রাস্তা নিয়ে আরো লিখেছি
ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকেই রাজপথে নেমে এসেছে স্কুল কলেজের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। অন্য যে কোন আন্দোলনের চেয়ে এ আন্দোলনে দেখা গেছে ভিন্ন মাত্রা। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ছাত্রছাত্রীরা গাড়ির ফিটনেস আর চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করছে। সড়কে গাড়ি চলাচলের লেনও ঠিক করে দিচ্ছে। নানা শ্লোগানে শ্লোগানে উত্তাল ছিল রাজপথ। মুখে মুখে ছিল ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
তারা নিজেদের লাভ লোকসান নয়, করছে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন। তাদের এই আন্দোলন কোন ব্যক্তি, কোন দল, কোন পক্ষ বা সরকারের বিরুদ্ধে নয়। তাদের এই দাবী গণমানুষের। তাদের এই সামাজিক আন্দোলন রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে আমজনতার সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারা চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করছে এটা তাদের দায়িত্বে মধ্যে পড়ে না। তাদের থাকার কথা শ্রেণীকক্ষে। খেলার মাঠে। কিন্তু এই সব বালক, কিশোর, ছাত্র ও ছাত্রীরা এখন রাজপথে অবস্থান নিয়েছে। হাতে হাতে রঙ্গ বেরঙ্গের প্ল্যাকার্ড। তারা বলছে, ‘রাস্তা বন্ধ, ‘রাষ্ট্রের মেরামত কাজ চলছে’। তারা বলছে, ‘আমরা পুলিশের বিরুদ্ধে না, আমরা সরকারের বিরুদ্ধে না, আমরা কারও হাসির বিরুদ্ধে না, আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শ্লোগান এখন রাজপথ ছাড়িয়ে মানুষের মুখে মুখে। ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তেমনি কিছু শ্লোগান নিচে তুলে ধরা হলো।
‘স্বার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে, গাড়ি চাপায় মানুষ মরে মন্ত্রী সাহেব হাসে’; ‘৪ জি স্পিড নেটওয়ার্কে নয়, ৪জি স্পিড বিচার ব্যবস্থা চাই’; ‘কেউ দেখতে চায়না তার আদরের সন্তানের ক্ষত বিক্ষত লাশ’; ‘ বাবা-মা ওদের পড়তে পাঠায়, মরতে নয়’; ‘তুমি এসএসসি পাশ করা পুলিশ, আমি এইচ এসসি পাশ করা শিক্ষার্থী আসো খেলা হবে’; ‘এদেশে বাবার হত্যার বিচার হয়, ছাত্র-ছাত্রীর নয়’; ‘ছাত্রদের আপাতত রাস্তা সামলাতে দিন, মন্ত্রী পুলিশকে স্কুলে পাঠান শিক্ষিত করতে’।
আরো আছে, ‘যতদিন বিচার পাবোনা, রাজপথ ছাড়বো না’; ‘একটি কুঁড়ি মাতাল হয়ে বারুদ গন্ধে ফুটবে কবে’; ‘সারা শহর উত্তাল পাতাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে’; ‘বিবেক তবে কবে ফিরবে’; ‘জনপ্রতিনিধিদের সপ্তাহে অন্তত তিনদিন গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হবে’; ‘মা তুমি আমার জন্য আর অপেক্ষা করো না, আমি আর ঘরে ফিরবো না’;
‘আমরা ৯ টাকায় ১ জিবি চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই’।
তাদের শ্লোগান হচ্ছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই’;‘ শিক্ষকের বেতের বাড়ি নিষেধ যে দেশে, পুলিশের হাতে লাঠি কেন সেই দেশে’; ‘যদি তোমাদের হাতে থাকে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ’; ‘ছাত্র-পুলিশ ভাই ভাই, নিরাপদ সড়ক চাই’; ‘ছোট ছোট ক্ষোভ, হলো বিক্ষোভ, হৃদয়ে আগুন, ছোট ছোট হাত ফোটাবে প্রভাত, আনবে ফাগুন’; ‘ আন্দোলন করে আমরা দোষী হলে, দোষী প্রিয় বঙ্গবন্ধু, কারণ আন্দোলন তিনিই শিখিয়েছেন’; ‘নিরাপদ সড়ক চাওয়া কি অপরাধ? তবে আমি অপরাধী’।
তারা বলছে, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি, যেথায় মরে বাসের চাপায়, হাসে মন্ত্রী মনি’; ‘আমার মা কাঁদছে, নৌমন্ত্রী হাসছে’; ‘আমিও শাজাহান নানার মত সারা জীবন হাসতে চাই, তাই নিরাপদ সড়ক চাই’; ‘চাইলাম বিচার পেলাম অত্যাচার’; ‘পুলিশ আংকেল আমাকে মানুষ মারার অস্ত্র দেখাবেন না, আমার কাছে মানুষ তৈরির অস্ত্র আছে’।
একটি ছোট্ট শিশু হাতের প্ল্যাকার্ডের লেখা ছিল ‘ পুলিশ আংকেল, আপনার চা-সিগারেটের টাকা আমি আমার টিফিনের টাকা দিয়ে দিচ্ছি, তাও আপনি এসব গাড়ি চালাতে দিয়েন না’।
নো লাইসেন্স নো রান: ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস, নিরাপদ সড়ক চাই, ৯ দফা মানতে হবে’ নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই’ এই শ্লোগানে গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর উত্তাল ছিল নারায়ণগঞ্জও। শহরের প্রধান প্রাণকেন্দ্র চাষাড়া গোল চত্তর, সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়, নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোডের সাইবোর্ড বিকাল পর্যন্ত হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের দখলে ছিল। সরকার ঘোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এর কোন প্রভাব পড়েনি।
এতে হাজার হাজার মানুষ র্দুভোগের শিকার হলেও তাদের কোন নেভেটিভ মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। বরং অনেকেই প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছেন নৌমন্ত্রীর কারণে আজ দেশের এই অবস্থা। তার পদত্যাগ করা উচিৎ। নিরাপদ সড়ক আমরাও চাই। বছরের পর বছর এই দাবি উঠলেও সরকার কার্যকরী প্রদক্ষেপ নেয়নি। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভুত ক্ষোভ একত্রিভুত হয়েছে কর্মিটোলায় বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে। তাই আজ শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে দেশ, সরকার অসহায়।
গাড়িগুলো এখন সারিবদ্ধ: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এলোপাতাড়ি গাড়িগুলো এখন সারিবদ্ধভাবে চলছে। বিশৃংখলাও দেখা যায়নি প্রাইভেট কারসহ অন্যান্য গাড়িতে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দল দলে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গাড়ির লাইসেন্স চেক করতে থাকে। এ সময় যেসব চালকের কাছে লাইসেন্স পাওয়া গেছে, তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর যাদের নেই তাদের জরিমানা করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেনি।
শিক্ষার্থীদের রাস্তায় ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। ফেসবুকে শেয়ার করে তুমুল প্রশংসা করেছেন অনেকে। একজন লিখেছেন, ‘দক্ষ ট্রাফিক পুলিশ’।
মো. হারুণ আল রসিদ লিখেছেন, ‘আমার বয়সে প্রথম দেখলাম ৪৭ বছর বয়সী দেশের বাঁকা রাস্তা কেমনে সোজা হয়... মন্ত্রী সোজা, এমপি সোজা, শ্রমিক, পুলিশ, সাংবাদিক সব সোজা।’
পুলিশের গাড়িগুলোয় লাইসেন্সসহ অন্যান্য কাগজপত্র সঙ্গে রাখতে চালকদের নির্দেশ দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি)।
লাইসেন্সবিহীন চালকের গাড়ি আটকে দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এই পরিস্থিতিতে ডিএমপি পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় থেকে এমন নির্দেশ দেয়া হয়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবর রহমানের গাড়ি আটকে দেয় বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে। শিক্ষার্থীরা গাড়ি আটকে চালকের লাইসেন্স দেখতে চায়। দেখা যায়, লাইসেন্সটি মেয়াদোত্তীর্ণ।
এরপর সেখানে কর্তব্যরত সার্জেন্ট জাফর ইমাম লাইসেন্স নবায়ন না করায় একটি মামলা করেন। জাফর ইমাম জানান, গাড়িটি ছিল প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবর রহমানের। যদিও গাড়িতে নজিবুর রহমান ছিলেন না।
অন্যদিকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া সংসদে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করতে ও বের হতে পারেননি এমপি-মন্ত্রীরাও। এক পৌর মেয়রকেও আটকে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ির বিরুদ্ধে করা হয়েছে মামলা। অবস্থা বেগতিক দেখে সংসদ থেকে বের হয়ে আবারও তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে সংসদে প্রবেশ করেছে গাড়ি।
সরকারি গাড়ির মূল কাগজ গাড়িতে রাখার নির্দেশ: নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র যাচইয়ের কাজ নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার পর সরকারি গাড়ি চালকদের যাবতীয় মূল কাগজপত্র সঙ্গে রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ জানান, চালকদের লিখিত ও মৌখিকভাবে বলে দেওয়া হয়েছে গাড়ির মূল কাগজপত্র সঙ্গে রাখতে।
বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর গত ২৯ জুলাই থেকে রাজধানীতে বিক্ষোভ চালিয়ে আসা শিক্ষার্থীরা গত দুদিন ধরে রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চালক ও যানবাহনের লাইসেন্স দেখতে চাইছে। কাগজ দেখাতে না পারলে আটকে দেওয়া হচ্ছে গাড়ি।
সংশ্লিষ্ট সরকারি গাড়ির চালকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বলেছেন, তাদের লাইসেন্স থাকলেও সরকারি গাড়ি চালান বলে তা সঙ্গে নিয়ে বের হন না। গাড়ির কাগজপত্র অফিসেই থাকে।
মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ বলেন, এখন তো পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। ওদেরকে (গাড়ি চালকদের) বলে দিয়েছি এখন থেকে মূল কাগজপত্র সঙ্গে রাখতে, মূল কাগজই তারা সঙ্গে রাখবে।
গাড়ি চালানোর সময় লাইসেন্স সঙ্গে রাখার নিয়ম লাইসেন্সের পেছনেই স্পষ্ট করে লেখা থাকে। পাশাপাশি বীমার কাগজ ও ব্লুবুকও সঙ্গে রাখার কথা চালকদের। ট্রাফিক সার্জেন্ট চাইলে তা দেখাতে হবে।
রাজপথে তারোকারা: ছাত্রদের এমন আন্দোলনে প্রথমে ফেসবুকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন শোবিজের তারোকারা। কিন্তু চতুর্থ দিন থেকে ছাত্রদের সঙ্গে রাজপথেও নামেন তারোকারা। পঞ্চম দিনেও শুটিং রেখে রাজপথে দেখা গেল তারোকাদের। স্লোগানে স্লোগানে মুখর করল তারাও।
বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় আন্দোলনে সংহতি প্রকাশের জন্য উত্তরা হাউস বিল্ডিং চৌরাস্তায় দাঁড়ান শিল্পী, কলাকুশলীরা। তাদের মধ্যে ছিলেন অভিনেতা লুৎফর রহমান জর্জ, অভিনেত্রী মনিরা মিঠু, অর্ষা, নির্মাতা সাগর জাহান, চয়নিকা চৌধুরীসহ অনেকেই। তারা বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই আছেন উত্তরার রাস্তায়, অংশ নিচ্ছেন আন্দোলনে।
অভিনেত্রী মনিরা মিঠু বলেন, আমি আছি আমাদের রক্তাক্ত বাচ্চাদের পাশে রাজপথে।
এদিকে বুধবার শুটিং বন্ধ রেখে উত্তরায় আন্দোলন করতে দেখা যায় পরিচালক সকাল আহমেদ, অভিনয়শিল্পী জাকিয়া বারী মম, নাদিয়া আহমেদ, নওশীন, অর্ষা, তৌসিফকে। শাহবাগে মানববন্ধনে অংশ নিতে দেখা যায় অভিনয়শিল্পী জ্যোতিকা জ্যোতি, নওশাবাকে।
শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবীতে যা আছে: ১. বেপোরোয়া ড্রাইভারকে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। ২. নৌ-পরিবহন মন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করতে হবে। ৩. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে। ৪. প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাতে স্পিড ব্রেকার দিতে হবে। ৫. সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। ৬. শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে, থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে। ৭. শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৮. ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবে না। ৯. বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না।
তারা নিজেদের লাভ লোকসান নয়, করছে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন। তাদের এই আন্দোলন কোন ব্যক্তি, কোন দল, কোন পক্ষ বা সরকারের বিরুদ্ধে নয়। তাদের এই দাবী গণমানুষের। তাদের এই সামাজিক আন্দোলন রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে আমজনতার সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারা চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করছে এটা তাদের দায়িত্বে মধ্যে পড়ে না। তাদের থাকার কথা শ্রেণীকক্ষে। খেলার মাঠে। কিন্তু এই সব বালক, কিশোর, ছাত্র ও ছাত্রীরা এখন রাজপথে অবস্থান নিয়েছে। হাতে হাতে রঙ্গ বেরঙ্গের প্ল্যাকার্ড। তারা বলছে, ‘রাস্তা বন্ধ, ‘রাষ্ট্রের মেরামত কাজ চলছে’। তারা বলছে, ‘আমরা পুলিশের বিরুদ্ধে না, আমরা সরকারের বিরুদ্ধে না, আমরা কারও হাসির বিরুদ্ধে না, আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শ্লোগান এখন রাজপথ ছাড়িয়ে মানুষের মুখে মুখে। ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তেমনি কিছু শ্লোগান নিচে তুলে ধরা হলো।
‘স্বার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে, গাড়ি চাপায় মানুষ মরে মন্ত্রী সাহেব হাসে’; ‘৪ জি স্পিড নেটওয়ার্কে নয়, ৪জি স্পিড বিচার ব্যবস্থা চাই’; ‘কেউ দেখতে চায়না তার আদরের সন্তানের ক্ষত বিক্ষত লাশ’; ‘ বাবা-মা ওদের পড়তে পাঠায়, মরতে নয়’; ‘তুমি এসএসসি পাশ করা পুলিশ, আমি এইচ এসসি পাশ করা শিক্ষার্থী আসো খেলা হবে’; ‘এদেশে বাবার হত্যার বিচার হয়, ছাত্র-ছাত্রীর নয়’; ‘ছাত্রদের আপাতত রাস্তা সামলাতে দিন, মন্ত্রী পুলিশকে স্কুলে পাঠান শিক্ষিত করতে’।
আরো আছে, ‘যতদিন বিচার পাবোনা, রাজপথ ছাড়বো না’; ‘একটি কুঁড়ি মাতাল হয়ে বারুদ গন্ধে ফুটবে কবে’; ‘সারা শহর উত্তাল পাতাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে’; ‘বিবেক তবে কবে ফিরবে’; ‘জনপ্রতিনিধিদের সপ্তাহে অন্তত তিনদিন গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হবে’; ‘মা তুমি আমার জন্য আর অপেক্ষা করো না, আমি আর ঘরে ফিরবো না’;
‘আমরা ৯ টাকায় ১ জিবি চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই’।
তাদের শ্লোগান হচ্ছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই’;‘ শিক্ষকের বেতের বাড়ি নিষেধ যে দেশে, পুলিশের হাতে লাঠি কেন সেই দেশে’; ‘যদি তোমাদের হাতে থাকে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ’; ‘ছাত্র-পুলিশ ভাই ভাই, নিরাপদ সড়ক চাই’; ‘ছোট ছোট ক্ষোভ, হলো বিক্ষোভ, হৃদয়ে আগুন, ছোট ছোট হাত ফোটাবে প্রভাত, আনবে ফাগুন’; ‘ আন্দোলন করে আমরা দোষী হলে, দোষী প্রিয় বঙ্গবন্ধু, কারণ আন্দোলন তিনিই শিখিয়েছেন’; ‘নিরাপদ সড়ক চাওয়া কি অপরাধ? তবে আমি অপরাধী’।
তারা বলছে, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি, যেথায় মরে বাসের চাপায়, হাসে মন্ত্রী মনি’; ‘আমার মা কাঁদছে, নৌমন্ত্রী হাসছে’; ‘আমিও শাজাহান নানার মত সারা জীবন হাসতে চাই, তাই নিরাপদ সড়ক চাই’; ‘চাইলাম বিচার পেলাম অত্যাচার’; ‘পুলিশ আংকেল আমাকে মানুষ মারার অস্ত্র দেখাবেন না, আমার কাছে মানুষ তৈরির অস্ত্র আছে’।
একটি ছোট্ট শিশু হাতের প্ল্যাকার্ডের লেখা ছিল ‘ পুলিশ আংকেল, আপনার চা-সিগারেটের টাকা আমি আমার টিফিনের টাকা দিয়ে দিচ্ছি, তাও আপনি এসব গাড়ি চালাতে দিয়েন না’।
নো লাইসেন্স নো রান: ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস, নিরাপদ সড়ক চাই, ৯ দফা মানতে হবে’ নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই’ এই শ্লোগানে গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর উত্তাল ছিল নারায়ণগঞ্জও। শহরের প্রধান প্রাণকেন্দ্র চাষাড়া গোল চত্তর, সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়, নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোডের সাইবোর্ড বিকাল পর্যন্ত হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের দখলে ছিল। সরকার ঘোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এর কোন প্রভাব পড়েনি।
এতে হাজার হাজার মানুষ র্দুভোগের শিকার হলেও তাদের কোন নেভেটিভ মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। বরং অনেকেই প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছেন নৌমন্ত্রীর কারণে আজ দেশের এই অবস্থা। তার পদত্যাগ করা উচিৎ। নিরাপদ সড়ক আমরাও চাই। বছরের পর বছর এই দাবি উঠলেও সরকার কার্যকরী প্রদক্ষেপ নেয়নি। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভুত ক্ষোভ একত্রিভুত হয়েছে কর্মিটোলায় বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে। তাই আজ শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে দেশ, সরকার অসহায়।
গাড়িগুলো এখন সারিবদ্ধ: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এলোপাতাড়ি গাড়িগুলো এখন সারিবদ্ধভাবে চলছে। বিশৃংখলাও দেখা যায়নি প্রাইভেট কারসহ অন্যান্য গাড়িতে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দল দলে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গাড়ির লাইসেন্স চেক করতে থাকে। এ সময় যেসব চালকের কাছে লাইসেন্স পাওয়া গেছে, তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর যাদের নেই তাদের জরিমানা করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেনি।
শিক্ষার্থীদের রাস্তায় ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। ফেসবুকে শেয়ার করে তুমুল প্রশংসা করেছেন অনেকে। একজন লিখেছেন, ‘দক্ষ ট্রাফিক পুলিশ’।
মো. হারুণ আল রসিদ লিখেছেন, ‘আমার বয়সে প্রথম দেখলাম ৪৭ বছর বয়সী দেশের বাঁকা রাস্তা কেমনে সোজা হয়... মন্ত্রী সোজা, এমপি সোজা, শ্রমিক, পুলিশ, সাংবাদিক সব সোজা।’
পুলিশের গাড়িগুলোয় লাইসেন্সসহ অন্যান্য কাগজপত্র সঙ্গে রাখতে চালকদের নির্দেশ দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি)।
লাইসেন্সবিহীন চালকের গাড়ি আটকে দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এই পরিস্থিতিতে ডিএমপি পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় থেকে এমন নির্দেশ দেয়া হয়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবর রহমানের গাড়ি আটকে দেয় বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে। শিক্ষার্থীরা গাড়ি আটকে চালকের লাইসেন্স দেখতে চায়। দেখা যায়, লাইসেন্সটি মেয়াদোত্তীর্ণ।
এরপর সেখানে কর্তব্যরত সার্জেন্ট জাফর ইমাম লাইসেন্স নবায়ন না করায় একটি মামলা করেন। জাফর ইমাম জানান, গাড়িটি ছিল প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবর রহমানের। যদিও গাড়িতে নজিবুর রহমান ছিলেন না।
অন্যদিকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া সংসদে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করতে ও বের হতে পারেননি এমপি-মন্ত্রীরাও। এক পৌর মেয়রকেও আটকে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ির বিরুদ্ধে করা হয়েছে মামলা। অবস্থা বেগতিক দেখে সংসদ থেকে বের হয়ে আবারও তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে সংসদে প্রবেশ করেছে গাড়ি।
সরকারি গাড়ির মূল কাগজ গাড়িতে রাখার নির্দেশ: নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র যাচইয়ের কাজ নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার পর সরকারি গাড়ি চালকদের যাবতীয় মূল কাগজপত্র সঙ্গে রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ জানান, চালকদের লিখিত ও মৌখিকভাবে বলে দেওয়া হয়েছে গাড়ির মূল কাগজপত্র সঙ্গে রাখতে।
বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর গত ২৯ জুলাই থেকে রাজধানীতে বিক্ষোভ চালিয়ে আসা শিক্ষার্থীরা গত দুদিন ধরে রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চালক ও যানবাহনের লাইসেন্স দেখতে চাইছে। কাগজ দেখাতে না পারলে আটকে দেওয়া হচ্ছে গাড়ি।
সংশ্লিষ্ট সরকারি গাড়ির চালকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বলেছেন, তাদের লাইসেন্স থাকলেও সরকারি গাড়ি চালান বলে তা সঙ্গে নিয়ে বের হন না। গাড়ির কাগজপত্র অফিসেই থাকে।
মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ বলেন, এখন তো পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। ওদেরকে (গাড়ি চালকদের) বলে দিয়েছি এখন থেকে মূল কাগজপত্র সঙ্গে রাখতে, মূল কাগজই তারা সঙ্গে রাখবে।
গাড়ি চালানোর সময় লাইসেন্স সঙ্গে রাখার নিয়ম লাইসেন্সের পেছনেই স্পষ্ট করে লেখা থাকে। পাশাপাশি বীমার কাগজ ও ব্লুবুকও সঙ্গে রাখার কথা চালকদের। ট্রাফিক সার্জেন্ট চাইলে তা দেখাতে হবে।
রাজপথে তারোকারা: ছাত্রদের এমন আন্দোলনে প্রথমে ফেসবুকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন শোবিজের তারোকারা। কিন্তু চতুর্থ দিন থেকে ছাত্রদের সঙ্গে রাজপথেও নামেন তারোকারা। পঞ্চম দিনেও শুটিং রেখে রাজপথে দেখা গেল তারোকাদের। স্লোগানে স্লোগানে মুখর করল তারাও।
বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় আন্দোলনে সংহতি প্রকাশের জন্য উত্তরা হাউস বিল্ডিং চৌরাস্তায় দাঁড়ান শিল্পী, কলাকুশলীরা। তাদের মধ্যে ছিলেন অভিনেতা লুৎফর রহমান জর্জ, অভিনেত্রী মনিরা মিঠু, অর্ষা, নির্মাতা সাগর জাহান, চয়নিকা চৌধুরীসহ অনেকেই। তারা বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই আছেন উত্তরার রাস্তায়, অংশ নিচ্ছেন আন্দোলনে।
অভিনেত্রী মনিরা মিঠু বলেন, আমি আছি আমাদের রক্তাক্ত বাচ্চাদের পাশে রাজপথে।
এদিকে বুধবার শুটিং বন্ধ রেখে উত্তরায় আন্দোলন করতে দেখা যায় পরিচালক সকাল আহমেদ, অভিনয়শিল্পী জাকিয়া বারী মম, নাদিয়া আহমেদ, নওশীন, অর্ষা, তৌসিফকে। শাহবাগে মানববন্ধনে অংশ নিতে দেখা যায় অভিনয়শিল্পী জ্যোতিকা জ্যোতি, নওশাবাকে।
শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবীতে যা আছে: ১. বেপোরোয়া ড্রাইভারকে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। ২. নৌ-পরিবহন মন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করতে হবে। ৩. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে। ৪. প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাতে স্পিড ব্রেকার দিতে হবে। ৫. সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। ৬. শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে, থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে। ৭. শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৮. ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবে না। ৯. বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ০৩/০৮/২০১৮দারুন সমসাময়িক।
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ০৩/০৮/২০১৮সাথে আছি বন্ধু
নিয়মিত লিখুন