www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অনিরাপদ বোতলজাত পানিও

দীর্ঘমেয়াদী ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, বমিভাব, পেট ব্যথা, জ্বর-ঠান্ডার মতো উপসর্গের জন্য দায়ী ওই কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া। কলিফর্ম মানুষের রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে আক্রান্ত হয় কিডনি!

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি ইউনিটের পরিচালক ড. মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে ওই গবেষণা পরিচালিত হয়।

বর্তমানে জারে করে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে পানি। ওই জারের পানি ও বোতলজাত পানির গুণাগুণ নিয়ে ওই গবেষণা করা হয়। মনিরুল ইসলাম জানান, এসজিএস ল্যাবরেটরিতে এসব পানির নমুনা পরীক্ষা করা হয়।

মনিরুল ইসলাম জানান, ৩৫টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি ও জার পানির ২৫০টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তিনি আরো জানান, রাজধানীর ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেট, চকবাজার, সদরঘাট, কেরাণীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালী, গুলশান, বনানী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী, আমিনবাজার, আশুলিয়া ও সাভার এলাকা থেকে জারের পানি নিয়ে ওই গবেষণা করা হয়।



পানিতে কী আছে জানার উপায় নেই

নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে একটি নির্দিষ্ট মান দিয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। পানি বাজারজাত করার ক্ষেত্রে ওই বিএসটিআইয়ের কিছু নির্ধারিত মাত্রা আছে। যাকে বলা হয় বিডিএস (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস)।

মনিরুল ইসলাম জানান, গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিংহভাগ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মনগড়াভাবে উপাদানগুলোর মাত্রা বা পরিমাণ বোতলের গায়ে উল্লেখ করেছে। এছাড়া বোতলজাত পানিতে কোনো কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার মতো কোনো দূষণ পদার্থ আছে কিনা তা জানার উপায় নেই।

অন্যদিকে, জারের গায়ে খনিজ উপাদানের উপস্থিতি বা গুণগত মান সম্পর্কিত কোনো লেবেলই থাকে না। ফলে পানির গুণাগুণ সম্পর্কে কোনো তথ্যই পায় না ভোক্তারা।

জারের পানিতে কলিফর্ম

ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শতভাগ জারের পানিতেই কলিফর্মের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসব জারের প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে টোটাল কলিফর্মের মাত্রা ছিল ১৭ ও ১৬০০ মিলিলিটার এমপিএন (সর্বোচ্চ সম্ভাব্য সংখ্যা)। আর ১০০ মিলিলিটার পানিকে কেবল ফেক্যাল কলিফর্মের মাত্রা ছিল ১১ ও ২৮০ মিলিলিটার এমপিএন।

গবেষণায় বলা হয়, বাজারজাতকৃত জার পানির শতভাগ উচ্চ মাত্রায় কলিফার্মযুক্ত। এছাড়া এলিফ্যান্ট রোড, চকবাজার, বাসাবো, গুলশান, বনানী থেকে পাওয়া জারের পানিতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ‘ফেক্যাল কলিফর্ম’ পাওয়া যায়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কলিফর্ম মূলত বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজেন, যেমন, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া সৃষ্টিতে উৎসাহ যোগায় বা সৃষ্টি করে। কলিফর্ম বিভিন্ন উপসর্গ ছাড়াও ক্রমাগত মানুষের রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। এতে পরবর্তীতে যেকোনো রোগ সৃষ্টিকারী অনুজীব দ্বারা খুব সহজেই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। এছাড়াও সংক্রমণের মাত্রা বেশি হলে শিশু ও বৃদ্ধ মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে যায়।



অসামঞ্জস্য মান

পানিতে উপস্থিত দ্রবণীয় খনিজ উপাদান (মিনারেল), লবণ ও আয়রনকে (লৌহ) একত্রে টিডিএস বলে। ভেঙে বললে টিডিএস হচ্ছে, টোটাল ডিসলভড সলিডস। সাধারণত অজৈব লবণ; যেমন, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম বাই কার্বনেট, ক্লোরাইড ও সালফেট এবং সামান্য পরিমাণের জৈব পদার্থকে সমষ্টিগতভাবে টিডিএস বলে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পানিতে টিডিএসের মাত্রা বেশি হলে পানির খরতা ও লবণাক্ততা বেড়ে যায়। এতে পানির পাইপ আটকে যায়। ওই অবস্থায় পাইপে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সংখ্যা বেড়ে যায়। টিডিএসের মাত্রা আদর্শ মানের থেকে কম হলে পানি পানসে স্বাদযুক্ত হয় এবং এসব পানি খাবারের অনুপোযোগী ধরা হয়।

পানির বোতলেই টিডিএসের মাত্রা থাকার কথা। কিন্তু বোতলের গায়ে নির্দেশিত উপাদানগুলোর মাত্রা অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষজ্ঞদের মতে খাবার পানির টিডিএস মাত্রা প্রতি লিটার পানিতে ৩০ মিলিগ্রাম হওয়া বাঞ্চনীয়। বর্তমানে বোতলজাত পানি ‘রিভার্স অসমোসিস’ নামক একটি প্রযুক্তিতে উৎপাদন করা হয়। ওই প্রযুক্তি কেবল পানিকে জীবাণুমুক্ত করে, তবে ওই পদ্ধতিতে উৎপাদিত পানির খনিজ উপাদানগুলোর মাত্রা হ্রাস পায়।

অন্যদিকে, জার পানির ক্ষেত্রে রিভার্স অসমোসিস প্রযুক্তি ব্যবহার হয় না বা মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে উৎপাদিত হয়। ফলে সেখানে বেশি মাত্রায় টিডিএস পাওয়া যায়।



‘মান নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত’

পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘আমি অনেক আগে থেকেই বলে এসেছি ভূগর্ভস্থ পানি বা টিউবওয়েলের পানিকে নিরাপদ ভাবা উচিত নয়, রিপোর্টটিতে যে ফলাফল এসেছে তাতে আমি মোটেও বিস্মিত নই।’

আইনুন নিশাত আরো বলেন, ‘সরকারে দায়িত্ব, এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানুষকে নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ করা। জারে বা বোতলে যেসব পানি সরবরাহ করা হচ্ছে সেগুলোর মান নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত।’ তবে সেই মান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ল্যাবরেটরিতে ব্যবস্থা আছে কী না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, ঢাকা ওয়াসা, পরিবেশ অধিদপ্তর এদেরকে নিরাপদ পানি সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’

দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘পানি হচ্ছে জীবন। যে রিপোর্ট পাওয়া গেছে তা নিশ্চয় উদ্বেগজনক।’

গোলাম রহমান আরো বলেন, আরো স্যাম্পল নিয়ে প্রয়োজনে অন্য ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা উচিত। যারা এই পরীক্ষা করেছেন তাদেরকে বলবো, আপনারা এই ফলাফল নিরাপদ খাদ্য কতৃপক্ষ, বিএসটিআই এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দেন, যাতে করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।’

এ বিষয়ে বিএসটিআইয়ের পরিচালক এস এম ইসহাক আলী বলেন, ‘আমরা একটি নির্দিষ্ট মান অনুসরণ করেই লাইসেন্স দিয়ে থাকি। নির্দিষ্ট মানের সাথে আন্তর্জাতিক একটি মান আছে আইএসও-1765 এটি অনুসরণ করেই আমরা লাইসেন্স দিয়ে থাকি। তাদের দক্ষ জনবল এবং ল্যাবরেটরি আছে কী না সব যাচাইবাছাই করেই তা দেওয়া হয়।’



প্রতিষ্ঠানগুলো গুণগত মান ঠিক রেখে পানি সরবরাহ করছে কী না, বিএসটিআই নিয়মিত তা পরিদর্শন করে কী না জানতে চাইলে বিএসটিআইয়ের পরিচালক বলেন, ‘আমরা নিয়মিত পরিদর্শন করি এবং কোথাও ভেজাল পেলে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’ এস এম ইসহাক আলী বলেন, ‘আমি এ পর্যন্ত ১৯৯টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছি যার মধ্যে জার ১৬৫টি এবং বোতল ৩৪টি। গত এক বছরে আমরা ৪১টি মোবাইল কোর্ট করছি যার মধ্যে মামলার সংখ্যা ৪০টি। জরিমানার পরিমাণ ২৮ লাখ ৫১ হাজার টাকা, জার ধ্বংস করেছি প্রায় ২ হাজার ৪০০ এবং জেল দিয়েছি তিনজনকে।’

মানসম্মত নিরাপদ পানি ব্যবহার না করার অপরাধে কতটি কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে জানতে চাইলে এস এম ইসহাক আলী বলেন, ‘বাতিলের সংখ্যার তথ্য এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। তবে অনেকগুলো লাইসেন্স বাতিল করেছি এটুকু আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৭৬৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৫/১২/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast