রক্ত শোষণ
সম্প্রতি ওয়েলথ এক্স (Wealth x) নামক একটি আর্থিক গোয়েন্দা ও পরিসংখ্যান সংস্থা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যাতে বলা হয়েছে যে, দুনিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অতি ধনী লোকের সংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। নিজস্ব অর্থবিত্ত এবং বিনিয়োগযোগ্য পরিসম্পদ মডেল ব্যবহার করে তৈরিকৃত সংস্থাটির রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অতি ধনী ব্যক্তির সংখ্যা ১৭.৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বে এই হার সর্বোচ্চ। এক্ষেত্রে চীনের অবস্থান দ্বিতীয় (১৩.৪ শতাংশ), তৃতীয় অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম (১২.৭ শতাংশ)। এই সময়ে অতি ধনীর সংখ্যা ভারতে বৃদ্ধি পেয়েছে ১০.৭ শতাংশ, হংকংয়ে ৯.৩ শতাংশ, আয়ারল্যান্ডে ৯.০০ শতাংশ, ইসরাইলে ৮.৬ শতাংশ, পাকিস্তানে ৮.৪ শতাংশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮.১ শতাংশ হারে। নিউইয়র্ক ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি তিনটি মহাদেশে (এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা) ৫টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের গবেষণা পরিচালনা করে থাকে।
বলাবাহুল্য, অতি ধনী বা ultra high networth (UHNW) বলে তাদেরকেই বিবেচনা করা হয়, যাদের সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি ডলার বা তার বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় যাদের সম্পদ আড়াই শ’ কোটি টাকারও বেশি তারাই অতি ধনী বলে গণ্য হন। অন্যান্য দেশের তুলনায় এই অতি ধনীদের সংখ্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ওয়েলথ এক্স-এর রিপোর্টে উল্লেখিত উন্নত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে জার্মানি, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, ইতালী, হংকং প্রভৃতি। তবে এসব দেশে অতি ধনী বৃদ্ধির হার বাংলাদেশ থেকে অনেক কম।
ওয়েলথ এক্স-এর রিপোর্টে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা উল্লেখ করেনি। তবে অতি ধনী হবার হার উল্লেখ করেছে যা বর্তমান বিশ্বের এক নম্বর ধনী ও পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। অবশ্য যদি ধরে নেই যে, ২০১২ সালে বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা ১০০ জন ছিল তাহলে ১৭.৩ শতাংশ হারে ২০১৭ সালে চক্রবৃদ্ধি হারে এই সংখ্যা ২১৯ বা ২২০-এ এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ অতি ধনী বা ২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিকের সংখ্যা বাংলাদেশে প্রতি ৫ বছরে দ্বিগুণ হচ্ছে। এর পাশাপাশি গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্ট হচ্ছে, বৈশ্বিক উদ্ভাবনী সূচক সংক্রান্ত। এতে এশিয়ার শীর্ষ উদ্ভাবনী দেশসমূহের একটি তালিকা প্রদর্শন করা হয়েছে। তালিকার অবস্থান অনুযায়ী ১৭টি দেশের নাম আছে। ক্রম অনুযায়ী এগুলো হচ্ছে : (১) সিঙ্গাপুর (২) দ. কোরিয়া (৩) জাপান (৪) চীন (৫) মালয়েশিয়া (৬) থাইল্যান্ড (৭) ভিয়েতনাম (৮) মঙ্গোলিয়া (৯) ভারত (১০) ব্রুনাই (১১) ফিলিপাইন (১২) ইন্দোনেশিয়া (১৩) শ্রীলঙ্কা (১৩) কম্বোডিয়া (১৫) নেপাল (১৬) পাকিস্তান এবং (১৭) বাংলাদেশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের অবস্থান সবার শেষে, যার অর্থ উদ্ভাভনে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদে। এই তালিকা দেখে পরিষ্কার উপলব্ধি করা যায় যে, শিক্ষা, সততা, দক্ষতা, পরিশ্রম, যোগ্যতা বা উদ্ভাবনী শক্তি বলে বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শোষণমূলক হবার কারণেই এখানে অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, দরিদ্র আরো দরিদ্রতর হচ্ছে। এটা রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রবণতা নয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে গত ৮ বছরে জাতীয় আয়ে জনসংখ্যার দরিদ্রতম ১০ শতাংশের হিস্যা ২ শতাংশ থেকে ১.০১ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ আয় সম্পদ ও ধনী দরিদ্রের বৈষম্য সাংঘাতিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে সম্পর্কিত ব্যবসায়ীরা অঢেল সম্পদ গড়েছেন বলে বলা হয়। দেশের রফতানি আয়ের আশি শতাংশ এই শিল্প যোগান দেয়। গার্মেন্টস কর্মীদের বেতন কত? সম্প্রতি তাদের জন্য আট হাজার টাকা মাসিক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা কি বৈষম্য ও বঞ্চনার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত নয়? সরকারি তথ্যানুযায়ী গত বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৩ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধির ফলে যে সম্পদ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে তা গুটিকয়েক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ভোগ করছে, তার ন্যায্য ও ইনসাফভিত্তিক বণ্টন হচ্ছে না। আবার অভিযোগ উঠেছে যে, আমাদের দেশে বর্তমানে যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তার সাথে কর্মসংস্থান এবং তৃণমূলের সম্পর্ক নেই। গ্রাম-গঞ্জের রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট, পানি নিষ্কাশন ও সেচ ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে শহর, নগর এবং মহাসড়কে ফ্লাইওভার ও উড়াল সড়ক তৈরির ফলে ধনিক-ঠিকাদার শ্রেণী লাভবান হচ্ছে গরীবরা নয়। এই শ্রেণীর উন্নয়ন তথা ধনী থেকে অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতির ভিত মজবুত হচ্ছে না। ঠিকাদার রাজনীতিকরা অর্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। আমদানি বাণিজ্যে ওভার ইনভয়েসিং নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্য বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিবেশিত এক হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে আমাদের আমদানি ব্যয় ও রফতানি আয়ের ব্যবধান ৮০০ বিলিয়ন টাকা অতিক্রম করেছে। ২০১৭ সালের Global Financial Integrity Report আরো ভয়াবহ। এতে অবৈধ অর্থ পাচারে বাংলাদেশকে শীর্ষ দেশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯-১১ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। আবার ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের রক্ষিত সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ৬৮৩ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ যা ভারতীয়দের রক্ষিত আমানতের প্রায় কাছাকাছি। আবার ২০০৫ সাল থেকে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বলে জিএফআই এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অর্থ ঐ সময়ের বাংলাদেশের মোট জাতীয় বাে জটের প্রায় দ্বিগুণ। রিপোর্টে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৫৩.৩৫২ কোটি টাকা। বিশ্লেষকদের হিসাব অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আরো অন্তত তিন লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। বিদেশে অর্থ পাচার, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক এবং অর্থ প্রতিষ্ঠানসমূহের লাখ লাখ কোটি টাকার অর্থ লোপাট, ঋণ কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ডেস্টিনিসহ এনজিওসমূহের প্রতারণা আত্মসাৎ প্রভৃতি এই সরকারের আমলেরই কীর্তি। এসব অপরাধের কোনও বিচার হয়নি। সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বলে দেশবাসী জানেন না। এরা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পায়, সরকারের কাছে থেকে অবৈধ বাণিজ্যিক সুবিধা নিয়ে এরা টাকার কুমির হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই অতি ধনীদের উত্থান হয়েছে। এদের মধ্যে আছে দুর্নীতিপরায়ণ কিছু ব্যবসায়ী শিল্পপতি, অবৈধ সুবিধাভোগী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, ছাত্র নেতা প্রমুখ। এই অতি ধনীদের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পৃক্ত লোকের সংখ্যাই বেশি। দেশ ও দেশের দরিদ্র মানুষের প্রতি এদের কোনও দায়িত্ববোধ নেই। এদের বেশিরভাগই স্বনামে-বেনামে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করেন না। এরা সরকারকে কর ফাঁকি দেন। বিদেশে বিনিয়োগের জন্য পুঁজি পাচার করেন, মালয়েশিয়া ও কানাডার টরেন্টোতে সেকেন্ড হোম বানান, ঈদের বাজার করেন বিদেশের মাটিতে, লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে কুরবানির পশু কিনেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য পাঠান আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায়। তারা লেক্সাস, বিএমডব্লিউ ও জাগুয়ার গাড়িতে চড়েন। অনেকে হেলিকপ্টার কিনতেও শুরু করেছেন। সরকারই তার দলীয় এবং জোটভুক্ত লোকদের এই সুযোগ করে দিয়েছেন। পাঠকদের হয়তো মনে আছে যে, ক্ষমতা গ্রহণের পর পর তিন কোটি ব্যয় সাশ্রয়ী বাল্ব প্রতিস্থাপনের জন্য সরকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। রাজধানীর প্রত্যেক বাসিন্দাকেই এ প্রকল্পের অধীনে পুরাতন বাল্ব ফেরত দিয়ে নতুন বাল্ব নিতে হয়েছিল। সরকার দলীয় এক ব্যবসায়ী এই বাল্ব তৈরি ও বিতরণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। পাইপ লাইনের গ্যাস বন্ধ করে সিডিল্ডারে গ্যাস সরবরাহের ব্যবসাও আরেক প্রভাবশালী দলীয় ব্যবসায়ীকে দেয়া হয়। বোতলজাত এই গ্যাসের দাম তিনি নিচ্ছেন গ্যাস স্টেশনের নির্ধারিত মূল্যের প্রায় তিনগুণ। বিদ্যুৎ খাতের কুইক রেন্টার প্ল্যান্টের মালিকদের অর্থ উপার্জনের এবং ভাগাভাগির ব্যাপক সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ইনডেমনিটির ফলে এখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নেই। এরপর প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বিশাল বিশাল অবকাঠামো তৈরির হিড়িক সৃষ্টি করা হয়েছে। শহর নগর গ্রাম গঞ্জের মানুষের নিত্য চলাচলের রাস্তাঘাট অলিগলি নির্মাণ ও মেরামতের দেখা নেই মহাসড়কের উপর অপ্রয়োজনীয় উড়াল সড়ক-ফ্লাইওভার তৈরি হচ্ছে। নির্মাণ সামগ্রির ব্যবসা চাঙ্গা হয়েছে। দলীয় কন্ট্রাক্টার-সাব কন্ট্রাক্টাররা কাজ পেয়ে নতুন কৌশল এঁটেছেন। কাজ করেন না, একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পার হলেই বাজেট বাড়ে দ্বিগুণ তিনগুণ, চারগুণ আরো বেশী। টাকা কামাইয়ের ব্যবস্থা তো এভাবেই হচ্ছে। মধ্যবিত্ত ও গরিবদের জন্য বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। এগুলো হচ্ছে অল্প কয়েকটি উদাহরণ। সরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় অবৈধভাবে দলীয় লোক ও স্বজনদের অঢেল অর্থ সম্পদের মালিক করে দেয়ার আরো লাখ লাখ উদাহরণ আছে। সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি, জমি, দালান কোঠা জবর দখলের মাধ্যমেও ধনী, অতি ধনী হবার অনেক নজির রয়েছে। খোদ রাজধানী শহরেই এ ধরনের অনেক ঘটনা আছে। ক্ষমতাসীন দলের ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী, এমপি, মন্ত্রী সিটি কর্পোরেশনের পদস্থ কর্মকর্তা মেয়র-কাউন্সিলররাও এর সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। মতিঝিলের আরামবাগে দিনে দুপুরে ডাকাতি ও জবর দখলের এমন একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায় যাতে সিটি দক্ষিণের একজন কাউন্সিলর ও ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের একজন নেতা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা জড়িত। দৈনিক সংগ্রামের প্রকাশনা সংস্থা বাংলাদেশ পাবলিকেশনস লি. এর একটি সম্পত্তি, ২৩ শতক জমির উপর নির্মিত একটি ৯ তলা ও দু’টি ৪ তলা ভবন ২০১৫ সালের ২রা জুলাই তারা জবর দখল করে নেয়। এটি সাড়ে তিন হাজার শেয়ার হোল্ডারের একটি সম্পত্তি। এদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মামলা নেয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কর্পোরেশনের মেয়র এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কাছেও অভিযোগ দিয়ে কাজ হয়নি। কোর্ট -কাচারী তো সরকারেরই হাতে। ভবনগুলোর ভাড়া বাবত প্রতিষ্ঠানটির আয় ছিল প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা, এখন দখলকারীরাই খাচ্ছে। সারা দেশেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের আয় ও সম্পদের একটি বিবরণী তুলে ধরেছিলেন। বলাবাহুল্য, দশম সংসদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের প্রার্থী ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক দল নমিনেশন পেপার দাখিল করেনি। ৩০০ আসনে মনোনয়ন প্রার্থীদের সংখ্যা ছিল ১১০৭ এবং ১৫৪ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ১৪৬টি আসনে ৩৮৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্রের সাথে হলফনামার আকারে আয়কর বিবরণীসহ আট ধরনের তথ্য রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে দাখিল করেছেন। তাদের প্রদত্ত ২০০৮ ও ২০১৩ সালের তথ্যের ভিত্তিতে আয় সম্পদ দায়-দেনা ও পারিবারিক ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, ৪৮ জন সাধারণ প্রার্থীর আয় গড়ে ৫৮২ শতাংশ বেড়েছে। এই হার মন্ত্রীদের বেলায় বার্ষিক ২৪৩ ভাগ, প্রতিমন্ত্রীদের বেলায় ৪৬৪ ভাগ এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা চিফ হুইপ ও হুইপের ক্ষেত্রে ৩০৭১ ভাগ। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ও ডেপুটি স্পিকারের আয় বেড়েছে যথাক্রমে ১৩৬ ও ৪৪৩৫ ভাগ। শতকরা হারে আয় বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরে সুজন সম্পাদক জানান যে, আওয়ামী লীগ নেতা নূরে আলম চৌধুরীর আয় বেড়েছে ৩২৯৮৫ ভাগ, আবদুল মান্নান খানের ৮৪২২ ভাগ, মাহবুবুর রহমানের ৮০০৭ ভাগ, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর ৪৪৩ ভাগ, ড. হাসান মাহমুদের ২০৩৬ ভাগ এবভং আফসারুল আমীনের ২৪৮০ ভাগ। এই তথ্য ছিল তাদেরই দেয়া। সরেজমিনে কেউ তদন্ত করলে অবশ্যই অনেক বেশি পাওয়া যেত।
আয়ের পরই সুজন সম্পাদক হলফনামার প্রদর্শিত তথ্য বিশ্লেষণে পাওয়া প্রার্থী এবং তাদের নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির একটি বিবরণী তুরে ধরেছিলেন। তাতে তিনি দেখিয়েছেন যে, ৪৮ জন প্রার্থীর ৫ বছরে গড়ে সম্পদ বেড়েছে ৩৬৩ ভাগ। এই হার মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ২৪৭ ভাগ, প্রতিমন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ৪৫৯ ভাগ, জাতীয় সংসদের উপনেতা, চিফ হুইপ এবং হুইপদের ক্ষেত্রে ১৬৮৯ ভাগ। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও তাদের মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সংখ্যা আমাদের দেশে তখন ছিল প্রায় ৭৭ জন। সুজনের তথ্যানুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে ৪৬ ভাগ, ডেপুটি স্পিকারের ২৩৮ ভাগ, মন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের ১০,৯৯৭ ভাগ, নূরে আলম চৌধুরীর ৬৪২৪ ভাগ, ড. হাসান মাহমুদের ৩৮৯২ ভাগ লতিফ ছিদ্দিকী ১৯৬৯ভাগ, মীর্জা আযমের ১৪১৪ভাগ মাহবুবুর রহমানের ১২৬৩ ভাগ এবং ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ১১৩৫ ভাগ। তিনি টাকার অংকে সম্পদ বৃদ্ধির একটি বিবরণীও দিয়েছেন। এই বিবরণী অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকারের একজন শীর্ষ ব্যক্তির বছরে সম্পদ বেড়েছে ৪১ কোটি ৪৮ হাজার ৩৪৬ টাকা, মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ১৭ কোটি ৫৪ লাখ ৩২ হাজার ৯৪১ টাকা, ড. হাসান মাহমুদের ১৪ কোটি ৮৫ লাখ ৭৪ হাজার ৫২৩ টাকা, ডা. রুহুল হকের ১০ কোটি ২৯ লাখ ৭৬ হাজার ৭০০ টাকা, সুরঞ্জিন সেনের ৭ কোটি ৭৪ লাখ ৫৬ হাজার ২০৬ টাকার। আবদুল মান্নান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুবুর রহমান প্রত্যেকের গড়ে সোয়া সাত কোটি টাকা করে। স্থান সঙ্কুলান সমস্যার কারণে আমি এখানে সকলের নাম উল্লেখ করলাম না।
আগেই বলেছি এটা এমপি প্রার্থী ক্ষমতাসীন জোটের কিছু সদস্যের নিজেদের দেয়া তথ্য, সকলের নয়। পূর্ণাঙ্গ সত্য বা অর্ধ সত্যও নয়; হয়তো একআনা বা তার কম সত্যও হতে পারে। সারা দেশে ক্ষমতাসীন দল, জোট এবং তার বাইরে যেসব রথি-মহারথিরা নামে বেনামে তাদের আয় ও সম্পদের যে পাহাড় গড়ে তুলেছেন, অনেকেই তা জানেন। মন্ত্রী-এমপি তাদের সন্তান ও আত্মীয়দের দুর্নীতির খবর প্রায়ই পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। গত দশ বছরে পুলিশ বাহিনীকে এই সরকার অবৈধভাবে অর্থবিত্ত উপার্জনের যে সুযোগ করে দিয়েছে, গত দু’শ বছরের ইতিহাসে তার নজির পাওয়া যাবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এই অর্থ কার? অবশ্যই সাধারণ মানুষের, যারা এদেশের মালিক। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ উপঅনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী-উপমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিসহ ৮টি সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তির বেতন-ভাতার বাইরে অন্যসব আয়ের উপর বিধিনিষেধ আরোপিত আছে। তাদের বেতন ভাতাও সংসদের আইন দ্বারা নির্ধারিত। সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতার পরও মন্ত্রীদের আয় যে হারে বেড়েছে তা শুধু অস্বাভাবিক নয়, বিস্ময়করও। একজন বিচারকের দুর্নীতি ও যুক্তরাজ্যে ছয়টি বাড়ি ক্রয়ের বিবরণীপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পরও কোনও তদন্ত হয়নি বরং তথ্য প্রদানকারীকে গ্রেফতার করে জেলে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়েছে। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্পষ্টত সংবিধান লংঘন করেছেন। তারা রক্ষক নন ভক্ষক। ফলে ধনী আরো ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্ররা হচ্ছে দরিদ্রতর। এই অবস্থায় মধ্যবিত্তের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। অতি ধনীরা সরকারেরই সৃষ্টি, সরকার তাদের সৃষ্টি করছেন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। পুঁজিবাদী শোষণের এটাই নীতি। এই প্রবণতা রোধ করা দরকার।
বলাবাহুল্য, অতি ধনী বা ultra high networth (UHNW) বলে তাদেরকেই বিবেচনা করা হয়, যাদের সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি ডলার বা তার বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় যাদের সম্পদ আড়াই শ’ কোটি টাকারও বেশি তারাই অতি ধনী বলে গণ্য হন। অন্যান্য দেশের তুলনায় এই অতি ধনীদের সংখ্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ওয়েলথ এক্স-এর রিপোর্টে উল্লেখিত উন্নত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে জার্মানি, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, ইতালী, হংকং প্রভৃতি। তবে এসব দেশে অতি ধনী বৃদ্ধির হার বাংলাদেশ থেকে অনেক কম।
ওয়েলথ এক্স-এর রিপোর্টে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা উল্লেখ করেনি। তবে অতি ধনী হবার হার উল্লেখ করেছে যা বর্তমান বিশ্বের এক নম্বর ধনী ও পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। অবশ্য যদি ধরে নেই যে, ২০১২ সালে বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা ১০০ জন ছিল তাহলে ১৭.৩ শতাংশ হারে ২০১৭ সালে চক্রবৃদ্ধি হারে এই সংখ্যা ২১৯ বা ২২০-এ এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ অতি ধনী বা ২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিকের সংখ্যা বাংলাদেশে প্রতি ৫ বছরে দ্বিগুণ হচ্ছে। এর পাশাপাশি গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্ট হচ্ছে, বৈশ্বিক উদ্ভাবনী সূচক সংক্রান্ত। এতে এশিয়ার শীর্ষ উদ্ভাবনী দেশসমূহের একটি তালিকা প্রদর্শন করা হয়েছে। তালিকার অবস্থান অনুযায়ী ১৭টি দেশের নাম আছে। ক্রম অনুযায়ী এগুলো হচ্ছে : (১) সিঙ্গাপুর (২) দ. কোরিয়া (৩) জাপান (৪) চীন (৫) মালয়েশিয়া (৬) থাইল্যান্ড (৭) ভিয়েতনাম (৮) মঙ্গোলিয়া (৯) ভারত (১০) ব্রুনাই (১১) ফিলিপাইন (১২) ইন্দোনেশিয়া (১৩) শ্রীলঙ্কা (১৩) কম্বোডিয়া (১৫) নেপাল (১৬) পাকিস্তান এবং (১৭) বাংলাদেশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের অবস্থান সবার শেষে, যার অর্থ উদ্ভাভনে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদে। এই তালিকা দেখে পরিষ্কার উপলব্ধি করা যায় যে, শিক্ষা, সততা, দক্ষতা, পরিশ্রম, যোগ্যতা বা উদ্ভাবনী শক্তি বলে বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শোষণমূলক হবার কারণেই এখানে অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, দরিদ্র আরো দরিদ্রতর হচ্ছে। এটা রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রবণতা নয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে গত ৮ বছরে জাতীয় আয়ে জনসংখ্যার দরিদ্রতম ১০ শতাংশের হিস্যা ২ শতাংশ থেকে ১.০১ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ আয় সম্পদ ও ধনী দরিদ্রের বৈষম্য সাংঘাতিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে সম্পর্কিত ব্যবসায়ীরা অঢেল সম্পদ গড়েছেন বলে বলা হয়। দেশের রফতানি আয়ের আশি শতাংশ এই শিল্প যোগান দেয়। গার্মেন্টস কর্মীদের বেতন কত? সম্প্রতি তাদের জন্য আট হাজার টাকা মাসিক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা কি বৈষম্য ও বঞ্চনার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত নয়? সরকারি তথ্যানুযায়ী গত বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৩ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধির ফলে যে সম্পদ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে তা গুটিকয়েক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ভোগ করছে, তার ন্যায্য ও ইনসাফভিত্তিক বণ্টন হচ্ছে না। আবার অভিযোগ উঠেছে যে, আমাদের দেশে বর্তমানে যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তার সাথে কর্মসংস্থান এবং তৃণমূলের সম্পর্ক নেই। গ্রাম-গঞ্জের রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট, পানি নিষ্কাশন ও সেচ ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে শহর, নগর এবং মহাসড়কে ফ্লাইওভার ও উড়াল সড়ক তৈরির ফলে ধনিক-ঠিকাদার শ্রেণী লাভবান হচ্ছে গরীবরা নয়। এই শ্রেণীর উন্নয়ন তথা ধনী থেকে অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতির ভিত মজবুত হচ্ছে না। ঠিকাদার রাজনীতিকরা অর্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। আমদানি বাণিজ্যে ওভার ইনভয়েসিং নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্য বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিবেশিত এক হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে আমাদের আমদানি ব্যয় ও রফতানি আয়ের ব্যবধান ৮০০ বিলিয়ন টাকা অতিক্রম করেছে। ২০১৭ সালের Global Financial Integrity Report আরো ভয়াবহ। এতে অবৈধ অর্থ পাচারে বাংলাদেশকে শীর্ষ দেশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯-১১ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। আবার ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের রক্ষিত সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ৬৮৩ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ যা ভারতীয়দের রক্ষিত আমানতের প্রায় কাছাকাছি। আবার ২০০৫ সাল থেকে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বলে জিএফআই এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অর্থ ঐ সময়ের বাংলাদেশের মোট জাতীয় বাে জটের প্রায় দ্বিগুণ। রিপোর্টে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৫৩.৩৫২ কোটি টাকা। বিশ্লেষকদের হিসাব অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আরো অন্তত তিন লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। বিদেশে অর্থ পাচার, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক এবং অর্থ প্রতিষ্ঠানসমূহের লাখ লাখ কোটি টাকার অর্থ লোপাট, ঋণ কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ডেস্টিনিসহ এনজিওসমূহের প্রতারণা আত্মসাৎ প্রভৃতি এই সরকারের আমলেরই কীর্তি। এসব অপরাধের কোনও বিচার হয়নি। সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বলে দেশবাসী জানেন না। এরা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পায়, সরকারের কাছে থেকে অবৈধ বাণিজ্যিক সুবিধা নিয়ে এরা টাকার কুমির হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই অতি ধনীদের উত্থান হয়েছে। এদের মধ্যে আছে দুর্নীতিপরায়ণ কিছু ব্যবসায়ী শিল্পপতি, অবৈধ সুবিধাভোগী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, ছাত্র নেতা প্রমুখ। এই অতি ধনীদের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পৃক্ত লোকের সংখ্যাই বেশি। দেশ ও দেশের দরিদ্র মানুষের প্রতি এদের কোনও দায়িত্ববোধ নেই। এদের বেশিরভাগই স্বনামে-বেনামে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করেন না। এরা সরকারকে কর ফাঁকি দেন। বিদেশে বিনিয়োগের জন্য পুঁজি পাচার করেন, মালয়েশিয়া ও কানাডার টরেন্টোতে সেকেন্ড হোম বানান, ঈদের বাজার করেন বিদেশের মাটিতে, লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে কুরবানির পশু কিনেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য পাঠান আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায়। তারা লেক্সাস, বিএমডব্লিউ ও জাগুয়ার গাড়িতে চড়েন। অনেকে হেলিকপ্টার কিনতেও শুরু করেছেন। সরকারই তার দলীয় এবং জোটভুক্ত লোকদের এই সুযোগ করে দিয়েছেন। পাঠকদের হয়তো মনে আছে যে, ক্ষমতা গ্রহণের পর পর তিন কোটি ব্যয় সাশ্রয়ী বাল্ব প্রতিস্থাপনের জন্য সরকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। রাজধানীর প্রত্যেক বাসিন্দাকেই এ প্রকল্পের অধীনে পুরাতন বাল্ব ফেরত দিয়ে নতুন বাল্ব নিতে হয়েছিল। সরকার দলীয় এক ব্যবসায়ী এই বাল্ব তৈরি ও বিতরণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। পাইপ লাইনের গ্যাস বন্ধ করে সিডিল্ডারে গ্যাস সরবরাহের ব্যবসাও আরেক প্রভাবশালী দলীয় ব্যবসায়ীকে দেয়া হয়। বোতলজাত এই গ্যাসের দাম তিনি নিচ্ছেন গ্যাস স্টেশনের নির্ধারিত মূল্যের প্রায় তিনগুণ। বিদ্যুৎ খাতের কুইক রেন্টার প্ল্যান্টের মালিকদের অর্থ উপার্জনের এবং ভাগাভাগির ব্যাপক সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ইনডেমনিটির ফলে এখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নেই। এরপর প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বিশাল বিশাল অবকাঠামো তৈরির হিড়িক সৃষ্টি করা হয়েছে। শহর নগর গ্রাম গঞ্জের মানুষের নিত্য চলাচলের রাস্তাঘাট অলিগলি নির্মাণ ও মেরামতের দেখা নেই মহাসড়কের উপর অপ্রয়োজনীয় উড়াল সড়ক-ফ্লাইওভার তৈরি হচ্ছে। নির্মাণ সামগ্রির ব্যবসা চাঙ্গা হয়েছে। দলীয় কন্ট্রাক্টার-সাব কন্ট্রাক্টাররা কাজ পেয়ে নতুন কৌশল এঁটেছেন। কাজ করেন না, একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পার হলেই বাজেট বাড়ে দ্বিগুণ তিনগুণ, চারগুণ আরো বেশী। টাকা কামাইয়ের ব্যবস্থা তো এভাবেই হচ্ছে। মধ্যবিত্ত ও গরিবদের জন্য বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। এগুলো হচ্ছে অল্প কয়েকটি উদাহরণ। সরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় অবৈধভাবে দলীয় লোক ও স্বজনদের অঢেল অর্থ সম্পদের মালিক করে দেয়ার আরো লাখ লাখ উদাহরণ আছে। সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি, জমি, দালান কোঠা জবর দখলের মাধ্যমেও ধনী, অতি ধনী হবার অনেক নজির রয়েছে। খোদ রাজধানী শহরেই এ ধরনের অনেক ঘটনা আছে। ক্ষমতাসীন দলের ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী, এমপি, মন্ত্রী সিটি কর্পোরেশনের পদস্থ কর্মকর্তা মেয়র-কাউন্সিলররাও এর সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। মতিঝিলের আরামবাগে দিনে দুপুরে ডাকাতি ও জবর দখলের এমন একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায় যাতে সিটি দক্ষিণের একজন কাউন্সিলর ও ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের একজন নেতা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা জড়িত। দৈনিক সংগ্রামের প্রকাশনা সংস্থা বাংলাদেশ পাবলিকেশনস লি. এর একটি সম্পত্তি, ২৩ শতক জমির উপর নির্মিত একটি ৯ তলা ও দু’টি ৪ তলা ভবন ২০১৫ সালের ২রা জুলাই তারা জবর দখল করে নেয়। এটি সাড়ে তিন হাজার শেয়ার হোল্ডারের একটি সম্পত্তি। এদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মামলা নেয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কর্পোরেশনের মেয়র এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কাছেও অভিযোগ দিয়ে কাজ হয়নি। কোর্ট -কাচারী তো সরকারেরই হাতে। ভবনগুলোর ভাড়া বাবত প্রতিষ্ঠানটির আয় ছিল প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা, এখন দখলকারীরাই খাচ্ছে। সারা দেশেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের আয় ও সম্পদের একটি বিবরণী তুলে ধরেছিলেন। বলাবাহুল্য, দশম সংসদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের প্রার্থী ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক দল নমিনেশন পেপার দাখিল করেনি। ৩০০ আসনে মনোনয়ন প্রার্থীদের সংখ্যা ছিল ১১০৭ এবং ১৫৪ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ১৪৬টি আসনে ৩৮৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্রের সাথে হলফনামার আকারে আয়কর বিবরণীসহ আট ধরনের তথ্য রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে দাখিল করেছেন। তাদের প্রদত্ত ২০০৮ ও ২০১৩ সালের তথ্যের ভিত্তিতে আয় সম্পদ দায়-দেনা ও পারিবারিক ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, ৪৮ জন সাধারণ প্রার্থীর আয় গড়ে ৫৮২ শতাংশ বেড়েছে। এই হার মন্ত্রীদের বেলায় বার্ষিক ২৪৩ ভাগ, প্রতিমন্ত্রীদের বেলায় ৪৬৪ ভাগ এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা চিফ হুইপ ও হুইপের ক্ষেত্রে ৩০৭১ ভাগ। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ও ডেপুটি স্পিকারের আয় বেড়েছে যথাক্রমে ১৩৬ ও ৪৪৩৫ ভাগ। শতকরা হারে আয় বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরে সুজন সম্পাদক জানান যে, আওয়ামী লীগ নেতা নূরে আলম চৌধুরীর আয় বেড়েছে ৩২৯৮৫ ভাগ, আবদুল মান্নান খানের ৮৪২২ ভাগ, মাহবুবুর রহমানের ৮০০৭ ভাগ, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর ৪৪৩ ভাগ, ড. হাসান মাহমুদের ২০৩৬ ভাগ এবভং আফসারুল আমীনের ২৪৮০ ভাগ। এই তথ্য ছিল তাদেরই দেয়া। সরেজমিনে কেউ তদন্ত করলে অবশ্যই অনেক বেশি পাওয়া যেত।
আয়ের পরই সুজন সম্পাদক হলফনামার প্রদর্শিত তথ্য বিশ্লেষণে পাওয়া প্রার্থী এবং তাদের নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির একটি বিবরণী তুরে ধরেছিলেন। তাতে তিনি দেখিয়েছেন যে, ৪৮ জন প্রার্থীর ৫ বছরে গড়ে সম্পদ বেড়েছে ৩৬৩ ভাগ। এই হার মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ২৪৭ ভাগ, প্রতিমন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ৪৫৯ ভাগ, জাতীয় সংসদের উপনেতা, চিফ হুইপ এবং হুইপদের ক্ষেত্রে ১৬৮৯ ভাগ। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও তাদের মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সংখ্যা আমাদের দেশে তখন ছিল প্রায় ৭৭ জন। সুজনের তথ্যানুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে ৪৬ ভাগ, ডেপুটি স্পিকারের ২৩৮ ভাগ, মন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের ১০,৯৯৭ ভাগ, নূরে আলম চৌধুরীর ৬৪২৪ ভাগ, ড. হাসান মাহমুদের ৩৮৯২ ভাগ লতিফ ছিদ্দিকী ১৯৬৯ভাগ, মীর্জা আযমের ১৪১৪ভাগ মাহবুবুর রহমানের ১২৬৩ ভাগ এবং ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ১১৩৫ ভাগ। তিনি টাকার অংকে সম্পদ বৃদ্ধির একটি বিবরণীও দিয়েছেন। এই বিবরণী অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকারের একজন শীর্ষ ব্যক্তির বছরে সম্পদ বেড়েছে ৪১ কোটি ৪৮ হাজার ৩৪৬ টাকা, মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ১৭ কোটি ৫৪ লাখ ৩২ হাজার ৯৪১ টাকা, ড. হাসান মাহমুদের ১৪ কোটি ৮৫ লাখ ৭৪ হাজার ৫২৩ টাকা, ডা. রুহুল হকের ১০ কোটি ২৯ লাখ ৭৬ হাজার ৭০০ টাকা, সুরঞ্জিন সেনের ৭ কোটি ৭৪ লাখ ৫৬ হাজার ২০৬ টাকার। আবদুল মান্নান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুবুর রহমান প্রত্যেকের গড়ে সোয়া সাত কোটি টাকা করে। স্থান সঙ্কুলান সমস্যার কারণে আমি এখানে সকলের নাম উল্লেখ করলাম না।
আগেই বলেছি এটা এমপি প্রার্থী ক্ষমতাসীন জোটের কিছু সদস্যের নিজেদের দেয়া তথ্য, সকলের নয়। পূর্ণাঙ্গ সত্য বা অর্ধ সত্যও নয়; হয়তো একআনা বা তার কম সত্যও হতে পারে। সারা দেশে ক্ষমতাসীন দল, জোট এবং তার বাইরে যেসব রথি-মহারথিরা নামে বেনামে তাদের আয় ও সম্পদের যে পাহাড় গড়ে তুলেছেন, অনেকেই তা জানেন। মন্ত্রী-এমপি তাদের সন্তান ও আত্মীয়দের দুর্নীতির খবর প্রায়ই পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। গত দশ বছরে পুলিশ বাহিনীকে এই সরকার অবৈধভাবে অর্থবিত্ত উপার্জনের যে সুযোগ করে দিয়েছে, গত দু’শ বছরের ইতিহাসে তার নজির পাওয়া যাবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এই অর্থ কার? অবশ্যই সাধারণ মানুষের, যারা এদেশের মালিক। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ উপঅনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী-উপমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিসহ ৮টি সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তির বেতন-ভাতার বাইরে অন্যসব আয়ের উপর বিধিনিষেধ আরোপিত আছে। তাদের বেতন ভাতাও সংসদের আইন দ্বারা নির্ধারিত। সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতার পরও মন্ত্রীদের আয় যে হারে বেড়েছে তা শুধু অস্বাভাবিক নয়, বিস্ময়করও। একজন বিচারকের দুর্নীতি ও যুক্তরাজ্যে ছয়টি বাড়ি ক্রয়ের বিবরণীপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পরও কোনও তদন্ত হয়নি বরং তথ্য প্রদানকারীকে গ্রেফতার করে জেলে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়েছে। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্পষ্টত সংবিধান লংঘন করেছেন। তারা রক্ষক নন ভক্ষক। ফলে ধনী আরো ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্ররা হচ্ছে দরিদ্রতর। এই অবস্থায় মধ্যবিত্তের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। অতি ধনীরা সরকারেরই সৃষ্টি, সরকার তাদের সৃষ্টি করছেন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। পুঁজিবাদী শোষণের এটাই নীতি। এই প্রবণতা রোধ করা দরকার।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ০৩/১০/২০১৮দারুণ information
-
রাকিব ইমতিয়াজ. ২৭/০৯/২০১৮জানলাম
-
এস এম আলমগীর হোসেন ২৭/০৯/২০১৮Good