নদী মৃত্যু
নদ-নদী, খাল-বিল, ঝর্ণাধারা এসব বাংলার মানুষের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। বাঙালির জীবন মানে নদী। এ নদী না হলে বাঙালির জীবন বিবর্ণ হয়ে পড়ে। সুখ হারিয়ে যায়। প্রকৃত অর্থে বাঙালির জীবনকে বর্ণিল করতে নদীর অবদান অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে নদী। দিনদিন আমরা নদীহীনতার দিকে ধাবিত হচ্ছি। মরুময়তা আমাদের ক্রমাগত গ্রাস করে ফেলছে।
গত ২৩ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশের নদ-নদীসমূহের দুর্দশার ওপর ধারাববাহিক রিপোর্ট ছাপা শুরু করেছে। একই তারিখে দৈনিক সংগ্রামও ভারতীয় জলাগ্রাসন এবং মাগুরার নবগঙ্গা-কুমারসহ ১০ জেলার ২৫ টি নদ-নদীর বিপন্ন অবস্থা নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এসব সচিত্র রিপোর্ট বলছে, নদীবহুল বাংলাদেশ এখন নদীহীন দেশে পরিণত হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে এখানকার জীববৈচিত্র্য। পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবনধারা।
পত্রিকাটি লিখেছে, একটা সময় ছিল বাংলাদেশকে বলা হতো নদীমাতৃক। এখন সবকিছু বদলে গেছে। এখন সেই নদীও নেই। পানিও নেই। নদী শুকিয়ে মাঠ হয়েছে। সেই মাঠে কোথাও ধু ধু বালুচর। কোথাও ফসলের মাঠ। পালতোলা নৌকা আর চোখে পড়ে না কোথাও। উত্তরাঞ্চলের সবনদীর চিত্রই ভয়াবহ। শুধু উত্তরাঞ্চল কেন, সারাদেশ থেকেই নদী এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
উল্লেখ্য, কুড়িগ্রামের ১৬ নদী পানিশূন্য। নীলফামারীর ২২ নদী আবাদি জমি। দিনাজপুরের পুনর্ভবায় খেলার মাঠ। অস্তিত্ব সংকটে ময়মনসিংহের অর্ধশত নদ-নদী। এগুলো হচ্ছে পত্রিকাটির সিরিজ রিপোর্টের প্রথম দিনের সাবহেডিংস।
দৈনিক সংগ্রাম হেডিং করেছে, ভারতের পানি আগ্রাসনে মাগুরার নবগঙ্গা-কুমারসহ ১০ জেলার ২৫ নদী মৃতপ্রায়। ৪ কোটি মানুষ পড়েছেন জীবন-মরণ সমস্যায়। তার মানে হচ্ছে দেশের সবকটি নদ-নদী এখন বিপন্ন। কোনও নদীরই আর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ নেই। দেশের প্রধান নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা অন্যতম। কিন্তু সে পদ্মা আর পদ্মা নেই। ফারাক্কা দিয়ে একতরফা পানিপ্রত্যাহারের ফলে এটিও ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে। বর্ষাকালে পদ্মায় পানি আসলেও শুকনো মওসুমে প্রায় পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। ভেঁড়ামারার ভাটিতে পদ্মার বুক দিয়ে গরুগাড়ি চলাচল করতে দেখা যায়। এতেই বোঝা যায় ফারাক্কা পদ্মাকে কীভাবে গ্রাস করেছে।
শুধু পদ্মা নয়। এর অববাহিকাজুড়ে যেসব নদ-নদী ছিল সেগুলোও মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে। মাগুরাসহ খুলনা বিভাগের ১০ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদীসমূহের প্রায় দেড়হাজার কিলোমিটার তলদেশ ইতোমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এলাকার পরিবেশ এখন চরমভাবাপন্ন। সেচসুবিধা ধ্বংস। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিম্নমুখী। কৃষিকাজ ব্যাহত। মৎস্যসম্পদ ধ্বংস। পশুসম্পদ উজাড়। নৌযোগাযোগ নেই। অকাল বন্যা দেখা দিচ্ছে অল্প বৃষ্টিতেই প্রতিবছর। অর্থাৎ বিরাট এ এলাকার জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে নদী শুকিয়ে যাবার ফলে।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রায় নদীহীন হতে চলেছে। নদী দখল করে মানুষ তৈরি করছে বাড়িঘর। শুকনো নদীতে আবাদ হচ্ছে ধানসহ বিভিন্ন ফসল। জেলার কোনও নদীতেই এখন স্রোত নেই। সবগুলোই মরা খাল। প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, জেলার নদীগুলোকে স্রোতধারায় ফেরাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু কখন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে তার আলামত নেই।
উল্লেখ্য, ঠাকুরগাঁও জেলা ২৫.৪০ থেকে ২৬.১০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.০৫ থেকে ৮৮.৩৬ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। বরেন্দ্র ও পুরাতন হিমালয় পাদভূমির অন্তর্ভুক্ত এ জেলার আয়তন ১,৮০৯.৫২ বর্গ কিলোমিটার। এর জনসংখ্যা প্রশাসনের মতে ১৪,৪৪,৭৮২। কিন্তু বেসরকারি সংস্থার হিসেবে জেলার জনসংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ।
জেলার ১৩ টি নদীর মধ্যে টাঙ্গন, ঢেপা, শুক, ভুল্লি ও সেনুয়া এ ৫ টি খননের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানানো হয়। এ খনন সম্পন্ন হলে নদীগুলো গতি ফিরে পাবে। তবে সবই ভবিষ্যদ্বাণী।
রাজশাহীর মানচিত্র থেকে ৭ নদী হারিয়ে গেছে। তীব্র খরায় ১৩ নদীর মধ্যে ১১ টি পানিশূন্য। রংপুরের ১৩ টি নদীও অস্তিত্বসংকটে। নদী বাঁচানোর কোনও উদ্যোগ নেই। লালমনিরহাটে পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায় ১৩ নদী। কুষ্টিয়ার ৮ নদ-নদী এখন মরা খাল। জয়পুরহাটের ৪ নদী বেদখল হয়ে গেছে। চলছে চাষাবাদ। পঞ্চগড় জেলার অধিকাংশ নদী নেই। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দীর্ঘতম ও ভয়াবহ ভৈরবও নদও এখন মরণাপন্ন। হেঁটে পাড়ি দেয়া যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা। সিলেটের পিয়াইন নদীর কান্না কেউ শোনে না। জামালপুরে অস্তিত্বসংকটে ঝিনাই ও সুবর্ণখালী নদী। হারিয়ে যাচ্ছে নাটোরের ৩২ টি নদ-নদী। সাতক্ষীরার ২৭ নদী অস্তিত্ব সংকটে। নওগাঁর ৭ নদীই এখন মরা খাল। মাদারীপুরে নদীগুলো বেহাল হুমকিতে নৌপথ। কুমিল্লাতে দখলে রুগ্ন ডাকাতিয়া হারিয়ে যাচ্ছে কালাডুমুর। এগুলো হচ্ছে নদী বিষয়ক রিপোর্টের হেডিং-সাবহেডিং। অর্থাৎ আমাদের নদীমাতৃক দেশটি অচিরেই নদীহীন জনপদ তথা মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে।
পৃথিবীর প্রায় সব শহর, বন্দর ও নগর নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। এখনতো সমুদ্রের ওপরই গড়ে তোলা হচ্ছে অসংখ্য হাইরাইজ বিল্ডিংসহ আধুনিক নগরী। অর্থাৎ নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠে শহর, বন্দর ও হাটবাজার। নদী ব্যতীত মানুষের জীবন অচল। রেল, বাস ইত্যাদি চালু হবার আগে নৌকা বা জাহাজই ছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন। নদীপথ ব্যবহার ব্যতীত মানুষের চলাচল, বাণিজ্য কিছুই চলতো না।
নদী হচ্ছে গ্রামবাংলার জীবন। নদী ঘিরেই আবর্তিত হয় মানুষের জীবনচক্র। তাই নদীর তীরে বসে হাট। গড়ে ওঠে কলকারখানা ও নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান। চাষাবাদও হয় নদীর তীরবর্তী ভূমিতে। কারণ চাষাবাদের জন্য প্রয়োজন হয় পানির। কম করে হলেও সেচ দিতে হয় নদীর পানি থেকে। কাজেই নদী ব্যতীত জমিতে সেচের কথা ভাবাই যায় না। আগেও কৃষিজমিতে সেচ দিতে হতো। এখনও হয়। তাই নদী ছাড়া পানি কোথা থেকে আসবে? তাই নদী জীবন। নদীই মরণ। নদী ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাতীত।
পদ্মা, ব্রহ্মপুর, করতোয়াসহ ৫৪ টি নদী প্রতিবেশী ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এসব অভিন্ন নদীর প্রায় প্রত্যেকটি বাঁধ, গ্রোয়েন নির্মাণ করে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারবার উদ্যোগ নিয়েছে। এনিয়ে অনেক দেনদরবার করেও ভারত কোনও কথা শুনতে চাইছে না। ফলে এককালের সুজলা সুফলা বাংলাদেশ এখন দ্রুত মরুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রকৃতি হয়ে উঠছে চরম ভাপাপন্ন। এবার দেশে শীত পড়েছে ৭০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরমও পড়বে সবচেয়ে বেশি বলে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন। অর্থাৎ এর প্রভাব যেমন মানুষসহ জীবজন্তুর ওপর পড়বে, তেমনই চাষাবাদও হবে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রকৃতি হবে বিরূপ। আর এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত কর্তৃক গঙ্গা নদীতে ফারাক্কাসহ অভিন্ন নদীর প্রায় সবকটিতে উজানে বাঁধ ও গ্রোয়েন নির্মাণ করে একতরফা পানিপ্রত্যাহার। অভিন্ন নদীসমূহের ভারতীয় অংশে পানি থৈ থৈ করলেও এপারের অংশের সব নদীর বুক করছে খাঁ খাঁ। এ হচ্ছে আমাদের নদীমাতৃক দেশের বর্তমান ট্র্যাজেডি।
ভূগর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে যাবার ফলে জমির ঊর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত সার। এতেও জমির স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে। কমে যাছে উৎপাদন। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় আমরা কতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি তা বলে শেষ করবার মতো নয়।
নদ-নদী, বিলপুকুর শুকিয়ে যাওয়াতে মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। মাছ যেমন পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনই পাখিসহ বন্য প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। সজারু, বনবেড়াল, বেজি, গুঁইসাপ, অজগর, শেয়াল, খাটাস, বনমোরগ, বিলুপ্ত হবার পথে। নীলগাই নামে ছোট হরিণ দেখা যেতো উত্তরাঞ্চলে এক সময়। সেটা বিলুপ্ত হয়েছে কয়েক দশক আগেই। কারণ এসব বন্য পশুপাখি জীবন বাঁচানোর জন্য খাদ্য ও পানি পাচ্ছে না মোটেও।
উত্তরাঞ্চলের জেলেরা বেকার। চাষের পুকুরে মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ হয় না। একসময় মৎস্যজীবীরা নদ-নদী ও বিলেঝিলে অবাধে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারতো। কিন্তু এখন সে নদী নেই। মাছ ধরবার জায়গাও নেই। তাই তারা অন্য পেশা বেছে নিচ্ছে বাধ্য হয়ে।
যাই হোক, পানির অপর নাম জীবন। আর পানির অন্যতম উৎস হল নদী। দেশের নদ-নদী রক্ষার্থে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রক্ষা করতে হবে পরিবেশ। নদীকে নাব্য রাখতে করতে হবে ক্যাপিটাল ড্রেজিং। আর বর্ষার পানি ধরে রাখবার ব্যবস্থাও নিতে হবে। অন্যথায় দেশের নদীগুলো স্থায়ীভাবে মরে যাবে। আর নদ-নদীর মৃত্যু ঘটলে মানুষসহ অন্য প্রাণিকুলও হবে বিপন্ন। তাই নদীর মৃত্যু মানে জীবনের বিনাশ এ কথা যতো তাড়াতাড়ি বুঝতে সক্ষম হবো ততোই মঙ্গল।
গত ২৩ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশের নদ-নদীসমূহের দুর্দশার ওপর ধারাববাহিক রিপোর্ট ছাপা শুরু করেছে। একই তারিখে দৈনিক সংগ্রামও ভারতীয় জলাগ্রাসন এবং মাগুরার নবগঙ্গা-কুমারসহ ১০ জেলার ২৫ টি নদ-নদীর বিপন্ন অবস্থা নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এসব সচিত্র রিপোর্ট বলছে, নদীবহুল বাংলাদেশ এখন নদীহীন দেশে পরিণত হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে এখানকার জীববৈচিত্র্য। পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবনধারা।
পত্রিকাটি লিখেছে, একটা সময় ছিল বাংলাদেশকে বলা হতো নদীমাতৃক। এখন সবকিছু বদলে গেছে। এখন সেই নদীও নেই। পানিও নেই। নদী শুকিয়ে মাঠ হয়েছে। সেই মাঠে কোথাও ধু ধু বালুচর। কোথাও ফসলের মাঠ। পালতোলা নৌকা আর চোখে পড়ে না কোথাও। উত্তরাঞ্চলের সবনদীর চিত্রই ভয়াবহ। শুধু উত্তরাঞ্চল কেন, সারাদেশ থেকেই নদী এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
উল্লেখ্য, কুড়িগ্রামের ১৬ নদী পানিশূন্য। নীলফামারীর ২২ নদী আবাদি জমি। দিনাজপুরের পুনর্ভবায় খেলার মাঠ। অস্তিত্ব সংকটে ময়মনসিংহের অর্ধশত নদ-নদী। এগুলো হচ্ছে পত্রিকাটির সিরিজ রিপোর্টের প্রথম দিনের সাবহেডিংস।
দৈনিক সংগ্রাম হেডিং করেছে, ভারতের পানি আগ্রাসনে মাগুরার নবগঙ্গা-কুমারসহ ১০ জেলার ২৫ নদী মৃতপ্রায়। ৪ কোটি মানুষ পড়েছেন জীবন-মরণ সমস্যায়। তার মানে হচ্ছে দেশের সবকটি নদ-নদী এখন বিপন্ন। কোনও নদীরই আর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ নেই। দেশের প্রধান নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা অন্যতম। কিন্তু সে পদ্মা আর পদ্মা নেই। ফারাক্কা দিয়ে একতরফা পানিপ্রত্যাহারের ফলে এটিও ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে। বর্ষাকালে পদ্মায় পানি আসলেও শুকনো মওসুমে প্রায় পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। ভেঁড়ামারার ভাটিতে পদ্মার বুক দিয়ে গরুগাড়ি চলাচল করতে দেখা যায়। এতেই বোঝা যায় ফারাক্কা পদ্মাকে কীভাবে গ্রাস করেছে।
শুধু পদ্মা নয়। এর অববাহিকাজুড়ে যেসব নদ-নদী ছিল সেগুলোও মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে। মাগুরাসহ খুলনা বিভাগের ১০ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদীসমূহের প্রায় দেড়হাজার কিলোমিটার তলদেশ ইতোমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এলাকার পরিবেশ এখন চরমভাবাপন্ন। সেচসুবিধা ধ্বংস। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিম্নমুখী। কৃষিকাজ ব্যাহত। মৎস্যসম্পদ ধ্বংস। পশুসম্পদ উজাড়। নৌযোগাযোগ নেই। অকাল বন্যা দেখা দিচ্ছে অল্প বৃষ্টিতেই প্রতিবছর। অর্থাৎ বিরাট এ এলাকার জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে নদী শুকিয়ে যাবার ফলে।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রায় নদীহীন হতে চলেছে। নদী দখল করে মানুষ তৈরি করছে বাড়িঘর। শুকনো নদীতে আবাদ হচ্ছে ধানসহ বিভিন্ন ফসল। জেলার কোনও নদীতেই এখন স্রোত নেই। সবগুলোই মরা খাল। প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, জেলার নদীগুলোকে স্রোতধারায় ফেরাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু কখন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে তার আলামত নেই।
উল্লেখ্য, ঠাকুরগাঁও জেলা ২৫.৪০ থেকে ২৬.১০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.০৫ থেকে ৮৮.৩৬ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। বরেন্দ্র ও পুরাতন হিমালয় পাদভূমির অন্তর্ভুক্ত এ জেলার আয়তন ১,৮০৯.৫২ বর্গ কিলোমিটার। এর জনসংখ্যা প্রশাসনের মতে ১৪,৪৪,৭৮২। কিন্তু বেসরকারি সংস্থার হিসেবে জেলার জনসংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ।
জেলার ১৩ টি নদীর মধ্যে টাঙ্গন, ঢেপা, শুক, ভুল্লি ও সেনুয়া এ ৫ টি খননের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানানো হয়। এ খনন সম্পন্ন হলে নদীগুলো গতি ফিরে পাবে। তবে সবই ভবিষ্যদ্বাণী।
রাজশাহীর মানচিত্র থেকে ৭ নদী হারিয়ে গেছে। তীব্র খরায় ১৩ নদীর মধ্যে ১১ টি পানিশূন্য। রংপুরের ১৩ টি নদীও অস্তিত্বসংকটে। নদী বাঁচানোর কোনও উদ্যোগ নেই। লালমনিরহাটে পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায় ১৩ নদী। কুষ্টিয়ার ৮ নদ-নদী এখন মরা খাল। জয়পুরহাটের ৪ নদী বেদখল হয়ে গেছে। চলছে চাষাবাদ। পঞ্চগড় জেলার অধিকাংশ নদী নেই। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দীর্ঘতম ও ভয়াবহ ভৈরবও নদও এখন মরণাপন্ন। হেঁটে পাড়ি দেয়া যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা। সিলেটের পিয়াইন নদীর কান্না কেউ শোনে না। জামালপুরে অস্তিত্বসংকটে ঝিনাই ও সুবর্ণখালী নদী। হারিয়ে যাচ্ছে নাটোরের ৩২ টি নদ-নদী। সাতক্ষীরার ২৭ নদী অস্তিত্ব সংকটে। নওগাঁর ৭ নদীই এখন মরা খাল। মাদারীপুরে নদীগুলো বেহাল হুমকিতে নৌপথ। কুমিল্লাতে দখলে রুগ্ন ডাকাতিয়া হারিয়ে যাচ্ছে কালাডুমুর। এগুলো হচ্ছে নদী বিষয়ক রিপোর্টের হেডিং-সাবহেডিং। অর্থাৎ আমাদের নদীমাতৃক দেশটি অচিরেই নদীহীন জনপদ তথা মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে।
পৃথিবীর প্রায় সব শহর, বন্দর ও নগর নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। এখনতো সমুদ্রের ওপরই গড়ে তোলা হচ্ছে অসংখ্য হাইরাইজ বিল্ডিংসহ আধুনিক নগরী। অর্থাৎ নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠে শহর, বন্দর ও হাটবাজার। নদী ব্যতীত মানুষের জীবন অচল। রেল, বাস ইত্যাদি চালু হবার আগে নৌকা বা জাহাজই ছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন। নদীপথ ব্যবহার ব্যতীত মানুষের চলাচল, বাণিজ্য কিছুই চলতো না।
নদী হচ্ছে গ্রামবাংলার জীবন। নদী ঘিরেই আবর্তিত হয় মানুষের জীবনচক্র। তাই নদীর তীরে বসে হাট। গড়ে ওঠে কলকারখানা ও নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান। চাষাবাদও হয় নদীর তীরবর্তী ভূমিতে। কারণ চাষাবাদের জন্য প্রয়োজন হয় পানির। কম করে হলেও সেচ দিতে হয় নদীর পানি থেকে। কাজেই নদী ব্যতীত জমিতে সেচের কথা ভাবাই যায় না। আগেও কৃষিজমিতে সেচ দিতে হতো। এখনও হয়। তাই নদী ছাড়া পানি কোথা থেকে আসবে? তাই নদী জীবন। নদীই মরণ। নদী ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাতীত।
পদ্মা, ব্রহ্মপুর, করতোয়াসহ ৫৪ টি নদী প্রতিবেশী ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এসব অভিন্ন নদীর প্রায় প্রত্যেকটি বাঁধ, গ্রোয়েন নির্মাণ করে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারবার উদ্যোগ নিয়েছে। এনিয়ে অনেক দেনদরবার করেও ভারত কোনও কথা শুনতে চাইছে না। ফলে এককালের সুজলা সুফলা বাংলাদেশ এখন দ্রুত মরুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রকৃতি হয়ে উঠছে চরম ভাপাপন্ন। এবার দেশে শীত পড়েছে ৭০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরমও পড়বে সবচেয়ে বেশি বলে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন। অর্থাৎ এর প্রভাব যেমন মানুষসহ জীবজন্তুর ওপর পড়বে, তেমনই চাষাবাদও হবে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রকৃতি হবে বিরূপ। আর এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত কর্তৃক গঙ্গা নদীতে ফারাক্কাসহ অভিন্ন নদীর প্রায় সবকটিতে উজানে বাঁধ ও গ্রোয়েন নির্মাণ করে একতরফা পানিপ্রত্যাহার। অভিন্ন নদীসমূহের ভারতীয় অংশে পানি থৈ থৈ করলেও এপারের অংশের সব নদীর বুক করছে খাঁ খাঁ। এ হচ্ছে আমাদের নদীমাতৃক দেশের বর্তমান ট্র্যাজেডি।
ভূগর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে যাবার ফলে জমির ঊর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত সার। এতেও জমির স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে। কমে যাছে উৎপাদন। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় আমরা কতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি তা বলে শেষ করবার মতো নয়।
নদ-নদী, বিলপুকুর শুকিয়ে যাওয়াতে মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। মাছ যেমন পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনই পাখিসহ বন্য প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। সজারু, বনবেড়াল, বেজি, গুঁইসাপ, অজগর, শেয়াল, খাটাস, বনমোরগ, বিলুপ্ত হবার পথে। নীলগাই নামে ছোট হরিণ দেখা যেতো উত্তরাঞ্চলে এক সময়। সেটা বিলুপ্ত হয়েছে কয়েক দশক আগেই। কারণ এসব বন্য পশুপাখি জীবন বাঁচানোর জন্য খাদ্য ও পানি পাচ্ছে না মোটেও।
উত্তরাঞ্চলের জেলেরা বেকার। চাষের পুকুরে মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ হয় না। একসময় মৎস্যজীবীরা নদ-নদী ও বিলেঝিলে অবাধে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারতো। কিন্তু এখন সে নদী নেই। মাছ ধরবার জায়গাও নেই। তাই তারা অন্য পেশা বেছে নিচ্ছে বাধ্য হয়ে।
যাই হোক, পানির অপর নাম জীবন। আর পানির অন্যতম উৎস হল নদী। দেশের নদ-নদী রক্ষার্থে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রক্ষা করতে হবে পরিবেশ। নদীকে নাব্য রাখতে করতে হবে ক্যাপিটাল ড্রেজিং। আর বর্ষার পানি ধরে রাখবার ব্যবস্থাও নিতে হবে। অন্যথায় দেশের নদীগুলো স্থায়ীভাবে মরে যাবে। আর নদ-নদীর মৃত্যু ঘটলে মানুষসহ অন্য প্রাণিকুলও হবে বিপন্ন। তাই নদীর মৃত্যু মানে জীবনের বিনাশ এ কথা যতো তাড়াতাড়ি বুঝতে সক্ষম হবো ততোই মঙ্গল।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ২৯/০৯/২০২৩তথ্যসমৃদ্ধ
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ২০/০৪/২০১৮জানা ছিল না।
-
আবু সাইদ লিপু ০২/০৪/২০১৮তথ্যবহুল
-
আনাস খান ০১/০৪/২০১৮ধন্যবাদ