লুটেরাদের স্বর্গরাজ্য
ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন না। প্রচলিত নীতি অনুযায়ী ঋণের টাকা মঞ্জুর এবং বিতরণের আগে ব্যাংকসমূহকে ঋণ গ্রহিতার চরিত্র, সামর্থ্য, সুপ্ত সম্ভাবনা (Character, Capacity, Capability) এবং ঋণের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্যতা, ফেরৎযোগ্যতা এবং আদায় যোগ্যতা (Reliability, Repayability and Realizability) প্রভৃতি নির্ণয় ও পরীক্ষা করে দেখতে হয়। এগুলো হচ্ছে ব্যাংক খাতের সাবধানতা ও দূরদর্শিতার অংশ। এই সাবধানতা না থাকলে বিনিয়োগ ফলপ্রসূ হয় না এবং বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরতও আসে না। গত নয় বছর ধরে আমাদের দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো Banking Prudence এর এই গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো দেখেশুনে অর্থ বিনিয়োগ করতে পারছেন না। সরকারি ব্যাংকগুলোতে অর্থনৈতিক (Feasibility) সম্ভাব্যতার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ বিনিয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে সরকারের বা সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপি ও নেতৃবৃন্দের হুকুম তামিল করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকরা নিজেরাই ভাগাভাগি করে ঋণ নিচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে যে, যে খাতে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে ঋণ নেয়া হচ্ছে। ঋণের ব্যবহারের সাথে এর কোন সম্পর্ক থাকছে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ঋণ খেলাপকারী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং রাজনৈতিক নেতারাই ঠিক করছেন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পদে কারা আসবেন। এরা এতই শক্তিশালী ও প্রভাবশালী যে ব্যাংকের সৎ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের বিরুদ্ধে ‘টুঁ’ শব্দটিও করতে পারেন না। খোদ অর্থ মন্ত্রণালয় অনিয়ম, অনাচার ও দুর্নীতির সাথে এত বেশি জড়িত যে, এ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কারো বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে ভয় পান না জানি তাদের গোপন বিষয়াবলী ফাঁস হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে, ব্যাংক খাতে ঋণ বেড়ে ৬ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এর মধ্যে খেলাপীর পরিমাণ ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। আবার, খেলাপী ঋণের ৩৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা সোনালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের। ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপী ঋণ হচ্ছে ২৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। বিদেশী নয়টি ব্যাংকের খেলাপী ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণ হচ্ছে ৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের দু’জন সিনিয়র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি দৈনিক রিপোর্ট করেছে যে, প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকেই একটি অশুভ সিন্ডিকেট কাজ করছে। তারা ঠিক করেন কারা এমডি হবেন, কারা ঋণ পাবেন এবং কিভাবে ব্যাংক পরিচালিত হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের ফলে এই সিন্ডিকেটের উৎপাত আরো বদ্ধি পাবে এবং খেলাপী ঋণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ ও ব্যাংকিং খাতের ডাকাতদের নিয়ে গড়ে ওঠা এ সিন্ডিকেট ভাল ব্যাংকগুলোকেও আর ভাল থাকতে দিচ্ছে না। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বৃহত্তম ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান সততা ও নিষ্ঠার অনন্য রোল মডেল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনায় জবরদস্তি পরিবর্তন আনা এবং তার পেছনে সরকারের ইন্ধন এটাই প্রমাণ করে যে, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে যে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং ঋণ খেলাপের ঘটনা ঘটছে সরকারের প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতায়ই তা হচ্ছে। তাদের আনুকূল্যেই এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের টাকা চুরি হয়েছে। তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আজ পর্যন্ত কোন শাস্তি হয়নি। রক্ষকরা এখন ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছেন বলে মনে হয়। সরকার এতই দুর্নীতিপরায়ণ এবং অযোগ্য হয়ে পড়েছেন যে তাদের হাতে কোন কিছুই নিরাপদ থাকছে না। সারা দেশ একটি লুটপাট সমিতিতে পরিণত হয়েছে। যে যেখান দিয়ে পারছে লুটপাট করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ খাতের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে, এই প্রতিষ্ঠানটি এই খাতে বিদ্যমান পরিবেশে কোন অনুকূল পরিবর্তন সাধন করতে পারবে বলে মনে হয় না।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আলম সারওয়ার ২৬/০৫/২০১৭ধন্যবাদ আপনাকে ভাই সুন্দর লেখা লেখালেখির জন্য শুভেচ্ছা থাকল