাদের ক্ষয়ক্ষতিও বেড়ে চলেছে। প্রতিমণ আলু উৎপাদন করতে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা খরচ পড়লেও চাষিরা এবার ২০০ থেকে ২২০ টাকার বেশি দরে বিক্রি করতে পারেনি। ফলে প্রতিমণ আলুতে কৃষকের ক্ষতি হয়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। স্মরণ করা দরকার, আলুর জন্য গত বছরও বিপুল পরিমাণ লোকসান গুণতে হয়েছিল। সে সময় দেশের বিভিন্ন স্থানের ৩৯০টি হিমাগার বা কোল্ড স্টোরেজে ৫৩ লাখ টন আলু সংরক্ষণের জন্য রেখেছিল কৃষকরা। কিন্তু সরকার কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ না নেয়ায় বছরশেষে ১৫ লাখ টন আলু অবিক্রীত থেকে যায়। এর ফলে প্রতি বস্তায় ৬০০ টাকা হিসাবে কৃষকদের লোকসান হয়েছে ১২ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। এমন অবস্থার প্রতিক্রিয়ায় চলতি বছরে আলু চাষের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল কৃষকরা। তা সত্ত্বেও যারা চাষ করেছে তারাও লোকসানের কবলে পড়েছে। বলা বাহুল্য, কেবলই ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল এবং চার-ছয় লেনের সড়কের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার ‘শ্রাদ্ধ’ করার পাশাপাশি সরকার যদি কৃষকদের সামান্য সাহায্যও করতো, তাহলেও এমন ভয়ংকর অবস্থার সুষ্টি হতে পারতো না। এজন্যই প্রশ্ন উঠেছে, কথিত উন্নয়ন আসলে কাদের জন্য করা হচ্ছে?
এ প্রসঙ্গেই প্রাধান্যে এসেছে দেশের ব্যাংকিং খাত। কারণ, সরকারের ভুল ও সুচিন্তিত ক্ষতিকর নীতি এবং দলীয় বিবেচনার কারণে দেশের ব্যাংকিং খাত অনেক অগেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদসহ তথ্যাভিজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে নীতিতে সংশোধন করা এবং বাস্তবভিত্তিক ব্যবস্থা না নেয়া হলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতই শুধু ধ্বংস হয়ে যাবে না, জাতীয় অর্থনীতিও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে অনেক তথ্যেরই উল্লেখ করেছেন তথ্যাভিজ্ঞরা। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে সংশোধনমূলক কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সরকার বরং এমন কিছু সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে, যেসবের পরিণতিতে ব্যাংকিং খাতের সর্বনাশই ত্বরান্বিত হবে। হয়েছেও।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সামষ্টিক অর্থনীতি বিষয়ে তার মূল্যায়নে বলেছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সম্পূর্ণ ‘এতিম ও বিকলাঙ্গ’ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যাংকিং খাতের রক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে উল্লেখ করে সিপিডি বলেছে, এই ব্যাংকই ‘এতিম ও বিকলাঙ্গ শিশুর’ ওপর নানাভাবে অত্যাচার করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবকিছু জানা সত্ত্বেও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের বছর বলে এ বছর আরো অনেক টাকাই পাচার হয়ে যেতে পারে বলে অশংকা প্রকাশ করেছে সিপিডি। বলেছে, জনগণের করের টাকা থেকে ব্যাংকগুলোকে ভর্তুকি দেয়ার চলমান কর্মকান্ড অবশ্যই বন্ধ করা দরকার। না হলে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতেরই সর্বনাশ ঘটবে। সেই সাথে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হবে জাতীয় অর্থনীতিও।
সিপিডি অবশ্য কিছু মৌলিক বিষয়কে পাশ কাটিয়ে গেছে। যেমন সিপিডি বলেনি, বাস্তবে ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে ও সহযোগিতায় ঋণখেলাপিসহ অসৎ ব্যবসায়ীরা নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলে অনেকাংশে সফল হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বেশি আলোচিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে সফল ও লাভজনক ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। সরকার তার রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিল করার ব্যাপারে তৎপর হওয়ার ফলে ইসলামী ধারার দুটি বড় ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদেই শুধু পরিবর্তন ঘটেনি, আতংকিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ আমানতকারীরাও। তারা এমনকি ব্যাংকগুলো থেকে তাদের সঞ্চয়ের অর্থ উঠিয়ে নিতেও শুরু করেছেন। অথচ ইসলামী ধারার এ দুটি ব্যাংকই বহু বছর ধরে দেশের জনগণের মধ্যে সঞ্চয়ের ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি করেছিল। সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশেও ব্যাংক দুটির ছিল বিপুল অবদান। অন্যদিকে মূলত ইসলাম বিরোধী উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে সুচিন্তিত আক্রমণের শিকার হওয়ার পর দুটি ব্যাংকই মুখ থুবড়ে পড়েছে। সরকারের অন্য কিছু সিদ্ধান্তের পরিণতিতেও দেশের ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় ঘটেছে। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রাধান্যে এসেছে নতুন কয়েকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও সরকার একের পর বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে রাজনৈতিক বিবেচনা। কিন্তু দেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারের পরিসর অত্যন্ত সীমিত হওয়ার কারণে এসব ব্যাংক মোটেও সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। ফারমার্স ব্যাংকের মতো কোনো কোনো ব্যাংক বরং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই লোকসান গোনার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে উঠেছে।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকারসহ অর্থনীতিবদরা সঠিকভাবেই বলেছেন, গলদ ছিল আসলে এসব ব্যাংককে অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্তের মধ্যে। কারণ, অত্যন্ত সীমিত অর্থনীতির বাংলাদেশে এত বেশি সংখ্যক ব্যাংকের লাভজনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল না, এখনো নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার একের পর বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছিল। দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা পৌঁছেছিল ৫৭টিতে। এসবের বাইরেও তৎপরতা চালাচ্ছে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত, দুটি বিশেষায়িত এবং নয়টি বিদেশি ব্যাংকসহ আরো বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অথচ বাংলাদেশের মতো ক্ষুদে অর্থনীতির একটি দেশে এত বেশি সংখ্যক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাভজনক হওয়া এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বাস্তবেও সেটাই ঘটেছে। এসব ব্যাংককে নিশ্চিত ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষার জন্যই সরকার জনগণের করের টাকার পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের মতো লাভজনক প্রতিষ্ঠানের মূলধনেও হাত দিয়েছে।
বলা হচ্ছে, বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা সত্যি উদ্দেশ্য হলে সরকারের উচিত বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেয়া এবং বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকসহ সম্ভাবনাময় সকল ব্যাংকের ব্যাপারে নীতি-কৌশল ও কর্মকান্ডে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো। না হলে এবং ঋণ ও বাণিজ্যের নামে লুণ্ঠনের বাধাহীন কারবারকে চলতে দেয়া হলে একদিকে কোনো ব্যাংকের পক্ষেই বিপর্যয় কাটানো এবং লাভজনক হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না, অন্যদিকে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে দেশের ব্যাংকিং খাত। একই কথা সত্য খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গেও। বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টেই বলা হয়েছে, আইন ও নিয়ম না মেনে বিশেষ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়ার ফলেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ এভাবে বেড়ে গেছে। সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের পাশাপাশি অন্য একটি কারণেরও উল্লেখ করেছেন সকলে। সে কারণটি হলো, ঋণের অর্থ নির্ধারিত সময়ে ফেরৎ না দিলে যেহেতু কোনো শাস্তিমূলক র্বরবস্থা নেয়া হয় না সে কারণেও ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি ৫৭টি ব্যাংকের প্রতিটিই কমবেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে।
আশংকার অন্য এক কারণ হলো, অর্থের পরিমাণের সঙ্গে ঋণ খেলাপি ব্যক্তিদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেড় লাখের বেশি ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছেন। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নানা ধরনের যুক্তি দেখালেও গলদ রয়েছে আসলে তাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে। বড় কথা, খেলাপি ঋণের প্রতিটি ক্ষেত্রে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এই নেতারা প্রভাব খাটিয়ে ঋণের ব্যবস্থা যেমন করেন তেমনি আবার বাঁচিয়ে দেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কবল থেকেও। ফলে ঋণের অর্থ না দিয়েও পার পেয়ে যান খেলাপিরা। মূলত সে কারণেই বেড়ে চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে ব্যাংকিং ইতিহাসে এক ‘বিরল ও অস্বাভাবিক বিষয়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, অবস্থায় পরিবর্তন না ঘটানো হলে দেশের ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিও মুখ থুবড়ে পড়বে। প্রসঙ্গক্রমে শেয়ারবাজারের লক্ষ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা থেকে ঘুষ-দুর্নীতির মহোৎসবের অনেক ঘটনারও উল্লেখ করা হচ্ছে। কারণ, প্রতিটি কেলেংকারিতে ক্ষমতাসীনদের রথি-মহারথিরাই জড়িত রয়েছেন। এজন্যই সব মিলিয়ে বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের সততা ও সদিচ্ছার অভাবই পরিস্থিতিকে এতটা ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। একই কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে জাতীয় অর্থনীতি।
কিন্তু এত কিছুর পরও জনগণকে কথিত উন্নয়নের কথাই শুধু শুনতে হচ্ছে। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেলেও নিস্তার নেই জনগণের!
সাধারণ মানুষ অবশ্য মনে করে, আসল কাজের কাজ কতটুকু করা হচ্ছে সে সম্পর্কে জানতে হলে আরো বহুবছর অপেক্ষা করতে হবে- যখন কৈফিয়ৎ বা জবাব দেয়ার জন্য মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরদের পাওয়া যাবে না। তবে একটি বিষয়ে সবচেয়ে বোকা মানুষেরও বিশ্বাস, এই যে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে, সেসবের বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কথাটা এমনকি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকেও মাঝেমধ্যে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত এসেই থেমে পড়েন অর্থমন্ত্রী। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই তাকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। সে ক্ষমতাও আসলে তার নেই। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদসহ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা আগেও বলেছেন এবং এখনো বলে চলেছেন, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সত্যি উদ্দেশ্য হলে সরকারের উচিত ছিল শিল্প-কারখানা স্থাপনের মতো প্রকল্পে বিনিয়োগ করা, যাতে মানুষের জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। যাতে রফতানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো সম্ভব হয়। কৃষিখাতের ব্যাপারেও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। চাষাবাদের মওসুমে ঋণ এবং সার-বীজ দেয়া থেকে শুরু করে ফলনের পর লাভজনক দামে পণ্য কিনে নেয়ার মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এসব কথার কোনো একটিও কিন্তু মুহিত সাহেবদের কানে ঢোকেনি। কৃষিমন্ত্রী এবং এককালের ‘কমরেড’ মতিয়া চৌধুরীকেও কৃষি বা কৃষকের স্বার্থে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ফলাফলও যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। সরকার যখন হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল এবং চার-ছয় লেনের মহাসড়ক বানানোর নামে জাতির ঘাড়ে বিপুল ঋণের বোঝা চাপাতে এবং বিদেশে অর্থ পাচাকারীদের সাহায্য করতে ঘেমে নেয়ে উঠছে, কৃষকরা তখন তাদের কষ্টের ফসল রাস্তায় ফেলে দিয়ে চোখের পানি ঝরাচ্ছে। এটা কিন্তু নিতান্তই কথার কথা নয়। মাত্র মাস চার-পাঁচেক আগে জামালপুর থেকে বগুড়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার রাস্তায় শত-হাজার মণ পাকা টমেটো ফেলে রেখেছিল কৃষকরা। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় এসবের ছবি ছাপানো হয়েছিল- যা দেখে মনে হচ্ছিল যেন সেই ‘লালে লাল দুনিয়ার’ মতো অবস্থা! টমেটোগুলোকে রাগে-দুঃখে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল টমেটো চাষিরা।
এর কারণ সম্পর্কে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, সাধারণ মানুষ যখন প্রতিকেজি টমেটো ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত দরে কিনে খাচ্ছিল, চাষিরা তখন তিন-চার টাকায়ও বিক্রি করতে পারছিল না। ফলে লোকসানই কেবল গুনতে হয়নি, হতাশাও গ্রাস করেছিল তাদের। এরই প্রতিক্রিয়ায় শত শত নয়, হাজার হাজার মণ টমেটো চাষিরা আশপাশের ডোবায় এবং রাস্তার ধারে ফেলে দিয়েছে। অনেকে আবার ক্ষেতেই পচিয়ে ফেলার পদক্ষেপ নিয়েছিল। তারা বলেছে, পচা টমেটো তাদের ক্ষেতের জন্য সার-এর কাজ করবে!
অন্যদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও’র এক জরিপ রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রায় ৭৫ হাজার একর জমিতে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে চার লাখ টন টমেটোর উৎপাদন হয়। ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি কেজির দর ২০ টাকা ধরে এর গড় দাম হয় প্রায় আটশ’ কোটি টাকা। কিন্তু বিক্রি না হওয়া থেকে পচে যাওয়া পর্যন্ত সংগ্রহ-পরবর্তী লোকসান বা পোস্ট-হারভেস্ট লস হয় প্রায় ৪৬ শতাংশের। সে হিসাবে প্রতিবছর প্রায় চারশ কোটি টাকার টমেটো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে এফএও তার জরিপ রিপোর্টে জানিয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ খবর চাষিদের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে তো বটেই, জাতীয় অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত ভীতিকর। এমন অবস্থাকে নিশ্চয়ই ‘উন্নয়ন’ বলার উপায় নেই!
শুধু টমেটোর বেলায় নয়, কমবেশি একই অবস্থা চলছে অন্য সব সবজির ক্ষেত্রেও। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে সমাধানের লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে এবছরও আলু চাষিরা ভয়ংকর বিপদে পড়েছে। তাদের ক্ষয়ক্ষতিও বেড়ে চলেছে। প্রতিমণ আলু উৎপাদন করতে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা খরচ পড়লেও চাষিরা এবার ২০০ থেকে ২২০ টাকার বেশি দরে বিক্রি করতে পারেনি। ফলে প্রতিমণ আলুতে কৃষকের ক্ষতি হয়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। স্মরণ করা দরকার, আলুর জন্য গত বছরও বিপুল পরিমাণ লোকসান গুণতে হয়েছিল। সে সময় দেশের বিভিন্ন স্থানের ৩৯০টি হিমাগার বা কোল্ড স্টোরেজে ৫৩ লাখ টন আলু সংরক্ষণের জন্য রেখেছিল কৃষকরা। কিন্তু সরকার কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ না নেয়ায় বছরশেষে ১৫ লাখ টন আলু অবিক্রীত থেকে যায়। এর ফলে প্রতি বস্তায় ৬০০ টাকা হিসাবে কৃষকদের লোকসান হয়েছে ১২ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। এমন অবস্থার প্রতিক্রিয়ায় চলতি বছরে আলু চাষের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল কৃষকরা। তা সত্ত্বেও যারা চাষ করেছে তারাও লোকসানের কবলে পড়েছে। বলা বাহুল্য, কেবলই ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল এবং চার-ছয় লেনের সড়কের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার ‘শ্রাদ্ধ’ করার পাশাপাশি সরকার যদি কৃষকদের সামান্য সাহায্যও করতো, তাহলেও এমন ভয়ংকর অবস্থার সুষ্টি হতে পারতো না। এজন্যই প্রশ্ন উঠেছে, কথিত উন্নয়ন আসলে কাদের জন্য করা হচ্ছে?
এ প্রসঙ্গেই প্রাধান্যে এসেছে দেশের ব্যাংকিং খাত। কারণ, সরকারের ভুল ও সুচিন্তিত ক্ষতিকর নীতি এবং দলীয় বিবেচনার কারণে দেশের ব্যাংকিং খাত অনেক অগেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদসহ তথ্যাভিজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে নীতিতে সংশোধন করা এবং বাস্তবভিত্তিক ব্যবস্থা না নেয়া হলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতই শুধু ধ্বংস হয়ে যাবে না, জাতীয় অর্থনীতিও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে অনেক তথ্যেরই উল্লেখ করেছেন তথ্যাভিজ্ঞরা। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে সংশোধনমূলক কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সরকার বরং এমন কিছু সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে, যেসবের পরিণতিতে ব্যাংকিং খাতের সর্বনাশই ত্বরান্বিত হবে। হয়েছেও।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সামষ্টিক অর্থনীতি বিষয়ে তার মূল্যায়নে বলেছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সম্পূর্ণ ‘এতিম ও বিকলাঙ্গ’ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যাংকিং খাতের রক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে উল্লেখ করে সিপিডি বলেছে, এই ব্যাংকই ‘এতিম ও বিকলাঙ্গ শিশুর’ ওপর নানাভাবে অত্যাচার করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবকিছু জানা সত্ত্বেও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের বছর বলে এ বছর আরো অনেক টাকাই পাচার হয়ে যেতে পারে বলে অশংকা প্রকাশ করেছে সিপিডি। বলেছে, জনগণের করের টাকা থেকে ব্যাংকগুলোকে ভর্তুকি দেয়ার চলমান কর্মকান্ড অবশ্যই বন্ধ করা দরকার। না হলে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতেরই সর্বনাশ ঘটবে। সেই সাথে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হবে জাতীয় অর্থনীতিও।
সিপিডি অবশ্য কিছু মৌলিক বিষয়কে পাশ কাটিয়ে গেছে। যেমন সিপিডি বলেনি, বাস্তবে ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে ও সহযোগিতায় ঋণখেলাপিসহ অসৎ ব্যবসায়ীরা নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলে অনেকাংশে সফল হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বেশি আলোচিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে সফল ও লাভজনক ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। সরকার তার রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিল করার ব্যাপারে তৎপর হওয়ার ফলে ইসলামী ধারার দুটি বড় ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদেই শুধু পরিবর্তন ঘটেনি, আতংকিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ আমানতকারীরাও। তারা এমনকি ব্যাংকগুলো থেকে তাদের সঞ্চয়ের অর্থ উঠিয়ে নিতেও শুরু করেছেন। অথচ ইসলামী ধারার এ দুটি ব্যাংকই বহু বছর ধরে দেশের জনগণের মধ্যে সঞ্চয়ের ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি করেছিল। সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশেও ব্যাংক দুটির ছিল বিপুল অবদান। অন্যদিকে মূলত ইসলাম বিরোধী উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে সুচিন্তিত আক্রমণের শিকার হওয়ার পর দুটি ব্যাংকই মুখ থুবড়ে পড়েছে। সরকারের অন্য কিছু সিদ্ধান্তের পরিণতিতেও দেশের ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় ঘটেছে। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রাধান্যে এসেছে নতুন কয়েকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও সরকার একের পর বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে রাজনৈতিক বিবেচনা। কিন্তু দেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারের পরিসর অত্যন্ত সীমিত হওয়ার কারণে এসব ব্যাংক মোটেও সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। ফারমার্স ব্যাংকের মতো কোনো কোনো ব্যাংক বরং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই লোকসান গোনার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে উঠেছে।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকারসহ অর্থনীতিবদরা সঠিকভাবেই বলেছেন, গলদ ছিল আসলে এসব ব্যাংককে অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্তের মধ্যে। কারণ, অত্যন্ত সীমিত অর্থনীতির বাংলাদেশে এত বেশি সংখ্যক ব্যাংকের লাভজনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল না, এখনো নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার একের পর বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছিল। দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা পৌঁছেছিল ৫৭টিতে। এসবের বাইরেও তৎপরতা চালাচ্ছে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত, দুটি বিশেষায়িত এবং নয়টি বিদেশি ব্যাংকসহ আরো বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অথচ বাংলাদেশের মতো ক্ষুদে অর্থনীতির একটি দেশে এত বেশি সংখ্যক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাভজনক হওয়া এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বাস্তবেও সেটাই ঘটেছে। এসব ব্যাংককে নিশ্চিত ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষার জন্যই সরকার জনগণের করের টাকার পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের মতো লাভজনক প্রতিষ্ঠানের মূলধনেও হাত দিয়েছে।
বলা হচ্ছে, বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা সত্যি উদ্দেশ্য হলে সরকারের উচিত বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেয়া এবং বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকসহ সম্ভাবনাময় সকল ব্যাংকের ব্যাপারে নীতি-কৌশল ও কর্মকান্ডে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো। না হলে এবং ঋণ ও বাণিজ্যের নামে লুণ্ঠনের বাধাহীন কারবারকে চলতে দেয়া হলে একদিকে কোনো ব্যাংকের পক্ষেই বিপর্যয় কাটানো এবং লাভজনক হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না, অন্যদিকে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে দেশের ব্যাংকিং খাত। একই কথা সত্য খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গেও। বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টেই বলা হয়েছে, আইন ও নিয়ম না মেনে বিশেষ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়ার ফলেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ এভাবে বেড়ে গেছে। সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের পাশাপাশি অন্য একটি কারণেরও উল্লেখ করেছেন সকলে। সে কারণটি হলো, ঋণের অর্থ নির্ধারিত সময়ে ফেরৎ না দিলে যেহেতু কোনো শাস্তিমূলক র্বরবস্থা নেয়া হয় না সে কারণেও ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি ৫৭টি ব্যাংকের প্রতিটিই কমবেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে।
আশংকার অন্য এক কারণ হলো, অর্থের পরিমাণের সঙ্গে ঋণ খেলাপি ব্যক্তিদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেড় লাখের বেশি ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছেন। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নানা ধরনের যুক্তি দেখালেও গলদ রয়েছে আসলে তাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে। বড় কথা, খেলাপি ঋণের প্রতিটি ক্ষেত্রে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এই নেতারা প্রভাব খাটিয়ে ঋণের ব্যবস্থা যেমন করেন তেমনি আবার বাঁচিয়ে দেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কবল থেকেও। ফলে ঋণের অর্থ না দিয়েও পার পেয়ে যান খেলাপিরা। মূলত সে কারণেই বেড়ে চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে ব্যাংকিং ইতিহাসে এক ‘বিরল ও অস্বাভাবিক বিষয়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, অবস্থায় পরিবর্তন না ঘটানো হলে দেশের ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিও মুখ থুবড়ে পড়বে। প্রসঙ্গক্রমে শেয়ারবাজারের লক্ষ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা থেকে ঘুষ-দুর্নীতির মহোৎসবের অনেক ঘটনারও উল্লেখ করা হচ্ছে। কারণ, প্রতিটি কেলেংকারিতে ক্ষমতাসীনদের রথি-মহারথিরাই জড়িত রয়েছেন। এজন্যই সব মিলিয়ে বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের সততা ও সদিচ্ছার অভাবই পরিস্থিতিকে এতটা ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। একই কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে জাতীয় অর্থনীতি।
কিন্তু এত কিছুর পরও জনগণকে কথিত উন্নয়নের কথাই শুধু শুনতে হচ্ছে। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেলেও নিস্তার নেই জনগণের!
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাইফ উদ্দিন সায়েম ৩০/১০/২০১৮অসম্ভব ভালো লিখেছেন। ভক্ত হয়ে গেলাম। যথেষ্ঠ তথ্যে ভরপুর লিখনি। ধন্যবাদ
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ২৭/১০/২০১৮বেশ লিখেছেন।