www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

দক্ষিণ এশিয়া

সর্বশেষ সার্ক সম্মেলন থেকে উপমহাদেশে জড়ো হয়ে থাকা অন্ধকারের ঘনঘটা ভেদ করে আশার বর্ণিল আলোক রশ্মি পরিদৃষ্ট হচ্ছে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমন, যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশগত বিপর্যয় মোকাবিলা, অভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার ও বিশেষায়িত জ্ঞানের আদান-প্রদানের অংগীকার দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত হয়েছে। তাছাড়া টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিমিত্তে বিভিন্ন সম্ভাবনা কাজে লাগাবার আগ্রহ পূর্বের চেয়ে আরও প্রগাঢ়ভাবে অনুভূত হয়েছে। বিশেষ করে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে পরস্পর সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের দরকার রয়েছে সে উপলব্ধি অত্র দেশসমূহের নেতৃবৃন্দ সম্ভবত প্রথমবারের মত সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়সমূহের পরিবর্তে উপমহাদেশের ভূপ্রকৃতি ও অর্থনৈতিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে তাকে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করলে রাষ্ট্রীক সীমারেখাকে প্রাথমিকভাবে সমন্বিত ও দ্রুত আঞ্চলিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে গণ্য করা যায়। তবে উদার ও মুক্ত মনে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করলে রাষ্ট্রীক সীমরেখা আঞ্চলিক সমন্বিত উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। প্রসঙ্গত বলা যায়, উক্ত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে না পারলে উপমহাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা সম্ভবত স্বপ্নের জগতেই থেকে যাবে।
যে সকল জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক চলকগুলো উপমহাদেশকে ৫টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করেছিল সেগুলো কী আদৌ ‘নিউট্রাল’ করা সম্ভব? উপমহাদেশের ইতিহাসের দিকে সংক্ষিপ্তভাবে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে অত্র এলাকায় কিছু বাস্তব পরিস্থিতি তথা ধর্মীয, সাংস্কৃতিক, নৃ-তাত্ত্বিক পার্থক্যই মূলত ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে বেড়ে ওঠার রোড ম্যাপ তৈরি করেছিল। শুধু তাই নয়, উল্লেখিত দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিহাসও বড়ই তিক্ত। কিন্তু ইতিহাসের নিগড়ে সংকীর্ণতার কূপম-ুকতার মধ্যে চিরকার আটকা পড়ে থাকতেই বা হবে কেনো? মানবেতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে গোষ্ঠীগত চেতনা, জাতিবোধ, ধর্মীয গ-ী ইত্যাদি বারবার বদলে গিয়েছে। এমন কী নৃ-গোষ্ঠীক চেতনাও বৃহত্তর স্বার্থে সমন্বিত হয়েছে। অনেক উদাহরণ রয়েছে যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। মানুষের স্বভাবসুলভ যুক্তিবাদী মনোভাব, উন্নয়ন আকাক্সক্ষা ও পরিপার্শ্বিক তথা বৈশ্বিক চেতনার বিকাশ মূলত এবং আত্মপরিচয়ের গ-ী-ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় ও অঞ্চলের বেড়াজাল ছিন্ন করে বৃহত্তর মানবকল্যাণমুখী হয়ে গিয়েছে। তবে নানাবিধ কারণে এরূপ পরিবর্তন সর্বত্র সমান তালে গিয়ে যায়নি সত্য।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কারণে রাষ্ট্রের উন্মেষ ঘটেছে। তবে রাষ্ট্রীক চেতনা পরিসীমা চিরায়ত নয় বরং নিয়ত পরিবর্তনশীল। রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে, বড় হয়েছে, ছোট হয়েছে আবর ভেঙ্গেও গিয়েছে। তবে এসব ভাঙ্গা-গড়ার কাজে সব সময় যে যৌক্তিক কোন কারণকাজ করেছৈ এমনও বলা যায় না। অকেক সময় নেতৃত্বদানকারী এলিটদের ইগো, মেজাজ-মর্জি, আর্থিক স্বার্থ, সামজিক ও রাজনৈতিক প্রাপ্তি বা বঞ্চনার হিসাব-নিকাশ এসব ক্ষেত্রে নিয়ামক বা মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে। সে যাই হোক না কেনো, মানুষ যেমন একা কখনও স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়, তেমনি বর্তমান হাই টেকনোলজি এবং স্যাটেলাইন দ্বারা প্রভুত্বকারী বিশ্বে কোন রাষ্ট্র বা জাতির পক্ষে একলা চলো নীতি নিয়ে অগ্রসর হওয়া প্রায় অসম্ভব। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অতীত ইতিহাসে বিভিন্ন কারণে জাতি রাষ্ট্রভিত্তিক ভৌগোলিক ঠিকানায় কট্টোর অবস্থান বজায় রাখার মনমানসিকতার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিংশ শতাব্দীতে গড়ে ওঠা সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী আদর্শানুপ্রাণীত হয়ে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, লিবিয়া, কিউবা একলা চলো নীতি থেকে বহু বহু যোজন দূরে সরে আসতে শুরু করেছে। এর বহু কারণও রয়েছে। মানুষের স্বভাবসুলভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করে সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী স্বর্গরাজ্য গড়ার প্রচেষ্টা যেমন অবাস্তব ছিলো, তেমনি দ্রুত চলমান পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথা শিল্পায়িত এবং মুক্ত বাজারমুখী শিল্পায়ন-উত্তর বিশ্বে টিকে থাকার জন্য অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাহিদা এবং দাবির ফলে পূর্বের অবস্থান পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা অনেকটা আবশ্যকীয়রূপে দেখা দেয়।
ঠাণ্ডা যুদ্ধোত্তর বিশ্ব এখন এক মেরুমুখী হলেও বাজার দখলের পারস্পরিক প্রতিযোগিতার কারণে অঞ্চলভিত্তিক জোট ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। কারণ তীব্র প্রতিযোগিতামুখর বিশ্বে এককভাবে কোন রাষ্ট্রের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া কষ্টকর। এ প্রয়োজনবোধদ থেকে বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক জোট গঠিহ হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত প্রভাবশালী ও দুর্দ- প্রতাপশালী দেশও আজ ‘নাফটা’ গঠন করেছে। ইউরোপের প্রভাবশালী দু’টো দেশ ব্রিটেন এবং ফ্রান্স তাদের মধ্যেকার ঐতিহাসিক শত্রুতামূলক সম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক ‘সুপ্রিমেসির’ ইগো থেকে আপাতত সরে এসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকার নিচে সমবেত হয়েছে। চালু হয়েছে ইউনিয়নের একক মুদ্রা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিকাশগামী দেশগুলো ‘আসিয়ান’ এর ভেতর দিয়ে আঞ্চলিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে সচেষ্ট হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? দক্ষিণ এশিয়ার চালচিত্র মূলত প্রধান প্রধান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, কখনও কখনও আক্রমণাত্মক মনোভাব, যুদ্ধ এবং অন্তত দু’টি রাষ্ট্র-ভারত ও পাকিস্তানের হাতে তথাকথিত শক্তির ভারসাম্য তত্ত্বের নিগড়ে পারমাণবিক মারণাস্ত্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে বিরোধ, সীমান্ত উত্তেজনা, একদেশের সন্ত্রাসীদের হীন রাজনৈতিক লক্ষ্যে অন্যদেশ কর্তৃক আশ্রয়-প্রশ্রয় এমন কী ট্রেনিং ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করার অভিযোগ ইত্যাদির মত নষ্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এতদ্ব্যতীত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাসের বেলাতেও পারস্পরিক সম্পর্ক বিশেষ করে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে পার্শ্ববর্তী দেশকে শত্রুদেশ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচারভিযান চালানো হয়। যেমন: ভারতের দলগুলো পাকিস্তানকে ড্যামেজ করে নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। আবার পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ভারতকে ‘ড্যামেজ’ করে প্রচারণা চালিয়ে ভোট বাণিজ্যে লাভবান হতে চায়। নেপালের সঙ্গে ভারতের এবং নেপালের সঙ্গে ভুটানের পারস্পরিক সম্পর্কও সস্তা রাজনৈতিক শ্লোগান দ্বারা প্রভাবিত। অর্থাৎ উপমহাদেশে ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার ইস্যুগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত আঞ্চলিক উন্নয়নের প্রয়াস উপেক্ষিত হয়েছে বারবার।
তবে ১৪তম সার্ক সম্মেলনে কিছু বিপরীত চিত্র আমরা দেখতে পাই। দীর্ঘদিনের জমে থাকা পুঁতিগন্ধময় পরিস্থিতিকে টপকিয়ে শুরু করেছে। সম্ভবত বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকে নষ্ট ভোটের অপরাজনীতির বদলে রাজনীতিকে সুষ্ঠু কাঠামোমুখী করার সাহসী ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব পরিবর্তনের পালে নতুন হাওয়া লাগিয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নোংরা রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে এসে উভয়ের উন্নয়নের লক্ষ্যে সত্যিকার ও বাস্তব উপায় উদ্ভাবনের জন্য উদার ও খোলামেলা মনোভাবস সৃষ্টি হচ্ছে। তা’ছাড়া সম্প্রতি পাকিস্তান এবং ভারতের নেতৃত্ব হয়তো উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন যে, দীর্ঘদিনের এবং অনেকটা কৃত্রিমভাবে তৈরি পরস্পর শত্রু ভাবাপন্ন মনোভাব উভয়ের জন্য ক্ষতি বৈ লাভ বয়ে আনেনি। তাই উভয় দেশ কিছুটা হলেও পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করেছে। এর উদাহরন হচ্ছে কিছুদিন আগে দিল্লীর অদূরে পাকিস্তানগামী ট্রেনের বগিতে আত্মঘাতী হামলার কারণ উদঘাটনের জন্য উভয় দেশ সম্মিলিত প্রয়াস নিয়েছে। জঙ্গি হামলার মতো ঘটনা উভয় দেশকে একইভাবে স্পর্শ করতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে জঙ্গি দমনের প্রশ্নে সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। উপমহাদেশের বিভিন্ন বিষয়াদিতে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্ক পর্যবেক্ষণ ও স্বার্থও সম্ভবত ‘একক দক্ষিণ এশিয়া থিসিসের নিমিত্তে কাজ করে যাচ্ছে। নেপালের মাওবাদী গেরিলাদের সরকারের অন্তর্ভুক্ত করে রাজনৈতিক ঐক্য ও অভ্যন্তরীণ বিবাদের মীমাংসা এবং সে সাথে গণতন্ত্রায়নের অগ্রযাত্রা উপমহাদেশের ঐক্যের জন্য সম্ভবত পাথেও হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব বিবেচনায় এ সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নোংরা রাজনীতির বেড়াজালে আবদ্ধ দক্ষিণ এশিয়াকে ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেখে সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই। হিমালয় থেকে ভারত মহাসাগরকে অর্থনৈতিক জোন হিসেবে বিবেচনায় রেখে পানিসম্পদের উন্নয়ন ও সমানুপাতিক বন্টনের জন্য সম্মিলিত মহাপরিকল্পনা নেয়া উচিত। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও ঐ একই নীতি নিতে হবে। তাছাড়া বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে ভুটানের অপার সম্ভাবনাকে সম্মিলিতভাবে কাজে লাগানো জরুরি। সড়ক ও ট্রেন যোগাযোগের ক্ষেত্রে উপমহাদেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত সংযুক্ত করতে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। সমুদ্র বন্টন ব্যবহার ও ট্রানজিট প্রশ্নেও এক ও অভিন্ন নীতি গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। কৃষি ও শিল্প পণ্য চলাচল কৃষি ও শিল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় মনোভাব থাকতে হবে। শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশের মাধ্যমে অপরাজনীতি সৃষ্ট পরস্পরের মধ্যেকার বিভেদ ও বিদ্বেষ দূর করতে হবে। এভাবে এগিয়ে গেলে হযতো দু’এক দশকের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারবে।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৮৭২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৪/০৪/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast