www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গুম আর কতদিন

আবারও গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তাদের স্বজনেরা। এই দাবি উচ্চারিত হয়েছে আকুতি ও অনুরোধের সুরে। ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম দিবস হিসেবে পালিত হলেও এবার আগের দিন অর্থাৎ ২৯ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত হয়েছিল এক ব্যতিক্রমী সংবাদ সম্মেলন- ‘মায়ের ডাক’। ২৯টি পরিবারের সদস্যরা এই সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। গুম হওয়াদের মায়েরা তো বটেই, স্ত্রী-সন্তানেরাও বক্তব্য রাখতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। মায়েরা তাদের গুম হওয়া সন্তানদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়েছেন। অন্যদিকে স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের এবং সন্তানরা পিতাদের ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছেন। আদিবা ইসলাম নামের একজন শিশু কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, সে তার বাবা পারভেজ হোসেনের সঙ্গে ঈদ করতে চায়। ‘ঈদে বাবাকে ফিরিয়ে দিন, প্লিজ’ বলে  কাঁদতে গিয়েও সে থেমে পড়েছে। কোনো কথাই আর বলতে পারেনি, যেন সে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল!
শিশু আবিদার এই কান্না ও আকুতি সাংবাদিকসহ উপস্থিত সকলকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। সকলেই নীরবে তাকিয়ে থেকেছেন শুধু। অন্য স্বজনদের অনেকে আবার সমবেতভাবে ডুকড়ে কেঁদে উঠেছেন। মায়েদের আবেদনেও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, শিশু আবিদার পিতা পারভেজ হোসেনকে ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর গুম করা হয়েছে। সেই থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। একই অবস্থা অন্য সকলেরও। মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও গুম হওয়াদের খোঁজ পাচ্ছেন না তাদের পরিবার সদস্যরা। সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেছেন, বেঁচে আছে না মেরে ফেলা হয়েছেÑ সে খবরটুকু জানতে পারলেও তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারতেন। কিন্তু কোনো খোঁজ-খবর না পাওয়ার ফলে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর এজন্যই তারা সংবাদ সম্মেলনের উদ্যোগ নিয়েছেন। শুধু সরকারের কাছে নয়, পরিবার সদস্যরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আবেদন জানিয়েছেন। তাদের ধারণা, প্রধানমন্ত্রী চাইলে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের হদিস তো পাওয়া যাবেই, তারা এমনকি জীবিত অবস্থায়ও ফিরে আসতে পারেন।
আমরা মনে করি, ‘মায়ের ডাক’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনটি মানুষ মাত্রকেই আন্দোলিত করেছে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, সব দেশেই গুম ও গুপ্তহত্যার মতো বিচারবহির্ভূত কর্মকান্ডকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে তো বটেই, অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গেও দেখা হয়। সভ্য ও গণতান্ত্রিক কোনো দেশে কোনো ব্যক্তিকে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের কোনো নেতা বা কর্মীকে গুম করা হবে এবং পরে এখানে-সেখানে তার লাশ পাওয়া যাবে- এমনটা কল্পনা করা যায় না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনস্থ হয়ে পড়া বাংলাদেশে গুম শুধু হচ্ছেই না, মাঝে-মধ্যে গুমের রীতিমতো ধুমও পড়ে যাচ্ছে। অনেকের খোঁজ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না- যেমনটি যাচ্ছে না আবিদা ইসলাম নামের ছোট্ট শিশুর পিতা পারভেজ হোসেনের। শিশুটি বলেছে, সে গুম শব্দের অর্থ জানে না, জানতেও চায় না। সে শুধু চায়, তার পিতা ফিরে আসুক। এবারের ঈদ সে তার বাবার সঙ্গে আনন্দে কাটাতে চায়। একই অবস্থা অন্য সকলেরও।
এখানে বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীর কথা উল্লেখ করতেই হবে। তিনি গুম হয়েছেন ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে। সঙ্গে তার ড্রাইভারও ছিল। কিন্তু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও এখনও ইলিয়াস আলীর কোনো খোঁজ মেলেনি। গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ অসংখ্য রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতা-কর্মী গুম হয়েছেন। আমিনুল ইসলামের লাশ টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলে পাওয়া গিয়েছিল। আরো অনেকের লাশও দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী বা খালের পাশে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু চৌধুরী আলমের মতো বেশিরভাগেরই এখনও কোনো খবর নেই। এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন শিশু আবিদা ইসলামের পিতা পারভেজ হোসেনের মতো আরো অনেকেও। কথা শুধু এটুকুই নয়। গুমের ব্যাপারে সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি মানবাধিকার সংগঠনের নেতা থেকে ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী পর্যন্ত সব শ্রেণী ও পেশার লোকজনকেই এখন গুম করা হচ্ছে। বড় কথা, তাদের প্রায় কারোই কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
আমরা মনে করি, এমন অবস্থা মোটেই সমর্থনযোগ্য গতে পারে না। সরকারের উচিত গুম ও গুপ্তহত্যার মতো ভয়ংকর অপরাধ বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া। বিষয়টি জরুরি এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালীসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সব দেশই বিভিন্ন সময়ে গুম-খুনের কঠোর বিরোধিতা করেছে। এখনও করছে। গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডকে এসব দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার একটি প্রধান ইস্যু পর্যন্ত বানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা অনেক উপলক্ষেই পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, গুম-খুন চলতে থাকলে এবং এসবের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হলে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য বিক্রি কঠিন হয়ে পড়বে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদেশিদের হুমকির কারণে শুধু নয়, দেশের ভেতরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্যও গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সরকারের উচিত কঠোর অবস্থান নেয়া। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, এসবের পেছনে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে অনেক আগেই সারা বিশ্ব জেনে গেছে। বিষয়টি কারো কাছেই আর গোপন নেই। সুতরাং সতর্ক হওয়া উচিত এখনই। আমরা চাই, সরকার ‘মায়ের ডাক’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের মর্মকথা অনুধাবন করুক এবং শিশু আবিদাসহ সকল মা এবং স্ত্রী ও সন্তানের মনে শান্তি ফিরিয়ে আনার দ্রুত পদক্ষেপ নিক।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৭৭৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ৩১/০৮/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast