www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

কোটা সংস্কার

বাংলাদেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে হাইকোর্টের রায়ের কারণ দেখিয়ে সরকার বলছে যে, চাকরির মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কার সম্ভব নয়, সেটি আসলে একটি আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ, যা বাধ্যতামূলক নয়।

তবে সরকারের একজন মন্ত্রী বলছেন, একে তারা আদালতের নির্দেশনা বলেই মনে করেন, যা মানতে হবে।

কোটার বিষয়টি মীমাংসার জন্য সচিব পর্যায়ের একটি কমিটি এখন কাজ করেছে।

কোটা সংস্কার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুক্তি হচ্ছে: মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখতে হাইকোর্টের রায় থাকায় তাদের পক্ষে কোটা পদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়।

কিন্তু হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, মূল রায় অন্য বিষয়ে হলেও কোটা বিষয়ে হাইকোর্ট তখন কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল।

গত ২০১২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়স সংক্রান্ত একটি রিট করেছিলেন খাদ্য বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক মো. জামাল উদ্দিন শিকদার।

বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়স ৫৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করেছিলেন। ২০১০ সালে এ সংক্রান্ত একটি আইন হয়।

কিন্তু ২০১১ সালে অমুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবীদের বয়সও দু'বছর বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়। এর কারণ হিসাবে সরকার তখন কারো প্রতি বৈষম্য না করার কথা বলেছিল।



সংস্কারপন্থীদের বিক্ষোভ আন্দোলন

এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে মুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবীদের পক্ষে ঐ রিটটি করেন মি. শিকদার।

সেখানে মুল বক্তব্য ছিল যে, অমুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়সসীমা এক করায় তাদের যে সম্মান ও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল, তা ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

তবে আদালতে শুনানির সময় অ্যাটর্নি জেনারেল জানান যে, সরকার ইতোমধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির অবসরের বয়স সীমা একবছর বাড়িয়ে ৬০ বছর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সেই বয়স ২০১০ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর করতে হাইকোর্ট সরকারকে আদেশ দেন।

ঐ রায়ের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, পরিবহন এবং তাদের সন্তানদের চাকরিতে কোটা সংরক্ষণের বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

কোটার বিষয়ে বলা হয়, চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ৩০% কোটা কঠোরভাবে বহাল রাখতে হবে এবং প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেসব পদ খালি থাকবে।

সেই রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করে। আপিল বিভাগে শুনানির পর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিনামূল্যের চিকিৎসা ও পরিবহন সেবাসহ চাকরিতে কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে পদ খালি রাখার অংশটি বাদ দিয়ে দেন আপিল বিভাগ।

পর্যবেক্ষণ হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক একে রায় বলেই মনে করেন।



আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী

তিনি বিবিসিকে বলেন, "আমার বিবেচনায় এটা আর পর্যবেক্ষণ নয়, এটা একটা রায়। কারণ আদালত সরকারকে সেটা মানতে বলে দিয়েছেন। তাই এটা বাধ্যতামূলকভাবে মানতে হবে।"

তবে মন্ত্রী জানান, মুক্তিযোদ্ধা কোটা থেকে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা ভিত্তিতে প্রার্থী নেয়ার সুযোগ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। সরকার সে অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, প্রার্থী নেয়া হচ্ছে।

হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটা রক্ষার কথা বলা হলেও, নাতি-নাতনিদের সুযোগ পাওয়া প্রসঙ্গে কিছু বলা হয়নি, যা পরবর্তীতে সরকার বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সংযোজন করে।

এই বিষয়ে মি. হক বলেন, ''এটা সরকারি আদেশে হয়েছে। কেউ যদি মনে করেন সেটা ঠিক হয়নি, তাহলে হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন।''

"চিলড্রেন' বলতে আমরা 'গ্র্যান্ড চিলড্রেন' বুঝায় বলে মনে করি। কেউ যদি মনে করে যে সেটা বোঝায় না, তাহলে তারা আদালতে যেতে পারেন। আদালত ফয়সালা দিয়ে দেবেন।"

এতো পরে কেন সরকার বিষয়টি সামনে তুলে ধরেছে, জানতে চাইলে আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক বলেন, "বেটার লেট দ্যান নেভার। যখনি কোটা সংস্কারের জন্য কমিটি হয়েছে, তখনি আমি বিষয়টি তুলে ধরে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। এখন তারা (সচিব কমিটি) বিষয়টি বিবেচনা করবেন।"

দুহাজার বারো সালের হাইকোর্টের সেই রায় পুরোপুরি অনুসরণ না করায় পরে কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার একটি মামলা হয়, যা এখনো চলছে।

এমন প্রেক্ষাপটে কোটা সংক্রান্ত আদালতের পর্যবেক্ষণ আবার আলোচনায় উঠে এসেছে।



ড. শাহদীন মালিক, আইন বিশেষজ্ঞ

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ রায়ের সঙ্গে দেয়া পর্যবেক্ষণ সরকারের অনুসরণ না করার উদাহরণ রয়েছে, যদিও সেসব ক্ষেত্রে আইন ব্যবস্থার কোন নজির নেই।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী জানান, পর্যবেক্ষণ মানা না মানার বিষয়ে এখনো তার কাছে কোন মতামত চাওয়া হয়নি। সেরকম অভিমত চাইলে তিনি সরকারকে পরামর্শ দেবেন। এ বিষয়ে আর কোন কথা বলতে তিনি রাজি হননি।

আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলছেন, আদালতের সব পর্যবেক্ষণ মানা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।

তিনি বলেন, "যেসব পর্যবেক্ষণ রায়ের বিচার্য বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, সেগুলো মেনে চলার বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি। কিন্তু যেগুলো সরাসরি জড়িত নয়, সেগুলো মেনে চলার বাধ্যবাধকতা অনেক কম। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের দেশে রায়ের বেশিরভাগ পর্যবেক্ষণ সরকার মেনে চলে না।''

তিনি জানান, হাইকোর্টের ঐ রিটের মূল বিষয় ছিল চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ব্যাপারটি। তার সঙ্গে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা বা পরিবহন সেবা, সন্তানদের চাকরিতে কোটা সংরক্ষণের যে বিষয়গুলো এসেছে, সেটা মূল বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। যেসব বিষয় সরাসরি সম্পৃক্ত না, সেটি মানতে সরকার বাধ্যও নয়। বরং তার মতে বিচার্য বিষয়ের সঙ্গে জড়িত অনেক পর্যবেক্ষণও সরকার মানে না।

"এর একটি উদাহরণ হলো রিমান্ড ও গ্রেপ্তার সংক্রান্ত যে পর্যবেক্ষণ, অনেক কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলো গত কয়েকবছরে সেভাবে মানাও হয়নি," বলছেন ড. মালিক।




"এরকম পর্যবেক্ষণ সরকার না মানলে এক্ষেত্রে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই, সেটি না মানলেও কিছু হয়না। তবে বিষয়টি সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্পৃক্ত। উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ যদি সরকার মেনে চলে, তা আইনের শাসনের জন্য ভালো।''

"কিন্তু বাংলাদেশের সরকারগুলি এরকম পর্যবেক্ষণ খুব একটা মানে না।"

মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের চাকরিতে কোটার ক্ষেত্রে যে পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়েছে, সেটি অনুসরণে সরকারের বাধ্যবাধকতা নেই বললেই চলে বলে ব্যাখ্যা করছেন ড. শাহদীন মালিক।

বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে এখন ৫৬% কোটা রয়েছে।

শিক্ষার্থীরা পুরো কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করলেও, সংরক্ষিত কোটার মধ্যে বড় অংশ, ৩০% মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য সংরক্ষিত থাকায় সেটিই এখন আলোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

এর বাইরে নারীদের জন্য ১০%, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০%, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫% আর ১% প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত।

এই ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে গত কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। ১১ই এপ্রিল বাংলাদেশের পার্লামেন্টে দেয়া একটি ঘোষণায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পুরো কোটা ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেন।

এরপর বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য একটি সচিব কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

তবে গত ১২ই এপ্রিল তিনি আবার সংসদে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ থাকায় সেটি সরকারের পক্ষে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

কোটা ব্যবস্থা বাতিল চেয়ে এ বছরের মার্চ মাসে আদালতে একটি রিট করা হয়েছিল। সেই রিট খারিজ করে দিয়ে আদালত বলেছিলেন যে, এটা সরকারের বিষয়, আদালতের নয়।-বিবিসি বাংলা
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৫৮২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২০/০৭/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast