www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ঋণ

আওয়ামী লীগ সরকার আবারও অত্যন্ত কঠিন শর্তে ভারতের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার চুক্তি করেছে। দেশটির অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলীর ঢাকা সফরকালে গত বুধবার স্বাক্ষরিত এই চুক্তি অনুযায়ী ভারতের রাষ্ট্রীয় এক্সিম ব্যাংক বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেবে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধ করতে হবে আগামী ২০ বছরের মধ্যে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এক শতাংশ হারে সুদ এবং দশমিক ৫০ শতাংশ হারে কমিটমেন্ট ফি বা প্রতিশ্রুতি মাশুল দিতে হবে। অর্থাৎ সুদের হার দাঁড়াবে এক দশমিক ৫০ শতাংশ।

আপাতদৃষ্টিতে কম সুদের নমনীয় ঋণ বলে মনে হলেও অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা চুক্তিটিকে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ, ঋণের অর্থ বাংলাদেশ নিজের ইচ্ছা বা প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যয় বা ব্যবহার করতে পারবে না। সবই করতে হবে ভারতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। চুক্তির মধ্যেই ১৭টি প্রকল্পের উল্লেখ করা হয়েছে- যেগুলোর প্রতিটি রেল ও সড়ক পথ, জাহাজ চলাচল, সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন এবং বিদ্যুতের উৎপাদন সম্পর্কিত। এর পর রয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা। এতে বলা হয়েছে, প্রতিটি প্রকল্পের জন্যই ভারতের ঠিকাদার নিয়োগ করতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশ চাইলেও নিজের বা অন্য কোনো দেশের নির্মাণ সামগ্রী কিনতে বা ব্যবহার করতে পারবে না। সকল সামগ্রী আমদানি করতে হবে ভারত থেকে এবং ভারতের বেঁধে দেয়া দামে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কোনো দরকষাকষি করতে বা আপত্তি জানাতে পারবে না। চুক্তিতে ৭৫ শতাংশ নির্মাণ সামগ্রীর কথা বলা হলেও অভিজ্ঞতার আলোকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাস্তবে একশ ভাগ সামগ্রীই ভারত থেকে ভারতের বেঁধে দেয়া দামে আমদানি করতে হবে। বড় কথা, দামের ব্যাপারে ভারতীয়রা কখনো কম নেয়ার বা সামান্য ছাড় দেয়ার চিন্তা পর্যন্ত করে না। তারা বরং আন্তর্জাতিক দরের তুলনায় অনেক বেশি দাম আদায় করে থাকে।

কথা আরো আছে। এবারের চুক্তিটিকে বলা হয়েছে লাইন অব ক্রেডিটের তৃতীয় চুক্তি। এর কারণ, এই চুক্তির আগেও ভারতের সঙ্গে একই ধরনের অর্থাৎ লাইন অব ক্রেডিটের আরো দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এবারের মতো ওই চুক্তি দুটিরও দ্বিতীয় পক্ষ ছিল ভারতের এক্সিম ব্যাংক। প্রথম চুক্তিটি ছিল ১০০ কোটি ডলারের এবং দ্বিতীয় চুক্তিতে ঋণের পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি ডলার। কিন্তু মেয়াদের বড় অংশ পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ৩০০ কোটির মধ্যে পেয়েছে মাত্র ৩৫ কোটি ডলার। সাবেক অর্থ উপদেষ্টাসহ বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন, এবারের চুক্তিটিও আগের দুটি চুক্তির মতো অশুভ পরিণতির শিকার হতে পারে। অর্থাৎ ভারত চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় নাও করতে পারে। সত্যিই তেমন কিছু ঘটলে বাংলাদেশকে সর্বাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। অনেক প্রকল্পই মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়বে- যেমনটি পড়ে আছে আগের চুক্তির ভিত্তিতে শুরু করা অনেক প্রকল্প।

এমন আশংকার কারণেই বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকসহ দেশপ্রেমিক কোনো মহলই ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে মোটেও সমর্থনযোগ্য মনে করছেন না। তারা বলেছেন, এত কঠিন শর্তে বিশ্বের কোনো দেশই অন্য কোনো দেশ বা বিশ্বব্যাংক ধরনের কোনো সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেয় না। সবচেয়ে দরিদ্র দেশও ঋণের বিপরীতে পাওয়া অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার নিশ্চিত করে নেয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের কাছ থেকে এতটাই কঠিন শর্তে ঋণ নেয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে- যার কারণে একদিকে সকল প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের আগে ভারতের অনুমতি নিতে হবে, অন্যদিকে প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে ভারতীয় ঠিকাদারের মাধ্যমে। শুধু তা-ই নয়, সব নির্মাণ সামগ্রীও ভারত থেকেই আমদানি করতে হবে- সেগুলোর দাম বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার এবং আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি হলেও কিছুই করার থাকবে না। তাছাড়া ভারতের এক্সিম ব্যাংক প্রয়োজনের সময় প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ ছাড় না করলে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে কি না, সে ব্যাপারেও চুক্তিতে কিছু বলা হয়নি। এর অর্থ, সকল বিষয়েই বাংলাদেশকে ভারতের ইচ্ছাধীন হয়ে পড়তে হবে। বাংলাদেশ চাইলেও ওই সব প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে কিংবা অন্য কোনো দেশ বা সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাস্তবায়ন বা সম্পন্ন করতে পারবে না।

লক্ষণীয় এবং খুবই তাৎপর্যপূর্ণ অন্য একটি বিষয় হলো, কোন কোন খাতে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যাবে- সে বিষয়েও বাংলাদেশকে ভারতের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। রেলপথ, সড়ক ও জাহাজ চলাচল এবং সমুদ্র বন্দরের উন্নয়নের মতো এমন ১৭টি খাতের কথাই চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে ভারতের সরাসরি স্বার্থ জড়িত রয়েছে। কারণ, করিডোর এবং ট্রানজিট ধরনের নানা নামের আড়ালে এরই মধ্যে বাংলাদেশের জমিনের ওপর দিয়ে ভারতের যানবাহন চলাচল শুরু হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম ও মংলাসহ এদেশের সমুদ্র বন্দরগুলোকেও ভারত তার ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বুধবার স্বাক্ষরিত চুক্তিটির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের ওপর তার কর্তৃত্ব আরো ব্যাপক ও শক্তিশালী করবে।

অতীতের দুটি লাইন অব ক্রেডিট নামের চুক্তির অতি তিক্ত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সর্বশেষ চুক্তির কঠিন শর্তসমূহের কারণেও আমরা একে মোটেই সমর্থনযোগ্য মনে করি না। সরকারের উচিত চুক্তিটিকে পুনরায় মূল্যায়ন করা এবং শর্তগুলোকে এমন পর্যায়ে নিয়ে আসা, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুণœ থাকে এবং দেশকে কোনোভাবেই ভারতের ইচ্ছাধীন হয়ে পড়তে না হয়। এজন্য ঠিকাদার নিয়োগে যেমন স্বাধীনতার ব্যবস্থা রাখতে হবে, তেমনি এমন আয়োজনও নিশ্চিত করতে হবে, বাংলাদেশ যাতে অভ্যন্তরীণ বাজার এবং অন্য যে কোনো দেশ থেকে নির্মাণ সামগ্রী কিনতে ও সংগ্রহ করতে পারে। ঋণের অর্থ ছাড় করার ব্যাপারেও ভারতীয় ব্যাংকের একচেটিয়া কর্তৃত্ব রাখা চলবে না। এ প্রসঙ্গে এমন শর্ত থাকা দরকার, যাতে অর্থ ছাড় করতে বিলম্ব বা গড়িমসি করলে বাংলাদেশ যে কোনো সময় চুক্তিটি বাতিল করার অধিকার পায়। সব মিলিয়ে আমরা চাই, বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে চুক্তি হোক সমতার ভিত্তিতে।
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ৭৯৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/১০/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast